ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০২ অক্টোবর ২০২৪, ১৭ আশ্বিন ১৪৩১

অবরোধে মহাসড়কে তীব্র যানজট ॥ গুজব ছড়িয়ে আশুলিয়ায় সহিংসতা : শ্রম উপদেষ্টা

শ্রমিক আন্দোলনে ফের অশান্ত গার্মেন্টস শিল্পাঞ্চল

অর্থনৈতিক রিপোর্টার

প্রকাশিত: ২৩:২৮, ১ অক্টোবর ২০২৪

শ্রমিক আন্দোলনে ফের অশান্ত গার্মেন্টস শিল্পাঞ্চল

শ্রমিক আন্দোলনে ফের অশান্ত গার্মেন্টস শিল্পাঞ্চল

সাভার, আশুলিয়া ও গাজীপুরের অধিকাংশ পোশাক কারখানা খোলার পাশাপাশি চলছে শ্রমিকদের আন্দোলনও। এতে করে রপ্তানিমুখী গার্মেন্টস খাতে আবারও অস্থিরতা বিরাজ করছে। অশান্ত হয়ে পড়েছে শিল্পাঞ্চল। ইতোমধ্যে এ খাতের উদ্যোক্তারা শ্রমিক-মালিকপক্ষের নিরাপত্তা দাবি করেছেন সরকারের কাছে।

এদিকে শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া দাবি করেছেন, নারী শ্রমিককে ধর্ষণ করা হয়েছে এবং দুজন শ্রমিককে হত্যা করা হয়েছে গুজব ছড়িয়ে আশুলিয়ায় সহিংসতা ও গুলি করেছে ‘অনুপ্রবেশকারীরা’। তবে মঙ্গলবার বড় ধরনের কোনো সহিংসতা হয়নি পোশাক খাতে। বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কে রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ করায় তীব্র যানজট তৈরি হয়েছে বিভিন্ন জায়গায়। এতে করে দুর্ভোগ বেড়েছে সাধারণ মানুষের।
অপরদিকে বকেয়া বেতনসহ পাওনা আদায়ে নবীনগর-চন্দ্রা সড়ক অবরোধ করে রাখে বার্ডস গ্রুপের শ্রমিকরা। তারা বিক্ষোভ চালিয়েছেন। এতে নবীনগর থেক জিরানি এবং ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের নবীনগর থেকে বিপিএটিসি পর্যন্ত যানজট দেখা দেয়। দুই মহাসড়কে অবরোধের কারণে সাভারের প্রায় সব রাস্তায় যানজট তৈরি হওয়ায় দুর্ভোগে পড়ে সাধারণ মানুষ। মঙ্গলবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে এসে আশুলিয়ার ঘটনা নিয়ে কথা বলেন শ্রম উপদেষ্টা। এ সময় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীও উপস্থিত ছিলেন। 

শ্রম উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ বলেন, গুজব ছড়িয়ে সোমবার আশুলিয়ায় সহিংসতা ঘটানো হয়েছে। সেখানে বিক্ষোভরত শ্রমিকদের মধ্যে ঢুকে অনুপ্রবেশকারীরা গুলি চালিয়েছে। গুজব থেকেই সংঘর্ষের সূত্রপাত জানিয়ে তিনি বলেন, আন্দোলনকারীদের মধ্যে অবস্থান নেওয়া অনুপ্রবেশকারীরা গুলিও ছুড়েছে।
উল্লেখ্য, সোমবার বেলা ১১টার দিকে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের জিরাবো এলাকার ম-ল গ্রুপের কারখানার সামনে ওই সংঘর্ষের  ঘটনা ঘটে। ওই সময় টঙ্গাবাড়ি এলাকার ম্যাংগো টেক্স লিমিটেডের সুইং অপারেটর কাউসার হোসেন খান গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। এ ছাড়া গুলিবিদ্ধ ও আহত হন আরও কয়েকজন শ্রমিক। শ্রম উপদেষ্টা বলেন, পুরো ঘটনায় পরিকল্পিতভাবে শ্রমিকদের 
উস্কে দিয়ে রাস্তায় নামানো হয়েছে। এর পরই পরিস্থিতির অবনতি হয়। উসকানিদাতা এবং অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করার কাজ চলছে বলে জানান তিনি। আশুলিয়ায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সর্বোচ্চ ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে জানিয়ে শ্রম উপদেষ্টা বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সর্বোচ্চ ধৈর্যের পরিচয় দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া আছে। একইসঙ্গে শ্রমিক এবং মালিকদের মধ্যে মডারেটর হিসেবে কাজ করার জন্য বলা হয়েছে।

নিহত শ্রমিকের পরিবারকে ক্ষতিপূরণের টাকা দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়ে তিনি বলেন, আহত শ্রমিকদেরও সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে। মঙ্গলবারও বাইপাইল এলাকায় বেশ কিছু শ্রমিক বেতন ভাতার দাবিতে রাস্তায় নেমেছে। 
উপদেষ্টা বলেন, দুই তিনটি গার্মেন্টসের শ্রমিকরা বেতন না পেয়ে রাস্তায় নেমেছে। এসব গার্মেন্টসের মালিকরা এখন পলাতক রয়েছে। যেসব মালিক প্রতিশ্রুতি দিয়েও শ্রমিকদের দাবিদাওয়া বাস্তবায়েনের ব্যাপারে কাজ করছেন না, তাদের ব্যাপারে আগেও বলেছি আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কথা। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে মালিকপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হচ্ছে বলেও জানান শ্রম উপদেষ্টা।

এদিকে গাজীপুর শিল্প পুলিশের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সারোয়ার আলম বলেন, এপিএল অ্যাপারেলস লিমিটেড কারখানার মালিকের সোমবার শ্রমিকদের বেতন দেওয়ার কথা ছিল। বেতন না দেওয়ায় শ্রমিকরা সকাল থেকে বিক্ষোভ করছেন। তারা মহাসড়ক অবরোধ করেছেন। শ্রমিক ও মালিকপক্ষের সঙ্গে কথা বলে সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, মঙ্গলবার জেলার ৯টি কারখানা বন্ধ আছে। এর মধ্যে চারটি কারখানা শ্রম আইনের ১৩ (১) ধারায় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এ ছাড়া একটি কারখানা লে-অফ, একটি অস্থায়ী বন্ধ এবং তিনটি কারখানায় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে।

গাজীপুর মহানগরীর ভোগড়া ও কোনাবাড়ী এলাকায় দুটি কারখানার শ্রমিকরা মঙ্গলবার সকাল থেকে বিভিন্ন দাবিতে বিক্ষোভ করছেন। এ সময় তারা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক ও ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক অবরোধ করেছেন। এতে মহাসড়কের উভয় পাশে পাঁচ-ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। ফলে মহাসড়কে চলাচলকারী যাত্রী ও যানবাহনের চালকেরা ভোগান্তিতে পড়েন। 

পুলিশ ও শ্রমিক সূত্রে জানা গেছে, গাজীপুর মহানগরীর মোগরখাল এলাকায় এপিএল কারখানার শ্রমিকরা গত মাসের শুরুতে এই কারখানার বকেয়া বেতনের দাবিতে বিক্ষোভ করেন। তখন মালিকপক্ষ বেতন দিতে অপারগতার কথা জানিয়ে ৩০ সেপ্টেম্বর সোমবার বেতন পরিশোধ করার দিন নির্ধারণ করেন। পরে শ্রমিকেরা মালিকপক্ষের কথা মেনে নিয়ে আর আন্দোলন করেননি। তবে মঙ্গলবারও কারখানা কর্তৃপক্ষ বেতন দেয়নি। সকাল সাড়ে আটটার দিকে আবার শ্রমিকরা গাজীপুর মহানগরীর ভোগড়া মোড়ে মহাসড়ক অবরোধ করেন।

এসময়ে উত্তেজিত শ্রমিকরা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে ভোগড়া এলাকায় ঢাকা-ময়মনসিংহ ও ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে অবরোধ সৃষ্টি করলে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের উভয় দিকে পাঁচ থেকে ছয় কিলোমিটার যানজটের সৃষ্টি হয়েছে।
এছাড়া, ভোগড়া থেকে টাঙ্গাইলের দিকে অন্তত পাঁচ কিলোমিটার পর্যন্ত যানজট সৃষ্টি হয়েছে। এতে দুর্ভোগে পড়েছেন এ দুই মহাসড়কে চলাচলকারী হাজার হাজার মানুষ।
কারখানার শ্রমিক হামিদুল ইসলাম বলেন, কয়েক মাস ধরে কারখানা বন্ধ। কিন্তু বন্ধ হওয়ার আগে আমরা যে কাজ করেছি, সেই বেতন এখনও পরিশোধ করেনি কর্তৃপক্ষ। ৩০ সেপ্টেম্বর বেতন দেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু দেয়নি।

তাই বাধ্য হয়ে সড়কে নামতে হয়েছে। অন্যদিকে, গাজীপুর মহানগরীর কোনাবাড়ী এলাকার এম এম নিটওয়্যার লিমিটেড কারখানার শ্রমিকরা টিফিন বিল, নাইট বিল ও হাজিরা বোনাস বৃদ্ধির দাবিতে মঙ্গলবার সকাল থেকে কাজ বন্ধ করে কারখানার ভেতরে বিক্ষোভ করছেন।
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর গাজীপুর জেলা কার্যালয়ের তথ্যমতে, পুরো  জেলায় সব মিলিয়ে নিবন্ধিত কারখানা আছে দুই হাজার ৬৩৩টি। এর বাইরে অনিবন্ধিত কারখানা আছে ৪০০  থেকে ৫০০টি। এসব কারখানায় প্রায় ২২ লাখ শ্রমিক কাজ করেন। বিচ্ছিন্নভাবে ৯টি কারখানা ছাড়া, গাজীপুরের ৯৮ শতাংশ পোশাক কারখানায় উৎপাদন স্বাভাবিক আছে। পোশাক কারখানাগুলোয় কর্মীরা সকালে কাজে যোগ দিয়েছেন।
ঢাকা উত্তর ট্রাফিক পরিদর্শক (প্রশাসন) হোসেন শহীদ চৌধুরী বলেন, শ্রমিকরা নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়কে বাইপাইল এলাকায় অবরোধ করায় দীর্ঘ যানজট সৃষ্টি হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়ক দুটি বন্ধ থাকায় আশপাশের সড়কগুলোও স্থবির হয়ে পড়ে।
আশুলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু বকর সিদ্দিক বলেন, বার্ডস গ্রুপের শ্রমিকরা এখনো সড়ক অবরোধ করে রেখেছেন। তারা বলছেন, তাদের পাওনা পরিশোধ না করা হলে তারা অবরোধ প্রত্যাহার করবে না। মালিকপক্ষের সঙ্গে সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা যোগাযোগ করছেন।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড সোয়েটার শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের আইন বিষয়ক সম্পাদক খায়রুল মামুন মিন্টু বলেন, বার্ডস গ্রুপ তাদের কারখানা বন্ধ ঘোষণার পর বিষয়টি নিয়ে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরে বিজিএমইএ, শ্রমিকসহ সকল পক্ষের একটি বৈঠক হয়। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গ্রুপটির শ্রমিকদের যাবতীয় আইনগত পাওনা পরিশোধের কথা ছিল। কিন্তু তারা তা করেনি।

এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএর সিনিয়র সহ-সভাপতি আব্দুল্লাহ হিল রাকিব বলেন, বার্ডসের মালিকপক্ষকে সোমবারই শ্রমিকদের কাছে গিয়ে পাওনা পরিশোধ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তারা যাননি। বার্ডসের মালিক ইঞ্জিনিয়ার আনোয়ার অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি আছেন। বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড শিল্প শ্রমিক ফেডারেশনের গাজীপুর মহানগর সভাপতি শফিউল আলম বলেন, মালিকপক্ষ গত ১৪ আগস্ট কারখানাটি বন্ধ ঘোষণা করে। যাবতীয় পাওনা পরিশোধে ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা চুক্তি হয়।

চুক্তি মোতাবেক গত জুলাই মাসের বকেয়া বেতন পরিশোধের দিন নির্ধারিত ছিল ২৫ সেপ্টেম্বর। ওই তারিখে বেতন না দেওয়ায় শ্রমিকরা রাস্তা অবরোধ করেছে। এদিকে, সাভারের আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষের সময় নিহত  পোশাক শ্রমিক কাউসার হোসেন খানের পরিবারকে পাঁচ লাখ টাকা আর্থিক সহায়তা দিয়েছে বিজিএমইএ।

কাউসার টঙ্গাবাড়ি এলাকার ম্যাংগো টেক্স লিমিটেডের সুইং অপারেটর ছিলেন। এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বিজিএমইএ জানিয়েছে, আশুলিয়ায় সংঘর্ষে শ্রমিক নিহত হওয়ার ঘটনায় বিজিএমইএ এর গভীর দুঃখ প্রকাশ করছে। এ ছাড়া শ্রম আইন অনুযায়ী তার সকল পাওনা দ্রুত পরিশোধ করা হবে বলেও জানিয়েছে বিজিএমইএ।
আশুলিয়ায় মহাসড়কে ৩৩ ঘণ্টা অবরোধ :  স্টাফ রিপোর্টার, গাজীপুর ও নিজস্ব সংবাদদাতা সাভার থেকে জানান, শ্রমিকদের পাওনাদি পরিশোধ না করে টিএনজেড গ্রুপের অ্যাপারেলস প্লাস লিমিটেড পোশাক কারখানা বন্ধ করে দেওয়ায় গাজীপুরে ক্ষুব্ধ শ্রমিকরা মঙ্গলবারেও ফের বিক্ষোভ করছেন। তারা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রায় ১১ ঘণ্টা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে অবরোধ করে রাখেন।

এতে ওই মহাসড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। অবরোধের কারণে যানজটের প্রভাব পড়েছে ভোগড়া বাইপাস সড়ক ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক হয়ে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কসহ আশপাশের সড়কগুলোতেও। এতে দিনভর চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছে ওই সড়কে চলাচলকারীরা। 
এদিকে সাভারের আশুলিয়ায় ৩৩ ঘণ্টা মহাসড়ক অবরোধ করে রাখেন পোশাক শ্রমিকরা। এতে যাত্রীরা চরম ভোগান্তিতে পড়েন।
পুলিশ ও আন্দোলনরত শ্রমিকরা জানান, গাজীপুর মহানগরীর ভোগড়া এলাকার টিএনজেড গ্রুপের প্রতিষ্ঠান অ্যাপারেলস প্লাস লিমিটেড পোশাক কারখানার শ্রমিকরা গত জুলাই মাসের ১৬ তারিখ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটিতে কাজ করেন। মালিকপক্ষ ১৭ তারিখ বিনা নোটিসে কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে। পরদিন শ্রমিকরা কাজে যোগ দিতে এসে কারখানা বন্ধের নোটিস দেখতে পেয়ে ২৬ দিনের বকেয়া বেতন ভাতা পরিশোধ করাসহ বিভিন্ন দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করে।

একপর্যায়ে শ্রমিক বিক্ষোভের মুখে শ্রমিকদের জুন মাসের বকেয়া বেতন পরিশোধ করলেও জুলাই মাসের বেতন পরিশোধ করেনি কারখানা কর্তৃপক্ষ। পরে কলকারখানা অধিদপ্তরে মালিক, শ্রমিক ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে ২৫ সেপ্টেম্বর বকেয়া বেতন পরিশোধের তারিখ নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু এদিনও কারখানা কর্তৃপক্ষ বেতন পরিশোধ করেনি। সোমবার শ্রমিকরা বন্ধ কারখানার গেটে জড়ো হয়ে বেতন ভাতা পরিশোধের দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করে।

দিনভর কারখানার সামনে অপেক্ষার পর বকেয়া পাওনাদি না পেয়ে বিকেল ৫টার দিকে তারা কারখানার পার্শ্ববর্তী ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের ওপর অবস্থান নিয়ে অবরোধ করে বিক্ষোভ করতে থাকে। শ্রমিকরা রাত দেড়টা পর্যন্ত ওই মহাসড়ক অবরোধ করে রাখে। পরে মধ্যরাতে বৃষ্টির কারণে সড়ক অবরোধ স্থগিত করে চলে যায়। পরদিন মঙ্গলবার সকালে শ্রমিকরা পুনরায় কারখানার গেটে জড়ো হতে থাকে।

সকাল ৮টার দিকে তারা ফের ওই মহাসড়কের ওপর অবস্থান নিয়ে অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করে। এ সময় তাদের সঙ্গে আশপাশের আরও কয়েকটি কারখানার শ্রমিকরা আন্দোলনে যোগ দেয়। শ্রমিক অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় পার্শ্ববর্তী কয়েকটি কারখানা এদিন ছুটি ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। সড়কে অবরোধের কারণে ওই মহাসড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এতে যানজটের সৃষ্টি হয়ে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কসহ আশপাশের সড়কগুলোতেও দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়।

শিল্প পুলিশ, থানা পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা অবরোধকারীদের সড়কের ওপর থেকে দিনভর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। অবশেষে প্রায় ১১ ঘণ্টা পর সন্ধ্যা ৭টার দিকে বকেয়া পাওনাদি পরিশোধের ঘোষণা দিলে আন্দোলনরত শ্রমিকরা সড়ক অবরোধ প্রত্যাহার করে নেয় এবং যানবাহন চলাচল শুরু হয়।   
আন্দোলনরত শ্রমিকরা জানায়, মলিকপক্ষের ঘোষণা অনুযায়ী আমরা শান্তিপূর্ণভাবে বেতনের জন্য গতকাল সারাদিন অপেক্ষা করেছি। হঠাৎ করে কর্তৃপক্ষ বকেয়া বেতন পরিশোধ না করে কারখানা বন্ধ ঘোষণা করেছে। তাই আমরা আমাদের সমুদয় বকেয়া পাওনা পরিশোধের জন্য সড়ক অবরোধ করি। 
বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড শিল্প শ্রমিক ফেডারেশনের গাজীপুর মহানগর সভাপতি শফিউল আলম বলেন, মালিকপক্ষ কারখানাটি বন্ধ ঘোষণা করেন এবং যাবতীয় পাওনা পরিশোধে ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা চুক্তি হয়। চুক্তি মোতাবেক গত জুলাই মাসের বকেয়া বেতন পরিশোধের তারিখ ছিল ২৫ সেপ্টেম্বর। ওইদিন বেতন পরিশোধ না করায় শ্রমিকরা সড়ক অবরোধ করেছিল। পরে আবার ৩০ সেপ্টেম্বর বেতন পরিশোধের তারিখ দিয়ে পরিশোধ করেনি কারখানা কর্তৃপক্ষ।

গাজীপুর শিল্প পুলিশের পরিদর্শক হাবিল বলেন, ভোগড়ায় টিএনজেড গ্রুপের অ্যাপারেলস প্লাস লিমিটেড কারখানার শ্রমিকরা বকেয়া বেতন ভাতা পরিশোধের দাবিতে ভোগড়া এলাকায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে অবস্থান নিয়ে সড়ক অবরোধ করে রাখে। সন্ধ্যা ৭টার দিকে বেতন পরিশোধের ঘোষণা দিলে আন্দোলনকারীরা প্রায় ১১ ঘণ্টা পর অবরোধ প্রত্যাহার করে নিলে যানবাহন চলাচল শুরু করে।
অপরদিকে মহানগরের কোনাবাড়ী এলাকার এমএম নিটওয়্যার লিমিটেড কারখানার শ্রমিকরা টিফিন বিল, নাইট বিল এবং হাজিরা বোনাস বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন দাবিতে দুদিন ধরে বিক্ষোভ করছেন। মালিকপক্ষ তাদের সমাধান না দেওয়ায় সোমবারেও কাজ যোগ না দিয়ে বিক্ষোভ করেছে।
এদিকে মহানগরীর চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় ডিলাক্স ফ্যাশন লিমিটেড কারখানার শ্রমিকরা তিন মাসের বকেয়া বেতনের দাবিতে বিক্ষোভ করছেন। সকালে আন্দোলনরত শ্রমিকরা আশপাশের কয়েকটি কারখানায় গিয়ে শ্রমিকদের কাজ বন্ধ করে দেয়। এ সময় তারা কর্মরত শ্রমিকদের তাদের সঙ্গে আন্দোলনের যোগ দেওয়ার জন্য আহ্বান জানালে বিশৃঙ্খলা এড়াতে চান্দনা চৌরাস্তা এলাকার কয়েকটি কারখানা সোমবারের জন্য ছুটি ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ।
গাজীপুর শিল্প পুলিশ-২ এর পুলিশ সুপার (এসপি) সারোয়ার আলম বলেন, শ্রমিক ও মালিক পক্ষের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে। পুলিশ আন্দোলনকারী শ্রমিকদের বুঝিয়ে মহাসড়ক থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। সেনা সদস্যরাও ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে শ্রমিকদের বুঝানোর চেষ্টা করছেন। 
সাভার ॥ সাভারের আশুলিয়ায় বকেয়া বেতন ও বোনাসের দাবিতে ৩৩ ঘণ্টা ধরে মহাসড়ক অবরোধ করে রেখেছে একটি তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা।

এতে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে সাধারণ যাত্রীদের। মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়কের বাইপাইল এলাকায় অবরোধ করে রেখেছে শ্রমিকরা। এর আগে সোমবার সকাল ৯টা থেকে মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করে বার্ডস গ্রুপের শ্রমিকরা।
শ্রমিকরা জানায়, গত মাসের ২৮ তারিখ থেকে বার্ডস গ্রুপের সকল কারখানা লে-অফ করা হয়। শ্রমিক ও কর্মচারীদের বেতন সেপ্টেম্বর মাসের ১০ তারিখে এবং সার্ভিস বেনিফিটসহ ক্ষতিপূরণ গত ৩০ সেপ্টেম্বর দেওয়ার কথা ছিল। চুক্তিমত শ্রমিকদের বেতন কারখানা কর্তৃপক্ষ পরিশোধ করলেও যে সার্ভিস বেনিফিটসহ ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা ছিল তা পরিশোধ করতে আরো তিন মাসের সময় চেয়েছে কারখানা কর্তৃপক্ষ। যার কারণে মহাসড়ক অবরোধ করে রেখেছে তারা।

সরেজমিনে নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়কের বিভিন্ন পয়েন্ট ঘুরে দেখা গেছে, আশুলিয়ার জিরানী বাজার, কবিরপুর, বাড়ইপাড়া, চক্রবর্তী, শ্রীপুর সব স্থানেই যানবাহন ঢাকামুখী লেনে পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। অপরদিকে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক হয়ে নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়কের চন্দ্রামুখী লেন বাইপাইল পর্যন্ত বন্ধ রয়েছে। এদিকে সকাল থেকেই শিল্পাঞ্চলের অধিকাংশ কারখানা খুলা থাকায় শ্রমিকরা ভোগান্তি নিয়েই কর্মস্থলে যোগদান করেছে।

গণপরিবহন ও দূরপাল্লার যানবাহন চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ থাকলেও শুধু রিক্সা, অটোরিক্সা অপর লাইনে চলতে দেখা গেছে। সাধারণ যাত্রীরা জানান, এ রকম ভোগান্তিতে কখনো পড়েনি তারা। সময়মতো অফিসে পৌঁছাতে পারবে কি না, তাও জানা নেই। অনেক লোকজন হেঁটেও গন্তব্যস্থলে গিয়েছে বলে জানান। ২৪ ঘণ্টা ধরে রাস্তা বন্ধ, আর কত ভোগান্তি পোহাতে হবে কে জানে।
অন্যদিকে গতকাল দুপুরে আশুলিয়ায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিতে কাউসার হোসেন খাঁন নামের এক শ্রমিক নিহত হওয়ার প্রতিবাদে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের জাহাঙ্গীরনগরের ডেইরি গেট এলাকায় মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছে শিক্ষার্থীরা। মঙ্গলবার দুপুর একটা থেকে জাবি শাখা ছাত্র ইউনিয়নের শিক্ষার্থীরা মহাসড়ক অবরোধ করে এ বিক্ষোভ করেন। এ সময় মহাসড়কের উভয় পাশে তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়। তারা হত্যাকা-ের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে দোষীদের বিচারের দাবি জানান।
৩৬ জন গ্রেপ্তার : এদিকে গত সোমবার আশুলিয়ায় যৌথ বাহিনীর ওপর হামলা, গাড়ি ভাঙচুর, সরকারি কাজে বাধা ও কারখানায় অনুপ্রবেশ করে লুটপাটের অভিযোগে ৩৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। মঙ্গলবার তাদের আদালতে প্রেরণ করা হয়েছে। শিল্পপুলিশ-১ এর এসআই রাশেদ মিয়া বাদী হয়ে অজ্ঞাত ১ হাজার ২০০ জনকে আসামি করে এ মামলা দায়ের করেছেন। 
পুলিশ জানায়, সোমবার আশুলিয়ার জিরাবো এলাকায় ম-ল নিটওয়্যার গার্মেন্টস লিমিটেড কারখানায় একটি ত্রিপক্ষীয় বৈঠক হয়। এ সময় শ্রমিকরা দুই শ্রমিককে গুম ও দুজনকে ধর্ষণের গুজব ছড়িয়ে অসন্তোষ সৃষ্টি করে। গুম ও ধর্ষণের গুজবের খবরে পাশের ন্যাচারাল ডেনিমস ও ন্যাচারাল ইন্ডিগো লিমিটেড কারখানার শ্রমিকরা অযৌক্তিক বিভিন্ন দাবিতে ফ্যাক্টরিতে কাজ বন্ধ করে কর্মবিরতি পালন করে।

পরে কর্তৃপক্ষ দুটি কারখানায় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করলে সব শ্রমিক একযোগে বের হয়ে আসে। উল্লেখ্য, সোমবার আশুলিয়ায় জিরাবোর টঙ্গাবাড়ি এলাকায় শ্রমিক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষে কাউসার হোসেন খাঁন নামে এক শ্রমিক গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। এ ঘটনায় আরও ছয় শ্রমিক গুলিবিদ্ধসহ অন্তত ৩০ জন আহত হয়েছেন। 
ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ : জাবি সংবাদদাতা জানান, আশুলিয়ায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে এক শ্রমিক নিহতের প্রতিবাদে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী। মঙ্গলবার দুপুর ১টা ১৪ মিনিটে বিশ^বিদ্যালয়ের প্রধান ফটক সংলগ্ন ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে অবরোধ শুরু করেন তারা। পরে দুপুর ২টায় তা শেষ হয়। এ সময় সড়কের উভয় লেনে যানজটের সৃষ্টি হয়। তবে অ্যাম্বুলেন্সসহ জরুরি পরিষেবার যান চলাচল স্বাভাবিক ছিল। এ ছাড়া সন্ধ্যা ৬টায় বিশ^বিদ্যালয়ের শহীদ মিনারে একই প্রতিবাদে মানববন্ধন করেছে আরেক দল শিক্ষার্থী।
অবরোধ চলাকালে ‘শ্রমিক হত্যা কেন, ড. ইউনুস জবাব চাই’, ‘রাস্তায় শ্রমিক মরে, ইউনূস কি করে’, ‘পোশাক শ্রমিক রাস্তায় মরে, ইউনূস কি করে’, ‘ছাত্র-শ্রমিক জনতা, গড়ে তোলো একতা’ ইত্যাদি স্লোগান দিতে দেখা যায়।
এ সময় ছাত্র ইউনিয়ন বিশ^বিদ্যালয় সংসদের একাংশের সাধারণ সম্পাদক ঋদ্ধ অনিন্দ্য গাঙ্গুলি বলেন, ‘আমরা যে অভ্যুত্থানটি ঘটিয়েছি সেটা ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান। এই অভ্যুত্থানে ছাত্রদের যতখানি ঠিক ততখানি অংশগ্রহণ ছিল শ্রমিকদের। কখনো কখনো শ্রমিকরা অগ্রভাগে ছিলেন এবং জীবন দিয়েছেন।

গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে নতুন সরকারের হাতে, রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে আন্দোলনরত পোশাক শ্রমিকরা খুন হচ্ছে সেটি আমাদের জন্য অত্যন্ত ক্ষোভের।’
এদিকে সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত মানববন্ধনে ছাত্র ইউনিয়ন বিশ^বিদ্যালয় সংসদের অপরাংশের সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম ইমনের সঞ্চালনায় নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থী সোহাগী সামিয়া বলেন, ‘গণঅভ্যুত্থানে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি জীবন দিয়েছে শ্রমিক শ্রেণি। সেই শ্রমিক শ্রেণি এখন পর্যন্ত যথাযথ চিকিৎসা পায়নি। তাদের এখনো আগের মতো বকেয়া বেতনের দাবিতে আন্দোলন করতে হয়। এই আন্দোলন করতে গিয়ে গুলি খেতে হয়। শ্রমিকের যথাযথ অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায় এর ফল ভালো হবে না।’

×