ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১

দুর্ঘটনা তদন্তে আরও এক কমিটি

সব জ্বালানি স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদার

স্টাফ রিপোর্টার, চট্টগ্রাম অফিস

প্রকাশিত: ২৩:৪৪, ৬ অক্টোবর ২০২৪

সব জ্বালানি স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদার

জ্বালানি স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদার

রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) দুটি তেলবাহী জাহাজে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে মাত্র চারদিনের ব্যবধানে। একই প্রতিষ্ঠানের একই ধরনের দুই জাহাজে পর পর ঘটনা নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এটি দুর্ঘটনা না নাশকতা, এমন সন্দেহ অনেকের মনে। তবে নৌপরিবহন এবং পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম শাখাওয়াত হোসেন এখনই চূড়ান্ত কোনো কথা বলতে রাজি নন। তিনি বলেছেন, আনুমানিক কোনো কথা বলতে চাই না। আপনারা অনুসন্ধান পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। 
রবিবার তিনদিনের সফরে চট্টগ্রামে আসেন নৌপরিবহন উপদেষ্টা এম শাখাওয়াত হোসেন। তিনি বিএসসির কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। দুপুরে বিএসসি কার্যালয়ে ব্রিফিংকালে বলেন, পর পর দুটি ঘটনার পর সন্দেহ যাতে দূর হয় বা প্রকৃত ঘটনা বেরিয়ে আসে তার জন্য এডিশিনাল সেক্রেটারিকে প্রধান করে পৃথক একটি কমিটি গঠন করা হবে। ৯-১০ সদস্যের বেশ বড় তদন্ত কমিটি, যাতে বিশেষজ্ঞরা থাকবেন। তাঁরা এখানে আসবেন, তদন্ত শুরু হবে, জাহাজগুলো দেখবেন সন্দেহজনক কিছু আছে কি না। এর পর সবকিছু পরিষ্কার হবে বলে জানান তিনি। 
 নৌপরিবহন উপদেষ্টা বলেন, বাংলার সৌরভ জাহাজে গত শুক্রবার সাড়ে ১২টার সময় ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে এমডি জানিয়েছেন। প্রতিটি মুহূর্তে কী হচ্ছে জানতে পারছিলাম। বিএসসি থেকে তদন্ত করতে বলেছি। জাহাজের ইন্সুরেন্সের ব্যাপার আছে। শুক্রবারের দুর্ঘটনায় একজন মারা গেছেন। তিনি আগুনে পুড়ে মারা যাননি। 
বিএসসির দুটি জাহাজে পরপর অগ্নিদুর্ঘটনার পর তেল পরিবহনের ব্যবস্থা প্রসঙ্গে উপদেষ্টা  জানান, বাংলার সৌরভ জাহাজে অগ্নিকা-ের পর লাইটারিংয়ের জন্য বিএসসি তাৎক্ষণিক দুটি জাহাজ ভাড়া করেছে। তবে একটি কথা বলে রাখি, ঘটনার ঘটার আগেই বিএসসির এমডি বলেছিলেন, বাংলার সৌরভের এটি শেষ ট্রিপ বা সেবা। কিন্তু দুভাগ্যজনকভাবে ঘটনা ঘটে গেছে।

আমার ভয় ছিল যদি এই তেল ব্লাস্ট হতো তা হলে বন্দর চ্যানেল বন্ধ হয়ে যেত। নেভি, কোস্ট গার্ড ও পোর্ট অথরিটি দ্রুত সময়ে গিয়ে আগুন নিভিয়েছে। নেভাল চিফ ভোর ৫টায় ফোন করে জানিয়েছেন, সম্পূর্ণ সহযোগিতা দিয়েছেন। নেভাল কমা-ার ও বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানের সঙ্গে সারাক্ষণ কথা হয়েছে। সাড়ে ৪টার দিকে আমাকে বলেছেন, সকলকে রেসকিউ করা হয়েছে। একজনকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। এত বড় একটি দুর্ঘটনা, যার জন্য আরও অনেককিছু হতে পারত।   
নৌপরিবহন উপদেষ্টা বলেন, বিএসসির জন্য নানা পরিকল্পনার বিষয়ও তুলে ধরেন। তিনি জানান, বিএসসির ৫টি জাহাজে প্রচুর লাভ হচ্ছে। এ জাহাজগুলোর একটিও বাংলাদেশে নেই। জামাইকাসহ বিভিন্ন দেশে কাজ করছে। বিএসসিতে জাহাজের বহর আরও বড় করা হবে। আমার ইচ্ছে, বিদেশী যারা আসবে তাদের বলব জাহাজ শিল্পে বিনিয়োগ করো। কিছুদিন আগে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের বলেছে পাট ও জাহাজ শিল্পে বিনিয়োগ করতে।

চীন থেকে চারটি নতুন জাহাজ সংগ্রহের বিষয়ে উপদেষ্টা জানান, দাম নির্ধারণের জন্য একটি টিম কাজ করছে। আমরা দাম কমানোর চেষ্টা করছি। কিন্তু জাহাজ সংগ্রহের প্রক্রিয়া যখন শুরু হয়েছিল তখন ডলারের দাম ছিল ৯০ টাকা। প্রকল্প বন্ধ না করার বিষয়ে মত দিয়ে তিনি বলেন, বন্ধ থাকলে তো আমরা জাহাজ পাব না। এখন বন্ধ করে দিয়ে যে টাকা অপচয় হয়েছে তা আপনার, আমার। গলায় কাটা লেগেছে, গিলতে হবে। তিনি জাহাজে সেফটির বিষয়টি ভালোভাবে দেখার আহবান জানান কর্মকর্তা ও দায়িত্বশীল থেকে।  একইসঙ্গে বিপিসির ক্যাপাসিটি আরো বাড়ানোর নির্দেশনা প্রদান করেন। 
উল্লেখ্য, বিপিসির দুটি অয়েল ট্যাঙ্কারে চারদিনের ব্যবধানে বিস্ফোরণ ও অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটেছে। প্রথম দুর্ঘটনাটি ঘটে ৩০ সেপ্টেম্বর। এদিন সকাল সাড়ে ১০টার দিকে তেলবোঝাই জাহাজ বাংলার জ্যোতির সামনের অংশে বিস্ফোরণের পর আগুন ধরে যায়। বাংলাদেশ নৌবাহিনী, কোস্ট গার্ড, ফায়ার সার্ভিস ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের বিশেষায়িত ইউনিট ও জাহাজ দ্রুততার সঙ্গে আগুন নেভাতে সক্ষম  হয়। এ দুর্ঘটনায় তিনজনের মৃত্যু হয়।

যারা মারা যান তারা হলেন জাহাজটির ডেক ক্যাডেট  সৌরভ, ফোরম্যান নুরুল ইসলাম ও ক্যাজুয়েল স্টাফ মো. হারুন। দ্বিতীয় দুর্ঘটনাটি ঘটে গত শুক্রবার রাত ১২টার দিকে। এদিনও দ্রুততার সঙ্গে আগুন নেভানো হয়। তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে মৃত্যুবরণ করেন স্টুয়ার্ড সাদেক মিয়া। তবে তিনি আগুনে পুড়ে মারা যাননি। উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়ার পথে মৃত্যুবরণ করেন। 
বিএসসির অগ্নিদুর্ঘটনা কবলিত দুটি জাহাজেই ছিল প্রায় ১২ হাজার মেট্রিক টন করে অপরিশোধিত জ¦ালানি তেল। আগুন লাগা পর পর দুই জাহাজই বিএসসির মালিকানার এবং দুই জাহাজই ছিল তেলবোঝাই। এতে করে অনেকের মনে সন্দেহের উদ্রেক হয়েছে। তবে সুষ্ঠু তদন্তে বেরিয়ে আসবে প্রকৃত ঘটনা। 
সকল জ¦ালানি স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদার ॥ সারাদেশে জ¦ালানি তেল সংশ্লিষ্ট সকল স্থাপনাগুলোর নিরাপত্তা  জোরদার করা হয়েছে। চট্টগ্রামে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের দুটি জাহাজে বিস্ফোরণ পরবর্তী অগ্নিকা-ের ঘটনার পর পরই পুরো দেশে জ¦ালানি খাত সংশ্লিষ্ট প্রত্যেক স্থাপনার নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। জ¦ালানি আমদানি, মজুত, সংরক্ষণের মতো বড় স্থাপনাগুলোর আধিক্য চট্টগ্রামে । এর পরে আছে নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা ও যশোর। এসব স্থাপনায় সিসি ক্যামেরা বৃদ্ধি, কয়েক স্তরের নিরাপত্তা বলয় এবং  সার্বক্ষণিক কড়া নজরদারির ব্যবস্থা হয়েছে। 
শনিবার উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক শেষে নির্দেশনার পর পরই দেশের সকল জ¦ালানিসংশ্লিষ্ট স্থাপনায় বাড়তি নিরাপত্তা প্রহরা এবং ব্যবস্থা নেওয়া হয়। চট্টগ্রামের বড় বড়  তেল পরিশোধন ও সংরক্ষণাগারগুলোতে ইতোমধ্যে বাড়তি নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এসব স্থাপনায় সেনাবাহিনী ও পুলিশের পাশাপাশি  গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত সকল সংস্থার সমন্বয়ে দেশের গুরুত্বপূর্ণ ইস্টার্ন রিফাইনারি, পদ্মা অয়েল কোম্পানি, মেঘনা পেট্রোলিয়াম, যমুনা অয়েল কোম্পানি, নারায়ণগঞ্জের ডিপো, যশোর ডিপোসহ বিভিন্ন অঞ্চলে থাকা  তেল সংরক্ষণাগারগুলোকে এখন নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে রাখা হয়েছে।
প্রসঙ্গত ৩০ সেপ্টেম্বর বিস্ফোরণ এবং অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে এমটি বাংলার জ্যোতিতে। এ ঘটনার চারদিনের মাথায় বিএসসির মালিকানাধীন বাংলার সৌরভেও বিস্ফোরণ এবং অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে। দুটি ঘটনায় নিহত হন ৪ জন। শত কোটি টাকার ত্রুড অয়েল রক্ষা হলেও পুরোপুরি বন্ধ হয়ে পড়ে জ¦ালানি তেল লাইটারিং। 
জানা গেছে, সরকারের তরফ থেকে এ ধরনের ঘটনাকে বেশ গুরুত্বসহকারে পর্যবেক্ষণের জন্য দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের নিয়োজিত করা হয়েছে। তারা এ ধরনের ঘটনায় নাশকতার সন্দেহ করছেন। তবে সরকারের নীতিনির্ধারকরা এখন তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের অপেক্ষায় রয়েছেন। জ¦ালানি নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে সারাদেশের সংশ্লিষ্ট স্থাপনাগুলোকে কড়া নজরদারির আওতায় আনা হয়েছে দ্রুত। 
জ¦ালানি খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বর্তমান পরিস্থিতিতে এ খাত কোনোভাবে অস্থিতিশীল হলে পুরো অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। একইসঙ্গে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হবে বৈদেশিক বাণিজ্য এবং অভ্যন্তরীণ যোগাযোগে। কেননা বাংলাদেশ আমদানি করা জ¦ালানির ওপরই নির্ভরশীল। এজন্য আমদানি করা জ¦ালানি সংরক্ষণ ও পরিশোধনে এখন নিরাপত্তা রক্ষা বড় চ্যালেঞ্জ। এ উদ্ভূত সময়ে এ খাতকে সুরক্ষা দিতে সরকারের প্রত্যেক সংস্থা তাই একযোগে নেমেছে।
উল্লেখ্য, আমদানি করা জ্বালানি দিয়েই মোটরযান, বিমান, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও  সেচসহ বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালিত হয়। ফলে কোনো মহল  দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা বিঘিœত করছে কিনা এ বিষয়ে খতিয়ে দেখছে সরকার। এজন্য প্রতিটি স্থাপনাকে ক্লোজড মনিটরিংয়ের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে।

×