ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৩ আশ্বিন ১৪৩১

সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি শ্রমজীবীর মানুষের

টানা বৃষ্টিতে স্থবির জনজীবন

স্টাফ রিপোর্টার

প্রকাশিত: ০১:০৯, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪

টানা বৃষ্টিতে স্থবির জনজীবন

দুই দিনের টানা বৃষ্টিতে ঢাকার বিভিন্ন সড়কে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়।  বৃষ্টি আর জলাবদ্ধতায় ভোগান্তিতে পড়ে সাধারণ মানুষ

দেশজুড়ে টানা বৃষ্টিতে স্থবির হয়ে পড়েছে জনজীবন। সকাল-সন্ধ্যা বিরামহীন অঝোরে ঝরেছে। সঙ্গে বইছে ঝড়ো বাতাস। কয়েকদিন ধরে বৃষ্টি ঝরলেও রবিবারের বৃষ্টি নাগরিক ভোগান্তি বাড়িয়েছে। দিন-রাত চলা এ বৃষ্টিতে রাজধানীবাসীর স্বাভাবিক কার্যক্রম থমকে গেছে। বর্ষার শেষ সময়ের বর্ষণে ঘর থেকে বের হওয়াও কঠিন হয়ে পড়েছে। সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে শ্রমজীবী মানুষেরা। অফিসগামী সাধারণ মানুষ, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগও অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে।

টানা বৃষ্টির কারণে অনেকে ঘর থেকে বের না হলেও শ্রমজীবীদের পেটের দায়ে বের হতে দেখা গেছে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ও সড়ক ঘুরে দেখা যায়, এদিন যারাই রাস্তায় বের হয়েছেন পড়েছেন বৃষ্টিতে সৃষ্ট দুর্ভোগে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নি¤œচাপের কারণে সারাদেশে ঝরছে বৃষ্টি। তবে বৃষ্টির হার বেশি খুলনা, বরিশাল, ঢাকা ও রাজশাহী বিভাগে। আজ সোমবারও এসব বিভাগে ভারি থেকে অতিভারি বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। তবে মঙ্গলবার থেকে বৃষ্টি কমে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে।
আবহাওয়াবিদ তরিফুল নেওয়াজ কবীর জনকণ্ঠকে জানান, সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ১২ ঘণ্টায় রাজধানী ঢাকায় ৫৯ মিমি বৃষ্টি হয়েছে। তবে মঙ্গলবার থেকে বৃষ্টির হার কমে আসবে। এদিন পটুয়াখালীতে দেশের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে ১৬১ মিমি।
সরেজমিন রাজধানীতে বৃষ্টির প্রভাবে অফিস-আদালত খোলা থাকলেও সেবাপ্রত্যাশীদের দেখা সেভাবে মেলেনি। সড়কে গাড়ির সংখ্যাও ছিল কম। তবে কোথাও কোথাও অব্যবস্থাপনার কারণে যানজট দেখা গেছে।

রবিবার দুপুরে মিরপুরে গাড়ির চাপ না দেখা গেলেও সড়কে জমেছিল পানি। সড়কে পথচারীর সংখ্যাও ছিল হাতেগোনা। কিন্তু দুপুরে ফার্মগেট ও কাওরানবাজার সড়কে দীর্ঘক্ষণ গাড়ি-মোটারযানকে থেমে থাকতে দেখা গেছে। এসব এলাকার মার্কেট, দোকানপাট খোলা থাকলেও ক্রেতা ছিল না বলে জানিয়েছেন বিক্রেতারা।
গতকালও সারাদেশের সমুদ্রবন্দরগুলোতে ৩ নম্বর সতর্ক সংকেত ও নদীবন্দরে ১ নম্বর সংকেত বলবৎ ছিল। আবহাওয়া অফিস জনকণ্ঠকে জানিয়েছে, সোমবার সমুদ্রবন্দরকে ২ নম্বর সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। এ ছাড়াও নদীবন্দরগুলোতেও সতর্ক সংকেত নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। 
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানায়, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল এবং তৎসংলগ্ন উত্তরপূর্ব বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত সুস্পষ্ট লঘুচাপটি ঘনীভূত হয়ে প্রথমে নি¤œচাপ ও পরবর্তীতে গভীর স্থল নি¤œচাপে পরিণত হয়েছে। এর ফলে এই বারিপাত চলছে। আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম মল্লিক জনকণ্ঠকে জানান, সাগরে লঘুচাপ সৃষ্টি হওয়ার প্রথম পর্যায়ে আবহাওয়া অফিস থেকে ভারি বর্ষণ ও পাহাড় ধসের সতর্কবার্তা দিয়েছে। কিন্তু এখন নি¤œচাপ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশে যাওয়ায় পাহাড় ধসের শঙ্কা নেই। 
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানায়, দেশজুড়ে চলমান বৃষ্টিপাত আরও একদিন অব্যাহত থাকতে পারে। সেইসঙ্গে এই সময়ে দেশের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারি থেকে অতিভারি বর্ষণ হতে পারে। তবে বর্ধিত ৫ দিনে বৃষ্টিপাতের প্রবণতা কমে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেতে পারে।
আবহাওয়াবিদ মো. বজলুর রশিদ জানান, মৌসুমি বায়ুর অক্ষের বর্ধিতাংশ ভারতের পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশ, বিহার, গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গ, গভীর স্থল নি¤œচাপের কেন্দ্রস্থল ও বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চল হয়ে আসাম পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। সেইসঙ্গে মৌসুমি বায়ু বাংলাদেশের ওপর সক্রিয় এবং উত্তর বঙ্গোপসাগরে প্রবল অবস্থায় রয়েছে।
সোমবার সকাল ৯টা পর্যন্ত রংপুর, রাজশাহী, ঢাকা, ময়মনসিংহ, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অনেক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেইসঙ্গে এই সময়েও দেশের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারি থেকে অতিভারি বর্ষণ হতে পারে। তবে সারাদেশে দিন ও রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে।
আগামীকাল মঙ্গলবার সকাল ৯টা পর্যন্ত দেওয়া আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, এই সময়ে রংপুর, রাজশাহী, ঢাকা, ময়মনসিংহ, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে।

সেইসঙ্গে দেশের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারি বর্ষণ হতে পারে। তবে এই সময়ে সারাদেশে দিন ও রাতের তাপমাত্রা ২-৩ ডিগ্রি বৃদ্ধি পেতে পারে। এ ছাড়া আগামী ৫ দিনে বৃষ্টিপাতের প্রবণতা কমে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেতে পারে বলেও পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
মোংলা বন্দরে পণ্য ওঠা-নামা ব্যাহত : স্টাফ রিপোর্টার ও নিজস্ব সংবাদদাতাররা জানান, বৈরী আবহাওয়া ও বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নি¤œ চাপের প্রভাবে টানা কয়েকদিনের বৃষ্টিতে প্রায় থমকে গেছে মানুষের জীবনযাত্রা। সুন্দরবন উপকূলে টানা ভারি বৃষ্টিতে মোংলা বন্দরে ব্যাহত পণ্য ওঠা-নামা। বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জে তিন শতাধিক মৎস্যঘের পানির নিচে। পৌর সদরসহ ২০ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।

টানা বৃষ্টিতে পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় ৫০ গ্রাম পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া কুষ্টিয়া, মুন্সীগঞ্জ,পিরোজপুর ও নোয়াখালীতে টানা বর্ষণে বিপর্যস্ত জনজীবন। প্লাবিত হয়েছে অনেক এলাকার নি¤œাঞ্চল। 
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নি¤œচাপের প্রভাবে ভারি বৃষ্টিপাতের ফলে সুন্দরবন উপকূলীয় জেলা বাগেরহাটের নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। গ্রামের পর গ্রামের ঘরবাড়ি, ফসলের খেত, রাস্তাঘাট ও চিংড়িঘের-পুকুর জলাবদ্ধ হয়ে আছে। ভাটির গোণ হওয়া সত্ত্বেও পানি নিষ্কাশনে প্রতিবন্ধকতা থাকায় গ্রামের পাশাপাশি  মোংলা, মোরেলগঞ্জ ও বাগেরহাট পৌরসভায় বিভিন্ন স্থান পানিবন্দি হয়ে আছে। জলাবদ্ধতার কারণে অসংখ্য পরিবার রান্নাবান্না করতে পারছে না। স্বাভাবিক কাজকর্মও বিঘিœত হচ্ছে। শহরে দোকাটপাট খুলেছে কম। যানবাহন কম। এতে বেশি বিপাকে পড়েছেন খেটে খাওয়া মানুষ।
বঙ্গোপসাগর প্রচ- উত্তাল হওয়ায় ইলিশ আহরণের ভরা মৌসুম সত্ত্বেও সমুদ্রে টিকতে না পেরে অধিকাংশ জেলে ট্রলার উপকূলসহ সুন্দরবনের বিভিন্ন স্থানে নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরে এসেছে। শরণখোলা সমুদ্রগামী ফিশিং ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি মো. আবুল হোসেন জানান, সাগরে প্রচ- ঢেউ হচ্ছে। ইলিশ আহরণের শত শত ট্রলার সুন্দরবন ও উপকূলের বিভিন্ন এলাকায় এখন নিরাপদ আশ্রয়ে রয়েছে।

বর্তমানে শত শত ফিশিং ট্রলার পাথরঘাটা, মহিদপুর, নিদ্রাছখিনা ও পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের মেহেরআলী, ভেদাখালী ও দুবলার বিভিন্ন খালে আশ্রয়ে রয়েছে।’ প্রায় ৪০ জন জেলের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে। তবে সুন্দরবন সংলগ্ন সমুদ্রে কোনো ট্রলার ডুবির খবর রবিবার দুপুর পর্যন্ত নিশ্চিত করে জানা যায়নি।

ঝড়ো হাওয়ার সঙ্গে ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে রবিবারও মোংলা বন্দরে মালামাল ওঠা-নামার কাজ ব্যাহত হয়।  মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের হারবার বিভাগ জানায়, মোংলা বন্দরে বর্তমানে ৭টি বাণিজ্যিক জাহাজ অবস্থান করছে। এর মধ্যে এমভি অপরাজিতা এবং এমভি ওয়েকু হোলিও জাহাজ দু’টিতে শুক্রবার রাত থেকে ভারি বৃষ্টির কারণে আমদানিকৃত সার খালাস বন্ধ থাকে।’
শরণখোলা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক শেখ মাহাবুব হোসেন বলেন, বৈরী আবহাওয়ায় সাগর আশান্ত হয়ে ওঠায় বহু ট্রলার সুন্দরবনের বিভিন্ন খালে আশ্রয় নিয়েছে। আশ্রয় নেওয়া জেলেদেরে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট এলাকার বনরক্ষীদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। 
মোরেলগঞ্জ, বাগেরহাট : বৈরী আবহাওয়া ও সাগরে সৃষ্ট লঘুচাপের প্রভাবে চারদিনের টানা প্রবল বর্ষণে বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জে  তিন শতাধিক মৎস্য ঘের পানিতে তলিয়ে গেছে। এক হাজার হেক্টর ফসলি জমির রোপা আমন পানিতে নিমজ্জিত হয়ে কৃষক দিশাহারা হয়ে পড়েছে। পৌর সদরসহ নি¤œাঞ্চলের ২০ গ্রামের শত শত পরিবার পানিবন্দি হয়ে রান্না খাওয়া বন্ধ হয়ে পড়েছে।

শনিবার বিকেল ৪টা থেকে রবিবার বেলা ১১টা পর্যন্ত দীর্ঘ ২০ ঘণ্টা  পৌর শহরের এলাকাগুলোতে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন এ ছাড়া  গত তিন দিন ধরে অধিকাংশ গ্রামগুলোতে বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ রয়েছে।
সরেজমিন রবিবার খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপজেলার ১৬টি ইউনিয়নসহ পৌর শহরে গত ৪ দিনে একটানা প্রবল বর্ষণে বৃষ্টির পানি জমে রাস্তাঘাট তলিয়ে গিয়ে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। রবিবার সকাল থেকেই শহরের ব্যবসায়ীরা কিছু  দোকানপাট  খুললেও অধিকাংশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে বন্ধ। প্রধান প্রধান  সড়কগুলোতে হাঁটুপানি জমে দোকানগুলোর  মধ্যেও  ঢুকে পড়েছে পানি।  

খেটে খাওয়া দিনমজুর শ্রমজীবী মানুষ পড়েছে বিপাকে। প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে নৌরুটে ও সড়কপথে যান চলাচল রয়েছে খুবই কম। ঢাকা চট্টগ্রাম দুরপাল্লার পরিবহন কম থাকায়  দীর্ঘ ৩-৪ ঘণ্টা পর পর নদীতে ফেরি পারাপার হয়েছে যাত্রীরা। 
নদীর তীরবর্তী  নি¤œাঞ্চল এলাকা খাউলিয়া, মোরেলগঞ্জ সদর, জিউধরা, বারইখালী, নিশানবাড়ীয়া, হোগলাবুনিয়া, বলইবুনিয়া,পঞ্চকরনের দেবরাজ কুমারিয়া জোলা, পুটিখালীর সোনাখালী, তেলীগাতির হেড়মা মিস্ত্রি ডাঙ্গাসহ ২০টি গ্রাম প্রবল বর্ষণে পানি জমে বাড়িঘরে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে শত শত পরিবার পনিবন্দি হয়ে পড়েছে। 
এ বিষয়ে উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা বিনয় কুমার রায় জানিয়েছেন, একটানা  ৪ দিন প্রবল বর্ষণে উপজেলার নিচু এলাকায় কিছু মৎস্যঘের তলিয়ে গেছে খবর পেয়েছি। ক্ষতিগ্রস্ত ঘেরগুলোর এখনো সঠিক তালিকা করা যায়নি। একটু বৃষ্টির চাপ কমলে সরেজমিন খোঁজখবর  নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ঘের মালিকের  তালিকা করে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অবহিত করা হবে।

উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, এ উপজেলায় এবারে ১৬হাজার ৫শ’ হেক্টর ফসলি জমিতে কৃষক স্থানীয় আমন ধান রোপণ করেছেন। এর মধ্যে নি¤œাঞ্চলের কিছু এলাকায়  প্রায় এক হাজার হেক্টর জমিতে বৃষ্টির পানি জমে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। তবে সেসব এলাকায় বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা  করা হয়েছে।

যে কারণে কৃষকের তেমন একটা ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে না।
কলাপাড়া, পটুয়াখালী : নি¤œচাপের প্রভাবে কলাপাড়ায় দুইদিনের টানা ভারি থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে গোটা এলাকার আমন ক্ষেত। সদ্য রোপণ করা আমন চারা এবং আমনের বীজতলার এক দুই তৃতীয়াংশ এখন পানির নিচে। কোথাও কোমর সমান আবার কোথাও হাঁটু সমান নিচে আমন খেত। অন্তত ৫০ গ্রামের মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।

মহিপুর ইউনিয়নের  ইউসুফপুর, বিপিনপুর, পুরানমহিপুরসহ অন্তত নয়টি গ্রাম এখন পানির নিচে রয়েছে। একই দশা নীলগঞ্জের আদমপুর, ফতেহপুর, তাহেরপুর, পশ্চিম সোনাতলা, কুমিরমারাসহ অন্তত ১২ গ্রামের। এভাবে উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের অন্তত অর্ধেকটা পানিতে ডুবে আছে। গ্রামের মানুষ জানান, পানি স্লুইসগেট থেকে ঠিকমতো নামতে পারছে না। এক শ্রেণির প্রভাবশালী মহল খালে এবং স্লুইসের সামনে পেতে মাছ ধরায় পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

কলাপাড়া পৌরসভার চিঙ্গরিয়া মহল্লার অর্ধেকটা পানিতে বন্দি হয়ে পড়েছেন। কৃষকসহ সাধারণ মানুষের ভোগান্তির যেন শেষ নেই। কৃষক সুলতান গাজী জানান, এবারে আমন চারা পচে গেলে আর এ বছর আমন ফসল পাওয়ার কোনো উপায় থাকবে না বলে অধিকাংশ কৃষকের মন্তব্য। উপজেলা কৃষিকর্মকর্তা কৃষিবিদ মোহাম্মদ আরাফাত হোসেন জানান, তিনি কৃষকের খোঁজখবর নিচ্ছেন। সমস্যা সমাধানে পানি দ্রুত নামার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছেন।
দৌলতপুর, কুষ্টিয়া : দৌলতপুরে নিম্নচাপের প্রভাবে রেকর্ড পরিমাণে বৃষ্টিপাত হয়েছে। শনিবার দুপুর ১২টা থেকে রবিবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত ৪ দশমিক ৪৪ ইঞ্চি (১১৩ মিলিমিটার) বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। যা চলতি বছরে সর্বোচ্চ বলে জানিয়েছেন কুষ্টিয়ার কুমারখালী আবহাওয়া কার্যালয়। 
গত শুক্রবার রাত থেকে শুরু হওয়া গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শনিবার বিকেল থেকে রূপ নেয় ভারি বৃষ্টিপাতে। পরে মধ্যে রাত থেকে রবিবার দুপুর পর্যন্ত দমকা ঝড়ো হাওয়ার সঙ্গে ভারি বৃষ্টিপাত শুরু হয়। রবিবার রাত ২টা থেকে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে পুরো  দৌলতপুর উপজেলা। ১২ ঘণ্টা  বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন থাকার ফলে চরম জন দুর্ভোগ দেখা দেয়।
ভারী বৃষ্টিপাত ও ঝড়ে হাওয়ার কারণে ভোগান্তিতে পড়েছে দৌলতপুর উপজেলার নিম্ন ও মধ্যে আয়ের মানুষ। ঘর থেকে খুব একটা বের হয়নি স্কুল -কলেজগামী শিক্ষার্থীরা। বিপাকে পড়েছেন ছোট বড় গো-খামারি, ডুবেছে ফসলের মাঠ। সকালে উপজেলার হোসেনাবাদ বাজারে কথা হয় দেলুয়ার হোসেন নামের এক অটোরিক্সাচালকের সঙ্গে। তিনি বলেন, রাত থেকে বৃষ্টির সঙ্গে বাতাস হচ্ছে। সকালে গাড়ি নিয়ে বাইরে এলাম ভাড়ার উদ্দেশ্যে। তবে রাস্তায় তেমন একটা মানুষের দেখা পাওয়া যাচ্ছে না।

বিদ্যুৎ সরবরাহ নিয়ে দৌলতপুর পল্লী বিদ্যুতের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার মির্জা কে ই তুহিনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, রবিবার ভোর রাত থেকে উপজেলা পুরো বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। দমকা হাওয়ার কারণে বেশ কিছু স্থানে বৈদ্যুতিক তার ছিঁড়েছে, দুটি বৈদ্যুতিক পোল ভেঙে গেছ। গাছ উপড়ে পড়েছে তারের ওপর। এ কারণে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ আছে। আবহাওয়া স্বাভাবিক হলে কাজ শুরু হবে। তবুও আমাদের কর্মীরা মাঠে কাজ করছে।
কৃষির ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিয়ে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার নুরুল ইসলামের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত ৮০ হেক্টর জমিতে ক্ষয়ক্ষতির হিসাব আমরা পেয়েছি। এর মধ্যে কলা, তুলা, মরিচ, সবজি ও কালাইয়ের হিসাব পেয়েছি।’
এদিকে আবহাওয়া নিয়ে কুষ্টিয়ার কুমারখালী আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মামুনুর রশীদ বলেন, চলতি বছরে গেল ২৪ ঘণ্টায় রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়েছে। এর আগে ১২ জুলাই ১১১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছিল। আগামী সোমবার থেকে আবহাওয়া কিছুটা উন্নতি হতে পারে।
নোয়াখালী : নতুন করে বৃষ্টিতে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। রবিবার শেষ বিকেলে নোয়াখালী সরকারি কলেজের অনার্স পড়ুয়া তিন শিক্ষার্থী রুফাইদা, জান্নাত ও তাসনিম গত এক মাস বন্যার পানিতে স্বাভাবিক জীবন-যাপন ব্যাহত হচ্ছে বলে নোয়াখালী জেলার নবাগত জেলা প্রশাসক খন্দকার ইসতিয়াক আহমেদের নিকট এসেছেন সহযোগিতার জন্য। তারা জানান, বন্যার কারণে কলেজ কিংবা বাড়ি কোথাও যেতে পারছেন না।

এদিকে নতুন করে বৃষ্টি শুরু হওয়ায় নোয়াখালীর সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আবারও অবনতি হয়েছে। গত কয়েক দিন ধরে শুরু হওয়া বৃষ্টিতে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়। এতে নতুন করে দুর্ভোগের মধ্যে পড়েছেন আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়ে বাড়ি ফেরা মানুষগুলো। তাঁদের অনেকেই এরই মধ্যে আবার আশ্রয়কেন্দ্রে আসতে শুরু করেছেন বলে জানা গেছে। নতুন বৃষ্টিপাতের ফলে যেসব সড়ক ও বাড়িঘর থেকে পানি সরে গেছে, সেগুলোর বেশির ভাগই আবার ডুবে গেছে। ডুবে গেছে জেলা শহর মাইজদীর বেশিরভাগ সড়ক। 
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তার কার্যালয়ের সূত্রে জানা গেছে, স্মরণকালের ভয়াবহ এ বন্যায় জেলার ২০ লাখের বেশি মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছিল। গত কয়েক দিন বৃষ্টি না হওয়ায় বিভিন্ন এলাকায় বন্যার পানি কমতে শুরু করে। এতে অনেক বাড়িঘর থেকে পানি নেমে যায়। পানিবন্দি মানুষের সংখ্যা কমে ১১ লাখ ৫৫ হাজার ৩০০ জনে দাঁড়ায়।

একইভাবে আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেওয়া মানুষের সংখ্যা ২ লাখ ২০ হাজার থেকে কমে ৩৫ হাজার ৪৪১ জনে নেমে এসেছিল। শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে শুরু হওয়া নতুন বৃষ্টিপাতে সেই সংখ্যা বেড়ে ৩৮ হাজার ২৭১ জনে দাঁড়িয়েছে। জেলা শহর মাইজদীর পুলিশ সুপার কার্যালয়ের সামনের সড়কে প্রায় হাঁটুপানি জমে আছে। শহরের লক্ষ্মীনারায়ণপুর এলাকার বাসিন্দা মরিয়ম বিবি বলেন, বাড়ির উঠানে এখনো কোমরসমান পানি।

ঘরের ভেতর হাঁটুপানি। রান্নাঘরের চুলা ডুবে গেছে অনেক আগে। বাইরে থেকে কিনে আনা শুকনা খাবার এবং প্রতিবেশীদের দেওয়া খাবার খেতে হচ্ছে। বৃষ্টিতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে গেছে। বন্যার কষ্টের কথা জানালেন জেলা শহরের রশিদ কলোনি এলাকার বাসিন্দা করিম মিয়া।

তিনি বলেন, ঘরের ভেতরে আবার পানি ঢুকেছে। ঘর থেকে বের হলেই হাঁটুসমান পানি। বন্যার পানিতে ঘরের আসবাবপত্রসহ অনেক কিছুই নষ্ট হয়ে গেছে।  জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা জাহিদ হাসান খান বলেন, নতুন করে বৃষ্টিপাত হওয়ায় জেলায় বন্যা পরিস্থিতির আবার অবনতি হয়েছে। পানি কমার কারণে যাঁরা এরই মধ্যে বাড়ি ফিরে গেছেন, তাঁরা নতুন করে সংকটে পড়েছেন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে যাঁরা পুনরায় আশ্রয়কেন্দ্রে আসতে চান, তাঁদের আসার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে তিন হাজারের বেশি মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছে।
মুন্সীগঞ্জ : টানা দুই দিনের ভারি বৃষ্টিপাতে বিভিন্ন স্থানে জলাবদ্ধতার তৈরি হয়েছে। এতে দুর্ভোগে পড়েছে মানুষ। জেলা শহরে প্রবেশ করতেই সদর উপজেলার মুক্তারপুরে জলাবদ্ধতায় যানজট তৈরি হয়। শহরের ফয়ার সার্ভিস সংলগ্ন প্রধান সড়ক তলিয়ে গেছে। মানিকপুর জেনারেল হাসপাতাল সংলগ্ন ডক্টরস ক্লিনিকে সামনে এবং দৈনিক সভ্যতার আলো অফস সংলগ্ন প্রধান সড়কে জলজট পথচারীদের দুর্ভোগে পড়েছে পথচারীরা। এ ছাড়া শহর ও আশপাশের বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টির পানি জমে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে।  
এদিকে অপরিকল্পিত ভরাটের কারণে জলাবদ্ধতায় অসহনীয় হয়ে পড়েছে লৌহজংসহ বিভিন্ন এলাকা।  পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা না থাকায় লৌহজং উপজেলায়ই দুর্ভোগে প্রায় ৫শ’ পরিবার। বিশাল এলাকাজুড়ে জলজট। যেন আলোর নিচে অন্ধকার। সামান্য বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতা আর ময়লা পানিকে সঙ্গী করেই কষ্টে পরিবারগুলোর বসবাস। উপজেলাটি শুধু কুমারভোগ গ্রামেই ১৫০ পরিবার দুর্ভোগে।
কনকসার, মামুদপট্টি, জসলদিয়া, কান্দিপাড়া ও মাওয়াসহ সব মিলিয়ে  উপজেলাটিতে প্রায় ৫শ’ পরিবার জলজটের শিকার। খাল-বিল ভরাটে প্রাকৃতিক পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা বিলিন। ড্রেনেজ ব্যবস্থাও নেই। তার ওপর নিয়মনীতি উপেক্ষা করেই পদ্মায় অবৈধ বালু উত্তোলন করে আবার ভরাটও করা হচ্ছে। এতে নদীভাঙন ও জলাবদ্ধতা ছাড়াও জীববৈচিত্র্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
পদ্মা সেতু ও ইলিশ ঘিরে মাওয়া-শিমুলিয়াসহ আশপাশের এলাকা পর্যটন হাবে পরিণত হয়েছে। বাণিজ্যিকীকরণেও জমির গুরুত্ব বেড়েছে। তাই পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা বন্ধ করেই চলছে জমির শ্রেণি পরিবর্তন। মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জাকির হোসেন  জানান, জলাবদ্ধতা নিরসনে কাজ চলছে।  
পিরোজপুর : সাগরে গভীর নি¤œচাপের ফলে পিরোজপুরে টানা বর্ষণে জনজীবন বিপর্যস্ত। শনিবার সকাল ৬টা থেকে রবিবার সকাল ৬টা পর্যন্ত ৯৬ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে। টানা বর্ষণে জেলার মঠবাড়িয়া, ভান্ডারিয়া ও ইন্দুরকানী উপজেলার নি¤œাঞ্চল দেড় থেকে দুই ফুট পানির নিচে প্লাবিত হয়েছে। মঠবাড়িয়া উপজেলার সাপলেজা, খেতাচিড়া, বড়মাছুয়া, ছোটমাছুয়া, ভান্ডারিয়া উপজেলার চরখালী, তেলীখালী এবং ইন্দুরকানী উপজেলার সাঈদখালী চর, কালাইয়াসহ বেশ কয়েটি গ্রাম দেড় থেকে দুই ফুট পানিতে প্লাবিত হয়েছে।

এতে আমনের ব্যাপক ক্ষতির আশংকা করছে কৃষকরা। এ ছাড়া টানা বর্ষণে সাধারণ জনজীবনে নেমে এসেছে স্থবিরতা। দিনমজুর, রিক্সাচালক, ক্ষেতমজুরসহ নি¤œআয়ের মানুষ চরম ভোগান্তিতে পড়েছে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. নজরুল ইসলাম জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় পিরোজপুর জেলায় ৯৬ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে। টানা বৃষ্টির ফলে জনজীবনে সমস্যা হচ্ছে। ফসলি জমি প্লাবিত হলেও ভাটার টানে পানি নেমে গেলে আমনের কোনো ক্ষতি হবেনা। তবে পানি জমে থাকলে আমনের ক্ষতি হবে।
মাগুরা ॥ শুক্রবার রাত থেকে রবিবার পর্যন্ত মুষলধারে বৃষ্টিপাত অব্যহত থাকায় জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। ফলে নিচু এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। শহরের নিচু এলাকায় পানি জমে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে বলে জনসাধারণ বিপাকে পড়েছে । 
লক্ষ্মীপুর : দুইদিনের ভারি থেকে অতিভারি বর্ষণে জেলা শহরসহ শতাধিক গ্রাম পুনরায় প্লাবিত হয়েছে। বন্যার ধকল কাটিয়ে উঠতে না উঠতে আবারও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ আরেকবার বন্যার কবলে পড়েছে। পুনরায় ফসলি খেতগুলো পানির নিচে তলিয়ে গেছে। এর মাঝে উজানের পানির চাপ তো রয়েছে। পানিবন্দি হয়ে লাখো মানুষ এতে দিশাহারা হয়ে পড়েছে।
লক্ষ্মীপুর পৌর এলাকার ২, ৬, ১৩ ও ১৪ ওয়ার্ডসহ বিভিন্ন এলাকা বর্তমানে হাঁটু থেকে কোমর পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। সদর উপজেলার উত্তর হামছাদি, চরশাহী, বাঙ্গাখাঁ, কুশাখালী, আধার মানিক, চররমনী মোহনের মেঘাচরসহ পানির নিচে রয়েছে। পুনরায় পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে রামগঞ্জের পৌর এলাকার কিছু অংশসহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা। পানি নামছে ধীরগতিতে। তার ওপর রয়েছে উজান থেকে নেমে আসা পানির চাপ।

×