ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ০৭ অক্টোবর ২০২৪, ২১ আশ্বিন ১৪৩১

গিরগিটি

ক্ষণে ক্ষণে রং বদলায় নানান রূপে প্রকাশ

শেখ আব্দুল আওয়াল, গফরগাঁও 

প্রকাশিত: ২৩:৩০, ৬ অক্টোবর ২০২৪

ক্ষণে ক্ষণে রং বদলায় নানান রূপে প্রকাশ

গফরগাঁওয়ে বিভিন্ন প্রজাতির গিরগিটি

রং বদলানোর ভালো-মন্দ দুটি দিকই আছে, কেউ বদলায় অস্তিত্বের প্রয়োজনে আবার কেউ স্বার্থের কারণে। এ বিষয়টি নিয়ে চমৎকারভাবে ডা. প্রদীপ কুমার রায় তার রং বদলায় কবিতায় লিখেছেন। গিরগিটি রং বদলায় বিপদ সংকেতে, এটাই জাগতিক নিয়ম জীব জগতে। তিনি কবিতার শেষ অংশে লিখেছেন। প্রতিবাদ অর্থহীন প্রতিবাদী মরে, দুঃখে ভরে বুক পৃথিবীর নানা অবিচারে।
পৃথিবীর অনেক প্রাণীই শত্রুর হাত থেকে নিজেকে বাঁচাত নিজের রং বদলিয়ে পরিবেশের সঙ্গে মিশে যায় কিংবা নিজেকে লুকাতে নতুন বেশ ধারণ করে। জীববিজ্ঞানের ভাষায় একে ক্যামোফ্লেজ (ঈধসড়ঁভষধমব) বা ছদ্মবেশ বলে। ছদ্মবেশধারীদের সঙ্গে গিরগিটির নামটি জুড়ে দিয়েছে। রং বদলানো আর গিরগিটি যেন প্রতিশব্দ আমাদের কাছে।
গিরগিটি বাংলাদেশের অনেক এলাকায় ‘রক্তচোষা’ নামে পরিচিত এক অতি নিরীহ সরীসৃপ। এরা ইচ্ছে মতো ত্বকের রং পরিবর্তন করতে পারে।

এই বৈশিষ্ট্যের কারণে এদের নিয়ে মানুষের মধ্যে অনেক ভুল ধারণাও আছে। এ কারণে এদের দেখলেই মানুষ মেরে ফেলতে উদ্যত হয়। অথচ এই রং পরিবর্তনের পেছনে রয়েছে আত্মরক্ষার কৌশল। অত্যন্ত ভীতু ও লাজুক প্রকৃতির এই প্রাণী নিজেকে পরিবেশের সঙ্গে মিশিয়ে রাখতে পছন্দ করে। কিন্তু এই রং পরিবর্তন এরা কীভাবে করে? বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বাস করতেন, গিরগিটি অক্টোপাসের মতো রং পরিবর্তন করে। তবে সম্প্রতি জীববিজ্ঞানী ও পদার্থবিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন, এটি সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি প্রক্রিয়া।

অনেকেই মনে করেন, প্রকৃতির সঙ্গে মিশে যাওয়ার জন্য গিরগিটি রং পরিবর্তন করে। প্রকৃতপক্ষে বিষয়টি সম্পূর্ণ উল্টো! এরা বরং নিজেদের আলাদা করতেই রং পরিবর্তন করে। আর স্বাভাবিক ও স্বস্তিদায়ক অবস্থায় এরা বরং প্রাকৃতিকভাবেই পরিবেশে সঙ্গে মিশে যায়। এদের সাধারণ সবুজ রং প্রকৃতির সবুজ পাতার সঙ্গে মিশে যায়। 
গফরগাঁও উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ও কৃষিবিদ রকিব আল রানা জনকণ্ঠকে জানান, ভুল নামের জন্যই মরছে উপকারী ‘গিরগিটি’ অথচ এই প্রাণীটিই আমাদের প্রকৃতির পরম বন্ধু। ক্ষতিকর পোকামাকড় খেয়ে আমাদের শাক-সবজি খেতে বা আমাদের গাছগাছালিপূর্ণ বাগানে সুরক্ষা দেয়। এই উপকারী গিরগিটির ইংরেজি নাম ঈড়সসড়হ এধৎফবহ খরুধৎফ এবং বৈজ্ঞানিক নাম ঈধষড়ঃবং াবৎংরপড়ষড়ৎ। এর লেজসহ দৈর্ঘ্য প্রায় ৩০ থেকে ৩৭ সেন্টিমিটার।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এবং বন্যপ্রাণী গবেষক ড. কামরুল হাসান বাংলানিউজকে বলেন, স্থানীয়ভাবে অনেকে এটাকে ‘রক্তচোষা’ বলে। আমরাও ছেলেবেলায় একে জেনে এসেছি এটা রক্তচোষা এবং এর আশপাশ দিয়ে কেউ গেলে তার রক্ত চুষে নিয়ে লাল হয়ে যায়-এ কুসংস্কারের কারণেই লোকজন এটাকে দেখলেই মেরে ফেলে।
প্রজনন মৌসুম সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘প্রজনন মৌসুমে এক পুরুষ গিরগিটির সঙ্গে অন্য পুরুষ গিরগিটির প্রতিযোগিতা হয়। পুরুষ গিরগিটিরা এভাবে শরীরের ভেতর থাকা মেলামিনগুলোকে লাল রঙে পরিবর্তন করে তার স্ত্রী গিরগিটির কাছে নিজেকে আকর্ষণীয় করে তোলে। তার সঙ্গিণীকে  ভোলানোর জন্যই প্রজনন ঋতুতে সে তার শরীর লাল করে ফেলে।
এ প্রাণীটিকে দেখে ভয়ের কোনো কারণ নেই। এটি পুরোপুরিভাবে আমাদের পরিবেশের উপকার করে। এর প্রধান খাবারই হলো পোকামাকড়। ওরা ওইসব পোকামাকড়ই খায় যেগুলো শাকসবজির ক্ষতি করে। এরা পতঙ্গ দমনে বিরাট ভূমিক পালন করে চলেছে।
বিষয়ে জানতে চাইলে ময়মনসিংহ আনন্দ মোহন কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রভাষক নজরুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, এ রং বদলানো গিরগিটি হিসেবে আমাদের কাছে সবচেয়ে বেশি পরিচিত যে প্রাণীটি তার নাম ক্যামিলিয়ন ভালগারিস (Chamaeleon vulgaris)।

বাংলাদেশে এটি পাওয়া যায় না। পাওয়া যায় আফ্রিকা, মাদাগাস্কার, আরবের দক্ষিণে, ইউরোপের স্পেন, ইতালি, সাইপ্রাসে, এশিয়ার শ্রীলঙ্কা ও ভারতে। এই প্রাণীটি পুরোপুরি বৃক্ষবাসী। প্রক্ষেপণযোগ লম্বা-আঁঠালো জিহ্বাটি অনেক দূর পর্যন্ত ছুড়ে দিয়ে পোকা-মাকড় ধরে খায়। এর রং বদলানোর স্বভাব রীতিমত শিল্পের পর্যায়ে পড়ে। অত্যন্ত ভীতু এই প্রাণীটি গাছগাছালির রঙের সঙ্গে এমনভাবে মিশে যায় যেন এর শিকারিরা গোলক ধাঁধায় পড়ে। এর চোখদুটি গোল গোল, একটু অস্বাভাবিক বড়। প্রতিটি চোখ স্বাধীনভাবে এদিক ওদিক ঘোরাতে পারে। এর লেজ কয়েলের মতো প্যাঁচানো, গাছের ডালকে আঁকড়ে ধরতে পারে এমন। মানুষ বা অন্য কোন শিকারি প্রাণীর মুখোমুখি হলে মুখ খুলে বড় হা করে ভয় দেখানোর চেষ্টা করে। আসলে সে নিজেই তখন ভয় পেয়েছে।
চট্টগ্রামের চিরসবুজ পাহাড়িয়া বনাঞ্চলে পাওয়া যায় ড্রাকো (উৎধপড় নষধহভড়ৎফরর) নামের উড়ুুক্কু গিরগিটি। এরা গাছের ডালে ডালে লাফিয়ে বেড়ায়। এদের প্রিয় খাবার পিঁপড়া। এদের অগ্রপদ ও পশ্চাৎপদের মাঝে পেটাজিয়াম নামের ডানা থাকে। পেটাজিয়ামের সাহায্যে এরা বাতাসে উড়তে পারে। এই ডানার রংও খুব সুন্দর। কমলা, লালচে বাদামি বা হলদে রঙের ওপর সবুজ ও কালো রঙের দাগ থাকে যা এদের দেহের বর্ণকে আকর্ষণীয় করেছে।

অভিযোজনের জন্য এদের দেহের রং পরিবেশের রঙের সঙ্গে মিশে যায়। বায়োলজির ভাষায় একে বলা হয় মিমিক্রি (সরসরপৎু)। এমন মিমিক্রি অন্যান্য প্রাণীতেও দেখা যায়। যেমন প্রজাপতির রং মিলে যায় ফুলের সঙ্গে কিংবা কোনো কোনো পতঙ্গের রং মিলে যায় পাতার সঙ্গে, ডালের সঙ্গে। এর ফলে এরা শত্রুর হাত থেকে বেঁচে যায়।
এক সময় আমাদের দেশের পথে ঘাটে দেখা যেত এমনই এক গিরগিটি মাবুইয়া (গধনঁরধ পধৎরহধঃধ)। বাংলা নাম ‘অঞ্জনা’ বা ‘আঁচিল’ কিংবা ‘মই সাপ’। ইংরেজি নাম ‘ঝশরহশ’। এরা কীটপতঙ্গ খায়। এরা খুব ভীতু প্রাণী। ভয় পেলে এদের লেজ খসে পড়ে। বায়োলজিতে একে বলে ‘অটোটমি’। এর দেহ খুব চকচকে বা উজ্জ্বল। অন্যান্য গিরগিটির মতো এরাও রং বদলাতে সক্ষম।
বাংলাদেশে পাওয়া যায় এমন আরেক সুন্দর ও নিরীহ গিরগিটি প্রজাতির নাম তক্ষক (এবশশড় মবপশড়)। মানুষের লোভ ও কুসংস্কারের শিকার হয়ে বিপর্যস্ত এই প্রাণীটি। এদের দেহ নীলচে-ধূসর রঙের ওপর লাল বা কমলা ফোঁটা ফোঁটা রঙের হয়। এরাও রং বদলাতে পারে। এরা নিশাচর প্রাণী। পোকা-মাকড় খায়, খুব জোরে জোরে শব্দ করে ডাকে। কিছুটা আগ্রাসী স্বভাবের, জোরে কামড়ে ধরতে পারে। চীনে কিছু ট্র্যাডিশনাল ওষুধ তৈরিতে এই প্রাণীটি ব্যবহৃত হয় বলে জানা যায়। যদিও এই ওষুধ তৈরির বিষয়টি কোনো বিজ্ঞানসম্মত নয় বলে তথ্য পাওয়া যায়। তক্ষকের অতিমূল্যের বিষয়টিও সত্য নয়। বরং অবৈধ সংগ্রহ ও পাচারের দায়ে হতে পারে কঠিন শাস্তি।
হাও স্টাফ ওয়ার্কম সূত্র মতে, গিরগিটির রং পরিবর্তনকারী বৈশিষ্ট্যগুলো এদের পরিবেশের সঙ্গে মিশে যেতে সাহায্য করে না। বরং এদের স্বাভাবিক, স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ অবস্থাই এদের পরিবেশের সঙ্গে মিশে যেতে সাহায্য করে। এরা পরিবেশের সঙ্গে মিশতে নিজের রঙের পরিবর্তন করে না বরং নিজেদের আলাদাভাবে তুলে ধরতে ত্বকের রঙের পরিবর্তন করে। 
সূত্র মতে আরও জানা যায়, ‘ত্বকের নিচে ইরিডোফোরস নামক স্ফটিক সদৃশ কোষগুলোর কাঠামোগত পরিবর্তনের ওপর নির্ভর করে এদের রঙের পরিবর্তন হয়। এগুলো আলোর প্রতিসরণ ঘটায়। যখন এরা উত্তেজিত হয়, হুমকি বোধ করে বা সঙ্গীর প্রতি ইতিবাচক বা প্রতিদ্বন্দ্বীর প্রতি নেতিবাচকভাবে মনোভাব প্রদর্শন করতে চায়, তখন স্ফটিকগুলো বিকৃত বা সংকুচিত হয়। আর এভাবেই এদের শরীরের রং পরিবর্তন হয়। 
২০১৫ সালে নেচার কমিউনিকেশনস জার্নালে প্রকাশিত গবেষণায় সুইজারল্যান্ডের জেনেভা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা বলেন, ত্বকের এই বিশেষ কোষগুলো ছোট আয়নার মতো কাজ করে যা বেছে বেছে আলোক তরঙ্গ প্রতিফলিত করে ও বিভিন্ন রং শোষণ করে। 
অনেক প্রাণীই বিভিন্ন রং প্রদর্শন করতে পারে। যেমন পাখি ও মাছ। সাধারণত দৃশ্যমান আলোর বর্ণালির নির্দিষ্ট অঞ্চলগুলোকে শোষণ করে বা প্রতিফলিত করে এসব প্রাণীর কোষগুলো বিভিন্ন রং প্রদর্শন করে। 
গিরগিটির কোষ অন্য প্রাণীদের তুলনায় ভিন্ন। গিরগিটির ইরিডোফোরস প্রকৃতপক্ষে নির্দিষ্ট রঙের পরিবর্তে বর্ণালির যেকোনো বা সমস্ত রংকে শোষণ বা প্রতিফলিত করতে পারে। 
‘কিছু প্রজাতি অন্যদের চেয়ে বেশি রং পরিবর্তন করে। উদাহরণস্বরূপ, কিছু প্রাণীর ত্বকের রং হালকা থেকে গাঢ় হয়, অন্যদের আরও প্রাণবন্ত, উজ্জ্বল রঙে পরিবর্তিত হয়। এই ধরনের বেশ কয়েকটি প্রজাতি রয়েছে, এদের মধ্যেও প্রচুর বৈচিত্র্য রয়েছে। এরা বিভিন্ন ধরনের রং পরিবর্তন করতে পারে, এমনকি এমন রং ধারণ করতে পারে যা মানুষ খালি চোখে দেখে না! 
জীবন্ত গিরগিটির ইরিডোফোরসের ভেতরে ক্ষুদ্র থলিতে রঞ্জক পদার্থ থাকে। কিন্তু যখন গিরগিটির মেজাজ পরিবর্তিত হয়, তখন এর স্নায়ুতন্ত্র এই কোষগুলো সক্রিয় করে, সংকুচিত বা প্রসারিত করে। 
গিরগিটি শান্ত থাকলে কোষগুলো কাছাকাছি থাকে ও আলোর ছোট তরঙ্গদৈর্ঘ্য (যেমন : নীল) প্রতিফলিত করে। উত্তেজনার সময় কোষগুলোকে পরস্পর থেকে দূরে ঠেলে দেয়, প্রতিটি ইরিডোফোরকে লাল, কমলা এবং হলুদের মতো দীর্ঘ তরঙ্গদৈর্ঘ্য প্রতিফলিত করতে সক্ষম করে।

×