ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ১৯ আশ্বিন ১৪৩১

নিখোঁজ শাহাদতের স্ত্রী ও মায়ের আক্ষেপ

মেয়েটা কথা শেখার পর কাকে বাবা বলে ডাকবে

নিজস্ব সংবাদদাতা, টাঙ্গাইল

প্রকাশিত: ২৩:২৭, ৩ অক্টোবর ২০২৪

মেয়েটা কথা শেখার পর কাকে বাবা বলে ডাকবে

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নিখোঁজ শাহাদতের স্ত্রী ও শিশুকন্যা

কাজে যাওয়ার কথা বলে বাড়ি থেকে বের হয়। এর পর ঢাকায় গিয়ে আন্দোলনে যোগ দেয়। ফোনে আন্দোলনের কথা শোনার পরই ফিরে আসতে বললেও সে আর আসেনি। সে কি বেঁচে আছে, নাকি মারা গেছে সেটাও জানতে পারলাম না। তার কোনো খোঁজখবরই পাচ্ছি না। এক নজর দেখার ইচ্ছে জাগে জীবিত বা মৃত মানুষটিকে। আমার পাঁচ মাস বয়সী একটা মেয়ে আছে। আমার সন্তানের ভবিষ্যৎ কি হবে। আমাদের কে দেখাশোনা করবে। মেয়েটা কথা শেখার পর কাকে বাবা বলে ডাকবে। আমি কি জবাব দেব। মেয়েকে কান্না জড়িতকণ্ঠে এভাবে কথাগুলো বলছিলেন ভেকু চালক নিখোঁজ শাহাদত হোসেনের স্ত্রী জিয়াসমিন।
জানা যায়, টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার আলীপুর গ্রামের আব্দুল হালিম ও আসমা খাতুনের বড় ছেলে শাহাদাত। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্ব গোলচত্বর এলাকায় যোগ দিয়েছিল শাহাদত হোসেন। এর পরই ৪ আগস্ট সরকার পতনের আন্দোলনে ঢাকার সাভারে যোগ দিয়ে নিখোঁজ হয় শাহাদত। 
সরেজমিন দেখা যায়, ঘটনার পর থেকেই প্রতিবেশীরা শাহাদতের বাড়িতে গিয়ে তার পরিবারকে সান্ত¡না দিচ্ছে। মা আসমা খাতুন ছেলের শোকে পাগলপ্রায়। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও ছেলের সন্ধান না পেয়ে হতাশ তারা। জীবিত বা মৃত একনজর দেখার অপেক্ষায় শাহাদতের স্ত্রী জিয়াসমিন। স্বামীহারা জিয়াসমিন কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানি শুকিয়ে ফেলেছেন। এখন তাদের একমাত্র শিশু সন্তানের ভরণপোষণ ও ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় সে। পাঁচ মাস বয়সী শিশু সানজিদা বাবার আদর থেকে বঞ্চিত দেড় মাসেরও বেশি সময় ধরে।

আর কোনোদিন বাবার আদর পাবে কি না তা নিয়েও রয়েছে সন্দেহ। বাবা না থাকায় এই শিশুকে নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন মা জিয়াসমিন। শাহাদত প্রায় তিন বছর আগে বিয়ে করেন জিয়াসমিনকে। এর পর তাদের ঘরে ফুটফুটে কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। নিখোঁজ শাহাদতের এই কন্যা সন্তানের বর্তমান বয়স সাড়ে ছয় মাস। শাহাদত পেশায় একজন ভেকু চালক ছিলেন। তবে তার সংসার সচ্ছল ছিল না। এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ভেকু গাড়ি চালাত সে। গাড়ি চালিয়ে যা উপার্জন হতো তাতেই সংসার চলত কোনো রকমে।  
পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, গত ৩ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্ব গোলচত্বর এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল শাহাদত। পরে ওই দিনই রাতে আন্দোলনে যোগ দিতে বন্ধুদের সঙ্গে সাভার যায় শাহাদাত। পর দিন ৪ আগস্ট সকালে তার স্ত্রীর সঙ্গে মোবাইলে শেষ কথা বলে শাহাদত। স্ত্রীকে ফোনে জানায় খুব দ্রুতই বাড়ি ফিরবে সে। এর পর ওই দিন বিকেলে শাহাদত তার মাকে অন্য একটি মোবাইলে ফোন দিয়ে কল করে জানায় সাভারের পরিস্থিতি খুবই খারাপ।

সেখানে শুধু গুলাগুলি হচ্ছে। কোনো দিকে যাওয়ার ব্যবস্থাই নেই। সেখান থেকে ফিরতে পারবে কি না তা নিয়ে মাকে শঙ্কার কথা জানায় শাহাদত। যে নম্বর থেকে শাহাদত  শেষবার ফোন করেছিল সেটিও তখন থেকেই বন্ধ রয়েছে। তার পর সেই ফোনে বারবার যোগাযোগ করলেও সেটিও বন্ধ পাওয়া যায়। এর পর আর খোঁজ মিলেনি তার সন্তানের। ঘটনার পর শাহাদতের বাবা ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতাল ও মর্গে ছেলের মরদেহ খুঁজে চলেছেন। এ ছাড়া আত্মীয়স্বজনসহ বিভিন্ন জায়গায় খুঁজেও তার সন্ধান পায়নি পরিবার। একমাত্র উপার্জনকারী ছেলেকে না পেয়ে দিশেহারা পুরো পরিবার। 
স্থানীয়রা জানায়, শাহাদত ও তার বাবার উপার্জনের টাকায় সংসার চলত। ছেলেটা এলাকাতেও আন্দোলন করেছে। বন্ধুদের ডাকে ঢাকায় আন্দোলনে যোগ দিয়ে নিখোঁজ হয় সে। তার একটি শিশু সন্তান রয়েছে। তার স্ত্রী শিশু সন্তান নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। বর্তমান সরকার যেন নিখোঁজ শাহাদতের সন্ধান দেয় এবং এই অসহায় পরিবারের পাশে দাঁড়ায়।
নিখোঁজ শাহাদতের মা আসমা খাতুন বলেন, মামা বাড়ির পরিবার বিএনপি সমর্থিত হওয়ায় বিএনপির লোকদের সাথেই চলাফেরা করত শাহাদত। বন্ধুদের সঙ্গে আন্দোলন করেছে এলাকায়। গত ৩ আগস্ট কাজের কথা বলে সন্ধ্যার দিকে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায় শাহাদত। পর দিন ৪ আগস্ট বিকেলে অন্য একটি নম্বর থেকে জানায় সে সাভারে আন্দোলনের মধ্যে রয়েছে। চারপাশে গোলাগুলি হচ্ছে, অবস্থা খুবই খারাপ। মনে হয় ফিরতে পারব না। ফোনের ও পাশ থেকে অনেক গোলাগুলির শব্দই শুনতে পাই। এর পরই ফোন কেটে দেয় সে। এর পর আর তার খোঁজ পায়নি।

আমার বাবাকে জীবিত বা মৃত এনে দেন আমার কাছে। বাড়িতে এনে যেন এক নজর দেখার পর গোসল করিয়ে কবরটুকু দিতে পারি। তাতে মনকে একটু সাান্ত¡না দিতে পারব। সরকারের কাছে দাবি আমার ছেলেকে এক নজর দেখতে চাই।
নিখোঁজ শাহাদতের বাবা আব্দুল হালিম বলেন, তার মায়ের সঙ্গে সর্বশেষ কথা হয়েছিল। এর পর ছেলের সন্ধান পেতে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতাল ও মর্গে খুঁজেছি অনেক। এখনো খুঁজেই চলেছি। কত লাশ মর্গে পড়ে ছিল, অথচ সেখানে আমার ছেলের লাশ পাইনি। আমার ছেলের সন্ধান চাই। ডায়েরি করতে থানায় কয়েক দিন ছেলে হারানোর জন্য গিয়েছিলাম। কিন্তু থানা পুলিশ প্রথমে ডায়েরি নিতে রাজি হয়নি। তবে গত ১৫ আগস্ট ডায়েরি নিয়েছে থানা পুলিশ।
এ ব্যাপারে কালিহাতী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল কালাম ভূঁইয়া বলেন, ওই সময় কেন নেয়নি তা আমি বলতে পারব না। আমার কাছে আসার পর আমি দ্রুতই ডায়েরিভুক্ত করেছি। নিখোঁজ শাহাদতকে খুঁজে বের করতে প্রয়োজনীয় কাজ চলমান রয়েছে।
এ বিষয়ে কালিহাতী উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা শাহাদাত হুসেইন জানান, খবর পেয়ে ওই পরিবারকে ডেকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ইতোমধ্যেই তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। নিখোঁজ শাহাদতকে খুঁজে পেতে আমাদের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

×