ময়মনসিংহের ধোবাউড়ায় নেতাই নদীর বাঁধ ভেঙে ও পাহাড়ি ঢলে পানিবন্দি মানুষ।
টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে শেরপুরের নালিতাবাড়ীর চেল্লাখালী এবং ভোগাই নদীতে প্রবল স্রোতে পানি প্রবেশ করে উপজেলার ১২টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা ছাড়াও নদীর তীরবর্তী বিভিন্ন গ্রাম বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। তিনদিনে মৃত্যু বেড়ে দাঁড়িয়েছে সাতজনে। এর মধ্যে নালিতাবাড়ীতে দুই সহোদর ভাইসহ পাঁচজন এবং ঝিনাইগাতীতে একজন এবং নকলায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে এক কৃষক মারা গেছেন। ১ হাজার হেক্টর জমির সবজি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২ হাজারের বেশি মাছের ঘের তলিয়ে গেছে।
এ ছাড়া, নেত্রকোনার চার উপজেলায় বন্যায় ৫০ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। কুড়িগ্রামে ভারি বর্ষণে শহরের জেলা প্রশাসকের কার্যালয় চত্বর, ফায়ার সার্ভিস চত্বর, টাপু ভেলাকোপা, চর হরিকেশ, তালতলা ও রৌমারীপাড়াসহ কয়েকটি এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। ভারি বৃষ্টিতে গাইবান্ধা জেলার অনেক এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। এতে চলাচলে দুর্ভোগে পড়েছেন জেলার বিভিন্ন এলাকার মানুষ। সুনামগঞ্জে রবিবার ভোরে পাহাড়ি ঢলে পানি বিপৎসীমায় প্রবাহিত হয়ে মহেষখলা বাজারে কোমর পানি হয়। প্রবল ¯্রােতে দোকানপাট ও আমন ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। খবর স্টাফ রিপোর্টার, নিজস্ব সংবাদদাতা ও সংবাদদাতার।
শেরপুরে জেলা প্রশাসনসহ স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, কয়েকদিনের টানা বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে নতুন নতুন গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। সদর ও নকলা উপজেলাসহ নি¤œাঞ্চলের অন্তত ২শ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আমন আবাদ, মাছের ঘের ও সবজি আবাদ। এদিকে, পাহাড়ি ঢলের পানিতে ডুবে ও বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে শেরপুরের নালিতাবাড়ী, ঝিনাইগাতী ও নকলায় বৃদ্ধ-নারীসহ সাতজনের মৃত্যু হয়েছে। নালিতাবাড়ী ও ঝিনাইগাতী উপজেলাসহ জেলার অন্তত ৪৭ হাজার হেক্টর আবাদি জমির আমন ধান ঢলের পানিতে তলিয়ে গেছে। এ ছাড়া ১ হাজার হেক্টর জমির সবজি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মাছের ঘের তলিয়ে গেছে ২ হাজারের বেশি। জেলার অন্তত দেড় লাখ কৃষক বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
অন্যদিকে, নালিতাবাড়ী উপজেলার ভোগাই ও চেল্লাখালী নদীর বাঁধ ভেঙে ও নদীর পাড় উপচে রামচন্দ্রকুড়া, কাকরকান্দি, নন্নী, পোড়াগাঁও, নয়াবিল, বাঘবেড়, কলসপাড়, মরিচপুরান, যোগানিয়া, রাজনগরসহ ১০টি ইউনিয়ন ও পৌর শহরের তিনটি স্থানে বাঁধ ভেঙে কয়েক হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
নালিতাবাড়ী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল ওয়াদুদ জানান, পাহাড়ি ঢলে উপজেলার ১৯ হাজার হেক্টর জমির আমন ধানখেত পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। প্রায় ১০০-১৫০ হেক্টর জমির সবজি আবাদ নষ্ট হয়েছে। তিনি বলেন, যদি দুইদিনের মধ্যে বানের পানি না নামে তাহলে আমন আবাদি জমির শতকরা ৮০ ভাগ ধান ক্ষতি হয়ে যাবে।
নালিতাবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মাসুদ রানা বলেন, আমরা বন্যার্তদের পাশে আছি। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বন্যার্তদের মাঝে শুকনা খাবার ও বোতলজাত পানি বিতরণসহ অন্যান্য খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করা হচ্ছে। একইসঙ্গে সেনাবাহিনী, বিজিবি ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সহযোগিতায় তাদেরকে উদ্ধার করতে কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।
এদিকে, শেরপুর জেলার বন্যাকবলিত এলাকার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করেছে প্রশাসন। বন্যাকবলিত বেশকিছু এলাকায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে। নালিতাবাড়ী ও ঝিনাইগাতী উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় রাতভর পানিবন্দি মানুষদের উদ্ধারের চেষ্টা করেছেন স্বেচ্ছাসেবীরা। পরে সেনাবাহিনীর সদস্যরাও উদ্ধারকাজ পরিচালনা করেন।
ঝিনাইগাতীর মহারশি নদীর ভেঙে যাওয়া বাঁধ পরিদর্শন করে দ্রুত সময়ের মধ্যে তা মেরামতের আশ্বাস দিয়েছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলী মো. আসাদুজ্জামান। তিনি বলেন, মহারশি নদীর বাঁধ উঁচু করার সুযোগ নেই। তবে, ভাঙনকবলিত স্থান দ্রুত মেরামত করা হবে।
বন্যা পরিস্থিতি ও সরকারি ত্রাণ বিতরণ সম্পর্কে শেরপুর জেলা প্রশাসক তরফদার মাহমুদুর রহমান রবিবার বলেন, অবিরাম বৃষ্টি ও ঢলের পানিতে হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। তাদের অনেকেই আশ্রয়কেন্দ্রে রয়েছেন। ৩টি উপজেলায় বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে রান্না করা খাবার বিতরণ করা হচ্ছে। সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস উদ্ধারকাজে সহযোগিতা করছে। পর্যাপ্ত শুকনা খাবার রয়েছে। এখন পর্যন্ত ১০ হাজার শুকনা খাবার প্যাকেট পানিবন্দি পরিবারগুলোর মাঝে সরবরাহ করা হয়েছে। আরও ২৫ হাজার প্যাকেট ত্রাণের চাহিদা দেওয়া হয়েছে।
নেত্রকোনা ॥ তিনদিনের ভারি বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে জেলার দুর্গাপুর, কলমাকান্দা, সদর ও পূর্বধলা উপজেলার অন্তত ২০টি ইউনিয়নের নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে ওই ইউনিয়নগুলোর শতাধিক গ্রামে পানি উঠেছে। প্রায় ৫০ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। তলিয়ে গেছে প্রায় সাড়ে তিনশ হেক্টর আমন ধানের খেত।
পাউবো সূত্রে জানা গেছে, রবিবার সোমেশ্বরী নদীর পানি দুর্গাপুর পয়েন্টে বিপৎসীমার শূন্য দশমিক ২৫ মিটার নিচ দিয়ে, কংস নদের পানি জারিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার শূন্য দশমিক ৩ মিটার নিচ দিয়ে এবং উব্দাখালীর পানি কলমাকান্দা ডাকবাংলো পয়েন্টে বিপৎসীমার শূন্য দশমিক ৫ মিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। বৃষ্টি ও ঢল অব্যাহত থাকলে দ্রুতই নদীগুলো বিপৎসীমা অতিক্রম করবে।
বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের পানিতে দুর্গাপুর উপজেলার কুল্লাগড়া, কাকৈইগড়া, বাকলজোড়া, চ-ীগড় ও গাঁওকান্দিয়া; কলমাকান্দার রংছাতি, লেংগুরা, খারনৈ, নাজিরপুর, বড়খাপন ও কলমাকান্দা সদর ইউনিয়নের নি¤œাঞ্চলের প্রায় ৩শ হেক্টর আমনের খেত ডুবে গেছে। চানপুর-গোবিন্দপুর, কলমাকান্দা-বওরাকোনা, কলমাকান্দা-বিষমপুর, কলমাকান্দা-মনতলাসহ বেশকিছু সড়ক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাঠে পানি উঠেছে।
রংছাতি ইউনিয়নের চন্দ্রডিঙ্গা গ্রামের কিছু বাড়িঘর ঢলের তোড়ে ভেঙে গেছে। জেলা প্রশাসক বনানী বিশ্বাস দুর্গাপুর ও কলমাকান্দা উপজেলার কয়েকটি প্লাবিত গ্রাম পরিদর্শন করেছেন। এ সময় তিনি ক্ষতিগ্রস্ত ও দরিদ্র কৃষকদের মাঝে তিন টন চাল ও ৪শ প্যাকেট শুকনা খাবার বিতরণ করেন।
কুড়িগ্রাম ॥ কুড়িগ্রাম ও আশপাশের এলাকায় ভারি বৃষ্টি ও ঢলে কুড়িগ্রামে ফের বাড়ছে নদ-নদীর পানি। গত ২৪ ঘণ্টায় কুড়িগ্রামে ১৬৪ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। গত দুইদিনে বৃষ্টি হয়েছে ৩২১ মিলিমিটার। তিস্তায় পানি বেড়ে বিপৎসীমার কাছাকাছি অবস্থান করছে। বৃষ্টিতে কুড়িগ্রাম শহরের জেলা প্রশাসকের কার্যালয় চত্বর, ফায়ার সার্ভিস চত্বর, টাপু ভেলাকোপা, চর হরিকেশ, তালতলা ও রৌমারীপাড়াসহ কয়েকটি এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে।
শহরের ড্রেনেজ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। মানুষের দুর্ভোগ চরমে উঠেছে। হাসপাতালপাড়া, রৌমারীপাড়া এবং তালতলা এলাকার অনেকের ঘরে পানি উঠেছে।
গত এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে তিস্তা ও ধরলার নিচু এলাকায় প্রায় ৫শ হেক্টর জমির আমন খেত তলিয়ে থাকায় তা নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা করছেন কৃষকরা। এদিকে, থেমে নেই নদ-নদীর ভাঙন। তিস্তার ভাঙনে রাজারহাটের গতিয়াশাম, চর গতিয়াশাম ও ধরলার ভাঙনে বেগমগঞ্জ, সারডোবসহ কয়েকটি এলাকায় বেড়েছে নদীভাঙন। এক সপ্তাহে এসব এলাকায় গৃহহীন হয়েছে অন্তত ৩ শতাধিক পরিবার। বেগমগঞ্জে ভাঙনে বিলীন হয়েছে একটি কমিউনিটি ক্লিনিক ও বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র। ঝুঁকিতে পড়েছে একটি হাইস্কুল।
গাইবান্ধা ॥ জেলায় নদ-নদীর পানি আবারও বাড়তে শুরু করেছে। ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা ও ঘাঘট নদীতে এক সপ্তাহ থেকে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। বন্যার আশঙ্কা করছেন নদীতীরবর্তী নি¤œাঞ্চলের মানুষ। ইতোমধ্যে অনেক এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। চলাচল করতে দুর্ভোগে পড়েছেন ওইসব এলাকার মানুষ। রবিবার গাইবান্ধা পাউবোর নিয়ন্ত্রণকক্ষের পাওয়া তথ্য থেকে জানা যায়, শনিবার সকাল ৯টা থেকে রবিবার সকাল ৯টা পর্যন্ত এই পরিমাণ পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী হাফিজুল হক বলেন, টানা বৃষ্টিতে জেলার নদ-নদীর পানি বাড়তে শুরু করেছে। অতিবৃষ্টি আর উজানের ঢল অব্যাহত থাকলে জেলার নি¤œাঞ্চলে স্বল্পমেয়াদি বন্যার শঙ্কা রয়েছে।
গাইবান্ধা জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. শফিকুল ইসলাম জানান, নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেলেও এখনো পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করেনি। বন্যার আগাম প্রস্তুতি হিসেবে ৬শ মেট্রিক টন চাল, শুকনা খাবারের প্যাকেট মজুত রয়েছে। আমরা সার্বক্ষণিক নজর রাখছি।
ধর্মপাশা, সুনামগঞ্জ ॥ উপজেলার ভারত সীমান্ত ঘেঁষে উত্তর বংশীকুন্ডা ইউনিয়নের মহেষখলা বাজারসহ রোপা-আমন ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। রবিবার ভোর থেকে হঠাৎ পাহাড়ি ঢলের পানি বিপৎসীমায় প্রবাহিত হয়ে মহেষখলা বাজারের ওপর কোমর পানির সঙ্গে প্রবল ¯্রােতে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ রোপা আমন ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে জানিয়ে উত্তর বংশীকুন্ডা ইউপি চেয়ারম্যান মো. নূর নবী তালুকদার বলেন, রবিবার ভোরে হঠাৎ পাহাড়ি ঢলের পানি বিপৎসীমায় প্রবাহিত হয়ে মহেষখলা বাজারে কোমর পানি হয়েছে।
তার সঙ্গে প্রবল স্রোতে দোকানপাট ও আমন ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। মহেষখলা বাজার হোটেল ব্যবসায়ী মো. আমিরুল ইসলাম ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, দোকানপাটের ভেতরে কোমর পানি হওয়ায় নিত্যপ্রয়োজনীয় মালামালসহ ইট, বালু, সুরকিসহ ভবন নির্মাণের সামগ্রী স্রোতের পানিতে ভেসে গেছে।