ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

ভেঙে গেছে ব্রিজ-কালভার্ট, রাস্তাঘাট

বন্যা পরিস্থিতির উন্নতিতে ফুটে উঠছে ক্ষতচিহ্ন

জনকণ্ঠ ডেস্ক

প্রকাশিত: ২৩:৩৯, ১ অক্টোবর ২০২৪

বন্যা পরিস্থিতির উন্নতিতে ফুটে উঠছে ক্ষতচিহ্ন

কুড়িগ্রামের উলিপুরে ধরলার ভাঙনে হুমকিতে খুদেরকুটি আব্দুল হামিদ উচ্চ বিদ্যালয় ও বন্যা আশ্রয় কেন্দ্র

বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটলেও বেড়েছে দুর্ভোগ। পানি কমতে না কমতেই দেখা দিয়েছে ভাঙন। আতঙ্ক ঘুম কেড়ে নিয়েছে নদীপাড়ের মানুষের। অনেক পরিবারের জমি, ঘরবাড়ি বিলীন হয়েছে নদীতে। টানা দুই-তিনদিনের বন্যায় পানির তোড়ে নদী তীরবর্তী এলাকার রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট ভেঙে গেছে। ধান ও সবজিখেত দীর্ঘসময় পানিতে ডুবে থাকায় ফসলের মারাত্মক ক্ষতির আশঙ্কা করছেন চাষিরা। খবর স্টাফ রিপোর্টার ও নিজস্ব সংবাদদাতার।
টানা বর্ষণ ও উজানের ঢলে তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহের কারণে নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার ৫ ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। এতে কমপক্ষে ১৫ হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দুইদিন আগে তিস্তার পানি ডালিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ২ সেন্টিমিটার ও কাউনিয়া পয়েন্টে ৩৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছিল। 
ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের দায়িত্বে থাকা নির্বাহী প্রকৌশলী আতিকুর রহমান জানান, মঙ্গলবার বেলা ৩টায়  তিস্তা নদীর পানি নীলফামারীর ডালিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার (৫২.১৫) ৬০ সেন্টিমিটার ও  কাউনিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার (২৯.৩১) ৪৩ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। 
এদিকে, বানের স্রোতে নীলফামারীর ডিমলা উপজেলায় সড়ক ভেঙে যাওয়ায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে নদীতীরবর্তী এলাকার আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দাসহ ৫ শতাধিক পরিবারের। বন্যায় উপজেলার ঝুনাগাছ চাপানী ইউনিয়নের ছাতুনামা কেল্লাপাড়া এলাকায় ২ কিলোমিটার সড়কটির ৩০ মিটার অংশ ভাঙনের কবলে পড়ে। এতে ওই ইউনিয়নের কেল্লাপাড়া আশ্রয়ণ প্রকল্পসহ তিস্তাপারের দুই হাজারের বেশি মানুষ যাতায়াতের চরম কষ্টে পড়েছে। 
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, আকস্মিক বন্যায় আমনসহ জমির বিভিন্ন ফসল প্লাবিত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রোপা আমনের ক্ষতি কিছুটা কম হলেও, অন্যান্য ফসলে ক্ষতির আশঙ্কা করছে।
কুড়িগ্রাম ॥ জেলার ব্রহ্মপুত্র, ধরলা ও তিস্তা নদীর পাকমতে শুরু করলেও চলছে তীব্র ভাঙন। ভাঙনে হারিয়ে যাচ্ছে ঘরবাড়ি, বসতভিটা আর আবাদী জমি। নিঃস্ব হচ্ছে মানুষ। সব হারিয়ে তারা এখন খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছে। 
গত দুইদিনে ধরলা নদীর পানি বৃদ্ধ পাওয়ায় উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের আক্কেল মামুদ কমিউনিটি ক্লিনিক, কুদের কুটি কাশেম বাজার জামে মসজিদ, ৬০টি বসতবাড়িসহ প্রায় ১২০ একর ফসলি জমি, গাছপালা নদীতে বিলীন হয়েছে। এ ছাড়া খুদের কুটি আব্দুল হামিদ উচ্চ বিদ্যালয়, বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র ভাঙনের হুমকিতে রয়েছে। অব্যাহত ভাঙন ঠেকাতে দিন-রাত গাছের ডাল ও বস্তা ফেলে আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে ভাঙনকবমানুষজন। বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের আকতার হোসেন, মোক্তার হোসেন, মহুবর রহমান, ইব্রাহীম আলী জানান, তাদের বসতবাড়ি ও জমাজমি নদীতে বিলীন হয়েছে। জরুরি ব্যবস্থা না নিলে এলাকার মানুষ সর্বস্বান্ত হয়ে যাবে।
বেগমগঞ্জ ইউপি চেয়ারম্যান বাবলু মিয়া বলেন, কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিতে ধরলার ভাঙনে আমার বাড়িসহ ৬০টি বসতবাড়ি কমিউনিটি ক্লিনিক বিলীন হয়ে গেছে। দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে স্কুল, বন্যা আশ্রয় কেন্দ্রসহ সব কিছু নদীতে বিলীন হয়ে যাবে। উলিপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. হারুন অর রশীদ বলেন, আক্কেল মামুদ কনদীগর্ভে বিলীন হয়েগেছে। তবে, চিকিৎসার উপকরণসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র উদ্ধার করা হয়েছে। বিঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করা হয়েছে।
ধরলা গ্রাসে যাত্রাপুরের সরকারপাড়া এলাকায় ব্যাপক ভাঙন চলছে। তিস্তা নদীর ভাঙনে রাজারহাট উপজেলার খিতাবখাঁ, চর খিতাব খাঁ, গতিয়াশাম, চর গতিয়াশামসহ ৭টি গ্রামে ৪০টি পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়েছে। গত দুদিনে চর গতিয়াশামে ৩০টি পরিবার ঘরবাড়ি সরিয়ে নিয়েছে। ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে শতাধিক পরিবার। ভাঙনকবলিত মানুষরা দিশেহারা হয়ে পড়েছে। 
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রাকিবুল হাসান জেলার বিভিন্ন নদ-নদীতে ভাঙন দেখা দিয়েছে। তিনি জানান, বরাদ্দ না থাকায় কৃষিজমি ও ঘরবাড়ি রক্ষায় তাদের করণীয় কিছু নেই। তবে স্কুলসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা রক্ষায় তারা জিও ব্যাগ ফেলছেন। 
লালমনিরহাট : পানি কমে যাওয়ায় ঘরবাড়িতে ফিরতে শুরু করছে বানভাসি মানুষ। দেখা দিয়েছে নদীভাঙন। কয়েক দিনের বন্যায় রাস্তাঘাট ভেঙ্গে যাওয়ায় চলাচলে চরম ভোগান্তিতে পড়ছেন বানভাসি মানুষ। নদী তীরবর্তী এলাকায় ভাঙনসহ ভেসে উঠছে ক্ষতচিহ্ন। লালমনিরহাটের ৫টি উপজেলার ২১টি ইউনিয়নে ২৫ হাজারের বেশি মানুষ পানিবন্দি হওয়ার পর নদীপাড়ে নতুনভাবে শুরু হয়েছে ভাঙন আতঙ্ক। রবিবার রাত ১১টার পর থেকে তিস্তা নদীর পানি কমায় বন্যার ক্ষতি দৃশ্যমান হতে শুরু করে।
আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা ইউনিয়নের বাহাদুর পাড়া, চৌরাহা, গোবর্দ্ধন, গরীবুল্লাহপাড়া,সদর উপজেলার তাজপুর, হরিণচড়া,খুনিয়াগাছ, রাজপুর ও গোকু-া এলাকার চর গোকু-ায় নদীভাঙন প্রকট আকার ধারণ করেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় তিস্তার ভাঙনে অন্তত ৫০টি বাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙনের মুখে রয়েছে আরও শতাধিক বাড়িঘর।
বাহাদুর পাড়ার ভাঙনের শিকার মজিবর রহমান বলেন, ‘তিনদিন ধরে ঘরের ভেতর পানি নিয়া কোনো রকমে দিন পার করছি। পানি কমার সাথে সাথে সোমবার সকাল থাকি শুরু হইছে নদীর ভাঙন। কোনো অকমে ঘর দুটা সারে নিবার পাইলেও আর কিছু অক্ষা কইরবার সুযোগ দিলে না।’
হরিণচড়া গ্রামের বাসিন্দা হাফিজুর রহমান জানান, বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর সোমবার বিকেল থেকে মঙ্গলবার সকাল থেকে হরিণচড়া গ্রামের প্রায় ২০টি বসতভিটা ও ১০০ বিঘা জমি তিস্তায় বিলীন হয়েছে। এখানে নদী ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। একের পর এক বসতভিটা ও কৃষি জমি নদীগর্ভে চলে যাচ্ছে। ভাঙনকবলিত পরিবারগুলো আশ্রয় নিচ্ছে রাস্তার ওপর, অন্যের জমিতে ও আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে। এই মুহূর্তে তিস্তার ভাঙন রোধ করা না গেলে অনেক মানুষের সহায় সম্বল নদীতে চলে যাবে। 
লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সুনীল কুমার জানান, জরুরি ভিত্তিতে যেসব এলাকার ভাঙন রোধ করা সম্ভব সেখানে বালুর বস্তা ও জিও ব্যাগ ফেলে তা রক্ষার চেষ্টা করা হচ্ছে। 
লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক এইচ এম রকিব হায়দার জানান, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা ও ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করা হচ্ছে। ভাঙনকবলিত পরিবারগুলোকে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে। আপাতত এসব পরিবারকে খাদ্য সামগ্রী সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।
রংপুর বিভাগে ‘আকস্মিক বন্যা’Ñ ইবিতে বিক্ষোভ : ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সংবাদদাতা জানান, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে গজলডোবা বাঁধ খুলে রংপুর বিভাগে ‘আকস্মিক বন্যা’ সৃষ্টির প্রতিবাদে বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে ইসলামী বিশ^বিদ্যালয়ে (ইবি)। মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টায় ক্যাম্পাসের প্রধান ফটক এলাকা থেকে বিক্ষোভ মিছিল শুরু হয়। মিছিলটি ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সড়ক ঘুরে প্রধান ফটকে সমাবেশে মিলিত হয়। এতে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সকল আন্তর্জাতিক নদীর ন্যায্য হিস্যা ও তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দাবি জানানো হয়। রংপুর বিভাগের সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে অনুষ্ঠিত এই কর্মসূচিতে বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা অংশ নেন।
সমাবেশে আল-কুরআন অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. জাকির হোসেন, জিওগ্রাফি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ইনজামুল হক, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ইবির সমন্বয়ক মুখলেসুর রহমান সুইটসহ অর্ধ-শতাধিক শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিলেন।
সমাবেশে শিক্ষার্থীদের হাতে ‘উত্তরবঙ্গের সঙ্গে বৈষম্য আর না আর না’, ‘উত্তরবঙ্গ বন্যায় ডুবে গেলে বাংলাদেশ অন্ধ হয়ে যাও কেন?’, ‘ত্রাণ নয়, স্থায়ী সমাধান চাই’, ‘উত্তরের কান্না চুপ কেন বাংলা’, ‘এত বৈষম্য কেন, উত্তরবঙ্গ কি বাংলাদেশের বাইরে’, ‘গজলডোবা বাঁধের ছলা, বন্যায় কেন ডুবে গলা’, ‘ভারতের আগ্রাসন কেন সহি?’ পানি বণ্টনে চাই জবাবদিহি’সহ বিভিন্ন লেখা সংবলিত প্ল্যাকার্ড দেখা যায়।

×