ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১

সংরক্ষণের সাহস দেখায় না প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরও

বুড়িগঙ্গা তীরে ধুঁকছে উনিশ শতকের আর্মেনীয় স্থাপনা

মোরসালিন মিজান

প্রকাশিত: ২২:৪৮, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪

বুড়িগঙ্গা তীরে ধুঁকছে উনিশ শতকের আর্মেনীয় স্থাপনা

সদরঘাট এলাকায় আর্মেনীয় জমিদার আরাতুনের প্রাসাদ

সবাই এখন ঢাকামুখী। সবাই বলতে, দেশের মানুষ। তবে কয়েকশ’ বছর আগে বাইরের দেশ থেকেও বহু মানুষ এখানে আসতেন। বিশেষ করে বণিক সম্প্রদায়কে বুড়িগঙ্গা তীরের শহর খুব আকৃষ্ট করত। অভিন্ন আকর্ষণে ঢাকায় এসেছিল আর্মেনীয়রা। আমদানি-রপ্তানি ব্যবসা করতেন তারা। ইতিহাসবিদদের মতে, ষোড়শ শতক থেকে আর্মেনীয়রা বাংলায় আসতে শুরু করে। ঢাকায় কবে কবে  আগমন ঘটেছিল এ ব্যাপারে নিশ্চিত তথ্য পাওয়া যায় না। আর্মেনীয়দের কিছু কবর আছে ঢাকায়।

কবরের শিলালিপিতে যে তথ্য পাওয়া যায় সে অনুযায়ী, অষ্টাদশ শতকের শেষভাগ থেকে তারা এখানে বসবাস করছিল। রেশম এবং পাটের ব্যবসায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিল সম্প্রদায়টি। বিপুল অর্থ বিত্তেরও মালিক ছিলেন তারা। ঢাকায় তাই অনেক স্থাপনা নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাদের নির্মিত ভবন, চার্চ, সমাধি কমপ্লেক্স এখনো ঢাকার প্রাচীন ইতিহাসের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। তবে একটি ভবন ঢাকার ইতিহাস আলোচনায় আলাদা গুরুত্ব পেয়ে আসছে সব সময়।

বুড়িগঙ্গা তীরে অবস্থিত ভবনটি আর্মেনীয় জমিদার আরাতুনের। ঠিক চিনতে পারছেন না? তাহলে আরেকটু পরিষ্কার করা যাক। রূপলাল হাউসটি তো চেনেন? ঐতিহ্যপ্রিয় বা পুরাকীর্তিপ্রেমীরা নিশ্চয়ই দেখে থাকবেন। হ্যাঁ, এই রূপলাল হাউসের মূল ভবনটি আসলে আরাতুনের। পরে তিনি এটি ব্যবসায়ী রূপলালের কাছে বিক্রি করে দেন বলে ইতিহাসবিদরা নিশ্চিত করেছেন। অর্থাৎ ক্রয়সূত্রে দ্বিতীয় মালিক রূপলাল।     
খ্যাতিমান ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন তার ঢাকা বিষয়ক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, উনিশ শতকের ঢাকায় নবাব আবদুল গণির আহসান মঞ্জিলের সঙ্গে জাঁকজমকের দিক থেকে পাল্লা দিতে পারত আরেকটি অট্টালিকাÑ রূপলাল দাসের রূপলাল হাউস। তাঁর অনুমান, মূল বাড়িটি ছিল ঢাকা বিখ্যাত আর্মেনীয় জমিদার আরাতুনের। তার কাছ থেকে এটি কিনে নেন রূপলাল দাস। রূপলাল দাস, সনাতন দাস ও রঘুনাথ দাস এই তিন ভাই ছিলেন ঢাকার ধনাঢ্য জমিদার।

এক পর্যায়ে পৃথক হয়ে রূপলাল ও রঘুনাথ ফরাশগঞ্জে চলে আসেন। প্রথমে এখানে রঘুনাথের বাড়ি নির্মিত হয়েছিল। ‘রঘুবাবুর বাড়ি’র ঠিক পাশে ছিল রূপলাল হাউস। কেনার পর মার্টিন কোম্পানিকে দিয়ে বাড়িটি পুনর্নির্মাণ করিয়েছিলেন তিনি। মুনতাসীর মামুনের মতে, রঘুনাথ ও রূপলালের বাড়ির মাঝখানের সীমানা প্রাচীর ভেঙে দিলে এটিকে এককই মনে হয়। রূপলাল হাউসের দ্বিতীয় তলায় বিভিন্ন আকার ও আয়তনের অর্ধশতাধিক কক্ষ ছিল। ভবনে আরও ছিল প্রশস্ত দরবার কক্ষ।

বিশাল ভবনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে উত্তর-দক্ষিণ পাশে বারান্দা নির্মাণ করা হয়েছিল। এ ধরনের ভবনে নাচঘর না রাখলেই নয়। রূপলাল হাউসের দু’তলার পশ্চিমাংশে অবস্থিত নাচঘর ছিল অত্যন্ত আকর্ষণীয়। 
ওই সময়ের বিবেচনায় গুরুত্বপূর্ণ অনেক ব্যক্তি রূপলাল হাউসের অতিথি হয়েছেন। একজনের কথা তো ঘুরে ফিরেই আসে। তিনি লর্ড ডারফিন। ভারতের ভাইসরয় ১৮৮৮ সালে এক সরকারি সফরে এসে রূপলাল হাউসে গমন করেন।

ইংরেজরা ডারফিনের মনোরঞ্জনের জন্য বল-নাচের আয়োজন করবে বলে ঠিক করেছিল। কিন্তু এ ধরনের একটি আয়োজন করার মতো বড় হলঘর কোথায় পাওয়া যাবে? আহসান মঞ্জিল ও রূপলাল হাউসÑ এ দুটির মধ্যে ভোটাভুটির মাধ্যমে নির্বাচন করা হয়েছিল রূপলাল হাউসকে। লর্ড ডারফিনকে নাচ দেখাতে দুদিনের জন্য দুইশ’ টাকায় ভাড়া নেওয়া হয়েছিল রূপলাল হাউস। 
৯১.৪৪ মিটার দীর্ঘ দ্বিতল ভবন গ্রিক স্থাপত্য রীতির অনবদ্য নিদর্শন। ভবনের বিশাল ডরিক কলাম, সেইসঙ্গে ওপরের দিকে মাঝখানটায় বড় একটি ঘড়ি স্থাপন করা হয়েছিল। সব মিলিয়ে ঢাকাবাসী চমকিত না হয়ে পারেননি। তবে বিষ শতকের প্রথম দশকে ভবনের জৌলুস কমতে থাকে।

১৯৪৭ সালে ভারতভাগের সময় রূপলালের উত্তরাধিকারীরা বাড়ি বদল করে কলকাতা চলে যান। এরপর থেকে প্রকৃত দুর্দিন নেমে আসে। পুরাকীর্তি সংরক্ষণের পরিবর্তে শুরু হয় ধ্বংসের খেলা। দেখতে  দেখতে ঢাকার অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্থাপত্য নিদর্শন দখলে নিয়ে নেন মসলা ও সবজি ব্যবসায়ীরা! 
বর্তমান অবস্থা জানতে চান? ওই যে বলা হলো মসলা ব্যবাসীদের কথা, সংরক্ষণের অভাবে ধুঁকতে থাকা ভবন দখলে নিয়েছেন তারাই। আপনি সামনে দিয়ে হেঁটে চলে যাবেন, চোখে পড়বে না! কারও কাছে জানতে চাওয়াও খুব একটা নিরাপদ নয়। ব্যবসায়ীরা খুব সন্দেহ করেন।

অবশ্য ভাগ্য ভালো হলে পুরনো কাউকে পেয়ে যেতে পারেন, সেক্ষেত্রে সহযোগিতা পাবার আশা থাকে। সাহস প্রসঙ্গে না বললেই নয়, ভবনে প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরের সাইনবোর্ড ঝুলানো আছে। আছে বটে। ভবন সংরক্ষণ বা সংস্কারের সাহসই আজও দেখাতে পারেনি সরকারি এই প্রতিষ্ঠান।

×