ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৫ আশ্বিন ১৪৩১

অমূল্য প্রত্নসম্পদ

বারোবাজারে সুলতানী আমলের ১৯ মসজিদ

সাজেদ রহমান

প্রকাশিত: ২২:৫৮, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

বারোবাজারে সুলতানী আমলের ১৯ মসজিদ

যশোরের বারোবাজারের প্রাচীন গোড়ার মসজিদ

বারোবাজার বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতœস্থল। প্রতœস্থলটি সুলতানী আমলের ধ্বংসপ্রাপ্ত ও প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শনের জন্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বিশেষ করে এখানে সুলতানী আমলের প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত অবস্থায় বেশকিছু ঢিবি ও স্থাপত্যিক নিদর্শন এখনো বিদ্যমান। প্রতœস্থলটি যশোর জেলা শহর থেকে ১৬ কিলোমিটার উত্তরে এবং কালীগঞ্জ বাজার থেকে ১২ কিলোমিটার দক্ষিণে ভৈরব নদীর উত্তর তীরে অবস্থিত। খুলনা-পার্বতীপুর রেল সড়ক এবং যশোর-ঝিনাইদহ প্রধান সড়ক সমান্তরালভাবে বারোবাজারের মধ্যে দিয়ে প্রসারিত। বর্তমানে বারোবাজার একটি সমৃদ্ধ বাণিজ্য কেন্দ্র।
বারোবাজার এবং এর চারপাশে ৩ থেকে ৪ কিমি ব্যাসার্ধের মধ্যে প্রচুর দীঘি এবং সাংস্কৃতিক ঢিবি রয়েছে। ধ্বংসাবশেষগুলোর মধ্যে কেবল বেলাট দৌলতপুর গ্রামে অবস্থিত গোড়ার মসজিদ দুর্বল অবস্থায় টিকে ছিল। প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তর এই এলাকা অনুসন্ধান করে এবং ১৪টি ঢিবি আবিষ্কার করে। কিন্তু ১৯৮৯ সালে কেবল গোড়ার মসজিদ এবং সাতগাছিয়া গায়েবানা মসজিদ ছাড়া অন্য প্রতœস্থলগুলো সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। শেষোক্ত প্রতœস্থলটি স্থানীয় জনগণ আংশিক উন্মোচন করে নামাজ পড়ার উপযুক্ত করে তোলে।

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ১৯৮৯-এ সাতগাছিয়া প্রতœস্থলের অবশিষ্ট অংশে খনন করে ৩৫ গম্বুজ বিশিষ্ট একটি মসজিদের ধ্বংসাবশেষ উন্মোচন করে। ১৯৯২-৯৩ সালে এলাকাটি পুনরায় জরিপ করে তা সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। ওই বছর জোড়বাংলা, গলাকাটা ও খড়ের দীঘিতে খননকাজ শুরু করা হয়। প্রায় এক দশক খননকার্যের ফলে প্রতœস্থলে ১৪টি স্থাপত্যিক কাঠামো ও অনেক হস্তান্তরযোগ্য প্রতœবস্তু আবিষ্কার হয়। এগুলো হলো মসজিদ, সমাধিক্ষেত্র, কবরস্থান, বন্দর, লৌকিক ভবন প্রভৃতি। সাংস্কৃতিক বস্তুর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো উৎকীর্ণ লিপি, অলঙ্কৃত ইট, মৃৎপাত্র, পোড়ামাটির ফলক, গুটিকা এবং মৃৎপাত্রের ভাঙা টুকরা।

জোড়বাংলা মসজিদ বেলাট দৌলতপুর গ্রামে জোড়বাংলা ঢিবিটির অবস্থান। প্রতœস্থলটি খননের ফলে সুলতানী আমলের এক গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদের ধ্বংসাবশেষ উন্মোচিত হয়। বর্গাকার মসজিদটির দেওয়ালগুলো ১.৪২ মি. প্রশস্ত। মসজিদের চারকোণে চারটি অষ্টকোণাকার বুরুজ রয়েছে। পশ্চিম দেওয়ালে আছে তিনটি মিহরাব। বহুভাঁজ বিশিষ্ট খিলানযুক্ত মিহরাবগুলো ফুলেল এবং জ্যামিতিক নকশা দ্বারা চমৎকারভাবে সুসজ্জিত। পশ্চিম দেওয়ালের সমান্তরালে পূর্ব দেওয়ালেও তিনটি খিলানযুক্ত প্রবেশপথ রয়েছে।

প্রতিটি পার্শ্ব দেওয়ালে জানালার পরিবর্তে বড় কুলুঙ্গির সুস্পষ্ট নিদর্শন ছিল। প্রার্থনা কক্ষের চারদিকের বারান্দা এবং দক্ষিণ বারান্দায় ৫টি কবর ছিল। বারান্দার মূল মেঝে কেটে পরবর্তী যুগে এখানে মৃতদেহ সমাধিস্থ করা হতো। সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ প্রাপ্ত প্রতœবস্তুর মধ্যে ছিল আরবি লিপি সংবলিত কয়েকটি টুকরা ইট। এ পর্যন্ত সাতটি টুকরা উদ্ধার করা হয়েছে। তারমধ্যে একটি পূর্ণাঙ্গ অবয়ব পাওয়া গিয়েছে, অন্যগুলো ভগ্নাবস্থায়। সবগুলো পাওয়া না যাওয়ায় এর সম্পূর্ণ পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। অসম্পূর্ণ লিপির পাঠোদ্ধারে মসজিদের নির্মাণ সংক্রান্ত একটি হাদিস সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। মসজিদটি সুলতান হোসেন শাহের পুত্র সুলতান গিয়াস উদ্দীন মাহমুদ শাহ এর সময়ে নির্মিত হয়।
গলাকাটা ঢিবি জোড়বাংলা ঢিবির প্রায় ১০০ মিটার পূর্ব, উত্তর-পূর্বদিকে অবস্থিত। ঢিবির দক্ষিণে বারোবাজার-হাকিমপুর পাকা সড়ক এবং উত্তরে এই এলাকার সর্ববৃহৎ গলাকাটা দীঘিটির অবস্থান। ১৯৯৩ সালে প্রতœস্থল খননের ফলে এখানে একটি মসজিদের ধ্বংসাবশেষ উন্মোচিত হয়। মসজিদটির ৪ কোণ অষ্টভুজাকার বুরুজ দ্বারা সুশোভিত যেগুলো সুষম ব্যবধানে আনুভূমিক বন্ধনী ও ছাঁচে তৈরি অফসেট দ্বারা সুসজ্জিত। মসজিদের পশ্চিম দেওয়ালে তিনটি মিহরাব রয়েছে। মিহরাবগুলো অলঙ্কৃত ইট দ্বারা সুসজ্জিত। মসজিদের উত্তর ও দক্ষিণ দেওয়ালের প্রতিটিতে দুইটি করে জালিবিশিষ্ট জানালা আছে। 
পীর পুকুর মসজিদ পীরপুকুর প্রতœস্থলের পশ্চিমে এর অবস্থান। ১৯৯৪ সালে খননের ফলে এ স্থানে ১৫ গম্বুজ বিশিষ্ট একটি মসজিদের ধ্বংসাবশেষ উন্মোচিত হয়। গম্বুজগুলোর সবই ধ্বংসপ্রাপ্ত। শুধুমাত্র মসজিদের দেওয়ালগুলো নির্দিষ্ট উচ্চতা পর্যন্ত টিকে আছে। মসজিদটির চার কোণে অলঙ্কৃত অষ্টভুজ কৌণিক বুরুজ সুষম ব্যবধানে আনুভূমিক বন্ধনী দ্বারা সজ্জিত ছিল।
নুনগোলা মসজিদ বারোবাজার ইউনিয়নের হাসিলবাগ গ্রামে পীরপুকুর মসজিদ থেকে প্রায় ২০০ মিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত। ঢিবির পূর্বদিকে নুনগোলা দীঘি নামে পরিচিত একটি বড় আয়তাকার পুকুর আছে। ১৯৯৪ সালে খননের ফলে এখানে এক গম্বুজ বিশিষ্ট একটি বর্গাকার মসজিদ উন্মোচিত হয়। মসজিদের প্রতি বাহু অভ্যন্তরভাগে ৬.৮০ এবং বহির্ভাগে ৯.১৮ মিটার দীর্ঘ।
পাঠাগার মসজিদ মিঠাপুকুর মৌজায় একটি ছোট ও অনুচ্চ ঢিবি। ১৯৯৫ সালে খননের ফলে একটি বর্গাকার মসজিদের ধ্বংসাবশেষ উন্মোচিত হয়। মসজিদের দেওয়াল ১.৩৮ মিটার পুরু। মসজিদটির ওপরের অংশ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। শুকুর মল্লিক মসজিদ প্রতœস্থলটি হাসিলবাগ মৌজায় অবস্থিত। এটি বারোবাজার থেকে ৩০০ মিটার দক্ষিণে। ১৯৯৬ সালের খননে এক গম্বুজ বিশিষ্ট একটি বর্গাকার মসজিদের ধ্বংসাবশেষ উন্মুক্ত হয়েছে। এর দেওয়াল ১.২২ মিটার পুরু।

গম্বুজ বিলুপ্ত এবং দেওয়াল নির্দিষ্ট উচ্চতা পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল। এর ৪টি অষ্টভুজ কৌণিক মিনার নির্দিষ্ট উচ্চতা পর্যন্ত টিকে আছে। ভবনটির পূর্বদিকে একটি প্রবেশপথ। কিবলা দেওয়ালে একটি অর্ধাবৃত্তাকার মিহরাব এবং এর উভয়পাশে একটি করে বন্ধ মিহরাব আছে।
ঘোপের ঢিবি বারোবাজার মৌজার গোবিনাথপুর গ্রামে ভৈরব নদীর ডান তীরে ছোট ও অনুচ্চ ঢিবিটির অবস্থান। ১৯৯৫ সালের সংক্ষিপ্ত খননে এখানে একটি কবরস্থানের ধ্বংসাবশেষ উন্মোচিত হয়েছে।
সাতগাছিয়া গায়েবানা মসজিদ বারোবাজার থেকে ৬ কিলোমিটার পশ্চিমে এবং বারোবাজার-হাকিমপুর সড়ক থেকে ২০০ মিটার উত্তরে সাতগাছিয়া গ্রামে প্রতœস্থলটি অবস্থিত। প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তর ১৯৯০ সালে এ স্থান খনন করে ৩৫ গম্বুজ বিশিষ্ট একটি আয়তাকার মসজিদের ধংসাবশেষ উন্মোচন করে। 
জাহাজঘাটা প্রতœস্থলটি ভৈরব নদীর উত্তর তীরে হাসিলবাগ গ্রামে অবস্থিত। ১৯৯৭ সালে খননের ফলে এখানে একটি চতুর্ভুজাকার কাঠামোর ধ্বংসাবশেষ উন্মোচিত হয়েছে। এই কাঠামোর ধ্বংসাবশেষ ছাড়া কোনো গুরুত্বপূর্ণ প্রতœবস্তু উদ্ধার হয়নি। কিন্তু নদী তীরের খুব কাছেই এই কাঠামোর অস্তিত্ব, কাঠামোর প্রকৃতি এবং উপাখ্যান থেকে ধারণা করা যায় যে এটি হয়তো মুহাম্মাবাদ শহরের একটি বন্দর ছিল।

নামাজগাঁও  প্রতœস্থলটি গলাকাটা মসজিদ থেকে ১ কিলোমিটার উত্তরে বেলাট দৌলতপুর গ্রামে অবস্থিত। এটি একটি আয়তাকার ঢিবি ছিল। এর সর্বোচ্চ শীর্ষ পার্শ্ববর্তী জমি থেকে ২ মিটার উঁচু ছিল। ঢিবিটির পূর্বদিকে গ্রামবাসীরা একটি ঈদগাহ তৈরি করে। ফলে স্থানটি নামাজগাঁও নামে পরিচিত হয়।
১৯৯৭ সালের খননে এখানে ৭টি ইট নির্মিত কবরসহ একটি সমাধিক্ষেত্রের ধ্বংসাবশেষ উন্মুক্ত হয়। ২০০১ সালের খননে বেশ জায়গা জুড়ে বিস্তৃত একটি সমাধিক্ষেত্রের ধ্বংসাবশেষও উন্মোচিত হয়েছে। এতে ১৬টি ইট নির্মিত কবর, ১টি কাঁচা কবর ও ১টি ইট বিছানো উন্মুক্ত অঙ্গন রয়েছে। ইটের তৈরি কবরগুলো দুই ধরনের- ধনুকাকৃতির ছাদ বিশিষ্ট ও করবেল ছাদ বিশিষ্ট। প্রথম প্রকার কবর ১১টি ও দ্বিতীয় প্রকার কবর ৫টি।
গোড়ার মসজিদ বেলাট দৌলতপুর মৌজায় অবস্থিত। বারান্দাসহ মসজিদটি বারোবাজারের একমাত্র টিকে থাকা প্রতœচিহ্ন ছিল। গম্বুজসহ মূল প্রার্থনা কক্ষটিও টিকে ছিল। কিন্তু তিনটি ছোট গম্বুজসহ বারান্দাটি সম্পূর্ণরূপে ধসে পড়ে যা পরবর্তীতে প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তর পুনর্গঠন করে। প্রার্থনা কক্ষ বা নামাজ ঘরের সঙ্গে সংযুক্ত কৌণিক মিনারগুলো অষ্টভুজাকার কিন্তু বারান্দার সঙ্গে সংযুক্ত ২টি মিনার প্রতি বাহুতে কৌণিক উদগত অংশসহ বর্গাকার।

এ ধরনের মিনার সাতক্ষীরার কালীগঞ্জের প্রবাজপুর মসজিদে এবং ফরিদপুরের পাতরাইলের মসজিদ আউলিয়া মসজিদে দেখতে পাওয়া যায়। মসজিদের পূর্বদিকে তিনটি এবং উত্তর ও দক্ষিণদিকে দুইটি খিলানযুক্ত প্রবেশ পথ আছে। কেন্দ্রীয় প্রবেশপথটি বড়। মসজিদের চার দেওয়ালে আছে আটটি সংযুক্ত স্তম্ভ। তার মধ্যে ৪টি পাথরের ও অবশিষ্ট ৪টি ইটের স্তম্ভ। কিবলা দেওয়ালে আছে পর্যাপ্ত অলঙ্করণ সমৃদ্ধ ৩টি অর্ধবৃত্তাকার মিহরাব।

কেন্দ্রীয় মিহরাবটি বড়। মিহরাবগুলোর উভয়পাশে দুইটি ছোট স্তম্ভ আছে এবং এদের শীর্ষদেশ বহু খাঁজ বিশিষ্ট। প্রতিটি মিহরাব পরস্পর গ্রথিত পোড়ামাটির অলঙ্করণ সমৃদ্ধ। আবর্তগুলোতে আছে ফুল ও লতাপাতার নকশা। মিহরাবগুলোর কাঠামোর ওপর মারলন রয়েছে এবং কেন্দ্রীয় মিহরাবটির শীর্ষে কলসের নকশা রয়েছে।

×