ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১১ অক্টোবর ২০২৪, ২৫ আশ্বিন ১৪৩১

শেরপুরে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এক নারীর আর্তি

‘ঢলে ঘর ধইসা গেছে মাথা গোঁজার ঠাঁই নাই’

নিজস্ব সংবাদদাতা, শেরপুর

প্রকাশিত: ২৩:০৪, ১০ অক্টোবর ২০২৪

‘ঢলে ঘর ধইসা গেছে মাথা গোঁজার ঠাঁই নাই’

শেরপুরে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত

‘ঢলে আমার তিনটা ঘর ধইসা গেছে। মাথা  গোঁজার ঠাঁই নাই। তিন দিন ধইরা না গুমাইয়া বইয়া থাহি। আমি অসহায় মানুষ। এহন  কেমনে এই ঘর ঠিক করমু চিন্তা কইরা কূল পাইতাছি না।’ আক্ষেপের সুরে এমন কথা বলছিলেন সাম্প্রতিক পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলার ব্রিজপাড় এলাকার বাসিন্দা রাশেদা বেগম। স্বামী ও পুত্র সন্তানহীন স্বল্প আয়ের বিধবা রাশেদার একটি থাকার ঘর, একটি রান্নাঘর ও একটি গোয়ালঘরের সবই ঢলের তা-বে ল-ভ- হয়ে গেছে।

ফিকে হয়ে উঠেছে তার বাঁচার স্বপ্ন। কেবল রাশেদাই নন, তার মতো টানা প্রবল বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলের বন্যায় ঝিনাইগাতী ও নালিতাবাড়ী উপজেলার প্রায় সাড়ে ৬ হাজার ঘরবাড়ি ভেসে গেছে এবং ধসে গেছে। বুধবার থেকে বন্যার পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে ভেসে উঠছে সেইসব ক্ষত। ফলে এখন ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের লোকজন চরম মানবেতর জীবনযাপন করছে।
বৃহস্পতিবার দুপুরে সরেজমিন গেলে কথা হয় ঝিনাইগাতী সদরের ব্রিজপাড় এলাকার বাসিন্দা জুলেখা বেগমের সঙ্গে।  তিনি জানান, ঢলের প্রথম ধাক্কাতেই শেষ সম্বল আমার ঘরবাড়ি ভাইসা গেছে। এহন থাহার জাগা নাই। খাওনেরও কিছু নাই। কিভাবে ঘর তুলমু, কি খামু এইডা নিয়াই ভাবতাছি। নালিতাবাড়ী উপজেলার খলিশাকুড়া গ্রামের বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম বলেন, ঢলের দিন আমার ছোট মেয়েটাকে কোনো রকমে ঘাড়ে নিয়ে ঘরের খুঁটি ধইরা গলা সমান পানিতে সারারাত দাঁড়ায়া ছিলাম।

মনে করছিলাম নিজেও বাঁচমু না, আর মাইয়াটারেও বাঁচাতে পারমু না। চোখের সামনে ঘরের সব জিনিস ভাসায়া নিয়ে গেছে, কিচ্ছু বাঁচাইতে পারি নাই। অটো চালায়া সংসার চালাইতাম, সেইটাও নষ্ট হয়ে গেছে গা। এহন কি যে করমু বুঝতাছি না। একই এলাকার বাসিন্দা নাকুগাঁও স্থলবন্দরের শ্রমিক চিন্তাহরণ বলেন, আমি গরিব মানুষ দিন আইনা দিন খাই। আমার তিনটা ঘর ঢলে ভাইঙ্গা নিয়ে গেছে গা। ঘরের ধান-চাল সবই ভাসায়া নিয়ে গেছে গা। এখন কি খায়া বাঁচমু? সরকার আমগরে সাহায্য না করলে আর কোনো উপায় নাই। আরেক বাসিন্দা জুলহাস বলেন, ঢলের পানিতে হাসমুরগিসহ ঘরের সব ভাসায়া নিয়ে গেছে গা। ছোট ছোট পুলাপান নিয়া কোনমতে জীবন বাঁচাইছি। 
তাদের মতো এমন অসহায়ত্বের গল্প দুই উপজেলার হাজার হাজার মানুষের। দিন এনে দিন খাওয়া এসব দরিদ্র মানুষ তাদের পেটের ক্ষুধার চেয়ে মাথা গোঁজার ঠাঁই নিয়ে বেশি চিন্তিত। প্রশাসন বলছে, ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি করে তাদের পুনর্বাসনে সহায়তা করা হবে।
৪ অক্টোবর শুক্রবার ভোররাত থেকে স্মরণকালের ভয়াবহ এক পাহাড়ি ঢল দেখেছে শেরপুরবাসী। স্থানীয়দের দাবি, প্রতিবছর বর্ষায় দুই তিন বার ঢলে ভাসলেও ইতোপূর্বে এমন তা-বলীলা কেউ দেখেনি আগে।
ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পাহাড় থেকে নেমে আসা ৪টি নদী পাড়ের মানুষ কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই সব ল-ভ- করে দেয় ঢল। গত তিনদিন থেকে বৃষ্টি না থাকায় ও উজানের পানি কমতেই ভেসে উঠছে তান্ডবলীলার চিত্র। 
বন্যায় জেলার ঝিনাইগাতী ও নালিতাবাড়ী উপজেলার অন্তত সাড়ে ছয় হাজার মাটির কাঁচা, আধা পাকা ও পাকা ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। ঢলের স্রোতের সামনে যা যা পড়েছে সব মিশিয়ে দিয়েছে মাটির সঙ্গে, নয়তো নিয়ে গেছে ভাসিয়ে। সব হারিয়ে দিশেহারা এসব পরিবার। পানি কমায় আশ্রয় কেন্দ্র থেকে নিজ ঘরে ফিরছে মানুষ, ভেঙে যাওয়া ঘর থেকে প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র উদ্ধারের চেষ্টা করছেন তারা। 
ঝিনাইগাতী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আশরাফুল আলম রাসেল জানান, প্রাথমিকভাবে প্রাপ্ত তথ্যে এ উপজেলায় ৫শ ঘর পুরোপুরি বিধ্বস্ত এবং এক হাজারের মতো ঘর আংশিক বিধ্বস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। তাদের সহায়তা করা হবে।
নালিতাবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো.মাসুদ রানা বলেন, এ উপজেলায় ৪ হাজার ৬৮টি ঘর সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত ও প্রায় ১২০০ ঘর আংশিক বিধ্বস্ত হয়েছে। তাদের পুনর্বাসনের জন্য উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। 
এ ব্যাপারে শেরপুরের জেলা প্রশাসক তরফদার মাহমুদুর রহমান বৃহস্পতিবার বিকেলে জানান, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ির তালিকা তৈরির কাজ চলছে। ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে টিন ও নগদ অর্থ বরাদ্দ চেয়ে চাহিদাপত্র পাঠানো হয়েছে। বরাদ্দ পেলেই ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে বিতরণ করা হবে।
নেত্রকোনায় পানি নামছে, কমেনি দুর্ভোগ ॥ নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে বন্যার পানি নামতে শুরু করলেও বানভাসি মানুষের দুর্ভোগ এখনো কমেনি। জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, পাঁচ উপজেলার ২৫ ইউনিয়নের প্রায় ৯০ হাজার মানুষ এখনো পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে। ১৫টি আশ্রয়কেন্দ্রে বাস করছেন ১শ’ ৬৫ জন নারী-পুরুষ। এদিকে কলমাকান্দা উপজেলার উব্দাখালী নদীর পানি বৃহস্পতিবারও বিপৎসীমার ৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। 
কয়েকদিনের টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে কলমাকান্দা, দুর্গাপুর, পূর্বধলা, বারহাট্টা ও সদর উপজেলায় আকস্মিক বন্যা দেখা দেয়। এতে ২৫টি ইউনিয়নের নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হয়। বন্যার কারণে ২শ’ ১২টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠদান বন্ধ রাখা হয়েছে। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এজিইডি) নির্বাহী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম জানান, বন্যায় জেলার সড়কপথে প্রায় ২শ’ কোটি টাকার মতো ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ৬শ’ ৫০ কিলোমিটার সড়কপথ তলিয়ে গিয়েছিল। এর মধ্যে ২শ’ ৫০ কিলোমিটার সড়ক এখনও পানির নিচে রয়েছে।

×