ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১

জয়পুরহাটের গ্রামে ফল ধরেছে ১০৩ গাছে

আরব দেশের খেজুর, চাষ হচ্ছে ২০ জেলায়

তাহমিন হক ববী

প্রকাশিত: ২২:৪০, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪

আরব দেশের খেজুর, চাষ হচ্ছে ২০ জেলায়

উত্তরাঞ্চলের মুনজিয়া গ্রামে সাইফুল ইসলামের বাগানে ১০৩টি গাছে আরব দেশের  খেজুর ধরেছে। চলছে পরিচর্যা

রোজার মাসকে উপলক্ষ করে টনকে টন খেজুর আমদানি করা হয় প্রতিবছর। ইফতারে খেজুরের জনপ্রিয়তা এবং চাহিদা বিপুল। সেখানে একটা সময় পর্যন্ত দেশী খেজুরের চেয়ে বেশি আদরণীয় ছিল বিদেশী খেজুর। বিশেষ করে সৌদি আরব থেকে আসা খেজুর। কিন্তু কয়েক বছর ধরে সেই সৌদি আরবের বিভিন্ন জাতের খেজুর চাষ করা হচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। খেজুর গাছে নারী ও পুরুষ ভেদ আছে।

পুরুষ গাছে ফল হয় না। কিন্তু পরাগায়ণের জন্য পুরুষ গাছ দরকার হয়। খেজুর গাছের পরাগায়ণ পোকা-মাকড়, মৌমাছি কিংবা বাতাসের মাধ্যমে কমই হয়ে থাকে। এমন একটি গ্রাম মুনজিয়া। উত্তরাঞ্চলের জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলায় এই গ্রাম। গাছে থোকায় থোকায় ঝুলছে কাঁচা-পাকা খেজুর।

মরিয়ম, আজোয়া, মেডজুল, আম্বার, সুক্কারিসহ ১০ জাতের খেজুর রয়েছে মুনজিয়া গ্রামের সাইফুল ইসলামের বাগানে। স্থানীয়ভাবে চাষিদের কাছে এসব খেজুর ‘আরবি খেজুর’ বা ‘সৌদি খেজুর’ নামে পরিচিত। স্থানীয় বাজার এবং সুপারশপে এখন বছরজুড়ে এই খেজুর পাওয়া যায়।

পৃথিবীতে প্রায় এক হাজারের বেশি খেজুরের জাত রয়েছে, এর মধ্যে সৌদি আরবে চারশ’র বেশি জাতের খেজুর উৎপন্ন হয়। কৃষিবিজ্ঞানী এবং চাষিরা বলছেন, সৌদি খেজুর মূলত দেশী খেজুরের চেয়ে দেখতে কিছুটা লম্বা এবং মাংসল হয়ে থাকে। স্থানীয়ভাবে উৎপন্ন সৌদি খেজুর আমদানি হওয়া সৌদি খেজুরের চেয়ে কিছুটা কম মিষ্টি। অন্যদিকে আমদানি হওয়া সৌদি খেজুরের চেয়ে কম শুষ্ক হয় দেশে উৎপন্ন হওয়া এসব সৌদি খেজুর।
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাগ্রিকালচারাল বোটানি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, মূলত দুটি কারণে বাংলাদেশে সৌদি খেজুরের চাষ দ্রুত জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এক, বাংলাদেশের আবহাওয়া এখন আগের চেয়ে অনেক উষ্ণ হয়ে উঠেছে। অর্থাৎ গ্রীষ্মের ভাব বেশি সময় ধরে থাকে। যে কারণে সৌদি আরবের আবহাওয়া সহিষ্ণু ফল এখানে এখন সহজে চাষ করা সম্ভব হচ্ছে।

দুই, বাংলাদেশের মাটিতে এখন আগের চেয়ে লবণাক্ততার পরিমাণও অনেক বেড়েছে। যে কারণে এ ফলের ফলন ভালো হচ্ছে। মূলত সে কারণেই দেশের কৃষি উদ্যোক্তাদের মধ্যে সৌদি খেজুর চাষ দ্রুত খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। আরেকটি কারণ হচ্ছে, খেজুর গাছ সাধারণত সব ধরনের মাটিতে চাষ করা যায়। যদিও বেলে ও বেলে- দোআঁশ মাটিতে সহজে চাষ করা যায় এই খেজুর।

কেবল নিশ্চিত করতে হবে পানি নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা যেন থাকে। এখন কেবল মানিকগঞ্জ নয়, মাগুরা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, বাগেরহাটসহ দেশের ২০টি জেলায় এ খেজুর বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে। বিশেষ করে যেসব জায়গায় মাটি বেলে এবং দোআঁশ ধরনের সেখানে। সেই সঙ্গে সরকারের কৃষি বিভাগও জেলায় জেলায় এই খেজুর চাষে উৎসাহী করছে নতুন কৃষি উদ্যোক্তাদের।

কৃষি বিভাগ নিজেরাও বিভিন্ন জেলায় এ পর্যন্ত ১৭টি আধুনিক উন্নত জাতের খেজুরের চারা আমদানি করে হর্টিকালচার সেন্টারে চাষ করছে এই খেজুর। মজার বিষয় হচ্ছে, খেজুর গাছে নারী ও পুরুষ ভেদ আছে। পুরুষ গাছে ফল হয় না। কিন্তু পরাগায়ণের জন্য পুরুষ গাছ দরকার হয়। খেজুর গাছের পরাগায়ণ পোকা-মাকড়, মৌমাছি কিংবা বাতাসের মাধ্যমে কমই হয়ে থাকে।
কৃষি গবেষকরা বলছেন, মূলত মধ্যপ্রাচ্যে থাকা প্রবাসী বাংলাদেশীদের হাত ধরেই দেশে সৌদি খেজুরের উৎপাদন শুরু। বাংলাদেশ কৃষি অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩-১৪ সালের দিকেই বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে সৌদি খেজুরের চাষ শুরু হয়। বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ  শুরুর দিকে তাদের প্রায় সবাই সৌদি আরব থেকে বীজ এবং চারা এনে গাছ লাগিয়েছিলেন। বাংলাদেশে প্রথম যারা বাণিজ্যিক ভিত্তিতে সৌদি খেজুর চাষ শুরু করেন তাদের একজন মানিকগঞ্জের শেখ মোহাম্মদ আব্দুল হালিম। তার মাধ্যমেও প্রতিটি টিস্যু কালচার চারা ধীরে ধীরে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। 
জয়পুরহাটের মুনজিয়া গ্রামের সাইফুল ইসলাম জানান, ২০২১ সালে ইউটিউব থেকে খেজুর বাগান করার আগ্রহ জন্মে। খোঁজ নিয়ে মানিকগঞ্জের শেখ মোহাম্মদ আব্দুল হালিম ও  নরসিংদীসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে চারা সংগ্রহ করেন তিনি।  ২০২১ সালের  ৪৫০টি চারা রোপণ করেন। প্রতিটি চারা ২৫০০ থেকে ৩০০০ টাকা করে  কেনেন।

এ ছাড়া প্রতিটি টিস্যু কালচার চারা সাড়ে ৯ থেকে ১০ হাজার টাকা দামেও কিনতে হয়েছে। তবে দাম নির্ধারিত হয় জাতের ওপর নির্ভর করে। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত আমার বাগানে সব মিলিয়ে প্রায় ২৩ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ইউটিউব দেখেই সব গাছের পরিচর্যা করেছি। এরই মধ্যে ১০৩টি গাছে ফল ধরেছে। যে ফল থেকে ৫-৭ লাখ টাকা বিক্রির আশা করছি।
মনজিয়া গ্রামের কৃষক সাইফুল ইসলাম বলেন, সাইফুল ইসলাম প্রথমে যখন বাগানে এসব গাছ লাগান তখন বিশ্বাস করিনি যে খেজুর ধরবে। অথচ এখন বাগানে অনেক সুন্দর খেজুর ধরেছে। বাগান দেখে অনেক ভালো লাগছে। আমরাও বাগান করার স্বপ্ন দেখছি।
রায়কালি গ্রামের অপর কৃষক আতোয়ার হোসেন জানান, আমি কিছুদিন আগে জানতে পারলাম, আমাদের আক্কেলপুরেই সৌদি আরবের খেজুর চাষ হচ্ছে। তাই বাগানটি দেখতে যাই। বাগান দেখে খুব ভালো  লেগেছে। গাছে গাছে খেজুর ধরে আছে। আমি ভাবছি আরব দেশের খেজুর বাগান গড়ে তুলব। 
এদিকে সরকারের কৃষি তথ্য সার্ভিসে দেওয়া তথ্য বলছে, খেজুরে প্রচুর প্রোটিন, ভিটামিন, মিনারেলস গুণাবলী রয়েছে। খেজুর হজম শক্তি বাড়ায়, রক্ত স্বল্পতা দূর করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য সারায়। রক্তশূন্যতা, ডায়রিয়া এবং সুস্থ গর্ভধারণে  খেজুর উপকারী বলে সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে।

×