ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৩ আশ্বিন ১৪৩১

অতিবর্ষণ ও উজানের ঢল

তিস্তায় পানি বৃদ্ধি, তলিয়ে গেছে উত্তরের পাঁচ জেলার নিম্নাঞ্চল

স্টাফ রিপোর্টার, নীলফামারী

প্রকাশিত: ২৩:৩০, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪

তিস্তায় পানি বৃদ্ধি, তলিয়ে গেছে উত্তরের পাঁচ জেলার নিম্নাঞ্চল

অবিরাম বর্ষণ ও উজানের ঢলে তিস্তার পানি বেড়ে বিপৎসীমা ছুঁইছুঁই

অবিরাম বর্ষণ ও উজানের ঢলে তিস্তার পানি বেড়ে বিপৎসীমা ছুঁইছুঁই। প্লাবিত হয়েছে উত্তরাঞ্চলের নীলফামারী, লালমনিরহাট, রংপুর, দিনাজপুর, কুড়িগ্রামের তিস্তা অববাহিকার নি¤œাঞ্চল। নীলফামারীর ডালিয়ায় দেশের সর্ববৃহৎ তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি জলকপাট খুলে দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। শনিবার বেলা বাড়ার সঙ্গে লাগাতার বৃষ্টিতে ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে তিস্তা। সূত্র মতে, শনিবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত উজানে ভারতের গজলডোবা ব্যারাজ থেকে দুই লাখ কিউসেক পানি ছাড়া হয়।

এতে করে ভারতের দোমহনী ও মেখলিগঞ্জ;  বাংলাদেশ সীমান্তের কালীগঞ্জ পর্যন্ত  অসংরক্ষিত এলাকায় লাল সংকেত জারি করা হয়। পাশাপাশি বাংলাদেশ অংশের ডালিয়ার তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত নদীর পানি বিপৎসীমা ছুঁইছুঁই করছিল। এ সময় বিপৎসীমার (৫২.১৫) দশমিক ৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে তিস্তার পানি প্রবাহিত হচ্ছিল। অপরদিকে, কাউনিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানি একই সময় বিপৎসীমার (২৯.৩১) দশমিক ০১ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। 

সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশ অংশের তিস্তায় হলুদ থেকে কমলা সংকেত জারি করা হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, যে হারে পানি বাড়ছে তাতে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এতে তিস্তা অববাহিকার জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় পানি প্রবেশ করছে। নি¤œাঞ্চলে ইতোমধ্যে প্রবেশ করেছে পানি। চরাঞ্চল ও বাসাবাড়িতে নদীর পানি প্রবেশ করেছে। 
তিস্তা অববাহিকার ডিমলা, জলঢাকা, পাটগ্রাম, হাতীবান্ধার গড্ডিমারী, দোয়ানী, ছয়আনী, সানিয়াজান ইউনিয়নের নিজ শেখ সুন্দর, বাঘের চর, সিঙ্গীমারি ইউনিয়নের ধুবনী, সিন্দুর্না ইউপির পাটিকাপাড়া, হলদিবাড়ী, ডাউয়াবাড়ী, কালীগঞ্জ উপজেলার ভোটমারী, শৈইলমারী, নোহালী, চর বৈরাতি, আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা, কালমাটি ও সদর উপজেলার ফলিমারীর চর, খুনিয়াগাছ, কুলাঘাট, রাজপুর, গোকু-া  প্লাবিত হয়েছে। 
পানি উন্নয়ন বোর্ড ডালিয়া শাখার উপ-প্রকৌশলী মো. রাশেদীন ইসলাম বলেন, তিস্তার পানি শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত বিপৎসীমার দশমিক ৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল এবং মাঝারি বর্ষণ অব্যাহত ছিল তিস্তা অববাহিকায়। 
এদিকে, ২৪ ঘণ্টায় বাংলাদেশ অংশের তিস্তার ডালিয়া পয়েন্টে ৬৯ মিলিমিটার ও কাউনিয়া পয়েন্টে ৩২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। অপরদিকে, উজানের ভারতের গজলডোবায় ২৫৩ মিলিমিটার, দোমহনীতে ১৩৮ দশমিক ৬ মিলিমিটার, মেখলিগঞ্জ পয়েন্টে ৭২ দশমিক ৬ মিলিমিটার, সেবক পয়েন্টে ২০৩ দশমিক ৮ মিলিমিটার, মাল্লিবাজার পয়েন্টে ৫০ দশমিক ৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়।  
অপরদিকে, রংপুর অঞ্চলের আবহাওয়া অফিস সূত্রমতে, ২৪ ঘণ্টায় উত্তরাঞ্চলের রংপুরে ৮৩ মিলিমিটার, দিনাজপুরে ১০৩, নীলফামারীর সৈয়দপুরে ১৪৪ ও ডিমলায় ১০০, পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় ২২৮ ও কুড়িগ্রামের রাজারহাটে ৪৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়।
জেলা প্রশাসক মো. নায়িরুজ্জামান বলেন, তিস্তার বিষয়টি প্রশাসনের নজরে রয়েছে। আমরা খোঁজখবর রাখছি। উপজেলা প্রশাসন, পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সার্বিক দেখভাল করার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। যেখানে প্রয়োজন তাৎক্ষণিকভাবে ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হবে।
বছরে তিস্তায় পলি পড়ছে দুই কোটি টন : প্রতিবছর সময়-অসময়ের বন্যায় পানির ধারণক্ষমতা কমে গেছে তিস্তা নদীর। উজানের পলিতে ভরাট হয়েছে নদীর বুক। ফলে, বর্ষায় ভারতে ভারি থেকে অতিভারি বৃষ্টিতে তিস্তায় বন্যা দেখা দিচ্ছে। ফসল, ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাটসহ অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। 
অপরদিকে, শুষ্ক মৌসুমে তিস্তা নদী শুকিয়ে মরা খালে পরিণত হচ্ছে। অনেক স্থানে হেঁটে নদী পারাপার হন স্থানীয়রা। পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, প্রতিবছর দুই কোটি টনের বেশি পলি আনছে তিস্তা। ৩১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ তিস্তা অববাহিকায় ১১৫ কিলোমিটার পড়েছে বাংলাদেশে। তিস্তা আন্তর্জাতিক নদী হওয়া সত্ত্বেও ভারত একতরফা বাঁধ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং প্রায় ছয় লাখ হেক্টর জমিতে সেচের জন্য পানি প্রত্যাহার করে নেওয়ার পর বাংলাদেশের জন্য পানি ছাড়ে। যে পানি আশীর্বাদ না হয়ে বেশিরভাগ সময় এদেশের মানুষের জন্য বয়ে আনছে অভিশাপ। ফলে অসময়ে তিস্তপাড়ে বন্যা দেখা দিচ্ছে। বছর বছর বাড়ছে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ।

এমন পরিস্থিতিতে নদী গবেষক ও উন্নয়ন বিশ্লেষকরা বলছেন, নদীকেন্দ্রিক কৃষিজমি রক্ষা, ভাঙন রোধসহ চরগুলো রক্ষায় সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে। নয়ত উজানের পলিতে নদীর বুক ভরাট হলে স্বল্প পানিতে প্রতিবছর অনাকাক্সিক্ষত বন্যায় ক্ষতির পরিমাণ বাড়তেই থাকবে। তারা মনে করছেন, তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যার যেমন প্রয়োজন আছে, তেমনি তিস্তা নদীর সুরক্ষার বিষয়টিও এখন জরুরি।
পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, উজানের ঢলের সঙ্গে প্রতিবছর দুই কোটি টন পলি বয়ে আনে তিস্তা নদী। এতে করেই নদীর বুক ভরাট হচ্ছে এবং স্বল্প বৃষ্টিতেই বন্যা দেখা দিচ্ছে। 
রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম বলেন, প্রতিবছর তিস্তা নদী দুই কোটি টন পলি বয়ে আনে। গতবছর অক্টোবরে ভারতে বাঁধ ধসের কারণে বিপুল পরিমাণ পলি এসেছে। ফলে, তিস্তার বুক উঁচু হয়েছে। তাই অল্প পানিতেই উত্তরের পাঁচ জেলায় বন্যা দেখা দিচ্ছে।

×