পাকতে শুরু করেছে পাহাড়ি ধান।
খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবন এই তিন পার্বত্য জেলার পাহাড়ে এবার জুম ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। ক’দিন পর পর থেমে থেমে বৃষ্টি আর অনুকুল আবহাওয়ার কারণে এবার জুমের আবাদ ও ফলন ভালো হয়েছে। জুমে এখন চলছে ধান কাটার উৎসব। ধান ছাড়াও বাহারি সবজির চাষ হযেছে জুমে। পার্বত্য অঞ্চলের পাহাড়ে পাকা সোনালী ধান জুমিয়াদের এনে দিয়েছে পারিবারিক স্বাচ্ছন্দ্য। ঘরে ঘরে এখন খুশির বন্যা বইছে।
কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবান এই তিন পার্বত্য জেলায় চলতি মৌসুমে প্রায় ১৯ হাজার ৮৬২ হেক্টর জমিতে ৪০ হাজার জুমিয়া পরিবার জুম চাষ করছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি জুমের আবাদ হয়েছে বান্দরবান পার্বত্য জেলায়। বান্দরবানে ২৮ হাজার পরিবার প্রায় ১২ হাজার হেক্টর জমিতে জুমের আবাদ করেছে। রাঙামাটিতে ৫ হাজার পরিবার সাড়ে ৫ হাজার হেক্টর জমিতে এবং খাগড়াছড়িতে ৬ হাজার ৬৮২ পরিবার ১১ হাজার ১২৪ হেক্টর জমিতে আবাদ করেছে।
পার্বত্য অঞ্চলে লাঙ্গলে চাষাবাদ জমির পরিমান খুবই কম। ফলে উপজাতিরা জীবন ধারণের একমাত্র উপায় পাহাড়ে আদিযুগের প্রথানুযায়ী জুম চাষের ফসল উৎপাদন করে থাকে। সাধারণত পৌষ-মাঘ মাসে মালিকানাধীন কিংবা পরিত্যক্ত ঘন বন-জঙ্গল, পাহাড় নির্বাচন করে জঙ্গল কাটা শুরু হয় এবং ফাল্গুন-চৈত্র মাস পর্যন্ত প্রখর রোদে শুকিয়ে আগুনে পুড়ে ছাই করা হয়। নেড়া পাহাড়ে বৈশাখের প্রথম বৃষ্টিতে প্রথম বীজ ধান বপন ও পরবর্তীতে বিভিন্ন তরিতরকারি বীজ বপনসহ নানা প্রকার ঔষধি ও সবজি রোপন করা হয়।
বর্তমানে জুম চাষের উৎপাদিত ফসলের মধ্যে রয়েছে- মারপা (শশা জাতীয়), বরবটি, শীম, বেগুন, চিকন মরিচ, ধনিয়া, কুমড়া, ধেরস, বাতিমা, কচু, আদামরিচ ও তিল ভুট্টাসহ ৪০ প্রকারের নানা প্রকার বর্ষা কালীন সবজি। এ সমস্ত সবজি পার্বত্য অঞ্চলের প্রতিটি হাটবাজারে প্রচুর পরিমানে এখন পাওয়া যাচ্ছে। প্রতিটি হাটের দিনে বিভিন্ন জেলার কাঁচামালের ব্যবসায়ীরা পাইকারী হারে তা ক্রয় করে ট্রাক ভর্তি করে চালান করছে সমতলের বিভিন্ন অঞ্চলে। জুম তরকারির মধ্যে জুম মিষ্টি কুমড়া ও সাদা কুমড়া সুস্বাধু বলে সব এলাকায় প্রিয়। জুম উৎপাদিত তরি তরকারিগুলো তুলনা মূলকভাবে অন্যান্য তরকারির চেয়ে কম মূল্য এবং ক্রেতার সংখ্যা বেশি বলে জানা গেছে। এবার এই দেশের অন্যান্য জেলায় তরিতরকারির দাম বেশি হওয়ায় জুম চাষিরা তাদের উৎপাদিত ফসল পাইকারী ব্যবসায়ীদের কাছে বেশ ভালো দামে বিক্রি করতে পারছে। অন্যান্য বছর যেখানে জুম চাষীরা প্রতি কেজি মারফা (শশা জাতীয়) ফল ২০ টাকা ২৫ টাকা দামে বিক্রি করতেন। বর্তমানে স্থানীয় বাজারে তা বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকা দামে। তরিতরকারী ন্যায্য মূল্য পেয়ে চাষীরা আনন্দিত।জুম চাষি খগেন্দ্র ও হরি ত্রিপুরা জানান, এবার প্রথম থেকে আবহাওয়া ছিল অনুকুলে। চৈত্র বৈশাখ মাসে জুমের গুল্ম লতা পুড়ে ফেলার জন্য ছিল প্রখর রোদ। জৈষ্ঠ-আষাঢ় মাসে ধানসহ বিভিন্ন ফলের চারা গজিয়ে উঠার জন্য পর্যাপ্ত বৃষ্টি ছিল। ব্যাপক হারে ভূমি ধ্বংসের আশঙ্কা থাকলেও ভূমি ধ্বস কম হওয়ায় কৃষকরা মারাত্মক ক্ষতি থেকে বেঁচে গেছে। ফলে এবার জুমে বাম্পার ফলন হয়েছে। খাগড়াছড়ি শহরের আলুটিলা, দীঘিনালা সড়কের বিভিন্ন স্থানে জুমে উৎপাদিত পাকা ধান কাটা শুরু হয়েছে।
জুম চাষ পরিবেশ ও প্রতিবেশের জন্য ক্ষতিকর হলেও পাহাড়ীদের ঐতিহ্যবাহী চাষাবাদ পদ্ধতি বলে চাষিদের আবাদ থেকে ফিরিয়ে রাখা যাচ্ছে না। বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে জুমিয়াদের পূর্নবাসন করার পরও জুম চাষ বন্ধ করা যায়নি। এ পরিস্থিতিতে জুমে নতুন জাতের ধান বপন ও পরীক্ষার জন্য বাংলাদেশ ধান গবেষনা ইনষ্টিউট আউষ মৌসুমের বিরি- ২৪, বিরি- ২৬, বিরি- ২৭ সহ গবেষণায় পরীক্ষাধীন দুটি জাতের ধান জুমে পরীক্ষামূলকভাবে খাগড়াছড়িতে আবাদ করেছে।
কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক বাছিরুল আলম জানান, প্রদর্শনী প্লটেও জুমের আবাদ ভাল হয়েছে। চারটি জাতের মধ্যে বিরি- ২৪ ও বিরি- ২৭ এর ফলন সবচেয়ে বেশি হয়েছে।
জুম চাষের উপর নেতিবাচক ধারণা থাকলেও পার্বত্য অঞ্চলের বড় ছোট প্রায় ১৪ টি বিভিন্ন ভাষাভাষীর পাহাড়ি জনগোষ্ঠি সাধারণত এ জুম চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে যুগ যুগ ধরে। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় নেতা ও আঞ্চলিক পরিষদ সদস্য গৌতম কুমার চাক্মার ১৯৮৮ সালে লেখা এক নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়, পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রায় ১ লাখ পরিবার জুম চাষ করে।
অপরদিকে ২০০১ সালে বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা ব্রাকের পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রামের ৫টি প্রধান জনগোষ্ঠির মধ্যে মুরং ৮৪.০৪ ত্রিপুরা ৫৪.০৮, মারমা ৪২.৩, চাক্মা ২২.০৭, এবং ১.০৬ ভাগ বাঙালি জুম চাষ করেন। চাক্মা ভাষা ঝুম, ত্রিপুরা ভাষায় ছুগ এবং মারমা ভাষায় ইয়া নামে পাহাড়ে জুম চাষ হয়ে থাকে।
এম হাসান