ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৩ আশ্বিন ১৪৩১

বন্ধ কারখানা খুলে দেওয়ার দাবি পোশাক শ্রমিকদের

গাজীপুরে বকেয়া বেতন দাবিতে বিক্ষোভ, সড়ক অবরোধ

স্টাফ রিপোর্টার, গাজীপুর

প্রকাশিত: ২৩:২১, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪

গাজীপুরে বকেয়া বেতন দাবিতে বিক্ষোভ, সড়ক অবরোধ

গাজীপুরে বন্ধ কারখানা খুলে দেওয়া ও বকেয়া বেতনের দাবিতে শনিবার শ্রমিকরা সড়ক অবরোধ করে

গাজীপুরে বন্ধ কারখানা খুলে দেওয়া এবং বকেয়া বেতন ভাতা পরিশোধসহ বিভিন্ন দাবিতে কর্মবিরতি ও বিক্ষোভ করেছেন চারটি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা। এ সময় তারা ঢাকা-ময়মনসিংহ ও কোনাবাড়ী-কাশিমপুর সড়ক অবরোধ করেন। শনিবার কোনাবাড়ী এলাকার যমুনা গ্রুপের যমুনা ডেনিমস লিমিটেড, দক্ষিণ সালনার পলাশটেক এলাকার এইচআরওয়ান ফ্যাশন লিমিটেড ও এইচআরওয়ান এক্সোসরিজ কারখানা এবং মেম্বারবাড়ি এলাকার সিলকেন সুইং লিমিটেড কারখানার শ্রমিকরা বিক্ষোভ ও অবরোধ করেন।
পুলিশ, আন্দোলনরত কর্মচারী-শ্রমিক ও স্থানীয়রা জানান, কোনাবাড়ী এলাকার যমুনা গ্রুপের যমুনা ডেনিমস লিমিটেড কারখানার উৎপাদন ফ্লোরে কর্মরত সুপারভাইজার, ইনচার্জ, ডিস্ট্রিবিউটরসহ শ্রমিকরা শনিবার সকাল আটটার দিকে কারখানার গেটে জড়ো হতে থাকেন। তারা কারখানায় কাজে যোগ না দিয়ে কর্মবিরতি শুরু করেন। এ সময় তারা প্রকাশিত গেজেট অনুযায়ী বেতন ভাতা, হাজিরা বোনাস ও বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট বৃদ্ধি এবং চাকরির বয়স ৬ মাস হলে বেসিক সমপরিমাণ ঈদ বোনাস প্রদানসহ ১৯ দফা দাবিতে বিক্ষোভ করতে থাকেন।

একপর্যায়ে তারা কারখানার পার্শ্ববর্তী কোনাবাড়ী-কাশিমপুর সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন। এতে ওই সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যানজটের সৃষ্টি হয়। খবর পেয়ে শিল্প পুলিশ, থানা পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে গিয়ে আন্দোলনরতদের বুঝিয়ে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সড়ক থেকে সরিয়ে দিলে যানবাহন চলাচল শুরু হয়।
যমুনা ডেনিমস লিমিটেডের কমপ্লায়েন্স ম্যানেজার সেলিম রেজা বলেন, দাবিগুলো নিয়ে আন্দোলনকারীদের মধ্যে থেকে ৮/১০ জনকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা আমাদের প্রস্তাব না মেনে কারখানার প্রধান ফটক অবরুদ্ধ করে বিক্ষোভ করেন। তারা অন্য শ্রমিকদের কারখানায় প্রবেশ করতে বাধা দেন। ঘটনাস্থলে সেনাবাহিনী, শিল্প পুলিশ অবস্থান করছে।
গাজীপুর শিল্প পুলিশ-২ এর সহকারী পুলিশ সুপার (কোনাবাড়ী জোন) জাহাঙ্গীর আলম জানান, সকালে আন্দোলনরত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কারখানায় প্রবেশ না করে প্রধান ফটকে ১৯ দফা দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন। একপর্যায়ে তারা কোনাবাড়ী-কাশিমপুর সড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন।
এদিকে সদর উপজেলার মেম্বারবাড়ী এলাকায় সিলকেন সুইং লিমিটেড কারখানার শ্রমিকরা তাদের সঙ্গে নানা অজুহাতে দুর্ব্যবহার ও হয়রানি করার অভিযোগে কারখানার কয়েকজন কর্মকর্তার অপসারণ এবং বেতন ভাতা বৃদ্ধিসহ ১৮ দফা দাবিতে কর্মবিরতি ও বিক্ষোভ করেছেন। এ সময় তারা প্রায় চার ঘণ্টা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে রাখেন।
আন্দোলনরত শ্রমিকরা জানান, কারখানার উৎপাদন ফ্লোরে প্রায়ই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দীর্ঘদিন ধরে শ্রমিকদের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দুর্ব্যবহার ও হয়রানি করেন। ওইসব কর্মকর্তার অপসারণ এবং বেতন ভাতা বৃদ্ধি করাসহ বিভিন্ন দাবিতে গত ১৬ সেপ্টেম্বর শ্রমিকরা বিক্ষোভ ও কর্মবিরতি করেন। শ্রমিক আন্দোলনের মুখে কারখানা কর্তৃপক্ষ ওইসব কর্মকর্তার অপসারণসহ শ্রমিকদের দাবি মেনে নেওয়ার আশ^াস দিয়ে নোটিস টানিয়ে দিলেও বাস্তবায়ন করেনি।

উপরন্তু আন্দোলনকারী শ্রমিকদের ছাঁটাই শুরু করে কর্তৃপক্ষ। এতে শ্রমিকদের মাঝে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে। এর পরিপ্রেক্ষিতে শনিবার সকালে শ্রমিকরা কারখানায় এলেও কাজে যোগ না দিয়ে কর্মবিরতি ও বিক্ষোভ শুরু করেন। একপর্যায়ে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা কারখানার পার্শ্ববর্তী মেম্বারবাড়ী এলাকায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের ওপর অবস্থান নিয়ে অবরোধ করেন।
জয়দেবপুর থানার ওসি আব্দুল হালিম জানান, সকাল থেকেই শ্রমিকরা কাজে যোগদান না করে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের অপসারণসহ ১৮ দফা দাবিতে মহাসড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকেন। এ সময় সড়কের উভয়পাশে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার এলাকায় যানজট সৃষ্টি হয়। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে তাদের সকল দাবি মেনে নেওয়া হলে প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টা পর শ্রমিকরা অবরোধ তুলে নিলে মহাসড়কে পুনরায় যানবাহন চলাচল শুরু হয়। শ্রমিক বিক্ষোভের কারণে কর্তৃপক্ষ শনিবার কারখানা ছুটি ঘোষণা করেন।
অপরদিকে মহানগরীর দক্ষিণ সালনার পলাশটেক এলাকার অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা এইচআরওয়ান ফ্যাশন লিমিটেড এবং এইচআরওয়ান এক্সেসরিজ কারখানা খুলে দেওয়া ও তিন মাসের বকেয়া বেতনের দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন ওই দুই কারখানার শ্রমিকরা। এ সময় তারা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করেন।
পুলিশ, শ্রমিক ও স্থানীয়রা জানান, কারখানার শ্রমিকদের পাওনা তিন মাসের বকেয়া বেতন পরিশোধ না করেই অনির্দিষ্টকালের জন্য কারখানা বন্ধ করে হঠাৎ গেটে নোটিস টানিয়ে দেয়।

শনিবার সকালে শ্রমিকরা কারখানায় কাজে যোগ দিতে এসে ওই নোটিস দেখতে পেয়ে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। এ সময় তারা বন্ধ কারখানা খুলে দেওয়া ও তিন মাসের বকেয়া বেতন ভাতা পরিশোধ করাসহ বিভিন্ন দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করেন। একপর্যায়ে তারা কারখানার পার্শ্ববর্তী ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে অবস্থান নিয়ে অবরোধ করে বিক্ষোভ করতে থাকেন। খবর পেয়ে শিল্প পুলিশ, থানা পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে গিয়ে আন্দোলনরতদের বুঝিয়ে সড়কের ওপর থেকে সরিয়ে দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
গাজীপুর শিল্প পুলিশের পরিদর্শক ফারুক বলেন, শ্রমিকদের মহাসড়ক অবরোধ করার খবরে ঘটনাস্থলে পৌঁছে তাদের বুঝিয়ে সড়ক থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এরপর তারা কারখানার সামনে অবস্থান নেন।
আশুলিয়ায় ৪৯ কারখানা বন্ধ : নিজস্ব সংবাদদাতা, সাভার  থেকে জানান সাভারে আশুলিয়ায় বন্ধ থাকা পোশাক কারখানা খুলে দেওয়া, শ্রমিকদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহার ও ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি করে ২২ হাজার টাকা করার দাবিতে ফের সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন শ্রমিকরা। শনিবার সকালে আশুলিয়ার বাইপাইল-আবদুল্লাহপুর সড়কের জিরাবো এলাকায় সড়ক অবরোধ করে এই বিক্ষোভ করেন তারা। এদিকে আজও শিল্প এলাকায় অন্তত ৪৯টি কারখানা বন্ধ রয়েছে।

জানা গেছে, এদিন সকালে লুসাকা গ্রুপের শ্রমিকরা শ্রমিকদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে বাইপাইল-আবদুল্লাহপুর সড়কের জিরাবো এলাকায় সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করে। পরে তাদের সঙ্গে আরও কয়েকটি কারখানার শ্রমিকরা যোগ দেন। এ সময় শ্রমিকরা বিভিন্ন কারখানায় ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। 
লুসাকা গ্রুপের বেক নীট লিমিটেডের শ্রমিকরা জানান, ৯ সেপ্টেম্বর মালিকপক্ষ কারখানার ২৭ জন শ্রমিকের নামোল্লেখসহ অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে আশুলিয়া থানায় একটি মামলা দায়ের করে।

পরে এ মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে শ্রমিকরা আন্দোলন করলে গত বৃহস্পতিবার কারখানা খুলে দেওয়ার পর মালিকপক্ষ জানায় তারা আমাদের কাছে মামলা প্রত্যাহার করে কপি হাতে দিয়ে দেবে। কিন্তু পরবর্তীতে আর তা দেয়নি। আজ সকালে কারখানায় এসে দেখি মালিকপক্ষ শ্রম আইনের ১৩(১) ধারায় কারখানা বন্ধ ঘোষণা করেছে। পরে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা আশপাশের কয়েকটি কারখানার শ্রমিকদের বের করে নিয়ে সড়কে অবস্থান নেন এবং শ্রমিকদের নামে মামলা প্রত্যাহার ও বন্ধ কারখানা খুলে দেওয়ার দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করে।
অপরদিকে ম-ল নীটওয়্যার লিমিটেডের আন্দোলনরত শ্রমিকরা বলেন, শ্রমিকদের ন্যূনতম বেতন ২২ হাজার টাকা করাসহ কয়েকটি দাবিতে আমাদের শ্রমিকরা আন্দোলন করছিল। আজ (শনিবার) কারখানায় এসে দেখি মালিকপক্ষ শ্রম আইনের ১৩(১) ধারায় কারখানা বন্ধ ঘোষণা করেছে। এ ছাড়া গত বৃহস্পতিবার থেকে স্থানীয় সন্ত্রাসীরা মালিকপক্ষের হয়ে আমাদের শ্রমিকদের ধরে নিয়ে মারধর করছে। এরই প্রতিবাদে আমরা আন্দোলন করছি। 
শিল্প পুলিশ জানায়, শনিবার আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলে মোট ৪৯টি কারখানায় উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ শ্রম আইন অনুযায়ী ১২টি এবং কারখানা খোলা রাখার পর কাজ বন্ধ আছে কিংবা ছুটি আছে এমন কারখানার সংখ্যা ৩৭টি।
আশুলিয়া শিল্প পুলিশ-১ এর পুলিশ সুপার মো. সারোয়ার আলম বলেন, শ্রমিকদের বুঝিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা হচ্ছে। এ ছাড়া বিভিন্ন পয়েন্টে আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্য মোতায়েন রয়েছে।

×