ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০ আশ্বিন ১৪৩১

কৃত্রিম চাষে উৎপাদন বাড়লেও কমেছে স্বাদ

বিলুপ্তির পথে দেশীয় স্বাদু পানির মাছ

শেখ আব্দুল আওয়াল, গফরগাঁও, ময়মনসিংহ

প্রকাশিত: ২৩:২১, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪

বিলুপ্তির পথে দেশীয় স্বাদু পানির মাছ

বিলুপ্তপ্রায় স্বাদু পানির বিভিন্ন প্রজাতির মাছ

মাছে ভাতে বাঙালি- বহুল প্রচলিত এ কথাটি এখন যেন শুধু কিতাবের কথা। হাওড়-বাঁওড়, পুকুর, খাল-বিল, হাটবাজারে মিঠাপানির সুস্বাদু মাছ আর আগের মতো পাওয়া যায় না। মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, হারিয়ে যাওয়া দেশী প্রজাতির মাছের সংখ্যা আড়াইশ’র বেশি। দেশী মাছের জায়গা এখন দখল করেছে বদ্ধ পানিতে চাষ করা পাঙ্গাশ, তেলাপিয়া, ক্রস ও কার্পজাতীয় মাছ। তারপরও জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে যে চাহিদা বেড়েছে, সে পরিমাণ মাছের জোগান দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ফলে বাজারে মাছের দাম চলে যাচ্ছে ক্রেতার নাগালের বাইরে।
উপজেলার স্থানীয় কয়েকজন জানান, সুতিয়া নদী, ব্রহ্মপুত্র নদ ও শীলা নদীতে সুস্বাদু দেশীয় মাছ এখন আর তেমন পাওয়া যায় না। তারা বলেন, যা পাওয়া যায় দাম আকাশচুম্বী। বিলুপ্তির ঝুঁকিতে থাকা বিভিন্ন দেশী মাছের অঞ্চল ভেদে ভিন্ন ভিন্ন নাম রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- চাপিলা, বৈচা, চাটুয়া, চাঁদা, নামা চাঁদা, গোল চাঁদা, আইড়, গুলশা, পাবদা, দেশী পুঁটি, সরপুঁটি, তিতপুঁটি, মেনি, ভেদা, শিং, কৈ, টাকি, শোল, গজার, ফলি, চিতল, মলা, ঢেলা, কানপোনা, দারকিনা, খয়রা, বাচা, বাটা, রিটা, পিয়ালি, জয়া, খৈলশা, ছোট টেংরা, বড় টেংরা, চান্দা, কাজলি, চ্যাং, কালবাউশ, বাঘাইড়, ভাঙ্গন, ছোট চিংড়ি, বাতাসি, বড় বাইম, তারা বাইম, শাল বাইম, চিকরা বাইম, কাকিয়া, কুইচ্চা, তারা, রখাকসা, খরকুটি, বাশপাতারি, পটকা, বেলেসহ নাম না জানা অনেক প্রজাতির দেশী মাছ।

দুই দশকে কৃত্রিম প্রজনন ও চাষের মাধ্যমে মাছের সরবরাহ ও চাহিদা অনেকাংশে বাড়ানো হয়েছে। বাংলাদেশে এখন প্রতি বছর সাড়ে ৪২ লাখ টনেরও বেশি মাছ উৎপন্ন হচ্ছে। এর মধ্যে নদী, বিল ও হাওড়সহ উন্মুক্ত জলাশয় থেকে ২৫ শতাংশ; পুকুর, ডোবার মতো বদ্ধ জলাশয় থেকে ৫৭ শতাংশ এবং বাকি অংশ সমুদ্র থেকে আহরিত হচ্ছে।
মৎস্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট কারণে অনেক মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। প্রাকৃতিক কারণগুলোর মধ্যে 
রয়েছেÑ জলাভূমির সঙ্গে বিশেষ করে নদী, হাওড়-বাঁওড় ও বিলের গভীরতা কমে যাওয়া, প্লাবন ভূমির সঙ্গে সংযোগ খাল ভরাট, জলাশয়ে বছরের অধিকাংশ সময় পানি না থাকা এবং প্রজনন মৌসুমে পানির প্রবাহ কমে যাওয়া। মনুষ্যসৃষ্ট কারণগুলো হচ্ছেÑ জমিতে রাসায়নিক সার ও অপরিকল্পিত মৎস্য আহরণ, প্রজনন মৌসুমে প্রজনন সক্ষম মাছ ও পোনা ধরা, কলকারখানার বর্জ্য নিকটস্থ জলাশয়ে ফেলা, কারেন্ট জালের ব্যবহার, মাছের আবাসস্থল ধ্বংস করা এবং ক্ষতিকর মৎস্য আহরণ সরঞ্জামের ব্যবহার।
মৎস্যবিদ জহিরুল ইসলাম আকন্দ বলেন, বর্ষার শুরুতে কারেন্ট জাল ও চায়না দুয়ারি জাল দিয়ে মা মাছ নিধনের ফলে বিলুপ্ত হচ্ছে দেশীয় মাছ। একটি অসাধু চক্র মাছের ডিম ও পোনা মাছ ধরেও দেশীয় মাছের সংকট সৃষ্টি করছে। দেশীয় প্রজাতির মাছ বিশেষ করে মাগুর, চাপিলা, শিং, পাবদা, টাকি, রুই, কাতল, মৃগেল, চিতল, রিটা, গুঁজি আইড়, কৈ, বোয়াল, খৈলশার মতো সুস্বাদু মাছগুলো এখন আর তেমন চোখে পড়ে না।

দেশী সরপুঁটি, গজার, বামাশ, টাটকিনি, তিতপুঁটি, বাঘা আইড়, গুলশা, কাজলি, মাগুর, চেলা বাতাসি, কালনা (ফলি), চেলা, বাতাসি, টেংরা, কানি পাবদা, পুঁটি, মলা, কালাবাউশ, শোল, মহাশোল, রিটা, তারা বাইম, বাতাই, কাকিয়া, বাইম, গুলশা, বেদরিসহ ৪০-৬৪টি জাতের মাছ হারিয়ে যেতে বসেছে। এর মধ্যে ২৯ প্রজাতির বিলুপ্ত প্রায় মাছ ফিরিয়ে এনেছে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই)।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সাবেক মৎস্যবিজ্ঞানী ড. কহিনূর ইসলাম জনকণ্ঠকে জানান, খাদ্যাভাসের তালিকায় মাছ একটি নিত্য খাবার; যা আমিষের চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কৃত্রিম উপায়ে ঘের-পুকুরে মাছের চাষ বৃদ্ধি পেলেও এতে প্রকৃত স্বাদ বিনষ্ট হচ্ছে। গ্রাম-গঞ্জের খাল-বিলে কিছু দেশীয় মাছ মিললেও চাহিদার তুলনায় তা অপ্রতুল। 
বাংলাদেশে মুক্ত জলাশয়ে মোট ২৬০ প্রজাতির মিঠা পানির মাছের মধ্যে ১২টি প্রজাতি চরম বিপন্ন এবং ১৪টি সংকটাপন্ন। যদিও চিংড়িসহ মিঠাপানির ২৯৬টি প্রজাতির মাছ এবং ৫১১টি সামুদ্রিক প্রজাতির মাছ রয়েছে। এসব বিষয় বিশ্লেষণ করলে মাছের যে প্রাকৃতিক জলাশয় ও মুক্ত জলাশয় রয়েছেÑ তা আমাদের অযাচিত ও অনৈতিক কীটনাশক ব্যবহারের কারণে মাছের স্বাভাবিক প্রজনন ও বংশবিস্তারকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। 
এ বিষয়ে মৎস্য কর্মকর্তারা জানান, দেশীয় মাছ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষের আওতায় আনতে হবে। বদ্ধ জলাশয়ে দেশী প্রজাতির মাছ যাতে বেশি পাওয়া যায় সেজন্য কিছু কৌশল অবলম্বন করা যেতে পারে। যেমনÑ ধানখেতে ছোট প্রজাতির মাছ চাষের ব্যবস্থা করা এবং এ ধরনের মাছ সারাবছর পেতে ধানখেতে মিনি পুকুর তৈরি, মাছের প্রজনন মৌসুমে মাছ না ধরা, ফাঁস জাল ব্যবহার না করা, রাক্ষুসে মাছ কমানোর জন্য বিষ প্রয়োগ না করা, রুই জাতীয় মাছের সঙ্গে ছোট প্রজাতির মাছের মিশ্র চাষ, জলাশয় এবং পুকুরে দেশী মাছ চাষাবাদের জন্য সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা। 

অভিজ্ঞ মহলের মতে দেশী মাছ সংরক্ষণের জন্য কারেন্ট জালের ব্যবহার বন্ধ করা, মাছের অভয়াশ্রম গড়ে তোলা, পুরনো জলাশয়গুলো সংস্কার করা, ছোট দেশী জাতের মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন ও অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয় সংরক্ষণ করে মাছের বংশবৃদ্ধির জন্য উপযোগী করে দেশীয় মাছের সংরক্ষণ করা জরুরি। জলাশয়, খাল, পুকুর ভরাটের কারণে মাছের আবাসস্থল থাকছে না যে কারণে হারিয়ে যাচ্ছে দেশীয় প্রজাতির সুস্বাদু মাছ।
মৎস্যবিদরা জানান, বাংলাদেশের জলাশয়ে ২৬০ প্রজাতির দেশীয় মাছ, ১২ প্রজাতির বিদেশী মাছ এবং ২৪ প্রজাতির চিংড়ি রয়েছে। জাতীয় অর্থনীতিতে মৎস্য খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। স্থুল জাতীয় উৎপাদনে এ খাতের অবদান শতকরা প্রায় ৪ ভাগ এবং কৃষির উৎপাদনে শতকরা ২১ ভাগ। জাতীয় রপ্তানি আয়ে মৎস্য খাতের ভূমিকা শতকরা ৪ ভাগ। এ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকা-ে প্রায় ১৩ লাখ শ্রমিক সার্বক্ষণিকভাবে এবং ১ কোটি ২৫ লাখ শ্রমিক খ-কালীনভাবে নিয়োজিত আছে। 

গফরগাঁও উপজেলার সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মুহা. মালিক তানভীর হোসেন জানান, ১৫টি ইউনিয়নের খাল-বিলে ও নদীতে দেশীয় মাছ হারিয়ে যাচ্ছে। উপজেলা বিভিন্ন খামার ও পুকুর, বিল মৎস্য চাষিদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে, দেশী শিং, মাগুর, পাপদা, টেংরা ও গুলশা চাষ করার জন্য। দেশীয় মাছ কমে যাওয়ার কারণ বিভিন্ন রকমের অবৈধ জাল, চিকন জাল দিয়ে পোনা মাছ নিধন। এগুলো নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে।

×