বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন ‘সঠিক ছিল’ মন্তব্য করে বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী বলেছেন, আন্দোলন দমাতে কঠোর হওয়ার ‘চাপ থাকলেও’ তা না হওয়ায় আওয়ামী লীগ সরকারে উচ্চ পর্যায়ে তাকে কৈফয়ত দিতে হয়েছে।
বৃহস্পতিবার পিলখানায় এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে বিজিবির ভূমিকা, পরবর্তীতে সাবেক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীসহ অন্যদের সীমান্ত পেরিয়ে দেশ ত্যাগ, পার্বত্য অঞ্চলের পরিস্থিতি এবং ৫ অগাস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশত্যাগের দিন বিজিবির ভূমিকা নিয়ে কথা বলেন।
আশরাফুজ্জামান বলেন, বিজিবির জনবল প্রায় ৫৭ হাজার। এর মাত্র ছয় শতাংশের মত ছাত্র আন্দোলনের সময় মোতায়েন করা হয়েছিল। সেই সংখ্যাটা সারা দেশ মিলিয়ে চার হাজারের মত।
“কেন এত কম মোতায়েন হয়েছে এ জন্য টাইম টু টাইম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর কাছে এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের নেতাদের কাছে কৈফিয়ত দিতে হয়েছে। অসংখ্যবার মিটিংয়ে জবাবদিহি করতে হয়েছে।
“পুলিশ যে ভূমিকা পালন করছে, সেই ভূমিকা বিজিবি অনেক ক্ষেত্রে ইচ্ছা করে পালন করেনি, সে বিষয়ে দোষারোপ করা হয়েছে আমাকে বা বিজিবিকে।”
তিনি বলেন, “অসংখ্য জায়গায় মোতায়েন করার জন্য বলা হয়েছে, আমরা করিনি। কারণ দেখেছি যেখানে ছাত্র বেশি রয়েছে, জনতা সুন্দরভাবে আন্দোলন করছে… শহীদ মিনারে সবচেয়ে বড় জমায়েত হচ্ছিল, সেখানে বিজিবি পাঠাইনি। আদেশ হওয়ার পরেও পাঠাইনি।”
মহাপরিচালক বলেন, তার নিজের মেয়ে এবং তার স্বামীও আন্দোলনে গেছেন।
“তাদেরকে বাধা দিইনি। আপন ভাগনে আন্দোলনে গেছে বাধা দিইনি। কারণ এটা একটা রাইট কাজের জন্য আন্দোলন হচ্ছিল।”
শাহবাগে আন্দোলনের সময় জমায়েত বেশি হওয়ায় বিজিবি সদস্যদের জাদুঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল বলে জানান মহাপরিচালক।
তিনি বলেন, পুলিশের চেয়ে ১৫/২০ গুণ বেশি মরণাস্ত্র আছে বিজিবির হাতে। কারণ সীমান্তে কখনো যুদ্ধ পরিস্থিতি হলে বিজিবিকে তা মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়। আন্দোলনের সময় বিজিবি সেসব ব্যবহার করেনি।
“বিজিবির কাছে লাইট মেশিনগান রয়েছে, মেশিনগান রয়েছে, মর্টার রয়েছে, গ্রেনেড রয়েছে, রকেট বিধ্বংসী অস্ত্র রয়েছে। এগুলো কোনটাই … ইচ্ছাকৃতভাবে মোতায়েন করা হয়নি। বিজিবির টহল পিকআপ যে গেছে, কোনোটাতেই উপরে এলএমজি ছিল না।
“অনেক বাহিনী দেখবেন এলএমজিসহ উপরে দাঁড়ানো, সেখানে আমরা ইচ্ছা করেই নিশ্চিত করেছি যে এলএমজি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে না, কারণ ঝুঁকি আছে ।”
বিজিবির হাতে যেন কারো প্রাণ না যায়, সেজন্য ‘সর্বোচ্চ চেষ্টা ছিল’ বলে তিনি দাবি করেন। বরং আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের খাবার সরবরাহ, আহত শিক্ষার্থীদের বাইরের হাসপাতাল থেকে এনে বিজিবি হাসপাতালে চিকিসা দেওয়ার কথা বলেন।
“সরকারি আদেশ পালন করার মত পরিস্থিতি দেখিয়ে অনেক কিছু আমরা ভেতরে ভেতরে করেছি। সেজন্য ছাত্র জনতা ৫ তারিখে আমাদের গেটে মিষ্টি নিয়ে এসেছে।”
মহাপরিচালক বলেন, “জুলাই মাসের শেষ দিকে যখন গণ গ্রেপ্তার শুরু হল, তখন বিজিবিকেও বলা হয়েছিল গ্রেপ্তার করতে। তখন বিজিবির একজন সদস্যও কাউকে গ্রেপ্তার করেনি। আমি বলেছি, বিজিবি গ্রেপ্তারের জন্য প্রশিক্ষিত না, প্রস্তুত না।”
বিজিবিকেও র্যাবের মত হেলিকপ্টার ব্যবহার করতে বলা হয়েছিল, কিন্তু বিজিবি তা করেনি বলে তথ্য দেন মেজর জেনারেল আশরাফুজ্জামান।
তিনি বলেন, “বিভিন্ন পরিস্থিতির কারণে ক্লিয়ার করে বলা হয়নি আমরা এগুলো কীভাবে করেছি, কীভাবে চাপ এসেছে বিভিন্ন দিক থেকে। তারপরও কীভাবে করেছি, সেটা আমাদের কমাণ্ডার বা আমাদের সদস্যরা জানেন।
“তারপরও একটা দুইটা ঘটনা ঘটেছে, এক অফিসার ফায়ার করছে, তাকে ওই মুহূর্তে অপসরণ করা হয়েছে। তিনি একটা ব্যাটালিয়নের কমাণ্ডার ছিলেন, একজন লেফটেন্যান্ট কর্নেল। তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত করে সর্বোচ্চ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে সেনাবাহিনীতে ফেরানো হয়েছে। একই সাথে তদন্ত করে দেখা যায়, তার সাথে একজন মেজর ছিলেন, যিনি গুলি করেননি, তবে তিনি অপেশাদারভাবে ভয় দেখিয়েছেন, যা একটা ভীতির সঞ্চার করেছেন ছাত্র জনতার মধ্যে। তাকেও শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে।”
বিজিবির গুলিতে মৃত্যুর কোনো তথ্য না পাওয়ার দাবি করে এ বাহিনীর মহাপরিচালক বলেন, “তবে কোনো প্রমাণ পাওয়া গেলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ছাত্র আন্দোলনের সময় র্যাবে থাকা দুইজনসহ তিন বিজিবি সদস্য নিহত হয়েছেন। আর ১০৩ জন সদস্য আহত হয়েছেন।
“দুর্ভাগ্যজনকভাবে ১০৩ জন আহত সদস্যের মধ্যে বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন পুলিশের শটগানের ছররা গুলিতে। তারা পুলিশের সাথে কাজ করছিল।”
বিজিবির কোনো সদস্য পালিয়ে যাননি এবং কোনো অস্ত্রও খোয়া যায়নি বলে তথ্য দেন মহাপরিচালক।
৫ অগাস্ট কী করেছে বিজিবি?
মহাপরিচালক বলেন, ৫ অগাস্ট বিজিবিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ঢাকার ১৪টি প্রবেশ পথে পাহারা দিতে হবে, যেন বাইরে থেকে ছাত্র জনতা প্রবেশ করতে না পারে।
“আদেশ এক জায়গা থেকে পাইনি। দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়, মন্ত্রী এমনকি… প্রেশারের মধ্যে থেকে ওই ১৪ জায়গায় ৮০/৯০জন করে বিজিবি সদস্যকে পাঠালাম।”
সেদিন সকালে ওইসব জায়গায় থেকে খোঁজ নেওয়ার কথা জানিয়ে মেজর জেনারেল আশরাফুজ্জামান বলেন, “তারা জানাল, এক একটি জায়গা থেকে ১০- ১৫ হাজার ছাত্র জনতা আসছে। আমি বলেছি সবাই পোস্ট ছেড়ে দিয়ে সাইডে চলে যাও। কারণ এখানে ১০- ১৫ হাজার ছাত্র জনতার গার্ড করার কোনো প্রয়োজন নেই। এখানে কোনো গার্ড করতে গেলে হতাহতের সংখ্যা বাড়বে।”
এখন বিজিবি পূজায়, যৌথ বাহিনীর সঙ্গে এবং গাজীপুরে শিল্প এলাকায় শান্তি রক্ষায় কাজ করছে বলে জানান মহাপরিচালক।
তিনি বলেন, আন্দোলনের সময় প্রতিদিন যে আইনশৃঙ্খলা বৈঠক হত, সেখানে পুলিশ যে ভূমিকা পালন করছে তা তুলে ধরে বলা হত, বিজিবি সেটা করছে না।
“পরিস্থিতি পরিবর্তিত না হলে আমি এখানে থাকতে পারতাম কিনা, তার নিশ্চয়তা আমি দিতে পারতাম না।”
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের সঙ্গে একটি ‘পেশাদার সম্পর্ক’ বজায় রাখার ব্যাপারে গুরুত্ব দিয়ে বিজিবি মহাপরিচালক বলেন, “সীমান্তের নিরাপত্তার বিষয় আছে। তবে কোনো কিছুতে কম্প্রোমাইজ করে নিজেরা ছাড় দিয়ে কোনো কিছু হবে না।”
‘পালাল কীভাবে’
সংবাদ সম্মেলনে দুর্গ পূজায় নিরাপত্তার বিষয়টির কথা বলেন সীমান্তরক্ষী বাহিনীর প্রধান। তিনি বলেন, সব ধরনের নিরাপত্তার ব্যবস্থাই তারা এবার নিয়েছেন।
পরে আওয়ামী লীগ নেতাদের অনেকে সীমান্ত পেরিয়ে পালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন আসে সংবাদ সম্মেলনে। এ বিষয়ে বিজিবির কোনো গাফলতি আছে কিনা জানতে চাওয়া হয়।
জবাবে মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান বলেন, “সত্যিকার অর্থে ৫ অগাস্ট বিকাল থেকে আমরা সেটা অনুমান করতে পারছিলাম। তখন অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়ে সারেনি। সমাজের সচেতন অনেক ব্যক্তিবর্গ, সুশিল ব্যাক্তিবর্গ অনেকের সাথেই আমরা আলোচনা করি। কারা কারা পালাতে পারে শতাধিক এমপি-মন্ত্রী, যারা অপরাধ করেছে, তাদের একটি তালিকা করে আমি আমাদের সকল আইসিপি ও সকল বিওপি, মানে রিজিওনাল ব্যাটালিয়ন সেক্টরে সরবরাহ করেছি।”
৭ অগাস্ট থেকে সীমান্ত পেরিয়ে পালানোর চেষ্টার সময় ২২ জনকে গ্রেপ্তারের কথা জানিয়ে বিজিবি মহাপরিচালক বলেন, ওই ২২ জনের মধ্যে উচ্চ পদস্থ চারজন রয়েছেন।
ভারতে সাথে বাংলাদেশের প্রায় ৪ হাজার ২০০ কিলোমিটার সীমান্ত থাকার তথ্য তুলে ধরে তিনি সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “কোনো দালাল যদি অর্থের বিনিময়ে পার করে দিতে চায়, অনেক ক্ষেত্রে সেটা সম্ভব হতে পারে। তবে বিজিবির সব ধরনের চেষ্টা আছে।
“যখন জানা গেল টাকার বিনিময়ে পার করে দেওয়া হচ্ছে, তখন সম্ভাব্য দালাল বা আশেপাশের এলাকাবাসীকে বলেছি, কেউ যদি চুক্তি করে টাকা দেয়, তা হলে বিজিবি দ্বিগুণ অর্থ পুরস্কার দেবে। তাদের পালানোর রোধ করে আইনের আওতায়, বিচারের আওতায় আনা আমাদের জাতীয় ও নৈতিক দায়িত্ব।”
বিগত সরকারের কোনো আলোচিত বাক্তিকে বিজিবির পক্ষ থেকে ‘আশ্রয়-প্রশ্রয়’ দেওয়া হলে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না বলেও হুঁশিয়ার করেন মেজর জেনারেল আশরাফুজ্জামান।
সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে কলকাতার ইকোপার্কে দেখা গেছে বলে সংবাদ মাধ্যমে খবর এসেছে। তিনি ইমিগ্রেশন পার হয়ে যাননি বলে পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে। তা হলে তিনি কোন পথে গেলেন, সেই প্রশ্ন সংবাদ সম্মেলনে করা হয়।
জবাবে মহাপরিচালক বলেন, “এটা আমারও প্রশ্ন, উনি কোন দিক দিয়ে গেলেন। সেটা যাওয়ার সময় তথ্য পেলে অবশ্যই তাকে আটক করা হত।”
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের যে বন্দি বিনিময় চুক্তি আছে, তার মাধ্যমে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ অন্যদের ফিরিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করেন বিজিবি প্রধান।
এবি