ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১

নওগাঁ জেলার সীমান্তবর্তী সাতটি নতুন রুট দিয়ে আসছে ফেনসিডিল

মিয়ানমার থেকে মাসে আসছে ৩০ কোটি টাকার ইয়াবা

শংকর কুমার দে

প্রকাশিত: ২৩:১২, ৮ অক্টোবর ২০২৪; আপডেট: ০৯:৩৪, ৯ অক্টোবর ২০২৪

মিয়ানমার থেকে মাসে আসছে ৩০ কোটি টাকার ইয়াবা

মিয়ানমার থেকে মাসে আসছে ৩০ কোটি টাকার ইয়াবা

বাংলাদেশের ১৪ জেলার সীমান্তবর্তী বিভিন্ন অঞ্চলের ১৪৬টি পয়েন্ট এখন অরক্ষিত। মাদক কারবারের কারণে বছরে পাচার হয় ৫ হাজার কোটি টাকা। মিয়ানমার ও ভারত থেকে বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে মাদক পাচার ও চোরাচালান হচ্ছে বাংলাদেশে। প্রায় প্রতিদিনই কেবলমাত্র মিয়ানমারের ৪৫ ইয়াবা কারখানায়  তৈরি লাখ লাখ ইয়াবার চালান বাংলাদেশে আসছে।

বাংলাদেশে মিয়ানমার থেকে প্রতিমাসে গড়ে ৩০ কোটি টাকার ইয়াবার চালান আসছে। এই হিসাব অনুযায়ী প্রতিবছর আসছে সাড়ে ৩ শতাধিক কোটি টাকার ইয়াবা। ভারত থেকে হেরোইন, ফেনসিডিলসহ বিভিন্ন ধরনের প্রচলিত-অপ্রচলিত মাদক। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্রে এ খবর জানা গেছে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি) এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিয়ানমার ও ভারত থেকে বাংলাদেশে মাদক পাচার ও চোরাচালানের পয়েন্টগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে মিয়ানমার থেকে স্থল ও নৌপথে ৬৬টি পয়েন্ট দিয়ে আসছে ভয়ংকর মাদক আইস ও ইয়াবা। ভারত থেকে হেরোইন, ফেনসিডিলসহ বিভিন্ন ধরনের প্রচলিত-অপ্রচলিত মাদক। বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমার ও ভারতের এই পয়েন্টগুলো অরক্ষিত থাকায় সহজেই মাদক পাচার হয়ে রাজধানী ঢাকাসহ দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। 
মিয়ানমার ও ভারত থেকে বিভিন্ন রুটে মাদক আসায় ভয়াবহ ঝুঁকিতে রয়েছে দেশ। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমার থেকে ইয়াবা তৈরির মূল উপাদান আইস বা ক্রিস্টাল মেথ (মেথএমফিটামিন) আসার পরিমাণ ব্যাপক হারে বেড়ে যাওয়ায় নতুন উদ্বেগ  তৈরি হয়েছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গত ৬ অক্টোবর প্রসাধনীর দোকান ও লবণবাহী ট্রাক থেকে কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলায় বিজিবি ও মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পৃথক অভিযানে ৩৮ হাজার ৫০০টি ইয়াবা জব্দ করা হয়েছে।

টেকনাফ পৌরসভার বাসস্টপ এলাকা ও কক্সবাজার-টেকনাফ আঞ্চলিক সড়কে পৃথকভাবে এ অভিযান চালানো হয়। এ সময় গ্রেপ্তার তিনজনকে রবিবার আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। অন্যদিকে কক্সবাজার-টেকনাফ আঞ্চলিক সড়কের রামুর মরিচ্যা যৌথ তল্লাশি চৌকিতে লবণবাহী একটি ট্রাক থেকে ৩৬ হাজার ৫০০টি ইয়াবা বড়ি উদ্ধার করেছেন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদস্যরা। মাদকের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির যথাযথ বাস্তবায়ন কল্পে মাঠপর্যায়ে বিজিবির অভিযান কর্মকা- এবং গোয়েন্দা তৎপরতা চলছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক সিফাত উল্লাহ জানিয়েছেন, শনিবার রাত আটটার দিকে টেকনাফ পৌরসভার বাসস্টপ এলাকার হক সুপার মার্কেটের মৌসুমি কসমেটিকস নামে একটি দোকানে ক্রেতা সেজে ইয়াবা কিনতে যান তাঁরা। কসমেটিকসের আড়ালে ইয়াবা বেচাকেনা করতেন লোহাগাড়ার বাসিন্দা দোকানমালিক মোহাম্মদ জালাল উদ্দীন (৪৩)। সেখানে তাঁর কাছ থেকে দুই হাজার ইয়াবা বড়ি জব্দ করা হয়। গ্রেপ্তারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করে ইয়াবা ও মাদক পাচার ও চোরাচালানের চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে।
বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল  সৈয়দ ওয়াহিদুজ্জামান তানজিদ বলেছেন, টেকনাফ থেকে চট্টগ্রামগামী সন্দেহজনক একটি ট্রাককে থামানো হয়। পরে তল্লাশি করে ট্রাকের ড্যাশ বোর্ডের ভেতর থেকে ১ কোটি ৯ লাখ ৫০ হাজার টাকার ইয়াবা চালানটি জব্দ করা হয়। এ সময় ট্রাকচালক চট্টগ্রামের চাক্তাই ভাঙ্গাপুর এলাকার মোহাম্মদ আরিফ (৩২) ও সহকারী কক্সবাজারের চকরিয়ার ইলিশিয়া বাজারের মো. ইসমাইল হোসেনকে (৩০) গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের পর তাদের ইয়াবা ও মাদক পাচার সংক্রান্ত বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, বাংলাদেশ-মিয়ানমারের ২৭১ কিলোমিটার সীমান্তের মধ্যে ১৭২ কিলোমিটারই অরক্ষিত। ইয়াবার চালান নিয়ে আসছে রোহিঙ্গারাও। মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা আসার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মরণনেশা ইয়াবার চালান আসার ঘটনাও বেড়েছে। হেরোইন, বাংলা মদ, চরস, গাঁজাসহ নানা ধরনের মাদকের স্থান দখল করে নিয়েছে ইয়াবা। 
মাদকদ্রব্য অধিদপ্তর- ডিএনসির কর্মকর্তারা বলছেন, সবচেয়ে বেশি ৬৬টি পয়েন্ট চিহ্নিত করা হয়েছে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে। এই পয়েন্টগুলো কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলায় চিহ্নিত করা হয়েছে। এই দুই জেলার যেসব পয়েন্ট অরক্ষিত, সেগুলো খুবই দুর্গম। এই দুই জেলায় এমন অনেক পয়েন্ট রয়েছে, যেখানে সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও যাননি। এই পয়েন্ট দিয়ে আগে আসত ইয়াবা।

এখন ইয়াবার সঙ্গে আইসও আসছে। নাফ নদী ও সাগরপথে মাছ ধরার ট্রলারে করেও বিভিন্ন রুটে আইস ও ইয়াবা আসছে। অপরদিকে ভারত থেকে যশোর, চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুরের ১৩টি পয়েন্ট দিয়ে দেশে ঢুকছে ফেনসিডিল। উত্তরাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলের ৮ জেলার ২৯টি পয়েন্ট দিয়ে ফেনসিডিল ও গাঁজা আসছে। এর মধ্যে পূর্বাঞ্চলের কুমিল্লার ৯টি পয়েন্ট এবং  ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ৬টি পয়েন্ট চিহ্নিত করা হয়েছে। এখন আইস আনতে বিপুল টাকা খরচ করছেন ইয়াবার কারবারিরা। কারণ, ইয়াবার চেয়ে এই মাদক বিক্রি করলে লাভ বেশি। তবে ইয়াবা আসাও বন্ধ হয়নি। 
ডিএনসি সূত্রে জানা গেছে, দেশের পশ্চিমাঞ্চলের নওগাঁ জেলার সীমান্তবর্তী সাতটি নতুন রুট দিয়ে ফেনসিডিল আসছে। সাতক্ষীরার সাতটি পয়েন্ট দিয়ে আসছে ফেনসিডিল ও ইয়াবা। রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, জয়পুরহাট ও দিনাজপুরের ২৪টি পয়েন্ট দিয়ে ফেনসিডিলের পাশাপাশি হেরোইন আসছে। এ ছাড়া যশোর, চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুরের ১৩টি পয়েন্ট দিয়ে দেশে ঢুকছে ফেনসিডিল। উত্তরাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলের ৮ জেলার ২৯টি পয়েন্ট দিয়ে ফেনসিডিল ও গাঁজা আসছে। এর মধ্যে পূর্বাঞ্চলের কুমিল্লার ৯টি পয়েন্ট এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ৬টি পয়েন্ট চিহ্নিত করা হয়েছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দেশের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোর যেসব পয়েন্ট দিয়ে বেশি মাদক আসছে, এগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। স্থলপথে সীমান্ত রক্ষার দায়িত্ব বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি)। আর উপকূলীয় অঞ্চলে কোস্টগার্ড দায়িত্ব পালন করে। এসব তথ্য সংশ্লিষ্ট বাহিনীকে জানানো হয়েছে। সীমান্তে মাদকসংক্রান্ত কোনো তথ্য পেলে সংশ্লিষ্ট বাহিনীকে জানানো হয়। কখনো কখনো একসঙ্গে অভিযানও চালানো হয়।
মাদক ও অপরাধ প্র িেতরোধে কাজ করা জাতিসংঘের সংস্থা ইউএনওডিসির সর্বশেষ প্রতিবেদনে (২০২৩) বাংলাদেশ অধ্যায়ে বলা হয়েছে, মাদক ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে দেশ থেকে প্র িেতবছর গড়ে আনুমানিক ৫ হাজার ১৪৭ কোটি টাকা পাচার হচ্ছে। চার ধরনের মাদক ক্রয় করে মাদক কারবারিদের মাধ্যমে এই অর্থ পাচার হচ্ছে। ইউএনওডিসির  প্রতিবেদনের  তথ্য অনুযায়ী, মাদক কারবারিরা সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার করে ফেনসিডিল ক্রয়ে।

ফেনসিডিল ক্রয়ে দেশ থেকে পাচার হয় ২১৫ দশমিক ৪ মিলিয়ন ডলার বা ২ হাজার ৩০৫ কোটি টাকা। এরপরই মিয়ানমার থেকে ইয়াবা ক্রয়ের মাধ্যমে পাচার করা হয় ১৪০ দশমিক ৩ মিলিয়ন ডলার বা ১ হাজার ১০৫ কোটি টাকা। এ ছাড়া হেরোইন ক্রয় করে ৬৬২ কোটি এবং ইনজেকটিং মাদক ক্রয়ে ৬৭৫ কোটি টাকা পাচার হচ্ছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের ভাষ্য, দেশ থেকে মাদক কারবারিদের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হলেও জড়িতদের আইনের আওতায় আনা যাচ্ছে না। কারণ, দেশের বাইরে অর্থ পাচারসংক্রান্ত বিষয়ে তদন্ত কর্মকর্তাদের কোনো প্রশিক্ষণ নেই। এমনকি অর্থ পাচারসংক্রান্ত মামলার তদন্তে কোনো দিকনির্দেশনা নেই। ফলে দেশের বাইরে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হলেও সুনির্দিষ্টভাবে জড়িতদের চিহ্নিত করা যাচ্ছে না।

×