ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১

বৃষ্টি হলেই মরণফাঁদে পরিণত হয় রাজধানীর বিভিন্ন রাস্তা ॥ ঝুঁকি নিয়ে চলছে যানবাহন

বড় বড় গর্তে বেহাল সড়ক

ইবরাহীম মাহমুদ আকাশ

প্রকাশিত: ২১:৩৪, ১৩ অক্টোবর ২০২৪; আপডেট: ১২:০৮, ১৪ অক্টোবর ২০২৪

বড় বড় গর্তে বেহাল সড়ক

রাজধানীতে বেহাল বিভিন্ন সড়ক। ছোট-বড় গর্তে সামান্য বৃষ্টিতে এই খানাখন্দে পানি জমে

বড় বড় গর্ত আর খানা-খন্দে বেহাল রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক। বিশেষ করে ঢাকার প্রবেশমুখ যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা থেকে শুরু করে সায়েদাবাদ, স্বামীবাগ, রাজধানী সুপার মার্কেটের সামনের সড়ক, টিটিপাড়া মোড়, ইত্তেফাক মোড় ও গুলিস্তান বঙ্গভবনের মোড় পর্যন্ত সড়ক যানবাহন চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। প্রায় আড়াই কিলোমিটার দূরত্বের সড়কটিতে কার্পেটিং, পিচ, পাথর, সুরকি উঠে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। দীর্ঘদিন সংস্কার না করায় বৃষ্টি হলে সড়কগুলো মরণফাঁদে পরিণত হয়।
রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থেকে ডেমরামুখী সড়কটির দুইপাশে বড় বড় গর্তের কারণে ঝুঁকি নিয়ে যানবাহন চলাচল করছে। পাশাপাশি কুতুবখালী-ডেমরা সড়ক, সায়েদাবাদ জনপথ মোড় থেকে মানিকনগর-টিটিপাড়া সড়কের অবস্থা খুবই খারাপ। খানা-খন্দ ও বড় বড় গর্তের কারণে দীর্ঘ যানজটে আটকে থাকতে হয় বলে পরিবহন চালকরা জানান। এ ছাড়া অলি-গলির সড়কগুলোর অবস্থাও নাজুক। বিভিন্ন সময় ঢাকা ওয়াসা, তিতাস ও বিদ্যুৎ বিভাগের পক্ষ থেকে সড়ক খুঁড়ে সেবা সংস্থার কাজ করে মেরামত না করার কারণে এই অবস্থা তৈরি হয়েছে বলে স্থানীয়রা জানান।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) অধীনে এক হাজার ৬৫৬ কিলোমিটারের (কিমি) বেশি সড়ক রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৩৫ শতাংশ সড়ক খানা-খন্দে ভরা। তাই দ্রুত সংস্কারের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে ডিএসসিসি কর্মকর্তারা জানান।
ডিএসসিসির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী কাজী মো. বোরহান উদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে অতি বৃষ্টির কারণে বিভিন্ন এলাকার সড়কে খানা-খন্দের সৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়া রেলওয়েসহ বিভিন্ন সংস্থার উন্নয়ন কাজের কারণে রাস্তাগুলো খোঁড়া হয়েছে। এই রাস্তাগুলো তাদের মেরামত করে দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তারা তা করেনি। তাই অতি বৃষ্টির কারণে রাস্তাগুলোর অবস্থা আরও খারাপ হয়ে গেছে। তবে আমরা নিজস্ব অর্থায়নে বিভিন্ন এলাকার সড়ক সংস্কারে কাজ শুরু করেছি। আশা করছি, চলতি মাসের মধ্যে সড়ক মেরামতের কাজ শেষ হবে।’
কাদামাটিতে একাকার সড়ক ॥ সরেজমিনে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ঘুরে দেখা গেছে, সবচেয়ে খারাপ অবস্থা সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী, মানিকনগর, টিটিপাড়া, গোপীবাগ, টিকাটুলী, নারিন্দা, স্বামীবাগ ও দয়াগঞ্জসহ পুরান ঢাকার বিভিন্ন সড়কের। বৃষ্টি হলে এসব এলাকার সড়কে কাদামাটি একাকার অবস্থা তৈরি হয়। খানা-খন্দ ও বড় বড় গর্তের কারণে তিন মিনিটের সড়ক অতিক্রম করতে এক থেকে দেড় ঘণ্টা লেগে যায় বলে যাত্রীরা জানান।
কমলাপুর এলাকায় খোকন নামের এক যাত্রী জনকণ্ঠকে বলেন, ‘ঢাকা শহরের মধ্যে সবচেয়ে বাজে অবস্থা মানিকনগর-টিটিপাড়া-মুগদা সড়কের। বড় বড় গর্তের কারণে স্বাভাবিক সময়ে এই সড়ক দিয়ে যাতায়াত করতে দীর্ঘ সময় যানজটে আটকে থাকতে হয়। আর বৃষ্টি হলে তো কথাই নাই। এক-দুই ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকতে হয়। গত বৃহস্পতিবার যাত্রাবাড়ী থেকে দুপুর ১২টায় কমলাপুরের উদ্দেশে বাসে উঠি। কমলাপুরে আসতে প্রায় দুই ঘণ্টা সময় লেগেছে। এর মধ্যে মানিকনগর থেকে টিটিপাড়া পর্যন্ত সড়ক অতিক্রম করতে এক ঘণ্টা সময় শেষ। অথচ এই সড়কটি তিন মিনিটের পথ নয়।’ এভাবে ঢাকার বেশিরভাগ সড়কের এই বেহাল অবস্থা বলে জানান।
একই অবস্থা গোপীবাগ সড়কটিরও। গুলিস্তান বঙ্গভবনের মোড় থেকে শুরু করে ইত্তেফাক মোড় হয়ে টিকাটুলীর রাজধানী সুপার মার্কেটের মোড় পর্যন্ত সড়কটি বেহাল অবস্থা। বৃষ্টি হলে খানা-খন্দে ভরা সড়কটিতে পানি জমে একাকার অবস্থা তৈরি হয়। সড়কে বড় গর্তের কারণে এক মিনিটের রাস্তা অতিক্রম করতে আধাঘণ্টা সময় লাগে বলে যাত্রীরা জানান। সম্প্রতি এই সড়কগুলোতে ইট ও বালু দিয়ে মেরামত করা হচ্ছে।
নিজাম উদ্দীন নামে গোপীবাগের এক বাসিন্দা জনকণ্ঠকে বলেন, ‘গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যে আগে রাস্তা দিয়ে হাঁটা যেত। এখন বৃষ্টি হলেই রাস্তা কাদামাটিতে একাকার হয়ে যায়। এ ছাড়া যানজটে অবস্থা আরও খারাপ হয়। এক মিনিটের পথ গোপীবাগ সড়ক অতিক্রম করতে আধাঘণ্টা সময় লেগে যায়। এই সড়কে ওয়াসা ও বিদ্যুতের লাইন বসানোর সময় গর্ত করা হয়েছিল। এরপর থেকে সড়কটির অবস্থা বেহাল হয়ে পড়ে। বৃষ্টি হলেই এই সড়কে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়।
পুরান ঢাকার জুরাইন রেলগেট থেকে দয়াগঞ্জ মোড় পর্যন্ত সড়কের দৈর্ঘ্য আড়াই কিমির কিছুটা বেশি। গেন্ডারিয়া নতুন রাস্তা হিসেবে পরিচিত এ সড়কের প্রায় পুরোটাই উঁচু-নিচু। কোথাও বড় গর্ত, কোথাও পিচ উঠে গেছে, কোথাও দেবে গেছে। দুই বছর ধরে এ অবস্থা বলে জানান স্থানীয়রা। একই অবস্থা গেন্ডারিয়া নতুন রাস্তার। সামান্য বৃষ্টিতেই গেন্ডারিয়া নতুন রাস্তার কিছু অংশ ডুবে যায়। সড়কের যে অংশে পানি জমেনি, সে অংশে প্রায় এক ফুট গভীর কাদা জমে যায় বলে জানান স্থানীয় বাসিন্দারা। গেন্ডারিয়া নতুন রাস্তার মতো ডিএসসিসির বেশকিছু সড়ক চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।
এ ছাড়া দয়াগঞ্জ রেলসেতুর নিচের সড়ক, যাত্রাবাড়ীর মীরহাজীরবাগ এলাকা ও ধোলাইরপাড় থেকে যাত্রাবাড়ী মোড় পর্যন্ত সড়কও চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এসব সড়কে বিভিন্ন সেবা সংস্থার খোঁড়াখুঁড়ি ও বৃষ্টির পানি জমে থাকায় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। একই অবস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকের পেছনের সড়কেরও। এই সড়কটি পানি নিষ্কাশনের পাইপ বসানোর জন্য কাটা হয় মাস কয়েক আগে।
ডিএসসিসির সূত্র জানায়, মতিঝিলের অভিসার সিনেমা হল সংলগ্ন পদচারী সেতুর নিচের সড়ক এবারের বৃষ্টিতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আবার বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ লাইনের জন্য এ সড়ক কাটতে হয়েছে। বৃষ্টিতে খানাখন্দ তৈরি হয়েছে সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালের আশপাশের সব সড়কে। একই অবস্থা ডেমরার বর্ণমালা স্কুল রোডেরও। এ ছাড়া ধলপুর আউটফল স্টাফ কোয়ার্টারের পশ্চিম পাশের সড়ক, হাতিরপুল বাজারের সামনের সড়ক, মগবাজার থেকে মালিবাগের দিকে যাওয়ার প্রধান সড়ক, মুগদা হাসপাতালের সামনের সড়ক ও বাসাবো-মাদারটেক প্রধান সড়কে ছোট-বড় গর্ত তৈরি হওয়ায় যানবাহন চলাচলে সমস্যা হচ্ছে। তাই এসব সড়ক দ্রুত মেরামতের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে কর্মকর্তারা জানান।
ঢাকা উত্তর সিটির সড়কেও খানা-খন্দ ॥ ঢাকা উত্তর সিটির (ডিএনসিসি) আওতাধীন অনেক এলাকার সড়ক ও অলিগলি খোঁড়াখুঁড়ি-কাটাকাটি কিংবা খানাখন্দের কারণে এখন চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। কোথাও সড়ক সংস্কারের কাজ করছে খোদ সিটি করপোরেশন। কোথাও আবার ঢাকা ওয়াসার পানির সরবরাহের সংযোগ স্থাপন ও অন্যান্য সেবা সংস্থার উন্নয়নকাজের জন্য সড়ক কেটে রাখা হয়েছে। আবার রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অনেক এলাকার সড়কের পিচ উঠে খানাখন্দ তৈরি হয়েছে।
ডিএনসিসি এলাকায় সড়ক রয়েছে এক হাজার ৩৪০ কিমি। এর মধ্যে প্রধান সড়ক ১৯০ কিমি, সংযোগ সড়ক (সেকেন্ডারি রোড) ৩৪৫ কিমি ও অলিগলির সড়ক ৮০৫ কিমি। এর মধ্যে প্রকৌশল বিভাগের হিসাবে ১৫০ কিমির বেশি সড়কের সংস্কার বা মেরামত এখন জরুরি হয়ে পড়েছে।
ডিএনসিসি সূত্র বলছে, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ৭১ কিমি সড়ক সংস্কারের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এতে ব্যয় হবে প্রায় ৩৫৫ কোটি টাকা। সড়ক সংস্কারের সঙ্গে ৬১ কিমি নালা ও ১৫ কিমি ফুটপাত নতুন করে নির্মাণ করা হবে। আর চলতি অর্থবছরে সড়ক সংস্কার (নালা ও ফুটপাত নির্মাণসহ) কাজে সাড়ে ৬০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
ডিএনসিসির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ফারুক হাসান মো. আল মাসুদ জানান, যেসব সড়কে ছোটখাটো গর্ত হয়েছে, সেগুলো মেরামত করা হচ্ছে। যেসব সড়ক বিভিন্ন সংস্থা কাটছে, তাদের কাজ শেষ হওয়ার পর তা মেরামত করা হবে।
সরেজমিনে বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ওয়াসার পাইপ, বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট লাইন বসানোর জন্য বিভিন্ন সময় সড়ক খোঁড়াখুঁড়ির কারণে বেহাল অবস্থা তৈরি হয়েছে ডিএনসিসির বিভিন্ন সড়কে। মোহাম্মদপুর এলাকার বেশিরভাগ সড়কে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ শুরু হয় এ বছরের শুরুতে। সেখানকার বিভিন্ন সড়কের নিচ দিয়ে নালা নির্মাণের জন্য পাইপ বসাচ্ছে ডিএনসিসি। আবার কিছু সড়কে ঢাকা ওয়াসা পানির পাইপ বসাচ্ছে। আবার কিছু সড়ক কাটা হয়েছে বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট সংযোগ স্থাপনের লাইন বসাতে। ফলে পুরো মোহাম্মদপুর এলাকার বেশিরভাগ সড়কে চলাচলের ক্ষেত্রে দুর্ভোগ তৈরি হচ্ছে বলে স্থানীয়রা জানান।
মাকছিম নামে মোহাম্মদপুর এলাকার এক বাসিন্দা জনকণ্ঠকে বলেন, ‘সড়কের অবস্থা এমন যে রিক্সায় উঠলেও উল্টে যাওয়ার ভয় করে। এ সড়ক অটোরিক্সা-রিক্সায় পার হওয়ার সময় কোমর ব্যথা হয়ে যায়। আবার সড়ক ভাঙাচোরা হওয়ায় যানজট  লেগেই থাকে।’

×