ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১

কটিয়াদীর ঐতিহ্য

পাঁচশ’ বছরের ঢাকিঢুলির হাট, বিক্রি হন বাদ্যযন্ত্রীরা

মাজহার মান্না ও সৈয়দ মুরছালিন

প্রকাশিত: ২৩:৪৭, ৮ অক্টোবর ২০২৪

পাঁচশ’ বছরের ঢাকিঢুলির হাট, বিক্রি হন বাদ্যযন্ত্রীরা

কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীর ৫শ’ বছরের ঐতিহ্যবাহী ঢাকিঢুলির হাটে ব্যান্ডপার্টির বাদ্যযন্ত্রীরা বাজনা বাজিয়ে দর্শক-ভক্তদের আকৃষ্ট করে

কারও কাঁধে ঝুলছে ঢাক। কেউ হাতে বয়ে বেড়াচ্ছেন সানাই, নানা জাতের বাঁশি, করতাল ও মঞ্জুরিসহ নানা রকমের বাদ্যযন্ত্র। হঠাৎ করে দেখে মনে হতে পারে বাদ্যযন্ত্রের প্রদর্শনী দেখাতে এসেছেন সবাই। কিন্তু আসলে তা নয়। এদের সবাই এসেছেন শ্রম বেঁচতে। রীতিমতো হাট বসিয়ে চুক্তিবদ্ধ হন তারা। 
হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় শারদীয় দুর্গোৎসব উপলক্ষে প্রতিবছর জেলার কটিয়াদী উপজেলা সদরের পুরাতন বাজারে ৫শ’ বছরের ঐতিহ্যবাহী ঢাকিঢুলির হাট বসে। এ হাট চলবে টানা দু’দিন। শেষ হবে দুর্গাপূজার শুরুর দিন ৯ অক্টোবর। এখানে ছাড়া বাংলাদেশের কোথাও এ ধরনের বাদ্যযন্ত্রীর হাট নেই। 
আয়োজকরা জানায়, বাদ্যযন্ত্রীর এ হাটে কেনাবেচা হয় না। পূজাম-পে বাজনা বাজিয়ে আরতি দেওয়া, দুর্গা মাকে খুশি করা আর দর্শক ভক্তদের আকৃষ্ট করতেই যন্ত্রিক বা ব্যান্ড পার্টি চুক্তি ভিত্তিক ভাড়া দেওয়া-নেওয়া হয় এ হাটে। দুর্গোৎসবের শেষদিন প্রতিমা বিসর্জন পর্যন্ত বাদ্য বাজিয়ে যন্ত্রিকদের বিদায় দিতে হয়। আর এর জন্যই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের পূজা আয়োজকরা এ হাটে এসে দরকষাকষি শেষে চুক্তিতে বাদ্যযন্ত্রীদের নিয়ে যায়। এ জন্য পূজাম-পে বাদ্যের বায়না ধরতে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শত শত বাদকযন্ত্রী স্ব স্ব বাদ্যযন্ত্র নিয়ে এ হাটে এসে হাজির হয়। 
পূজার আয়োজকগণ দেশের প্রায় সর্বত্রই সুনাম ছড়িয়ে পড়া এই হাটে ছুটে আসেন ভালোমানের বাদক নিতে। এ বছর পূজার জাঁকজমক আয়োজন। ফলে ঢাকিঢুলির হাটেও বাদ্যযন্ত্রীদের সরব আনাগোনা। পূজাম-পগুলোও ইতোমধ্যে সুসজ্জিত হয়ে উঠেছে। লগ্ন শুরু হলেই ঢাক-ঢোলের তালে পূজারীদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠবে পূজাম-পগুলো। তাই দূর দূরান্ত থেকে ঢাক ঢোল, সানাই, বাঁশি নিয়ে বাদ্যযন্ত্রীদের আগমণ শুরু হয়ে গেছে। 
সংশ্লিষ্টরা জানায়, আশপাশের যন্ত্রিক ছাড়াও ময়মনসিংহ, ঢাকা, টাঙ্গাইল, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জ, কুমিল্লাসহ নানা প্রান্ত থেকে শত শত বাদ্যযন্ত্রীরা আসেন এ হাটে। ঢাকঢোল, সানাই, বিভিন্ন ধরনের বাঁশি, কাসর, করতালসহ হাজার হাজার বাদ্যযন্ত্রের পসরায় হাট উপচে পড়ে। যন্ত্রীরা দলে দলে দফায় দফায় বাজায় বাদ্যযন্ত্র। বাজনার তালে তালে নাচ আর রং-ঢঙয়ের অঙ্গভঙ্গিতে গ্রাহকদের আকৃষ্ট আর প্রদর্শন করে জানান দেয় কার হাতের সাফাই কত।

এ সময় পুরো বাজার এলাকার আকাশ বাতাস মুখরিত হয় বাজনার সুরে। সাধারণত একটি ঢাক ১৩-১৫ হাজার, ঢোল ১০-১২ হাজার, বাঁশি প্রকারভেদে ১০ হাজার থেকে ২০ হাজার,‘ব্যান্ডপার্টি’ ছোট ৩০ হাজার থেকে ৫০ হাজার এবং বড় ৬০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত ভাড়া দেওয়া হয়। বাদ্যযন্ত্রীরা পূজাম-পে বাজনা বাজিয়ে দর্শক ও ভক্তদের আকৃষ্ট করে থাকেন। দুর্গাপূজা শুরুর দিন থেকে প্রতিমা বিসর্জন পর্যন্ত টানা ৫ দিন তাদের বাজনা বাজাতে হয়।
নরসিংদী থেকে এসেছেন সানাই বাদক রঞ্জন দাস। তিনি জানান, কটিয়াদীর ঐতিহ্যবাহী ঢাকির হাটে আমরা আসি। এখান থেকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঢাক বাজাতে চলে যাই। গত বছর পাঁচ দিনের চুক্তিতে সিলেটের একটি পূজাম-পে গিয়েছিলাম। এ বছরও বিভিন্ন জায়গার লোকজনের সঙ্গে কথা চলছে। বিক্রমপুর থেকে আসা ঢাকি শানু কুমার জানান, আমার বাপ-দাদারা এই হাটে আসতেন। ২০ বছর ধরে আমিও এই ঢাকির হাটে আসি। প্রত্যেকবারই বায়না হয়ে যায়।
জনশ্রুতিতে আছে, ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে স্থানীয় সামন্ত রাজা নবরঙ্গ রায়ই সর্বপ্রথম তার রাজপ্রাসাদে দুর্গাপূজার আয়োজন করেন। উপজেলা সদর থেকে দুই কিলোমিটার উত্তরে চারিপাড়া গ্রামে ছিল রাজার প্রাসাদ। আজও রাজার আমলে খনন করা কোটামন দীঘিটির মনোরম দৃশ্য দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করে। পূজা উপলক্ষে রাজপ্রাসাদ থেকে সুদূর মুন্সীগঞ্জের বিক্রমপুরের পরগনায় বিভিন্ন স্থানে বার্তা পাঠানো হয়। ঢাকঢোল বাঁশিসহ বাদ্যযন্ত্রীদের আগমনের জন্য সে সময় নৌ-পথ ব্যবহার করা হতো। বাদ্যযন্ত্রীরা কটিয়াদী-মঠখোলো সড়কের পাশে পুরনো ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে যাত্রাঘাট নামক স্থানে পূজার দুইদিন আগে এসে পৌঁছত।
পরবর্তীতে পার্শ্ববর্তী মসুয়া গ্রামে বিশ্ব নন্দিত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের পূর্বপুরুষ হরি কিশোর রায় চৌধুরীর বাড়িতে মহা ধুমধামে পূজা শুরু হয়। সেই সঙ্গে চলে বিভিন্ন পূজার বাদ্যযন্ত্রের প্রতিযোগিতা। দিন দিন পূজার সংখ্যা বৃদ্ধি এবং বিভিন্ন জমিদারদের মধ্যে ঢাকির হাটের স্থান নির্ধারণ নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। পরে যাত্রাঘাট থেকে স্থান পরিবর্তিত হয়ে ৫ কিলোমিটার দূরবর্তী আড়িয়াল খাঁ নদের তীরবর্তী কটিয়াদী পুরনো বাজারে ঢাকির হাট গড়ে ওঠে। সেই থেকে প্রতি বছরই এখানে নিয়মিত ঢাকিঢুলির হাট বসে আসছে। 
এলাকাবাসী কটিয়াদী বাজারে এ ঢাকিঢুলির হাট বসায় তারা গর্বিত। তবে দিন দিন হাটে ক্রেতা-বিক্রেতা বাড়তে থাকায় বর্তমানে বাজারে জায়গা সংকুলান হচ্ছে না। তাই হাটের জন্য একটি ভালো স্থান নির্বাচন করার দাবি তাদের দীর্ঘদিনের। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রায় দুইশ’ ঢাকি ও আর বাঁশিওয়ালা আসেন এ হাটে। তাদের অস্থায়ী আবাসনের জন্য একটি অতিথিশালা নির্মাণ ৭ বছর আগে শুরু হলেও এখনো সম্পন্ন হয়নি। ফলে প্রতিবছরই পূজা মৌসুমে ভোগান্তি পোহাতে হয় ঢাকি ও বাঁশিওয়ালাদের। মুন্সীগঞ্জ থেকে ঢাকি বিনয় দাস ও গৌরাঙ্গ চন্দ্র দাসহ অনেকেই এসেছেন এ হাটে। তারা থাকছেন স্থানীয় বিভিন্ন মন্দির আর হোটেলে। এ জন্য তাদের বাড়তি টাকা খরচ করতে হচ্ছে। এতদিনেও তাদের অতিথিশালা নির্মাণ না হওয়ায় হতাশা ব্যক্ত করেন।  
ঢাকির হাট ব্যবস্থাপনা সমন্বয়ক বিপদ কুমার সাহা জানান, ইতোমধ্যে বেশকিছু ঢাকির দল চুক্তিবদ্ধ হয়ে হাট ছেড়েছে। এর মধ্যে ১০ হাজার থেকে এক লাখ টাকায় ঢাকিরা ম-পে গেছেন। তবে কিছু ঢাকির জন্য ম-প মিলবে না। তাদের খাওয়া-দাওয়া ও যাতায়াতের খরচ ব্যবস্থাপনা কমিটির পক্ষ থেকে দেওয়া হচ্ছে।
কটিয়াদীর ইউএনও মোহাম্মদ ওয়াহিদুজ্জামান গণমাধ্যমকে বলেন, পাঁচশ’ বছরের ঐতিহ্যবাহী ঢাকির হাট উপজেলার ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সকলেই এ হাটের গৌরব ধরে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা করে চলেছে। উপজেলা প্রশাসন আগত বাদ্যযন্ত্রীদের সার্বিক নিরাপত্তা দিয়ে থাকে। 
কটিয়াদী থানার অফিসার ইনচার্জ আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, ঢাকির হাটকে ঘিরে কটিয়াদী বাজার এলাকায় শত শত মানুষের সমাগম ঘটে। হাটের ব্যবস্থাপনায় রয়েছে স্থানীয় গণ্যমান্যদের সমন্বয়ে একটি কমিটি। এ ছাড়া ক্রেতা-বিক্রেতাদের নিরাপত্তায় প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয় স্থানীয় প্রশাসন।

×