ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৭ অক্টোবর ২০২৪, ১ কার্তিক ১৪৩১

১৫ বছরে অনিয়ম ও দুর্নীতি করে সম্পদের পাহাড় গড়েন সাবেক এই এমপি

নামে-বেনামে ৫ হাজার কোটি টাকার মালিক এনামুল

মামুন-অর-রশিদ, রাজশাহী

প্রকাশিত: ২২:২৭, ১৬ অক্টোবর ২০২৪

নামে-বেনামে ৫ হাজার কোটি টাকার মালিক এনামুল

এনামুল হক

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে টানা তিনবার সংসদ সদস্য ছিলেন রাজশাহীর বাগমারা আসনে। সর্বশেষ ২০২৪ সালের নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন বঞ্চিত হন। তবে স্বতন্ত্র হয়ে লড়াই করে হেরে যান। রাজনীতিতে প্রবেশের আগে ব্যবসায়ী ছিলেন তিনি। রাজনীতিতে এসে গত ১৫ বছরে সম্পদের পাশাপাশি চরম অনিয়ম-দুর্নীতির পাহাড় গড়েছেন তিনি। নানা বিতর্কের সৃষ্টিকারী এই ব্যক্তি হলেন রাজশাহী-৪ (বাগমারা) আসনের সাবেক এমপি ও বাগমারা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রকৌশলী এনামুল হক। 
নারী কেলেঙ্কারি তার পিছু ছাড়েনি গেল ১৫ বছর। বিঘার পর বিঘা জমি দখল, অন্যের দোকান ভেঙে মার্কেট নির্মাণ, নিয়োগ বাণিজ্য এবং দলীয় পদ বাণিজ্য করে হাতিয়ে নিয়েছেন হাজার হাজার কোটি টাকা। তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে উঠে এসেছে বিস্তর দুর্নীতির চিত্র। গত ১৫ বছরে ক্ষমতার প্রভাব ও নিজের সন্ত্রাসী বাহিনীকে কাজে লাগিয়ে অবৈধভাবে গড়ে তোলেন সম্পদের পাহাড়। নামে-বেনামে পাঁচ হাজার কোটি টাকার মালিক সাবেক এমপি এনামুল। নিজের মালিকানায় ‘নর্দান পাওয়ার সল্যুউশন লিমিটেড’ নামের ৫০ মেগাওয়াটের কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্ট করেছেন।

ঢাকার পান্থপথে এমএ টাওয়ার নামে একটি এবং আদাবরে একটি বহুতল ভবন, রাজশাহী শহরে আবাসিক বহুতল ভবন, সাহেববাজারে সিটি সেন্টার নামে আরেকটি বাণিজ্যিক বহুতল মার্কেট সাবেক এই এমপির। শহরের বিসিক এলাকায় সাকোয়াটেক্স নামে গার্মেন্ট, নির্বাচনী এলাকা বাগমারায় ডুপ্লেক্স ভবন, ভবানীগঞ্জে বহুতল ভবনে ‘ভবানীগঞ্জ নিউ মার্কেট’ এবং সালেহা কোল্ড স্টোরেজ করেছেন। এনা প্রপার্টিজ নামে তার সারাদেশে ডেভেলপার ব্যবসাও রয়েছে।

ছয় কোটি টাকারও বেশি মূল্যের বিলাসবহুল ছয়টি গাড়ি রয়েছে তার। তিনটি ঢাকায় ও তিনটি রাজশাহীতে ব্যবহার করেন। নানান প্রক্রিয়ায় ব্যাংকে গচ্ছিত আছে তার সাড়ে ১৪ কোটি টাকা। ইতোমধ্যে তিনি গ্রেপ্তার হয়েছেন। এখন রয়েছেন রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে।
স্থানীয়রা বলছেন, ক্ষমতায় থাকাকালে এনামুলের চোখ যে জমিতে পড়েছে, তা দখল করে ছেড়েছেন। তার জমির পরিমাণ শত বিঘার ওপরে। সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে জমি দখল করে সেই জমিতে মার্কেট নির্মাণ করারও অভিযোগ রয়েছে আওয়ামী লীগের এই নেতার বিরুদ্ধে। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই নেন ‘নর্দান পাওয়ার সল্যুউশন লিমিটেড’ নামের ৫০ মেগাওয়াটের কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্ট। 
স্থানীয়রা বলেন, প্রশাসনকে অবৈধভাবে ব্যবহার করে আর নিজের সন্ত্রাসী বাহিনীকে কাজে লাগিয়ে এসব অপকর্ম করেছেন সাবেক এমপি এনামুল। এরই মধ্যে তার সম্পদসহ অনিয়মের খোঁজে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন।
নির্বাচনী এলাকার শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ নিয়ন্ত্রণ করতেন এমপি এনামুল নিজে। প্রতি শিক্ষক নিয়োগে ১৫-২০ লাখ টাকা দিতে হতো তাকে। এমনকি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগেও নিতেন লাখ লাখ টাকা। এই কাজে সহযোগিতা করতেন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান প্রধান বা তার অনুগত কমিটি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দপ্তরি নিয়োগেও চার লাখ টাকা করে নিয়েছেন এনামুল।
স্থানীয় একাধিক শিক্ষক জানিয়েছেন, ভবানীগঞ্জ সরকারি কলেজের ভাইস প্রিন্সিপালের মাধ্যমে প্রায় দেড় কোটি টাকার নিয়োগ বাণিজ্য করেছেন। শিক্ষকপ্রতি ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা নিতেন। এমনকি অনুদানের টাকা এলেও আত্মসাৎ করতেন। এমন ঘটনা ঘটেছে প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই। এর বাইরেও সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পে বরাদ্দের জন্য তাকে সুনির্দিষ্ট কমিশন দিতে হতো। বাগমারা উপজেলার যে কোনো বরাদ্দ করা সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বাজেট থেকেও ১০ শতাংশ কমিশন নিতেন এনামুল।
গত বছরের নভেম্বরে এক তরুণীর সঙ্গে আপত্তিকর ভিডিও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর নারীলিপ্সু এই এমপির বিরুদ্ধে তারই এলাকায় প্রতিবাদী মানববন্ধন হয়। ভিডিওতে রাজশাহী কলেজের ছাত্রী পরিচয় দিয়ে ওই তরুণী বলেন, ‘চাকরি দেওয়ার নাম করে এমপি এনামুল হক আমাকে সাত বছর ধরে ধর্ষণ করে আসছেন।

কিন্তু চাকরি দেননি।’ এমপির সঙ্গে পরিচয়ের বিষয়ে তিনি জানান, কৃতী শিক্ষার্থীদের পুরস্কৃত করার সময় তিনি এনামুল হকের নজরে পড়েন। এরপর ফোন করে প্রেমের প্রস্তাব দেন। পরে চাকরি ও বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে দীর্ঘদিন অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলেন।
আগেও একাধিক নারীর সঙ্গে এনামুল হকের অডিও-ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। এর মধ্যে সম্প্রতি ছড়িয়ে পড়া এক ভিডিও চ্যাটে এক নারীর উদ্দেশে অশ্লীল কথা বলতে দেখা যায় এমপিকে। এ ছাড়া এক নারী তার সঙ্গে গোপনে প্রেম ও বিয়ের তথ্য প্রকাশ করেন। এরপর এনামুল হক তাকে তালাক দিয়ে আলোচিত হন।
একাধিক সূত্র জানায়, ২০০৮ সালে রাজশাহীর বাগমারার সাবেক সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার এনামুলের বাৎসরিক আয় ছিল ২০ লাখ টাকা। স্ত্রীর ছিল না কোনো আয়। তবে দুইজনের শেয়ারসহ নগদ ও ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ ছিল প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকা। আর ১৫ বছরের ব্যবধানে এনামুলের বার্ষিক আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক কোটি ২৪ লাখ টাকা।

স্ত্রীর বাৎসরিক আয় না থাকলেও দুইজনের নামে শেয়ারসহ নগদ ও ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থ রয়েছে পৌনে চৌদ্দ কোটি টাকা। অপ্রদর্শিত অর্থের তো হিসাব নেই। এর বাইরে নিজের ক্ষমতার ব্যবহার করে ব্যাংক থেকে স্ত্রীর নামে এক হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আর ফেরত দেননি। রাজশাহী-৪ আসনের সাবেক এমপি এনামুল হকের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে বিভিন্ন দুর্নীতি ও অনৈতিক কার্যক্রমের অভিযোগ রয়েছে। তিনি তার নির্বাচিত এলাকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দপ্তরি নিয়োগে ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা ঘুষের বিনিময়ে নিয়োগ প্রদান করেছেন।

তার নিজ নামে রাজশাহী, ঢাকা ও গাজীপুরে কৃষি ও অকৃষি জমিসহ তাদের পরিবারের নামে মোট ২৩ কোটি ৫০ লাখ ৯৬ হাজার ৪৩৭ টাকার সম্পদের তথ্য পাওয়া যায় দুদকের গোয়েন্দা তথ্যানুসন্ধানে। ইতোমধ্যে এনামুলের বিরুদ্ধে অর্থপাচার, প্রকল্পে অনিয়মসহ দেশে-বিদেশে বিপুল অবৈধ সম্পদ গড়ার অভিযোগে দুদকের গোয়েন্দা ইউনিটের তথ্য আমলে নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হকের বিরুদ্ধে আয়বহির্ভূত অন্তত পাঁচ হাজার কোটি টাকার সম্পদ অর্জনের তথ্য পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। 
সূত্র মতে, ২০১৪ সালে এনামুল হক এবং তার স্ত্রী তহুরা হক দুদকে মাত্র আট কোটি ৩৪ লাখ ৬৫ হাজার ৫০০ টাকার সম্পদ বিবরণী দাখিল করেছিলেন। কিন্তু ওই সময়ই তাদের সম্পদ ছিল অন্তত দেড় হাজার কোটি টাকার। এনামুলকে ওই সময় দুদক কার্যালয়ে হাজির হওয়ার নির্দেশও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী এক নেতার প্রভাবে পার পেয়ে যান এনামুল।

তখন দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, এনামুল হকের মালিকানাধীন ও অংশীদারিত্বে থাকা ১৪টি প্রতিষ্ঠানের তথ্য গোপন করা হয়। এ ছাড়া এনা প্রপার্টিজ, সালেহা-ইমারত কোল্ড স্টোরেজ, এনা-ডুঙ্গা লিজিং, নর্দান পাওয়ার সল্যুউশন লিমিটেড, এনা ইন্টারন্যাশনাল, এনা কারস, এনা এনার্জি লিমিটেডসহ অন্য প্রতিষ্ঠানে তার শেয়ার বা মালিকানার বিষয়টিও সম্পদ বিবরণীতে গোপন করেছিলেন।
সূত্র জানায়, ২০০৮-০৯ ও ২০১২-১৩ অর্থবছরের আয়কর রিটার্নেও এনামুল হক সম্পদের তথ্য গোপন করেছিলেন। তার নামে ১৪টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থাকলেও আয়কর রিটার্নে উল্লেখ করা হয়েছিল সাতটি প্রতিষ্ঠানের নাম। তবে দুদক অনুসন্ধান চালিয়ে ঢাকা সিটি করপোরেশন (উত্তর-দক্ষিণ), রাজশাহী সিটি করপোরেশন, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক, পিপলস লিজিং কোম্পানি, আল-ফালাহ ব্যাংক, ব্র্যাক-ডেল্টা হাউজিং, রাজশাহী জেলা রেজিস্ট্রার, বাগমারা, নওগাঁ, নবাবগঞ্জ, নাটোর সাব-রেজিস্ট্রার, ঢাকার ১৩টি সাব-রেজিস্ট্রি অফিস এবং ঢাকা জেলা রেজিস্ট্রারের কাছ থেকে এনামুল হক এবং তার স্ত্রী তহুরা হকের নামে অর্থ ও স্থাবর সম্পত্তি রেজিস্ট্রেশন সংক্রান্ত তথ্য যাচাই-বাছাই করে বিপুল সম্পদের তথ্য পেয়েছে। 
গত ১৬ সেপ্টেম্বর রাজধানীর আদাবর থেকে গ্রেপ্তার হন এনামুল। গ্রেপ্তারের পর র‌্যাবের দেওয়া তথ্যমতে, এনা গ্রুপের চেয়ারম্যান ও সাবেক এমপি এনামুল পাঁচ হাজার কোটি টাকার সম্পদের মালিক। তিনি ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর এনামুল হককে ঘিরে অবৈধ সম্পদ অর্জন, ঋণ পরিশোধ না করা, ভূমি দখল, অবৈধ নিয়োগ-বাণিজ্যসহ প্রকল্পের টাকা আত্মসাতের মতো নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির ঘটনা উঠে আসতে শুরু করে। অভিযোগ উঠেছে, হাজার কোটি টাকার ঋণখেলাপিও তিনি। এ অবস্থায় তার সম্পদসহ দুর্নীতি-অনিয়মের খোঁজে নামে দুদক।
এলাকাবাসীর দাবি, তিনবার এমপি থাকায় এনামুল এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন। কেউ প্রতিবাদ করলেই হেলমেট বাহিনী দিয়ে হামলা চালানো হতো। সেইসঙ্গে প্রশাসনকে ব্যবহার করে গ্রেপ্তার করা হতো। এভাবে শক্তি প্রয়োগ করে তিনি ভবানীগঞ্জে নিজে একটি বহুতল মার্কেট গড়েছেন। যার নাম দেওয়া হয়েছে ভবানীগঞ্জ নিউমার্কেট। এই মার্কেট নির্মাণের আগেও সেখানে ৬০-৭০টি দোকান ছিল। সেগুলো প্রভাব খাটিয়ে ভাঙচুর করে তাদের বিতাড়িত করেন এনামুল ও তার বাহিনী।
আক্তার হোসেন নামে বাগমারার এক আওয়ামী লীগ কর্মী বলেন, ‘এনামুলের বিরুদ্ধে বাগমারায় ইটের ভাঁটি ও জমি দখলের অভিযোগের শেষ নেই। সাবেক এই এমপি নৈশপ্রহরী, স্কুল-কলেজে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ, তদবির-বাণিজ্য, ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও পৌর নির্বাচনে মনোনয়ন-বাণিজ্যেও পটু ছিলেন।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাগমারার এক আওয়ামী লীগ নেতা অভিযোগ করে বলেন, ‘ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে মনোনয়ন পাইয়ে দেওয়ার নাম করে ১০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন সাবেক এমপি এনামুল।’ শুধু তাই নয়, অবৈধভাবে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলা সাবেক এমপি এনামুল তার অধীন বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন মাসের পর মাস আটকে রাখতেন।

×