ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০১ অক্টোবর ২০২৪, ১৫ আশ্বিন ১৪৩১

বসতভিটা,শতশত বিঘা ফসলি জমি বিলীন

বন্যার পানি কমার সঙ্গে বাড়ছে নদী ভাঙনের ব্যাপকতা

​​​​​​​জনকণ্ঠ ডেস্ক

প্রকাশিত: ২২:৩৫, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৪

বন্যার পানি কমার সঙ্গে বাড়ছে  নদী ভাঙনের ব্যাপকতা

.

টানা বর্ষণে উত্তরাঞ্চলে সৃষ্ট বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে। রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জ টাঙ্গাইলে পরিস্থিতির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ফুটে উঠছে বন্যার ক্ষত। এসব অঞ্চলের নদীপাড়ের মানুষ এখন ভাঙন আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন। খবর স্টাফ রিপোর্টার, নিজস্ব সংবাদদাতা সংবাদদাতার।  

পানি কমতে শুরু করায় নদীভাঙন আতঙ্কে এখন তিস্তাপাড়ের মানুষ। বিশেষ করে তিস্তা, ঘাঘট, যমুনেশ্বরী, করতোয়া, ধরলা, দুধকুমার ব্রহ্মপুত্রসহ অসংখ্য নদ-নদী বিধৌত রংপুর অঞ্চলের পাঁচ জেলার নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। কোথাও কোথাও তিস্তার পানি বিপৎসীমা উপচে নদী তীরবর্তী চরাঞ্চলে ঢুকে পড়েছে। স্বল্প মেয়াদি বন্যার সঙ্গে দেখা দিয়েছে ভাঙনের আশঙ্কা। আমন ধান শীতকালীন শাক-সবজির ক্ষেতসহ ডুবেছে বিভিন্ন ফসলি জমি। প্রভাব পড়েছে গ্রামীণ যোগাযোগ ব্যবস্থার পাশাপাশি রেলপথেও।

রংপুর বিভাগের তিস্তা নদীর পানি সমতল হ্রাস পাচ্ছে, দুধকুমার নদীর পানি সমতল স্থিতিশীল আছে, অপরদিকে ধরলা নদীর পানি সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে। তিস্তা নদীর পানি সমতল রংপুর জেলার কাউনিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অপরদিকে ধরলা দুধকুমার নদীসমূহের পানি সমতল বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

জানা গেছে, তিস্তাবেষ্টিত গঙ্গাচড়া উপজেলার লক্ষ্মীটারি, কোলকোন্দ, গজঘণ্টা, আলমবিদির, নোহালী, কাউনিয়া উপজেলার বালাপাড়া, মধুপুর, হারাগাছ, ঢুসমারা, শহীদবাগের গান্নার চর, পীরগাছা উপজেলার ছাওলা পাওটানার প্রায় ১০ টি গ্রামের হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এসব  তিস্তা নদী সংলগ্ন এলাকার বিভিন্ন জায়গায় গ্রামীণ রাস্তাঘাট তলিয়ে গেছে।

বন্যার আতঙ্কে নদী তীরবর্তী নি¤œাঞ্চলের মানুষের নির্ঘুম রাত কেটেছে। এমন আকস্মিক বন্যায় চরম দুর্ভোগে পড়ছে বানভাসিরা। নিয়ে অষ্টমবারের মতো বন্যার কবলে পড়ল তিস্তাপাড়ের মানুষ। টেপামধুপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান রাশেদুল ইসলাম জানান, চরগনাই গ্রামে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে অনেকের ঘরবাড়ি। অনেক পরিবার ভাঙন ঝুঁকিতে রয়েছে, যে কোনো সময় সেগুলোও নদীতে তলিয়ে যেতে পারে। এছাড়াও উঠতি ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সোমবার ভাঙনকবলিত এলাকায় কাউনিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. মহিদুল হক, জেলা ত্রাণ কর্মকর্তা মোতাহার হোসেন, প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. আহসান হাবীব সরকারসহ স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানরা পরিদর্শন করেছেন। পানি উন্নয়ন বোর্ড রংপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম জানান, তিস্তার কাউনিয়া পয়েন্টে পানি কমলেও বিপৎসীমার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহ হচ্ছে। তিস্তা সংলগ্ন নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। বিষয়গুলো নিয়ে সবসময় মনিটরিং করা হচ্ছে। যাতে রাস্তাঘাট, ব্রিজ ভেঙে না যায় সেই বিষয়টি মাথায় রেখে কাজ করা হচ্ছে।

নীলফামারী : তিস্তার পানি সোমবার বিপৎসীমা থেকে নিচে নামলেও বন্যা প্লাবিত এলাকার পানি এখনো পুরোপুরি নেমে যায়নি। তবে ধীরে ধীরে পানি নামলেও বানভাসি পরিবারগুলো চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। রান্না করে খাওয়ার মতো  পরিস্থিতি এখনো তৈরি হয়নি। সরকারিভাবে চাল শুকনা খাবার বিতরণ করতে দেখা গেছে। পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে নদীভাঙন শুরু হয়েছে। ধরলায় তীব্র ভাঙন চলছে। বড় বড় স্থাপনা অর্ধশতাধিক বসতঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। বন্যার পানিতে আমন ক্ষেত জেগে উঠলেও শাক-সবজির ব্যাপক ক্ষতির শঙ্কা করা হচ্ছে।

নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার পূর্বছাতনাই, খগাখড়িবাড়ি, টেপাখড়িবাড়ি, খালিশাচাঁপানী, ঝুনাগাছ চাঁপানী ইউনিয়ন ৫টির প্রায় ১৫ হাজার মানুষজন বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ডিমলা উপজেলার পিআইও মেজবাউর রহমান জানান, সোমবার ইউনিয়নে ৩০ মেট্রিক চাল, হাজার ৫৮০ প্যাকেট শুকনা খাবার বিতরণ করা হয়।  পূর্বছাতনাই ইউনিয়নের ঝাড়শিংহেশ্বর চর এলাকার ওসমান গনি বলেন, প্রায় দেড় হাজার পরিবারের বসতবাড়ি তলিয়ে যায় বানের পানিতে। এখন পানি কমছে। আমন ধানক্ষেত রক্ষা পেলেও বাদামসহ অন্যান্য শাক-সবজি নষ্ট হয়েছে।

কুড়িগ্রাম : উজানের ঢল টানা বৃষ্টিতে ধরলা, তিস্তা ব্রহ্মপুত্র, দুধকুমার নদ-নদীর পানি সামান্য বেড়ে আবার কমতে শুরু করেছে। তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমার সে. মি নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে, প্রবল ¯্রােতে তিস্তার বিভিন্ন এলাকায় ভাঙন শুরু হয়েছে। এতে দুর্ভোগে পড়েছেন ওই জনপদের মানুষ। ঘরবাড়ি, জমিজমা নদীগর্ভে তলিয়ে যাচ্ছে। কুড়িগ্রাম  জেলা পানি উন্নয়ন  বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, জেলার তিস্তা নদীর কাউনিয়া পয়েন্টে পানি কমে বিপৎসীমার   সে.মি. নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অন্য নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী কর্মকর্ত জানান, তিস্তা নদীর পানি কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভাঙন চলছে। ভাঙন রোধে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।

লালমনিরহাট : বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও বেড়েছে দুর্ভোগ। টানা কয়েকদিনের বৃষ্টি আর উজান থেকে আসা পানিতে তিস্তা নদীতে পানি বেড়ে যাওয়ায় বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এতে লালমনিরহাটের পাঁচ উপজেলার ২১টি ইউনিয়নে ২৫ হাজারের বেশি মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ে। রবিবার রাত ১১টার পর থেকে তিস্তা নদীর পানি কমতে শুরু করায় বন্যার ক্ষতি দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। নদীপাড়ের অধিকাংশ বাড়ি থেকে পানি নেমে গেছে। বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটলেও বেড়েছে দুর্ভোগ। বন্যার পানির স্রোতে ভেসে গেছে ঘরবাড়ির বিভিন্ন জিনিসপত্র।

টানা দুই-তিন দিনের বন্যায় নদী তীরবর্তী কিছু এলাকার বেশকিছু রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট ভেঙে গেছে। উঠতি আমন ধান বিভিন্ন সবজি ক্ষেত ডুবে আছে বন্যার পানিতে। দীর্ঘ সময় ডুবে থাকায় এসব ফসলের ক্ষতির আশঙ্কা করছেন চাষিরা। একই সঙ্গে বন্যার পানিতে ভেসে গেছে বেশ কিছু পুকুরের মাছ। 

লালমনিরহাট  কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সাইখুল আরিফিন জানান, তিস্তাপাড়ে বন্যায় আগাম শীতকালীন শাক-সবজির অনেক ক্ষেত পানিতে তলিয়ে গেছে। দ্রুত পানি নেমে না গেলে এসব ফসলের বেশ ক্ষতি হবে। জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সুনীল কুমার জানান, তিস্তাপাড়ে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। বন্যাকবলিত এলাকা থেকে পানি নামতে শুরু করেছে। মঙ্গলবারের মধ্যে বন্যা পরিস্থিতির সার্বিক উন্নতি হতে পারে। নদীর পানি কমতে শুরু করায় ভাঙনের আশঙ্কা করা হচ্ছে।

লালমরিহাট জেলা প্রশাসক এইচ এম রকিব হায়দার বলেন, বন্যা কবলিত এলাকা থেকে পানি নেমে যাচ্ছে। তিস্তাপাড়ে পানিবন্দি পরিবারের মাঝে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ১৩ লাখ টাকা ৯০ মেট্রিক টন জিআর চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। যা সংশ্লিষ্ট উপজেলা প্রশাসন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বন্যার্তদের মাঝে বিতরণ শুরু করেছেন।

সিরাজগঞ্জসিরাজগঞ্জে যমুনায় পানি বাড়ছে। সেই সঙ্গে ভাঙনও দেখা দিয়েছে। যমুনার ভাঙনে নদীপাড়ের মানুষ দিশেহারা। ভাঙনের কবলে জমি-জিরাত, বসতবাড়ি হারিয়ে বহু পরিবার নিঃস্ব হয়ে পড়েছে।  যমুনা নদী ভাঙছে উজানে এবং ভাটিতে। জিও ব্যাগে বালির বস্তা ফেলা ছাড়া কোনো পদক্ষেপ নেই পানি উন্নয়ন বিভাগ। প্রকল্প  তৈরি করে শুকনো মৌসুমে কাজ করার প্রতিশ্রুতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ সংশ্লিষ্ট বিভাগের।

সিরাজগঞ্জের উজানে যমুনা নদী ভাঙছে সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার পারপাচিল, হাটপাচিলসহ আশপাশে এলাকায়। সিরাজগঞ্জের ভাটিতে এনায়েতপুর থেকে শাহজাদপুরের কৈজুরি পর্যন্ত ভাঙ্গন বিস্তৃতি লাভ করেছে।

ইতোমধ্যে নদীভাঙনে অনেক মানুষের বাড়িঘর, বসতভিটা শত শত বিঘা ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। যার কারণে অনেকেই নিঃস্ব হয়ে গেছেন। এছাড়া ভাঙনের কবলে রয়েছে আরও শত শত বিঘা ফসলি জমি, বাড়িঘর, হাটবাজার, বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি  স্থাপনা। ভাঙনকবলিত মানুষের অভিযোগ, পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা আর ঠিকাদারদের গাফিলতিতে বাস্তবায়ন হচ্ছে না প্রকল্পটি। যার কারণে নদীতীর সংরক্ষণ বাঁধের নির্মাণকাজও সহজে শেষ হচ্ছে না, ভাঙন থেকে বসতবাড়ি আবাদি জমি রক্ষা করা যাচ্ছে না। ফলে, প্রতিনিয়ত নদীভাঙনের শিকার হতে হচ্ছে যমুনা নদীর তীরবর্তী মানুষকে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোখলেছুর রহমান জানান, নদীর ডানতীর রক্ষা প্রকল্পের কাজ প্রায় ৫২ ভাগ শেষ হয়েছে। আপাতত জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙন রোধের চেষ্টা চলছে। বর্ষা মৌসুম শেষ হলে আগামী ২৫ সালের জুন মাসের মধ্যে প্রকল্পের কাজ পুরোপুরি শেষ হবে। এখন ভাঙনের তীব্রতা কমে এসেছে। সেখানে নদীতীর সংরক্ষণ বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের কাজ চলমান। মোট ১৭টি প্যাকেজের মধ্যে সাতটি প্যাকেজের কাজ শুরু হয়েছে। নির্ধারিত সময়েই বাকি কাজ শেষ করা হবে। সাড়ে ৬০০ কোটি টাকার মধ্যে সাড়ে ৩০০ কোটি টাকা আগামী জুন পর্যন্ত বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

টাঙ্গাইল : উত্তরের নেমে আসা ঢলে টাঙ্গাইলের সব নদীর পানি দিন দিন বাড়লেও বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি বাড়লেও জেলায় বন্যার আশঙ্কা নেই বলে জানিয়েছে টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের দেওয়া তথ্যমতে, গত বুধবার থেকে সোমবার পর্যন্ত জেলার নদীগুলোর পানি প্রতিদিন বাড়ছে। পানি বৃদ্ধির কারণে কোনো কোনো নদীতীরে ভাঙন দেখা দিয়েছে।

টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ডেও (টাপাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী সাজ্জাত হোসেন জানান, জেলার সব নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেলেও বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। উত্তরের ঢল সাধারণত ক্ষণস্থায়ী হয়ে থাকে, তাই পানি বৃদ্ধি পেলেও বন্যার আশঙ্কা নেই। নদীর পানি বৃদ্ধির বিষয়টি প্রতিমুহূর্ত পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। জেলার কোনো স্থানে নদী ভাঙন দেখা দিলে তারা জরুরি সেবা হিসেবে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

×