ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১

নেই খেলার মাঠ, সঙ্কুচিত হচ্ছে ক্যাম্পাস 

স্কুল-কলেজের জায়গায় শপিংমল-মার্কেট

আসিফ হাসান কাজল

প্রকাশিত: ২৩:০৬, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪; আপডেট: ২৩:০৭, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪

স্কুল-কলেজের জায়গায় শপিংমল-মার্কেট

স্কুল-কলেজের জায়গায় শপিংমল-মার্কেট

রাজধানীর মিরপুর-১ নম্বর এলাকা। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ব্যস্ত থাকে এই এলাকা। চলে গাড়ি, বিকট শব্দে বাজে হর্ন। কাঁচঘেরা মার্কেটের সামনে সারিবদ্ধ প্রাইভেটকার-রিক্সা। দেখে বোঝার উপায় নেই, এই মার্কেটটি একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জায়গায় গড়ে উঠেছে। মার্কেটের বহুতল ভবন স্কুলটিকে ঢেকে যেন সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে।

অভাগা এই স্কুলের নাম ‘শাহ আলী গার্লস স্কুল’। এটি শুধুই মিরপুরের একটি স্কুলের চিত্র নয়। রাজধানীর অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এভাবেই গিলে খাচ্ছে মার্কেট-শপিংমল। ঢাকার বাইরেও এই সংস্কৃতি এখন বিস্তার লাভ করেছে ঢের।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ম্যানেজিং কমিটি বা গভর্নিং বডির সদস্যরা এখন বিদ্যালয়ের পড়াশোনার চেয়ে আয় বাড়ানোতে বেশি মনোযোগী। স্কুলের ভবনের জায়গা ডেভেলপার কোম্পানিকে দিতে প্রতিষ্ঠান প্রধানদেরও অশেষ ইচ্ছা। এর ফলে স্কুল-কলেজগুলো মার্কেটের চাপে কঙ্কালসার হতে চলেছে। কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা এবং আইনের ফাঁক দিয়ে একটি নোংরা সংস্কৃতির মহোৎসব চলছে। আবার অনেক জায়গায় নদী, প্রাকৃতিক খাল দখল করে স্কুল-কলেজ মাদ্রাসা গড়ে তোলা হচ্ছে বলেও একাধিক প্রমাণ রয়েছে।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যান প্রফেসর তপন কুমার সরকার জনকণ্ঠকে জানান, বিদ্যালয় বা কলেজের পাঠদানের অনুমতির ক্ষেত্রে এ বিষয়গুলো লক্ষ্য করা হয়। পাঠদানের নীতিমালায় স্পষ্ট বলা আছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান লাভজনক কাজে জড়িত থাকতে পারবে না। কিন্তু স্কুলের ম্যানেজিং কমিটি, প্রধান শিক্ষক আমাদের অবগত না করেই এই ধরনের কাজগুলো করছেন। খেলার মাঠের পরিবর্তে তারা মার্কেট, রেস্তরাঁ বানাচ্ছেন।

এসব বিষয়ে যদি অভিযোগ আসে, তবে অবশ্যই আমরা তদন্ত করব এবং ও প্রয়োজনে ওইসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠদান বাতিল করা হবে।
বোর্ড চেয়ারম্যানের এমন হুঁশিয়ারি থাকলেও বাস্তবতা হচ্ছে- এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে ক্ষমতার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা। সমাজে তাদের একচেটিয়া প্রভাবও রয়েছে। এর ফলে কার্যত কোনো ব্যবস্থা দেখারও কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না।
শিক্ষা বোর্ড কর্মকর্তারা জানান, এরজন্য শিক্ষা প্রশাসনের সমন্বয়হীনতা প্রধান দায়ী। কারণ শিক্ষা বোর্ড পাঠদানের অনুমতি দেওয়ার আগে পরিদর্শন এবং সে অনুযায়ী প্রতিবেদন দিয়ে থাকে। অনুমোদন দেওয়ার পর পুরো বিষয়টি দেখভাল করে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। কারণ মাঠপর্যায়ে তাদের একাধিক অফিস ও কর্মকর্তা রয়েছে।

এসব কর্মকর্তাদের নিয়মিত কাজ স্কুল-কলেজগুলো পরিদর্শন এবং প্রতিবেদন দাখিল করা। কিন্তু কার্যত এসব বিষয়ে কোনো উদ্যোগই দেখা যায় না। যে কারণে রাজধানীর কতগুলো স্কুলের জায়গায় মার্কেট বা অন্যান্য স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে, তার পরিসংখ্যানও তাদের জানা নেই।
ঢাকা জেলা শিক্ষা অফিসার আব্দুল মজিদ জানান, সম্প্রতি মিরপুরের এনডিসি মডেল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি একটি মার্কেট নির্মাণ করতে চেয়েছিল।

আমরা এ বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছি। পরে তারা এই মার্কেট আর করতে পারেনি। তিনি আরও বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ ম্যানেজিং বা গভর্নিং বডি। তারা চাইলে কাউকে কারণ দর্শানো, কাউকে সাময়িক বহিষ্কার করেন। আবার অনেক ক্ষেত্রে আদালতের রায় বাস্তবায়নেও বাধা হয়ে দাঁড়ান। সে কারণে প্রতিষ্ঠানপ্রধান বা স্কুলের শিক্ষকদের এ বিষয়ে কিছু করার থাকে না। কার্যত ম্যানেজিং কমিটির ইচ্ছার বিপরীতে কেউ অবস্থান করতে থাকে ছেঁটে ফেলে দেওয়ার অনেক নজির রয়েছে।
ঢাকা শিক্ষা অফিস সূত্র বলছে, ২০২১ সালে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের আওতাধীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামনে কোনো স্থায়ী দোকান না রাখতে পুলিশ বাহিনীর সহযোগিতা চাওয়া হয়েছিল। এই আদেশের আলোকে কোথাও কোথাও লোক দেখানো ব্যবস্থা নেওয়া হলেও কার্যত কিছুই হয়নি।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (বিদ্যালয়) সৈয়দ জাফর আলী জনকণ্ঠকে জানান, প্রতিষ্ঠান দুই ধরনের।

একটি সরকারি, অন্যটি বেসরকারি। সরকারি প্রতিষ্ঠানের সামনে এমন দোকান-মার্কেট খুব বেশি দেখা যায় না। কিন্তু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সামনে এই প্রবণতা ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। মাউশির জনবল সীমাবদ্ধতা উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ম্যানেজিং বা গভর্নিং বডিকে আইনিভাবে ব্যাপক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত স্থানীয় রাজনীতির প্রভাব। এ কারণে শিক্ষা প্রশাসনও অনেকটা অসহায়। তবে এখন সময় এসেছে, এগুলো অপসারণ করার। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কখনোই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

প্রাথমিকেও একই চিত্র ॥ এদিকে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান বলছে, ঢাকা মহানগরীর ২৯৫টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ৫৭টি বিদ্যালয়ের জমি বেদখলে রয়েছে। ওয়াসা, পুলিশ ও আনসার ক্যাম্প ছাড়াও বস্তি, ক্লাবঘর, কমিউনিটি সেন্টার, কাঁচাবাজার বসিয়ে এসব বিদ্যালয়ের জমি দখলে নেওয়া হয়েছে। এছাড়াও সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দখল করে বসেছে বিদ্যালয়ের ক্লাসরুম, মাঠ ও ভবন। রয়েছে মসজিদ, ঈদগাহ ইত্যাদি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ব্যক্তি মালিকানার জায়গায় প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়গুলো সরকারি হলেও জমিগুলো সরকারের অধীনে নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এ ছাড়া কোথাও কোথাও পূর্ব পুরুষরা স্কুলের জন্য মৌখিকভাবে জায়গা দিলেও তাদের ছেলে-মেয়েরা এখন জমি ছাড়ছেন না। কোথাও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জমি হাইস্কুল বা কলেজ দখলে নিয়েছে।
মিরপুর পল্লবীর বনফুল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জায়গা একটি কলেজের নামে কাগজ লিখে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ আছে। গাবতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টির জমি দানকারীর ছেলেরা ছাড়ছেন না। এমন বিষয় রয়েছে বাংলাবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও।
এ বিষয়ে জানতে ঢাকা অঞ্চলের উপ-পরিচালক মো. হাসান খসরুকে একাধিকবার ফোন দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
নদী দখল করে হচ্ছে স্কুল-কলেজ ॥ শুধু যে স্কুল-কলেজের জায়গায় মার্কেট-দোকান অবৈধ স্থাপনা তৈরি হচ্ছে, জায়গা বেহাত হচ্ছে, তা শুধু নয়। অনেক নদীর জমি দখল করা হচ্ছে স্কুল-কলেজের নামে। নৌ মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, ঢাকা ও ঢাকার চারপাশের নদী দখল করে আছে অন্তত ছয়টি বিদ্যালয় ও আটটি কলেজ।

এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঢাকা, টঙ্গী ও নারায়ণগঞ্জের বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা ও ধলেশ^রী নদীর জায়গা দখল করে গড়ে উঠেছে। এরমধ্যে চর মীরেরবাগ প্রাথমিক বিদ্যালয় (মৌজা মীরেরবাগ, দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ) পরিচালনা করছিলেন মো. আবুল চেয়ারম্যান। বিদ্যালয়টি সেমিপাকা। জায়গা দখল করে সীমানা দেওয়ালও দেওয়া হয়েছে।

একতলা ভবনটি বুড়িগঙ্গা নদী দখল করে আছে। কামরাঙ্গীরচরে বুড়িগঙ্গা নদী দখল করে আছে শেখ জামাল সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়। সীমানাপ্রাচীরসহ ছয়তলা পাকা ভবন এটি। কোন্ডা, দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে বুড়িগঙ্গার জায়গায় পাকা ভবনে রয়েছে কান্দাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে বুড়িগঙ্গা নদী দখল করে দোতলা পাকা ভবন করে গড়ে তোলা হয়েছে হাসনাবাদ কামুচাঁন শাহ উচ্চ বিদ্যালয়।

কামরাঙ্গীরচরে বুড়িগঙ্গা গণ-পাঠাগার সমাজকল্যাণ সংস্থার নামেও নদীর জমি দখল করা আছে। এ ছাড়াও বসিলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি তুরাগ নদীর জমি দখল করে তিনতলা পাকা ভবন করা হয়েছে (বসিলা মৌজা)। আরব মিশন পাবলিক স্কুল, আমিন মোমিন হাউজিং সংলগ্ন। এটি মোহাম্মদপুরে অবস্থিত। মৌজা কাঁটাসুর। তুরাগ নদী দখল করে একতলা পাকা ভবন নির্মাণ করা হয়েছে।
গাজীপুরের টঙ্গী বাজার সিরাজ উদ্দিন সরকার বিদ্যানিকেতন অ্যান্ড কলেজ তুরাগ নদ দখল করে তিনতলা ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। শুধু ভবন ছাড়াও স্কুলটিতে বাণিজ্যিক সংশ্লিষ্টতাও আছে। নদীর থেকে সংলগ্ন রাস্তার বাইরে এটি অবস্থিত। বালু নদী দখল করে তলনা রুহুল আমিন খান উচ্চ বিদ্যালয়টি দোতলা ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এটি রাজধানীর খিলক্ষেতে অবস্থিত।

ঢাকার ডেমরার বীৎপুর হাজী মো. লালমিয়া উচ্চ বিদ্যালয় চারতলা পাকা ভবন। বীৎপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এটিও নদী দখল করে করা হয়েছে। বালুরপাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দক্ষিণপাড়া রূপগঞ্জেও একই ঘটনা ঘটেছে। নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে শীতলক্ষ্যা নদী দখল করে আধাপাকা ভবনে গড়ে তোলা হয়েছে পাঁচতারা জুনিয়র হাইস্কুল।

×