ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৩ আশ্বিন ১৪৩১

বন ভবনে কর্মশালায় উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান

ঢাকার খাল উদ্ধারে প্রতি সপ্তাহে অভিযান চালাতে হবে

স্টাফ রিপোর্টার

প্রকাশিত: ২৩:১৯, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪

ঢাকার খাল উদ্ধারে প্রতি সপ্তাহে অভিযান চালাতে হবে

উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান

রাজধানী ঢাকা গত এক শতাব্দী ধরে ক্রমাগত জনসংখ্যা বৃদ্ধি, দ্রুত নগরায়ণ, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং এ সংশ্লিষ্ট পরিবেশ-প্রতিবেশগত উল্লেখযোগ্য স্থানিক এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন হয়েছে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর ঢাকা শহরের অভ্যন্তরে নগর অবকাঠামো বৃদ্ধির ফলে ক্রমান্বয়ে এখানকার সবুজ আচ্ছাদন ও জলাভূমির পরিমাণ কমে গেছে। তাই নগরের ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা, বাষ্পীভবন ও বায়ু দূষণ বাড়ছে। ফলে স্থানীয় বাসিন্দাদের বসবাসের জন্য এই শহর দিনে দিনে অনুপযোগী হয়ে পড়ছে।
১৯৬৭ সালে ঢাকা শহর নীল এলাকা ছিল ২৬ শতাংশ, সবুজ স্থান ছিল ৪৪ শতাংশ এবং শহুরে এলাকা ছিল ৩১ শতাংশ। ২০২৪ সালে তা পরিবর্ত হয়ে ঢাকা শহরে নীল এলাকায় ৪ শতাংশ, সবুজ এলাকা ১২ শতাংশ ও শহর এলাকা হয়েছে ৮০ শতাংশ। তাই ঢাকা শহর ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকার সবুজায়ন বৃদ্ধি, জলাভূমি ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে ১৯টি স্থানকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চিহ্নিত করে তিনটি বৃহত্তর কর্মসূচির আওতায় ১৯টি প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রস্তাব করা হয়েছে ১০০ বছরের কৌশলগত এক কর্মপরিকল্পনায়। 
শনিবার রাজধানীর আগারগাঁও বন ভবনে সিইজিআইএস আয়োজিত ‘বিগত ১০০ বছরে ঢাকা শহরের নগর প্রতিবেশ, ভূমি ব্যবহার এবং জীববৈচিত্র্য স্থানিক ও সময়ানুক্রমিক পরিবর্তন ও কৌশলগত কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন’ শীর্ষক মতবিনিময় কর্মশালায় এই প্রস্তাব করা হয়। কর্মশালায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় ও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।
তিনি বলেন, ‘ঢাকার নগর পরিকল্পনায় সবুজায়ন, জীববৈচিত্র্য ও জলাভূমি সংরক্ষণকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। পরিবেশের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নগর উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রয়োজন। সবুজ ও জলাভূমি রক্ষায় সকল বিভাগের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন।’
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘ঢাকার খালগুলো দিয়ে ব্লু নেটওয়ার্ক করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। যে খালগুলো এখনো উদ্ধার করা সম্ভব, সেগুলো দিয়ে এ নেটওয়ার্ক করা হবে। অবৈধভাবে দখল হওয়া খাল উদ্ধারে রাজউককে প্রতি সপ্তাহে অভিযান পরিচালনা করতে হবে। কোনো অন্যায়কে বৈধতা দেওয়া যাবে না। অবৈধ দখলকৃত খাল উদ্ধারে প্রয়োজনে অভিযান বাড়াতে হবে। ঢাকার উন্মুক্ত মাটিতে ঘাস লাগাতে হবে। এ কাজে কমিউনিটিকে সম্পৃক্ত করতে হবে।’
সিইজিআইএস এর নির্বাহী পরিচালক মালিক ফিদা এ. খানের সভাপতিত্বে কর্মশালায় গবেষণা দলের টিম লিডার ও সিইজিআইএস এর প্রিন্সিপাল স্পেশালিস্ট ড. ফারহানা আহমেদ গবেষণালব্ধ একটি বিশদ প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন। 
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা গত এক শতাব্দী ধরে ক্রমাগত জনসংখ্যা বৃদ্ধি, দ্রুত নগরায়ন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং এ সংশ্লিষ্ট পরিবেশ-প্রতিবেশগত উল্লেখযোগ্য স্থানিক এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তনগুলো প্রত্যক্ষ করে আসছে। ঢাকা শহরের অভ্যন্তরে নগর অবকাঠামো বৃদ্ধির ফলে ক্রমান্বয়ে এখানকার সবুজ আচ্ছাদন ও জলাভূমির পরিমাণ সমহারে হ্রাস পাচ্ছে এবং এই নগরের ভূমিপৃষ্ঠের তাপমাত্রা, বাষ্পীভবন ও বায়ু দূষণ বাড়ছে। ফলে স্থানীয় বাসিন্দাদের বসবাসের জন্য এই শহর দিনে দিনে অনুপযোগী হয়ে পড়ছে।
সিইজিআইএস এর মাধ্যমে পরিচালিত এই গবেষণা ঢাকার বাস্তুতন্ত্রের বর্তমান অবস্থা বিশ্লেষণ করে পুনরুদ্ধারের সুযোগ এবং চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করেছে। বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ, সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের মতামত ও বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ গ্রহণ ইত্যাদির ভিত্তিতে সিইজিআইএস কাজটি সম্পন্ন করে একটি খসড়া কৌশলগত কর্মপরিকল্পনা প্রস্তুত করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে পরিকল্পনাটিতে ঢাকা শহর ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকার সবুজায়ন বৃদ্ধি, জলাভূমি ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে ১৯টি স্থানকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চিহ্নিত করে তিনটি বৃহত্তর কর্মসূচির আওতায় ১৯টি প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়েছে। কৌশলগত এই কর্মপরিকল্পনাটি যাচাই বাছাইপূর্বক বাস্তবায়নের সুযোগ রয়েছে।
কর্মপরিকল্পনায় বলা হয়, ঢাকা সপ্তম শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠিত হয়। ঢাকায় নগরায়ন শুরু হয় ১৬০০-এর দশকে এবং ১৯৮০ সাল থেকেই শহরের আকার বৃদ্ধি। ২০১৫ সালের এর মধ্যে তা প্রায় তিনগুণ বেড়েছে। বিবিএস-২০২২ সালের তথ্যমতে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা, প্রতি জনসংখ্যার ঘনত্ব ৩৯,৪০৬ জন বর্গ কিলোমিটার।
সবুজ এলাকা বলতে আমরা বুঝি গাছ, গুল্ম, ঘাস বা গাছপালাসহ এলাকা, যেমন পার্ক, খেলার মাঠ, বাগান এবং ছাদের বাগান। ঢাকায় বর্তমানে সবুজ এলাকা রয়েছে ১২ শতাংশ। ঢাকায় সবুজ এলাকা বলতে বর্তমানে জাতীয় বোটানিক্যাল গার্ডেন ৮৭ হেক্টর, জাতীয় চিড়িয়াখানা ৭৬ হেক্টর, কুর্মিটোলা গলফ ক্লাব খেলার মাঠ ৩৮ হেক্টর, রমনা পার্ক ২৮ হেক্টর, চন্দ্রিমা উদ্যান ৩০ হেক্টর,  সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ৩৮ হেক্টর, সংসদ ভবন মাঠ ১৫ হেক্টর, ওসমানী উদ্যান ১১ হেক্টর, কেন্দ্রীয় শিশু পার্ক ৭ হেক্টর, বুড়িগঙ্গা ইকো-পার্ক ও শিপিং মিউজিয়াম ৫ হেক্টর এবং বলধা গার্ডেন ১ দশমিক ২ হেক্টর সবুজ এলাকা রয়েছে। নীল এলাকা বলতে বলা হয়- নদী, খাল, হ্রদ বা জলভূমি, জলাধান ও পুকুর। ঢাকায় বর্তমানে নীল এলাকা রয়েছে মাত্র ৪ শতাংশ। তবে দিন দিন শহর এলাকা সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে প্রায় ৮০ শতাংশ শহর এলাকায় রয়েছে ঢাকায়। তাই ঢাকা শহর ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকার সবুজায়ন বৃদ্ধি, জলাভূমি ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে একাধিক প্রস্তাব ও পরিকল্পনা নিয়ে কর্মশালায় আলোচনা করেন বক্তারা।  
কর্মশালায় অন্যদের বক্তব্য রাখেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. ফারহিনা আহমেদ, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসক মো. মাহমুদুল হাসান, রাজউকের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব) মো. ছিদ্দিকুর রহমান সরকার এবং বন বিভাগের প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী। উন্মুক্ত আলোচনায় বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার প্রতিনিধি, গবেষক ও পরিবেশকর্মীরা অংশ নেন। কর্মশালার শেষে ঢাকার পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সম্মিলিত প্রচেষ্টার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। এর পরে উপদেষ্টা রাবার বাগান মালিক সমিতির নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সভা করেন। তাদের বিভিন্ন বক্তব্য শোনেন এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের আশ্বাস দেন।

×