ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১০ অক্টোবর ২০২৪, ২৫ আশ্বিন ১৪৩১

অলৌকিক গল্প ও ঐতিহ্যের স্মারক বিবিচিনি শাহী মসজিদ

প্রকাশিত: ১৯:২৯, ১০ অক্টোবর ২০২৪

অলৌকিক গল্প ও ঐতিহ্যের স্মারক বিবিচিনি শাহী মসজিদ

মোগল আমলের অন্যতম পুরাকীর্তি বরিশাল জেলার সীমান্তবর্তী এলাকা বাকেরগঞ্জ উপজেলার সীমান্তে  বরগুনা জেলার বেতাগী উপজেলার বিবিচিনি শাহী মসজিদ। পাঁচশত বছরের পুরনো এ মসজিদটির স্থাপত্য শৈলী মুগ্ধ করছে পর্যটকদের। দৃষ্টিনন্দন মসজিদটি দেখতে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ছুটে আসে পর্যটকরা। 

বাকেরগঞ্জ উপজেলা শহর থেকে বরগুনা আঞ্চলিক সড়কে ২৫ কিলোমিটা দক্ষিণে ও বেতাগী উপজেলা শহর থেকে আঞ্চলিক সড়ক ধরে উত্তর দিকে ১০ কিলোমিটার গেলেই বিবিচিনি গ্রাম। সেখানেই চারিদিকে সবুজের সমারোহের মধ্যে উঁচু এক টিলার ওপর মাথা উচুঁ করে দাঁড়িয়ে আছে মসজিদটি। মসজিদের সামনের দিকে বড় বড় খেজুর গাছ সহ নানা প্রজাতির গাছের বাগান। 

কথিত আছে এই মসজিদকে ঘিরে উপকূলীয় বাংলায় ইসলাম প্রচার শুরু হয়। প্রায় ৫০০ বছরের পুরানো এই স্থাপনা আকারে বড় না হলেও স্থাপত্য শৈলীতে বেশ রাজসিক হওয়ায় মসজিদটি দেখে মুগ্ধ হন সবাই। তাই দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এখানে ছুটে আসেন পর্যটকরা। এই মসজিদ ঘিরে রয়েছে অনেক অলৌকিক গল্পও।

ইতিহাস ও স্থানীয়দের মুখে এমন গল্প থেকে জানা যায়, সম্রাট শাহজাহানের আমলে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশে শাহ নেয়ামতুল্লাহ নামের এক সাধক পারস্য থেকে দিল্লি আসেন। ওই সময় শাহজাহানের দ্বিতীয় ছেলে বাংলার সুবাদার শাহ সুজা তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। ১৬৫৯ খ্রিস্টাব্দের শেষ দিকে ইসলাম প্রচারে শাহ নেয়ামতুল্লাহ তার শিষ্যসহ বজরায় চড়ে গঙ্গা অতিক্রম করে বিষখালী নদীতে নোঙর করেন। তখন শাহ সুজার অনুরোধে গ্রামে এক গম্বুজ বিশিষ্ট একটি মসজিদ করা হয়। পরে নেয়ামতুল্লাহর কন্যা চিনিবিবি ও ইছাবিবির নামের সঙ্গে মিলিয়ে গ্রামের নাম রাখা হয় বিবিচিনি এবং মসজিদটির নামও সেখান থেকেই নেওয়া। এ ছাড়াও শাহ নেয়ামতুল্লাহর নামের সঙ্গে মিল রেখে বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ উপজেলার নিয়ামতি ইউনিয়নে বিবিচিনি গ্রামের পাশের গ্রামের নাম রাখা হয় নেয়ামতি।

আরও জানা যায়, বিষখালী নদীর পানি লবণাক্ত থাকায় সুপেয় পানির অভাবে এই এলাকার মানুষেরা অনেক কষ্টে ছিল। শাহ নেয়ামতুল্লাহ কষ্ট অনুভব করেন এবং তার তসবিহটি বিষখালী নদীতে ধুয়ে দেন। অলৌকিকভাবে এতে এখানকার পানি সুপেয় হয়ে যায়। আজও সেই পানি তেমনই রয়েছে।

এছাড়াও ওই সময় সুন্দরবন সংলগ্ন বিষখালীতে কুমিরের ভয়ংকর আনাগোনা ছিল। কিন্তু শাহ নেয়ামতুল্লাহ আসার পর থেকে নাকি বিবিচিনির ধারে কাছেও কোনো কুমির আসত না।

মুঘল আমলের মসজিদটির দৈর্ঘ্য ৩৩ ফুট, প্রস্থ ৩৩ ফুট। দেয়ালগুলো ৬ ফুট চওড়া। দক্ষিণ ও উত্তর দিকে ৩টি করে মোট ছয়টি জানালা আছে। জাফরি ইট দিয়ে তৈরি মসজিদটি সমতল থেকে কমপক্ষে ৩০ ফুট উঁচু টিলার উপর। মসজিদের মধ্যে প্রবেশের জন্য একটি দরজা। মসজিদটির টিলার উপর উঠতে দর্শনার্থী ও মুসুল্লিদের জন্য পূর্ব ও দক্ষিণ পাশে দুটি সিঁড়ি রয়েছে। পূর্ব পাশের সিঁড়িটি ২৫ ধাপের, উচ্চতা ৪৬ ফুট এবং দক্ষিণ পাশের সিঁড়িটি ২১ ধাপের, উচ্চতা ৪৮ ফুট। তবে দক্ষিণ পাশের সিঁড়িটির অধিকাংশ স্থানই ভেঙে গেছে। 

মসজিদের কাছেই ৩টি পুরানো দিঘি ছিল। এসব দিঘি নিয়েও বেশ জনশ্রুতি আছে। বড় দিঘীটির নাম ইছাবিবির দিঘী। বর্তমানে দিঘীগুলোর অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। এ ছাড়াও মসজিদের পাশে ৩টি কবর আছে। লম্বায় একেকটি ১৪ থেকে ১৫ হাত। মসজিদটির পশ্চিম ও উত্তর পাশের কবরে শায়িত সাধক নেয়ামতউল্লাহ এবং চিনিবিবি ও ইছাবিবি।

বিবিচিনি শাহী মসজিদের দায়িত্বরত মুয়াজ্জিন আবু হানিফ বলেন, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিদিনই মসজিদটি দেখতে আসেন দর্শনার্থীরা। তবে শুক্রবার এই আগমন বেশি থাকে। তিনি আরো বলেন, ৫০০ বছরের পুরনো মসজিদটি শত শত বছর বন জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে ছিল। স্থানীয়দের উদ্যোগে সেই জঙ্গল পরিষ্কার করে একশত দশ বছর ধরে নিয়মিত মুসল্লিরা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে আসছে। বিভিন্ন প্রান্তের অগণিত নারী-পুরুষ এখানে এসে নামাজ আদায় করেন। টাকা-পয়সাও দান করেন। জুমার নামাজেও অনেক মুসুল্লি আসেন।

এদিকে ঐতিহ্যের সাক্ষী এই স্থাপনার কিছু কিছু অংশের দেয়ালের পলেস্তারা খসে গেলে ১৯৮৫ সালে উপজেলা পরিষদের অর্থায়নে তা মেরামত করা হয়। ১৯৯২ সালে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ এটির রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারের দায়িত্ব নেয় এবং ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে তালিকাভুক্ত করে। মসজিদটির উপরে উঠতে সিড়ির দক্ষিণ পাশে উপজেলা পরিষদের বরাদ্দে দর্শনার্থীদের জন্য তৈরি করা হয়েছে আধুনিক অজুখানা। এছাড়াও মসজিদটির উত্তর পাশে সরকারি বরাদ্দে দর্শনার্থীদের জন্য তৈরি করা হয়েছে শাহী কটেজ।
 

 

ফুয়াদ

×