দেবী দুর্গার প্রতি বন্দনা--- ছবি জীবন ঘোষ
শরতের শিশির সিক্ত ধরণীতল, মেঘ জড়িত আকাশ, শিউলী ঝরা মায়াময় অনাবিল প্রভাতের আলো। এমন শুভক্ষণে করুণাময়ী দেবী দুর্গা আসছেন আলোকবর্তিকা হাতে। সনাতন (হিন্দু) ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস মতে, জগৎজননী মহামায়ার পূজা মানে প্রকৃতির সেবা করা। বিশ্বাস মতে, বিশ্বব্রহ্মামা-ের সকল শক্তির মিলিত রূপ দেবী দুর্গা। শক্তি, মুক্তি ও শান্তির অধিষ্ঠাত্রী দেবী দুর্গা সকল প্রকার অনাচার, অবিচার, বৈশ্বিক মহামারি, জরাজীর্ণতা দূর করার প্রয়াসে সর্বোপরি অসুর ও অশুভ শক্তির বিনাশকল্পে ধরাধামে নেমে আসেন। তাই তো মহাশক্তিরূপিনী চিন্ময়ীদেবীর আগমনে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের এত আয়োজন। বেজে ওঠে ঢাকির ঢাক, ধর্ম উৎসব রূপ নেয় চিরায়ত লোক উৎসবে, ধূপের গন্ধ বয়ে আনে পূজার সমুদয় অনুসঙ্গ। সবমিলিয়ে শান্তিময় হয় বসুন্ধরা।
এমন শারদীয় দুর্গা পূজা সমাগত। শেষ সময়ে প্রতিমা থেকে শুরু করে প্যান্ডেল তৈরি ও আলোকসজ্জাসহ সকল কাজ এগিয়ে চলছে দ্রুতগতিতে। এ বছর খুলনা জেলায় ৯১৩টি পূজাম-পে সাড়ম্বরে চলছে এই আয়োজন। পূজা নির্বিঘ্নে করতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। থাকবে তিন স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা। সর্বক্ষণিক থাকবে গোয়েন্দা নজরদারি।
পূজা উদ্যাপন পরিষদের তথ্য মতে, খুলনার উপজেলা ও মহানগর মিলে মোট ৯১৩টি ম-পে পূজা অনুষ্ঠিত হবে। যা গত বছরের চেয়ে ১৩১ খানা কম। এর মধ্যে মহানগরের আটটি থানায় গেল বছর ১৩৫টি পূজাম-পে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এ বছর হবে ১২৪টি ম-ফে। ১২৪টির মধ্যে সদরে ২৩টি, সোনাডাঙ্গায় ১১টি, খালিশপুরে ১০টি, দৌলতপুরে ২১টি, খানজাহান আলীতে ৭টি, হরিণটানায় ৫টি, লবণচরায় ৯টি এবং আড়ংঘাটা থানা এলাকায় রয়েছে ৩৮টি পূজামন্দির। অপরদিকে জেলার নয়টি উপজেলায় ৭৮৯টি মন্দিরে পূজা অনুষ্ঠিত হবে। যা গত বছরের চেয়ে ১২০টি কম। প্রতিবছরের ন্যায় এ বছরও ডুমুরিয়া উপজেলাতে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক পূজা অনুষ্ঠিত হবে। এ সংখ্যা ২০১টি। এছাড়া ফুলতলায় ৩৪টি, পাইকগাছায় ১২৯টি (পৌরসভায় ৬টি), দাকোপে ৬৫টি (চালনা পৌরসভায় ১০টি), বটিয়াঘাটায় ৯৬টি, রূপসায় ৭৪টি, তেরখাদায় ৮২টি, দিঘলিয়ায় ৬১টি এবং কয়রা উপজেলায় ৪৭টি ম-পে পালিত হবে এই ধর্মীয় উৎসব।
বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদ নগর শাখার সাধারণ সম্পাদক প্রশান্ত কুমার কুন্ডু বলেন, নিরাপত্তা বিধানে রাতে যেন লোডশেডিং না হয় সে আহ্বান জানাই। ইতোমধ্যে প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরে ম-পের তালিকা প্রেরণ করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, প্রতিটি কমিটিকে কঠোরভাবে বলা হয়েছে ২২ দফা নির্দেশনা মেনে চলার জন্য। এটা মনিটরিং করার জন্যও আমাদের দল তৈরি করা হয়েছে। আমরা বিগত বছরগুলোতে দেখেছি শহরে গভীর রাত পর্যন্ত ভক্তরা প্রতিমা দর্শন এবং প্যান্ডেল ও আলোকসজ্জা উপভোগ করেন। সে বিষয়টিও মাথায় রেখে নিরাপত্তার কথা ভাবা হয়েছে।
আর জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক বিমান সাহা বলেন, সঠিক নিরাপত্তার জন্য প্রশাসনের সঙ্গে পরিকল্পনা করা হয়েছে। প্রশাসনের বিভিন্ন বাহিনীর পাশাপাশি থাকবে মন্দির কমিটির নিজস্ব স্বেচ্ছাসেবক দল। নানা কারণে এ বছর পূজার সংখ্যা কমে গেছে। তারপরও সাড়ম্বরে পূজা অনুষ্ঠিত হবে বলে আমরা মনে করি। যে সকল মন্দিরে পূজা অনুষ্ঠিত হবে সেখানে স্থানীয় প্রশাসন, সমস্ত রাজনৈতিক দল, সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও ছাত্র নেতৃবৃন্দকে সম্পৃক্ত করে নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে মন্দিরগুলোকে।
জেলা পুলিশ সুপার টি এম মোশাররফ হোসেন জানান, পূজা সুন্দর করতে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। পৃথকভাবে উপজেলা পূজা পরিষদ ও প্রতিটি কমিটির নেতৃবৃন্দের সঙ্গে মতবিনিময় সভা হয়েছে। প্রতি মন্দিরে একজন করে পুলিশ অফিসারের সঙ্গে অন্যান্য সদস্যরা নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। তবে কোনো ধরনের গুজবে কান না দেওয়ার জন্য মানুষের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার জুলফিকার আলী হায়দার বলেন, পূজা নির্বিঘ্নে করতে প্রতিটি মন্দিরে পুলিশ ও আনসার সদস্যরা সর্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করবেন। এছাড়া সাদা পোশাকে গোয়েন্দা নজরদারিসহ অতিরিক্ত পুলিশ সদস্য মোতায়েন থাকবে মন্দির ও আশপাশের এলাকায়। তিনস্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকবে।
পঞ্জিকা মতে, প্রতিবছর আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষের ষষ্ঠী থেকে দশমী তিথি পর্যন্ত; পাঁচ দিন চলে এই শারদীয় দুর্গা উৎসব। জাঁকজমকপূর্ণভাবে দেবীর বোধন, আমন্ত্রণ ও অধিবাস দিয়ে আগামী ৯ অক্টোবর মহাষষ্ঠীর মধ্যদিয়ে শুরু হচ্ছে পূজা। চলবে ১২ অক্টোবর পর্যন্ত। কেননা, এ বছর অষ্টমী ও নবমী এবং নবমী ও দশমী তিথি একই দিনে পড়েছে। তাই যে কোনো একদিনে দুই তিথির পূজা অনুষ্ঠিত হবে। তবে সরকারি ছুটি পরদিন ১৩ অক্টোবর। অবশ্য দশমীর দিন শনিবার হওয়ায় অনেকেই রবিবার প্রতিমা নিরঞ্জন করবেন বলে জানিয়েছেন আয়োজকরা।
দুর্গা পূজার কথকতা
মহাদেবী দুর্গা মহিষাসুর মর্দিনী। অর্থাৎ মহিষাসুরকে যুদ্ধে তিনি বিনাশ করেছিলেন। দেবী যুদ্ধ করে স্বর্গরাজ্য ভ্রষ্ট দেবতাদেরকে পুনরায় স্বর্গে পুনর্বাসিত করেছিলেন। বারো মাসে তেরো পার্বণ কথাটি হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্য প্রচলিত থাকলেও শারদীয় বা দুর্গা পূজাই বেশি আনন্দ-উৎসবের মাধ্যমে উদযাপিত হয়। দেবী দুর্গা শক্তির রূপ, তিনি পরব্রহ্ম। অনান্য দেব- দেবী মানুষের মঙ্গলার্থে তার বিভিন্ন রূপের প্রকাশ মাত্র। হিন্দু ধর্মশাস্ত্র অনুসারে দেবী দুর্গা ‘দুর্গতিনাশিনী’ বা সকল দুঃখ-দুর্দশার বিনাশকারিণী। ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরের শরীর থেকে আগুনের মতো তেজরশ্মি একত্রিত হয়ে বিশাল এক আলোকপুঞ্জে পরিণত হয়। ওই আলোকপুঞ্জ থেকে আবির্ভূত এক দেবী মূর্তি, তিনিই দুর্গা।
দেবী দুর্গা ত্রিনয়না বলে তাকে ‘ত্রৈম্বক্যে’ বলা হয়। বাম চোখ হলো বাসনা (চন্দ্র), ডান চোখ কর্ম (সূর্য) ও কেন্দ্রীয় চোখ হলো জ্ঞান (অগ্নি)। দুর্গার ১০ বাহুতে যে ১০টি অস্ত্র রয়েছে, সেই অস্ত্রসমূহও বিভিন্ন প্রতীকের ইঙ্গিতবাহী। শঙ্খ ‘প্রণব’ বা ওঙ্কার ধ্বনির অর্থবহতা নির্দেশ করে। তীর-ধনুক দেবীর শক্তিমত্তার প্রতীক। হস্তে ধৃত বজ্রাগ্নি হলো ভক্তের সঙ্কল্পের দৃঢ়তা। দুর্গার হাতের পদ্ম বা ‘পঙ্কজ’ অর্থ হলো পদ্ম যেমন কাদামাটির ভেতর হতে অনাবিল হয়ে ফোটে, তেমনি দেবীর উপাসকরাও যেন লোভ-লালসার জাগতিক কাদার ভেতর হতে আত্মার বিকাশ ঘটাতে পারে। দেবীর তর্জনীতে ধরা সুদর্শন চক্র তার শুভতার লালন ও অশুভের বিনাশের ইচ্ছার প্রকাশ। দুর্গার হাতে ধরা তলোয়ার জ্ঞানের ইঙ্গিত ও ত্রিশূল হলো সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ গুণের প্রকাশ। হিন্দু শাস্ত্র মতে, দৈত্য, বিঘœ, রোগ, পাপ ও ভয়-শত্রুর হাত থেকে যিনি রক্ষা করেন, তিনিই দুর্গা।
তবে দুর্গা পূজা কখন ও কোথায় প্রথম শুরু হয়েছিল, এ তথ্য বেশ কঠিন। ভারতের দ্রাবিড় সভ্যতায় মাতৃতান্ত্রিক দ্রাবিড় জাতির মধ্যে মাতৃদেবীর পূজার প্রচলন ছিল। সিন্ধু সভ্যতায় (হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো সভ্যতা) দেবীমাতা, ত্রিমস্তক দেবতা, পশুপতি শিবের পূজার প্রচলন ছিল। দুর্গা শিবের অর্ধাঙ্গিনী সে হিসাবে অথবা দেবীমাতা হিসাবে পূজা হতে পারে। তবে কৃত্তিবাসের রামায়ণে আছে, শ্রী রাম চন্দ্র কালিদহ সাগর (বগুড়ার?) থেকে ১০১টি নীল পদ্ম সংগ্রহ করে সাগর কূলে বসে বসন্তকালে সীতা উদ্ধারের জন্য সর্বপ্রথম শক্তি তথা দুর্গোৎসবের (বাসন্তি পূজা) আয়োজন করেছিলেন। মারকে-েয় পুরাণ মতে, চেদি রাজবংশের রাজা সুরাথা খ্রিস্টের জন্মের ৩শ’ বছর আগে কলিঙ্গে (বর্তমানে ওড়িষ্যা) দুড়িশ্যা নামে দুর্গাপূজার প্রচলন করেছিলেন। নেপালে আজও দুড়িশ্যা বা দাশিন নামেই পূজা হয়। যদিও প্রাচীন ওড়িষ্যার সঙ্গে নেপালের পূজার কোনো যোগসূত্র আছে কিনা তা অস্পষ্ট।
মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যে দুর্গা পূজার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। ১১শ’ শতকে অভিনির্ণয়ে, মৈথিলী কবি বিদ্যাপতির দুর্গাভক্তিতরঙ্গিণীতে দুর্গা বন্দনা পাওয়া যায়। ১৫১০ সালে কুচ বংশের রাজা বিশ্বসিংহ কুচবিহারে দুর্গাপূজার আয়োজন করেছিলেন। ১৬১০ সালে কলকাতার বারিশার রায় চৌধুরী পরিবার প্রথম দুর্গা পূজার আয়োজন করেছিলেন বলে ধারণা করা হয়।
দুর্গাপূজা ভারতের অসম, বিহার, ঝাড়খ- ও ওডিশায় ব্যাপকভাবে উৎযাপন করা হয়। পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরায় (যেখানে বাঙালি হিন্দুরা ব্যাপক সংখ্যায় বসবাস করে) সবচেয়ে বড় সামাজিক, সাংস্কৃতিক উৎসব হিসাবে এটা উৎযাপিত হয়। বিভিন্ন স্থানে এই পূজাকে শারদীয় পুজা, শারদোৎসব, মহাপূজা, মায়ের পূজা, ভগবতী পূজা হিসাবে উৎযাপন করা হয়। তবে বিহার, অসম, ওডিশা, দিল্লি, মধ্যপ্রদেশে দুর্গাপূজা, মহারাষ্ট্র, গুজরাট, উত্তর প্রদেশ, পাঞ্জাব, কেরালা, হিমাচল প্রদেশ, মহিশুর, তামিলনাড়ু, অন্ধ্র প্রদেশে এ পূজাকে নবরাত্রি পূজা বলা হয়। তবে দুর্গা পূজার ইতিহাস নিয়ে নানা জনে নানা মতবাদ উল্লেখ করেছেন।
বঙ্গে এই পূজাকে শারদীয় পূজা, শারদোৎসব, মহাপূজা, মায়ের পূজা, ভগবতী পূজা হিসাবে উৎযাপন করা হয়। তবে বিহার, অসম, ওডিশা, দিল্লি, মধ্যপ্রদেশে দুর্গা পূজা, মহারাষ্ট্র, গুজরাট, উত্তর প্রদেশ, পাঞ্জাব, কেরালা, হিমাচল প্রদেশ, মহিশুর, তামিলনাড়ু, অন্ধ্র প্রদেশে এ পূজাকে নবরাত্রি পূজা বলা হয়। তবে দুর্গাপূজার ইতিহাস নিয়ে নানাজনে নানা মতবাদ উল্লেখ করেছেন। নেপালে ও ভুটানেও স্থানীয় রীতিনীতি অনুসারে প্রধান উৎসব হিসাবে পালন করা হয়। এছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, ফ্রান্স, সিঙ্গাপুর, মরিশাস, ফিজি, টোবাকো, কুয়েতসহ বিশ্বের বহু দেশে অভিবাসী হিন্দুদের বা বাঙালি হিন্দুদের নানা সংগঠনে এই উৎসব হয়। ২০০৬ সালে মহাদুর্গা পূজা অনুষ্ঠান ব্রিটিশ মিউজিয়ামের গ্রেট কোর্টে অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
আমাদের দেশের প্রতিটি জেলায় ব্যাপক আয়োজনের মধ্যদিয়ে এই পূজা হয়ে থাকে এবং সরকারিভাবে একদিনের (দশমীতে) ছুটি থাকে। সাতক্ষীরার কলারোয়ার ১৮ শতকের মঠবাড়িয়ার নবরত্ন মন্দিরে (১৭৬৭) দুর্গা পূজা হতো বলে লোকমুখে শোনা যায়। ঢাকেশ্বরী মন্দির চত্বরে আছে দুই ধরনের স্থাপত্যরীতি মন্দির। প্রাচীনতমটি পঞ্চরত্ন দেবী দুর্গার যা সংস্কারের ফলে মূল চেহারা হারিয়েছে। মন্দিরের প্রাচীন গঠনশৈলী বৌদ্ধ মন্দিরের মতো। ধারণা করা হয়, দশম শতকে এখানে বৌদ্ধ মন্দির ছিল যা পরে সেন আমলে হিন্দু মন্দির হয়েছিল এবং ১১শ’ বা ১২শ’ শতক থেকে এখানে কালী পূজার সঙ্গে দুর্গা পূজার হতো। ইতিহাসবিদ দানীর মতে, প্রায় সাড়ে পাঁচশ’ বছর আগে রমনায় কালী মন্দির নির্মিত হয়েছিল এবং এখানেও কালী পূজার সঙ্গে দুর্গা পূজার হতো।
দেবী দুর্গা তত্ত্ব
দেবী দুর্গা তত্ত্বটি খুবই বৃহৎ। বাঙালি হিন্দুদের সব চেয়ে বড় এই উৎসবকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট আলোড়ন দীর্ঘস্থায়ী হয় সবচেয়ে বেশি। দুর্গা পূজা মহাপূজা, এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। কেননা সমস্ত দেবতার সম্মিলিত তেজ থেকে যে মহাদেবী আবির্ভূত হয়েছিল, তার পূজাতে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ নানাভাবে অংশগ্রহণ করে থাকে। ভক্তের শুধু ভক্তি নয় ভালবাসাও পেয়েছে দেবীদুর্গা। তাই মহাতত্ত্বময়ী- মহাশক্তি দেবী কালক্রমে কন্যা ¯েœহ পেয়ে আসছেন। পিতৃগৃহে কন্যার আগমনের আবহ আনন্দ এবং পিতৃগৃহ থেকে কন্যা বিদায়ের বেদনা বাঙালি গৃহে এক বাস্তবরূপী ছবি ফুটে ওঠে এই দুর্গা পূজায়। তাই তো পূজার সময় বিবাহিত নারীরা সন্তানদের নিয়ে পিতৃগৃহে অবস্থান করেন।
দেবীতত্ত্বের বৈদিক ভিত্তি দেবীসূক্ত এবং রাত্রিসূক্ত। দেবী সূক্তের দেবতা বাক। তিনি সর্বাশিক্তা, সর্বশক্তি সমন্বিতা সর্বব্যাপিনী এবং সর্বশ্রষ্টি। তিনিই একাদশ রুদ্র রূপে বিচরণ করে। আবার তিনিই সমুদয়, সমুগণ, বিষ্ণু প্রভৃতি দ্বাদশ আদিত্যকে ধারণ করে। চন্ডীতে তিনি বলেছেন, এ জগতে একা আমিই আছি এবং আমা ভিন্ন অতিরিক্ত আর কেহ নেই। কালিকা পুরাণ মতে শ্রীহরি দেবীকে বহন করেছেন। হরি শব্দের অর্থ সিংহ। শ্রীশ্রী চন্ডীতে উল্লেখ আছে গিরিরাজ হিমালয় দেবীকে সিংহ দান করেছে।
আবার শিব পুরাণ বলে ব্রহ্মা দুর্গাকে বাহনরূপে সিংহ দান করেছে শুম্ভ-নিশুম্ভ বধের সুবিধার্থে। দেবীর বাহ্য লক্ষণের সঙ্গে সিংহের লক্ষণগুলো মিলিয়ে দেখে বোঝা যাবে দেবীর বাহনরূপে সিংহ কেন? দেবী নিখিল বিশ্বের রাষ্ট্রী বা সম্রাজ্ঞী। আর সিংহ হলো পশুরাজ্যের স। দেবী অস্ত্রধারিণী ও সিংহ নখরধারী। দেবী জটাজুট সমাযুক্ত ও সিংহ কেশবী। দেবী মহিষাসুর মর্দিনী সিংহ মহিষের সঙ্গে যুদ্ধে বিজয়ী।
দেবীর কল্পারম্ভ অর্থ সংকল্প। আর সংকল্প অর্থ দেবী বা দেব পূজার উদ্দেশ্য। এই উদ্দেশ্যই মানুষ দেবী বা দেব পূজায় নিয়োজিত করে। সংকল্প যেখানে স্থীর, গভীর, একাগ্র, শ্রদ্ধাযুক্ত পূজা সেখানেই স্বার্থকতাম-িত। সকল দেব-দেবী পূজায় সংকল্প থাকলেও দুর্গা পূজায় সংকল্প একটু বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। দুর্গা পূজার সংকল্প সাত প্রকার। কৃষ্ণা, প্রতিপদ, ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমীতেও সংকল্প করে পূজা করতে হয়। কল্পরম্ভ বা সংকল্প করা মানে চ-ীর ঘট স্থাপন করে যথাশক্তি পূজা করা।
পৃথিবীর ছয় মাস দিন ও ছয় মাস রাত্রিতে দেবতাদের হয় মাত্র একদিন। শ্রাবণ থেকে পৌষ মাস দেবগণের রাত্রি এবং মাঘ থেকে আষাঢ় মাস দেবগণের দিন। আবার বলা যায় শ্রীহরির শয়ন থেকে উত্থান পর্যন্ত রাত্রি। তাই শ্রাবণ থেকে পৌষ দেব-দেবীর পূজার বোধন অপরিহার্য। শারদীয় দুর্গা উৎসব দেবদেবীগণের রাত্রি বিধায় বোধন করতে হয়। অবশ্য এই সময়টাকে দক্ষিণায়ন বা পিতৃপক্ষও বলে। দেবী পূজা হলো জাতি গঠনের প্রেরণা। আর জাতি গঠন বা রাষ্ট্র গঠনের মূল ভিত্তি হলো সংহতি। এই সংহতিকে জাতির কল্যাণে স্বার্থক প্রয়োগই রাষ্ট্র নির্মাণ পূর্ণাঙ্গ হয়। বৈদিক সূক্তে দেবী নিজেই বলেছে, “আমি এই বিশ্ব রাজ্যের অধিশ্বরী”।
দেবী প্রতিমায় আমরা যে পূজা করি তার দিকে দৃষ্টি দিলে এই রাষ্ট্র পরিকল্পনার নিখুঁত দিকটি কি দেখতে পাই না? প্রত্যেক রাষ্ট্রে চারটি শ্রেণির মানুষ দেখা যায়। বুদ্ধিজীবী, বীর্যজীবী, ব্যক্তিজীবী ও শ্রমজীবী। এই চার শক্তির পূর্ণ অভিব্যক্তি ও পরস্পর সহচার্য যেখানে অবিঘিœত, সেখানে জাতি বা রাষ্ট্র অপ্রতিহত গতিতে তার লক্ষ্য পথে এগিয়ে যেতে সমর্থ। পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্র ভাবনা থেকেই এ দেশে সৃষ্টি হয়েছিল ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রীয়, বৈশ্য ও শূদ্র- এই চার বর্ণ বিভাগ। তবে এই বিভাগ ভেদবুদ্ধি প্রণোদিত নয়।
পূজা মন্দিরে দুর্গা প্রতিমার দিকে তাকালেই আমরা দেখি দুর্গা মহারণঙ্গিনী, পদতলে মহিষাসুর বিমর্দিত ও অবলুণ্ঠিত। দুর্গাকে সে আক্রমণ করছে বিপুল বিক্রমে। আবার দুর্গা বাহন সিংহও আক্রমণ করছে মহিষাসুরকে। দুর্গার ১০ হাত ১০ দিক রক্ষা করার প্রতীক। ১০ দিক হলো পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ, ঈশান, বায়ু, অগ্নি, নৈঋত, ঊর্ধ্ব এবং অধঃ। এই ১০ প্রহরণ নিয়ে প্রতি আক্রমণ করছে মহিষাসুরকে। তবে ভীষণ এই রণাঙ্গনে দেবীর মুখে ক্রোধভাব নেই। দেবীর শিরোদেশে মহাদেবাদিদেব শিব অধিষ্ঠিত। দুর্গা দেবীর ডান পাশে কার্ত্তিক। আর এই অধিষ্ঠিতের মধ্যে মূল শক্তি দেবী দুর্গা।
তাকালেই প্রথমে মনে হয় অসুর শক্তিকে পদানত করতে পারলেই লাভ করা যায় মহাসুন্দর শিবকে মস্তকের উপরে। লক্ষ্মী হলো ধনশক্তি বা বৈশ্যশক্তি, গণেশ হলো জনশক্তি বা শ্রমশক্তি, সরস্বতী হলো জ্ঞানশক্তি এবং দেব সেনাপতি কার্ত্তিক ক্ষাত্রশক্তির দেবতা। তাই পুত্র, কন্যা স্বরূপ চার শক্তিকে (লক্ষ্মী, সরস্বতী, গণেশ ও কার্ত্তিক) নিয়ে আসেন। দেবীর প্রতিমা দর্শনে লব্ধ জ্ঞানই রাষ্ট্রীয় জ্ঞান বা রাষ্ট্রীয় বিজ্ঞান। বস্তুত দুর্গা প্রতিমাই হিন্দুদের জাতীয় প্রতিমা। দেবী পূজায় সমাজের সকল স্তরের লোকেরই প্রয়োজন। হাত কর্মের প্রতীক, অলস্য, নিদ্রা, তন্দ্রা, জড়তা প্রভৃতি মহাপাপ দূরীভূত করে জাতির মধ্যে সর্বতোপ্রসারি কর্মশক্তি জাগিয়ে তোলার জন্যই তিনি দশভুজা। আবার বলা যায় দশে মিলে কাজ করার কল্যাণই দশভুজ। দেবী দুর্গার ১০ রূপের মধ্যে আছে কালী, ঊর্ধ্বতারা, ত্রিপুরা, ভুবনস্বরী, ভৈরবী, ছিন্নমস্তা, ধোমাবতী, বগলামুখি, মাতঙ্গী ও কমলা দেবী।
মহালয়া অমাবস্যায় দেবীপক্ষের সূচনা
সাধকের সাধন জগতে ও মহাবিজয়িনী বিন্দুবাসিনী মহাদেবীর আবির্ভাব ঘটে মহালয়া সাধনাবস্থার পরম প্রার্থিব পবিত্র মুহূর্তে। অবশ্য মহালয়া উদ্যাপন তারই স্মারক উৎসব। সনাতন ধর্মের বহুবিধ তত্ত্বের মধ্যে মহালয়া তত্ত্ব সুগভীর যোগতাত্ত্বিক দর্শন তত্ত্ব। দেবীশক্তিকে পূজা করার জন্য অর্থাৎ দেবীশক্তি আপন সাধনায় সঞ্চার করার জন্য সুগভীর তাৎপর্য ব্যাঞ্জক মহালয়া তিথির উত্তরকালে দেবীপক্ষের শুরু হয়। তাই বলা হয় বাঙালি হিন্দুদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গা পূজার পুণ্যলগ্ন এই মহালয়া।
চন্দ্রের ষোড়শ ভাগের এক ভাগকে বলা হয় কলা বা তিথি। চন্দ্র এক কলায় হ্রাস বা বৃদ্ধির দশাটি ১৫ দিন পর পর ঘটে। যে পক্ষে চন্দ্র হ্রাস পায় সে পক্ষকে বলা হয় কৃষ্ণপক্ষ এবং যে পক্ষতে বৃদ্ধি পায় সে পক্ষকে বলা হয় শুক্লপক্ষ। কৃষ্ণপক্ষের সর্বশেষ তিথি অমাবস্যা এবং শুক্লপক্ষের সর্বশেষ তিথি পূর্ণিমা। যে কারণে দেখা যায় কৃষ্ণপক্ষের চন্দ্রের এক এক কলা হ্রাস পেতে পেতে শেষ তিথি আসা পর্যন্ত (১৫ দিন পর) চন্দ্র কিরণবিহীন হয়ে পড়ে; চন্দ্রের এই কিরণবিহীন অবস্থাই হলো অমাবস্যা। হিন্দু শাস্ত্র মতে যেমন কয়েকটি প্রসিদ্ধ পূর্ণিমা আছে, তেমন আছে কয়েকটি প্রসিদ্ধ অমাবস্যাও। প্রসিদ্ধ পূর্ণিমার মধ্যে রয়েছে মধু পূর্ণিমা, মাঘী পূর্ণিমা, লক্ষ্মী পূর্ণিমা, রাশ পূর্ণিমা, গুরু পূর্ণিমা, বৈশাখি পূর্ণিমা ইত্যাদি। আর প্রসিদ্ধ অমাবস্যার মধ্যে আলোক অমাবস্যা, দ্বিপান্বিতা অমাবস্যা এবং মহালয়া অমাবস্যা অন্যতম।
অমাবস্যা তিথিতে চাঁদ দেখা যায় না। কৃষ্ণপক্ষে অন্তর্জগতে অর্থাৎ মনের ক্ষয়পক্ষে সর্বশেষ স্তরে মন আর মন থাকে না। তখন ‘অমা’ অবস্থায় বর্তমান থাকে। ‘অমা’ শব্দের অর্থ যাহা মাপা যায় না বা কোনোভাবেই পরিমাপ করার উপায় থাকে না। সাধন জীবনে প্রকৃত অবস্থায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য সাধক তখন ‘অমা’ অবস্থায় প্রবেশ করে। আর এ অবস্থায় পরিমাপ করার অর্থ হলো পরিমাপবিহীন অনন্ত-অসীম একটি অবস্থায় অবস্থান করা এবং এমন একটি অবস্থায় উপনীত হওয়াই অমাবস্যাবস্থা।
মহালয়া অমাবস্যা হয় আশ্বিন মাসে। যে কৃষ্ণপক্ষের শেষে মহালয়া অমাবস্যা হয় সেই কৃষ্ণপক্ষকে বলা হয় অপরপক্ষ। এই পক্ষে যারা অপর হয়ে গেছেন বা মারা গেছেন সেই পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে তর্পণ এবং মহালয়া তিথিতে হয় পার্বণ শ্রাদ্ধ। বিশেষ শ্রাদ্ধাদি পারলৌকিক ক্রিয়া কৃষ্ণপক্ষে বিহিত। অবশ্য এর অনেক তাত্ত্বিক কারণ আছে। মহত্ত্বের আলয় মহালয়। তাতেস্ত্রিয়ামাপ করে মহালয় শব্দের উৎপত্তি। মহতের-মহানের গৃহে প্রবেশ করা বা প্রাণ অমাবস্যা অবস্থায় প্রবেশ করার অর্থই হলো মহালয়। অমাবস্যা স্ত্রীলিঙ্গ বাচক শব্দ। আর অমাবস্যার বিশেষণ হলো মহালয়া। তাইতো ব্যাকরণের নিয়ম অনুসারে বিশেষণ বিশেষ্যের লিঙ্গ প্রাপ্ত হয়ে আকারন্ত মহালয়া হয়েছে।
আবার বলা যায় দীক্ষার দিন গুরু তার সাধন ক্ষমতা বলে শিষ্যকে কুটরক্ত জ্যোতি করিয়ে থাকেন। দর্শনকৃত সে জ্যোতি হলো ব্রহ্ম জ্যোতি। জ্যোতিই বিভিন্ন ধর্ম শাস্ত্রে ব্রহ্ম জ্যোতি, লাইট, নূর ইত্যাদি রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। অমাবস্যা হলো মনরূপ চন্দ্রের সম্পূর্ণ ক্ষয়াবস্থা। সে অবস্থায় এ জ্যোতিদর্শন নিকল্প স্থিরভাবে হয়। সাধক যখন কুটস্থের আরও গভীরে তখন মহালয়া অমাবস্যা অবস্থা এবং সে অবস্থায় সাধকের সাধন প্রক্রিয়া পূর্ণতার পথে অগ্রসর হয়। মহালয়ে প্রবেশ করার অর্থই হলো নিজেকে জানা অর্থাৎ নিজের মধ্যে যে প্রচ- শক্তি সুপ্ত আছে সাধন বলে তাকে জাগ্রত করা এবং জাগ্রতশক্তিকে আয়ত্তে এনে বিশ্বের মঙ্গলের কাজে ন্যস্ত করা।
মহালয়া অমাবস্যার পরদিন থেকে দেবীপক্ষের শুরু হয়। দেবীপক্ষ মানে অসুরদের বিরুদ্ধে দেবীর সংগ্রামের পক্ষ। মহালয়া অমাবস্যার পরবর্তী শুক্লপক্ষে দেবীর পূজা। হিন্দুশাস্ত্র অনুযায়ী, এদিন কৈলাসের শ্বশুরালয় ছেড়ে সন্তানদের নিয়ে পৃথিবীতে আসেন দেবী দুর্গা। তখন থেকেই মন্ডপে দুর্গা পূজার ক্ষণগণনা শুরু হয়। এদিন অমাবস্যার শুরু এবং পরবর্তী পূর্ণিমায় কোজাগরী লক্ষ্মীপূজার মধ্যদিয়ে শেষ হয় দেবীপক্ষ। পুরাণ অনুযায়ী, মহালয়ার দিনেই ব্রহ্মার কাছ থেকে মহিষাসুরকে বধ করার দায়িত্ব পান দেবী দুর্গা। ব্রহ্মার বরেই মহিষাসুর মানুষ ও দেবতাদের অজেয় হয়ে উঠেছিলেন।
ফলে তাকে পরাজিত করার জন্য ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর যে মহামায়ারূপী নারী শক্তি তৈরি করেন; তিনিই দেবী দুর্গা। দশভুজা দুর্গা টানা নয় দিন যুদ্ধ করে মহিষাসুরকে বধ করেন। মহালয়ার ভোরে চন্ডীপাঠের মধ্য দিয়ে শুরু হয় দেবী দুর্গার আবাহন। আর এ চন্ডীতেই আছে দেবী দুর্গার সৃষ্টির বর্ণনা ও তার প্রশস্তি। তাই মহালয়া অতিপুণ্য তিথি। যারা প্রতিপাদাদিকল্পে দুর্গা পূজা করে তারা মহালয়ার পরদিন অর্থাৎ শুক্লা প্রতিপদ (প্রথম তিথি) থেকে পূজা শুরু করেন।
শারদীয় দুর্গা পূজায় দেবীর অকালবোধন
দেবী দুর্গা বছরে দু’বার আসেন, শরতে ও বসন্তে। দুই পূজার মধ্যে প্রভেদ শুধু একটি। আষাঢ়ের শুক্ল একাদশী থেকে কার্তিকের শুক্ল একাদশী পর্যন্ত দেবতাদের শয়নকাল। তাই আশ্বিনের পূজায় দেবীকে জাগিয়ে নিতে হয়। এই জাগানোর নামই ‘বোধন’। শয়নকালের চার মাসকে ‘অকাল’ বা অসময় বলা হয়, তাই এই বোধনকে বলে ‘অকালবোধন’। বাসন্তী পূজায় শয়নকাল উত্তীর্ণ বলে বোধনপর্ব অনুপস্থিত। অকালবোধন হওয়া সত্ত্বেও শাস্ত্রে এই শারদীয় পূজাকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে ‘মহাপূজা’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
দেবীকে আবাহনের প্রথাটিও অতিসুন্দর। পঞ্জিকা নির্দিষ্ট মুহূর্তে দেবীবিগ্রহের সামনে মেঝেতে আঁকতে হয় আটটি পাপড়িযুক্ত একটি পদ্মফুল, তার কেন্দ্রে গঙ্গামাটি দিয়ে ছড়িয়ে দিতে হয় পঞ্চশস্য। ঘটে সিঁদুর দিয়ে দেবপুত্তলিকা বা স্বস্তিকচিহ্ন এঁকে, জলভরে স্থাপন করতে হয় সেই পঞ্চশস্য-ছড়ানো মাটিতে। ঘটের উপর থাকে আম্রপল্লব বা পঞ্চপল্লব। প্রতিটি পল্লবের ডগায় থাকে সিঁদুরের টিপ। পঞ্চপল্লবের উপর এক সরা আতপচাল রেখে তার উপর রাখা হয় একটি সশীষ ডাব এবং তার উপর একটি নতুন গামছার আবরণ। মালা পরানো হয় ঘটের গলায়। দেবীকে আবাহন করে প্রতিটি বস্তু স্পর্শ করে চলে মন্ত্রোচ্চারণ, দুই-আতপ চাল এবং চন্দনে অলংকৃত হয় দেবীঘট। এর সঙ্গে থাকবে ঘট, ঘণ্টা, ঢাক, কাঁসরধ্বনি, ঊর্ধ্বমুখী হয় ধূপদীপের শিখা।
সৃষ্টির আদিলগ্নে বিশ্বচরাচরে যখন অকূল জলরাশি ছাড়া আর কিছুই নেই, তখন সেই জলেই অনন্তনাগের শয্যায় নিদ্রিত ছিলেন ভগবান শ্রীবিষ্ণু। তিনি দেবী মহামায়ার মায়াপ্রভাবে নিদ্রিত ছিলেন বলে, দেবীর আর এক নাম বিষ্ণুমায়া। এসময় বিষ্ণুর কর্ণমল থেকে জন্ম নেয় দুই ভয়ঙ্কর দানব, মধু ও কৈটভ। তারা জন্মেই দেবতাদের বিনাশ করতে উদ্যত হলো। বেগতিক দেখে মহামায়ার শরণাপন্ন হন সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা। তার স্তবস্তুতিতে প্রসন্ন হয়ে আপন মায়া সংবরণ করে বিষ্ণুকে জাগ্রত করেছিলেন দেবী। তারপর বিষ্ণু। এই দানবদ্বয়কে হত্যা করে সৃষ্টি রক্ষা করেন। ব্রহ্মার আবাহনই ছিল দেবীর প্রথম অকালবোধন। এরপর আরও দুইবার অকালবোধন হয়।
কুমারী পূজা
দুর্গা পূজার অন্যতম আয়োজন কুমারী পূজা। কুমারী পূজার দার্শনিক তত্ত্ব হলো নারীতে পরমার্থ দর্শন ও পরমার্থ অর্জন। বিশ্বব্রহ্মান্ডে যে ত্রিশক্তির বলে প্রতিনিয়ত সৃষ্টি, স্থিতি ও লয় ক্রিয়া সাধিত হচ্ছে; সেই ত্রিবিধ শক্তিই বীজাকারে কুমারীতে নিহিত। কুমারী প্রকৃতি বা নারী জাতির প্রতীক ও বীজাবস্থা। তাই কুমারী বা নারীতে দেবীভাব আরোপ করে তার সাধনা করা হয়। এ সাধন পদ্ধতিতে সাধকের নিকট বিশ্বজননী কুমারী নারীমূর্তির রূপ ধারণ করে; তাই তার নিকট নারী ভোগ্য নয়; পূজ্যা। পৌরাণিক কল্পকাহিনীতে বর্ণিত আছে, এ ভাবনায় ভাবিত হওয়ার মাধ্যমে রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব নিজের স্ত্রীকে ষোড়শীজ্ঞানে পূজা করেছিলেন।
কুমারী পূজা হলো তন্ত্রশাস্ত্রমতে অনধিক ষোলো বছরের কুমারী মেয়ের পূজা। বিশেষত দুর্গা পূজার অঙ্গরূপে এই পূজা অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়াও কালী পূজা, জগদ্ধাত্রীপূজা এবং অন্নপূর্ণা পূজায় কুমারী পূজার প্রচলন রয়েছে। সে কারণে সকালে ঢাক-ঢোল-বাদ্যসহকারে নানা আচারের মধ্যদিয়ে একজন শিশু কন্যাকে দেবী দুর্গার সামনে বসিয়ে কুমারী পূজা করা হয়।
বিশেষ করে নবরাত্রি উৎসবের অষ্টমী (অষ্টমী দিন) ও নবমীতে (নবম দিন) সম্পাদিত হয়। অনুষ্ঠানটিতে প্রধানত নয়টি মেয়ের পূজা জড়িত, যা দেবী দুর্গার (নবদুর্গা) নয়টি রূপকে প্রতিনিধিত্ব করে। শাস্ত্রমতে কুমারী পূজার উদ্ভব হয় বানাসুর বধ করার মধ্য দিয়ে। গল্পে বর্ণিত রয়েছে, বানাসুর এক সময় স্বর্গ-মর্ত্য অধিকার করায় বাকি বিপন্ন দেবগণ মহাকালীর শরণাপন্ন হন। সে সকল দেবগণের আবেদনে সাড়া দিয়ে দেবী পুনর্জন্মে কুমারীরূপে বানাসুরকে বধ করেন। এরপর থেকেই মর্ত্যে কুমারী পূজার প্রচলন শুরু হয়।
পুরোহিতদর্পণ প্রভৃতি ধর্মীয় গ্রন্থে কুমারী পূজার পদ্ধতি এবং মাহাত্ম্য বিশদভাবে বর্ণিত হয়েছে। বয়সের ক্রমানুসারে পূজাকালে এই সকল কুমারীকে বিভিন্ন নামে অভিহিত করা হয়। এক বছরের কন্যা সন্ধ্যা, দুই বছরের সরস্বতী, তিন বছরের ত্রিধামূর্তি, চার বছরের কালীকা, পাঁচ বছরের সুভগা, ছয় বছরের ঊমা, সাত বছরের মালিনী, আট বছরের কুব্জিকা, নয় বছরের কালসন্দর্ভা, ১০ বছরের অপরাজিতা, ১১ বছরের রূদ্রানী, ১২ বছরের ভৈরবী, ১৩ বছরের মহালক্ষ্মী, ১৪ বছরের পীঠনায়িকা, ১৫ বছরের ক্ষেত্রজ্ঞা এবং ১৬ বছরের কন্যা অন্নদা বা অম্বিকা নামে পূজিত হয়।
দেবীর বাহন রহস্য ও ফলাফল
পুরাকালে বৈদিক মুণীঋষিরা ভেবেছিলেন, দেশ ও রাষ্ট্রের যা কিছু শুভ বা অশুভ ঘটনা, তার সঙ্গে দুর্গ দেবীর আসা-যাওয়ার কোনো সম্পর্ক আছে কি না। দেবীর গমনাগমনের উপর সজাগ দৃষ্টি রেখে এবং কার্যকারণ সম্পর্কের যাবতীয় বিচার-বিশ্লেষণ করে তারা দায়ী করেছিলেন বার, তিথি ও নক্ষত্রকে। শাস্ত্রকার প-িতরা বুঝতে পেরেছিলেন যে, মানুষের কাজকর্ম ও পাপপুণ্যের ভার দেব-দেবীরা কিছুটা হলেও গ্রহ, নক্ষত্র, তিথি লগ্নের উপর দিয়ে রেখেছেন। তাই ঈশ্বর নির্দেশিত এই মহাজাগতিক শক্তির অস্তিত্ব এবং কার্যকারিতাকে কোনোভাবেই অস্বীকার করা চলে না। শাস্ত্রকারদের বিধান অনুযায়ী, দেবী দুর্গা শিবপুরী কৈলাস থেকে মর্ত্যে আগমন এবং পুনরায় কৈলাসে ফিরে যাওয়া চারটি বাহন বা উপায় বের করেন। চারটি বাহন হলো গজ (হাতি), ঘোটক (ঘোড়া), নৌকা ও দোলা (পালকি)।
দেবী দুর্গার আগমন বা গমন যদি রবিবার বা সোমবার পড়ে তাহলে তার বাহন গজ, মঙ্গল বা শনিবার হলে বাহন হয় ঘোটক, বৃহস্পতিবার বা শুক্রবারে হলে দোলা এবং বুধবার হলে তিনি নৌকায় যাতায়াত করেন। দেবী দুর্গার আগমন সপ্তমী তিথিতে এবং গমন দশমী তিথিতে। এই সপ্তমী ও দশমী কি বারে পড়ছে তার উপর নির্ভর করে দেবীর বাহন। দেবীর এই ভিন্ন বাহনের ভিন্ন ভিন্ন তাৎপর্য নির্ণয় করা হয়েছে।
গজ : গজ, ঘোটক, নৌকো ও দোলা এই চারটি বাহন ব্যবহৃত হলেও, গজকেই বিশেষভাবে প্রাধান্য দিয়ে শুভযাত্রার প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ঐতিহাসিক কাল থেকেই গজ রাজকীয় মর্যাদার অধিকারী। হাতির পিঠে যাতায়াত এবং হাতিকে প্রতিপালন করা অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত ও রাজকীয় মর্যাদার পরিচায়ক। তাই গজে আগমন বা গমন মানবসভ্যতা ও রাষ্ট্রের জন্য অতীব মঙ্গলজনক বলে মানা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘গজে চ জলদা দেবী শস্যপূর্ণা বসুন্ধরা’, অর্থাৎ গজপৃষ্ঠে গমনাগমনে ধরিত্রী শস্যশ্যামলা হয়ে মর্ত্যবাসীর জীবন সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে ভরিয়ে তুলবে।
ঘোটক: গজের পরেই রয়েছে ঘোটকের স্থান। তবে ঘোটককে কিন্তু গজের মতো সম্মান দেননি শাস্ত্রকারগণ। এক্ষেত্রে ঘোটক অনেকটাই অস্থিরতা এবং নিরাপত্তাহীনতার প্রতীক। গজেন্দ্রগমনে যে ধৈর্য ও স্থৈর্য আছে, হাতির পিঠে চড়লে যেভাবে আরোহীর সুরক্ষা নিশ্চিত হয়, তা ঘোটকের ক্ষেত্রে অনুপস্থিত। তাই ঘোটকের পিঠে দেবীর গমনাগমন মানুষের জীবনে চাঞ্চল্য এবং সুরক্ষার অভাব সুচিত করে। শাস্ত্রে বলা হয়েছে, ‘ফলম-ছত্রভঙ্গস্তুরঙ্গমে’, অর্থাৎ দুর্গার ঘোটকে যাতায়াতকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংসারিক ক্ষেত্রে অস্থিরতা তৈরি হয়। এর ফলে ব্যাপক রাজনৈতিক উত্থান-পতন, দুর্ঘটনা, অপমৃত্যু, বিশৃঙ্খলা, অরাজকতার প্রভাব বেড়ে ওঠে।
নৌকা: নৌকায় গমনাগমন বিষয়ে বলা হয়েছে, ‘শস্যবৃদ্ধিস্তথাজলম্’। কল্পনা করা হয়েছে যে, দৈবশক্তির জলপথে পরিভ্রমণের সময়ে জলে প্রবল আলোড়ন হয়, যার ফলাফল জলোচ্ছ্বাস বা প্লাবন। আবার জলই তো মানুষের জীবন, মানুষের সভ্যতাও নদীমাতৃক। তাই এর শুভ দিকটি হলো জলপ্লাবনে নদীর দুকূল ছাপিয়ে ওঠে এবং দুপাশের শস্যভূমি আর্দ্র, উর্বর, সরস ও আরও সবুজ হয়ে ওঠে। অর্থাৎ দুর্গার নৌকাবিহারে শস্যবৃদ্ধির সম্ভাবনা সুপ্ত রয়েছে।
দোলা: চারটি যানবাহনের মধ্যে সবচেয়ে অশুভ হিসেবে কল্পনা করা হয়েছে দোলা বা পালকিকে। এটাকে বলা হয়, ‘ফলম-মড়ক’। মনে করা হয়েছে, দেবীর পালকিবাহকদের পায়ের ছাপে পৃথিবী কেঁপে ওঠে, প্রকৃতি ও মানুষের সুখ-আনন্দ-সন্তোষের শুভ সম্ভাবনাগুলো হয় পদপিষ্ট। তার ওপর দোলার আচ্ছাদনের মধ্যে অন্তরালে থাকার জন্য দেবীর কৃপাদৃষ্টি থেকে বঞ্চিত হয় তার পথের দু’পাশের মানবসভ্যতা। তাই দোলায় গমনাগমনের ফল হলো খরা, মহামারি, ভূমিকম্প, রাষ্ট্রসংকট, মন্বন্তর, দুর্ভিক্ষ, গণমৃত্যু ও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, শুধু গজকে বাদ দিলে অন্য তিন ক্ষেত্রেই সংহার বা প্রলয়ের আশঙ্কা থেকে যায়। শুধু গজই শুভফল প্রদান করে, এই হলো শাস্ত্রবিধান। সৃষ্টি ও লয়কে কেন্দ্র করেই গ্রহ-নক্ষেত্রের যোগবিয়োগের অঙ্ক চলে আসছে চিরকাল ধরে, তা অনুসরণ করে আজও এই গণনা ও ফলাদেশ নির্ণয় করা হয়।
এবছর দেবী দোলায় আগমন করবেন। শাস্ত্রকারগণের মতে এটি সবচেয়ে অশুভকর। এতে দুর্যোগ, দুর্ভোগ, যুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আবার তিনি গমন করবেন ঘোটকে। এটিও কিছুটা অসম্মানীয়। ঘোটক অনেকটাই অস্থিরতা এবং নিরাপত্তাহীনতার প্রতীক। অর্থাৎ দেবীর মায়ের ঘোটকে যাতায়াতকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংসারিক ক্ষেত্রে অস্থিরতা তৈরি হয়। তবে এ থেকে পরিত্রাণ পেতে শাস্ত্রে বিহীত পূজার বিধান রয়েছে।
অপরদিকে দেবীর ভক্তকুল মনে করেন দেবী দুর্গা প্রবিছর ধরাধামে আসেন দেশ ও জাতির মঙ্গল কামনায়। তিনি আসেন শরতের শিশির ভেজা প্রভাতের সূর্যের মতো সমস্ত পাপ মুছে দিয়ে পৃথিবীর সকল জাতিগত বিভেদ, হিংসা, হানাহানিসহ সকল অশুভতা বিনাশ করে যান। তিনি যেমন অসুর মর্দিনী তেমনি জগতের অসুরতা দূর করে মানুষের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা করবেন। পৃথিবীর জন্য মঙ্গল প্রদীপ জ্বালিয়ে যাবেন। সম্পদে-সমৃদ্ধিতে সকলে ভরপুর থাকবে প্রতিবছর সেই আশীর্বাদই করে যান তিনি। তবে যেহেতু দুর্গা পূজা অসুর বধের পূজা। আমাদের মধ্যেও নানা প্রকার অসুরত্ব রয়েছে। সে জন্যে অনেক প-িত বলেছেন নিজের মধ্যে বিরাজিত অসুরত্বের যদি নিধন না করা হয় তবে ব্যর্থ হয়ে যাবে দুর্গা পূজার ব্যাপক বিস্তৃত আলোড়ন সৃষ্টিকারী বর্ণিল অনুষ্ঠানমালা।
সিঁদুর খেলা
সিঁদুর খেলা আক্ষরিক অর্থে ‘বারমিলন খেলা’। সিঁদুর (সিন্দুর) এক প্রকার রঞ্জক পদার্থ। এটি সাধারণত মেয়েদের সিঁথিতে একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত অবধি প্রসারিত টিকা বা কপালে টিপের আকারে ব্যবহৃত হয়। হিন্দুধর্মে সিঁদুর বিবাহিতা নারীর প্রতীক। অবিবাহিত মেয়েরা সিঁথিতে সিঁদুর পরেন না, আর বিধবাদের সিঁদুর ব্যবহার শাস্ত্রমতে নিষিদ্ধ। হিন্দুদের পূজানুষ্ঠানের সময়ও সিঁদুর ব্যবহৃত হয়। সিঁদুরের ইতিহাস অতি প্রাচীন বলে ধারণা করা হয়। এর রং লাল, কারণ এটি শক্তি ও ভালোবাসার প্রতীক। হিন্দু বিবাহের সময়ে একজন নারীর কপালে সিঁদুর দিয়ে চিহ্ন এঁকে স্ত্রীর মর্যাদা দেন স্বামী। পরবর্তীতে বাঙালি হিন্দু নারীরা স্বামীর দীর্ঘ জীবন ও মঙ্গল কামনায় পুরো বৈবাহিক জীবনে সিঁদুর পরে থাকেন।
সিঁদুর খেলা পূজা সংশ্লিষ্ট একটি বাঙালি হিন্দু সংস্কার। পূজার প্রতিমাকে সিঁদুর দিয়ে বরণ করে নেওয়ার পর এই খেলা শুরু হয়। পুরাণে আছে সাধারণ নারীদের ওপর পার্বতী সিঁদুর ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। এরপর কুলীন স্ত্রীরা পূজার জন্য এলে পার্বতী নিজ আঙ্গুল চিরে রক্ত দিয়ে এদের সিঁথিতে সিঁদুর পরিয়ে দিয়েছিলেন। কপালে সিঁদুর প্রয়োগেরও কিছু বিধি ও ফলনির্দেশ শাস্ত্র প্রদান করে। জানা যায়, তর্জনী দিয়ে সিঁদুর পরলে শান্তি পাওয়া যায়। মধ্যমা দিয়ে ধারণ করলে আয়ু বৃদ্ধি পায়।
দশমী আসতেই উমাকে তার শ্বশুরবাড়ি পাঠানোর তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়। রীতিনীতি মেনে মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি পাঠানো হয়। বিদায়ের আগে সিঁদুর খেলা হয়। কারণ, মা দুর্গাকে বাঙালিরা বিবাহিতা নারী হিসাবে মনে করে। অনেকের বিশ্বাস, যথাযথ রীতি মেনে সিঁদুর খেলা হলে অকালে কোনো মহিলা বিধবা হবেন না। বিজয়া দশমীর দিন দেবীর মুখে পানপাতা ছুঁইয়ে, সন্দেশ খাইয়ে এবং সিঁদুর পরিয়ে করা হয় বরণ। এর পরই বিবাহিতা বাঙালি নারীরা মেতে ওঠে সিঁদুর খেলায়। আগে শুধু বিবাহিতা নারীদেরই সিঁদুর খেলতে দেখা যেত। এখন অবশ্য অবিবাহিতারাও মেতে ওঠে সিঁদুর খেলায়।
এই ঐতিহ্যবাহী সিঁদুর খেলার উৎসের সঠিক তারিখ ও স্থান জানা যায়নি। এক তত্ত্ব অনুযায়ী, এর ঐতিহ্য প্রায় ২০০ বছর আগে জমিদারদের দুর্গা পূজায় গৃহবধূদের মধ্যে সুখী বা খুশি হওয়ার জন্য উদ্ভব করেছিল। দ্বিতীয় তত্ত্ব অনুযায়ী, সিঁদুর খেলার ঐতিহ্য দুর্গা পূজার রূপে প্রায় ৪০০ বছরের পুরনো। সিঁদুর খেলা তার স্বামী এবং শিশুদের সমস্ত অশুভ শক্তি থেকে রক্ষা করার জন্য নারীর ক্ষমতার প্রতীক। সিঁদুর খেলা রীতির মাধ্যমে, বাংলার হিন্দু নারীরা একে অপরের দীর্ঘ এবং সুখী বিবাহিত জীবন প্রার্থনা করে। প্রতিবেশীদের মধ্যে পারিবারিক দ্বন্দ্ব এবং ক্ষুদ্র শত্রুতা এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয়।
দুর্গা দেবীর বিসর্জন
নবমীর রাত পোহালেই ঢাকে বেজে উঠে বিজয়ার সুর। তীরকাঠির সুতো ছিঁড়ে ঘট নাড়িয়ে ছিন্ন করা হবে ভক্তের সঙ্গে দেবীর বন্ধন। হলুদমিশ্রিত জলে বা দর্পণে দেবীর মুখ দেখে হবে বিজয়া দশমী। অপরাজিতা লতায় তাঁকে আরাধনা করে চলবে অপরাজিতা পূজা। সবশেষে দেবীকে মিনতি করে বলা হবে, ‘সংবৎসরব্যতীতে তু পুনরাগমনায় চ’, তাকে মনে করিয়ে দেওয়া হয় আবার আসার কথা, তাই দেবীর যাওয়া সর্বদা পুনরাগমনের প্রতিশ্রুতিতে পূর্ণ। এরপর দশমীর বেলা পেরিয়ে যায়। শিবলোকের হিমেল হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে প্রাণের ছোঁয়া। যোগীবর শিব নিত্যকার মতোই ধ্যানমগ্ন; তবু মগ্নতার মধ্যেই তার মুখম-লে এক অদ্ভুত প্রসন্নতা। হঠাৎ ডানা ঝাঁপটানির শব্দ! ধ্যানমগ্ন মহেশ্বর চোখ মেলে দেখলেন, পাশে রাখা ব্রহ্মদ-ে এসেছে নীলকণ্ঠ পাখি। সে তার প্রভুকে বলে, মা তার ছেলেমেয়েদের নিয়ে যথাসময়ে রওনা হয়েছেন কৈলাসের পথে। স্মিতমুখে বার্তা গ্রহণ করেন মহেশ্বর। মর্ত্যে তখন অনাদৃশ্য, গঙ্গাভিমুখী সারি সারি প্রতিমা, রাজপথ শোভাযাত্রার আলোয় আলোয় ভরে উঠেছে। দেবীর মুখে লেগে থাকা সন্দেশ এবং মাথায়-কপালে লেপে থাকা সিঁদুরে সম্পন্ন হবে বিসর্জন।
শহিদ