ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৪ অক্টোবর ২০২৪, ৯ কার্তিক ১৪৩১

ইন্দুপ্রভা দেবীর লেখা কবিতা ও আত্মজীবনী

১২০ বছর আগে লেখা নাটোরের রাজকুমারীর সেসব চিঠি

কালিদাস রায়, নাটোর

প্রকাশিত: ২৩:৪৪, ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪

১২০ বছর আগে লেখা নাটোরের রাজকুমারীর সেসব চিঠি

আলোকচিত্রে ইন্দুপ্রভা দেবী

২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে নাটোর জেলা ট্রেজারিতে পাওয়া যায় একটি আলোকচিত্র। রূপার ফ্রেমে রাজসিক ঢংয়ে বাঁধাই করা আলোকচিত্রে আভিজাত্যের ছাপ স্পষ্ট। ফটোফ্রেমের গঠনশৈলী গতানুগতিক নয়। অনুসন্ধানে জানা যায়, ফ্রেমের এক কোণে ছোট্ট করে লেখা ইন্দুপ্রভা দেবী। তাৎক্ষণিকভাবে পরিচয় জানা না গেলেও পরে জানা যায়, ফ্রেমবন্দি এক নারী হলেন নাটোরের দিঘাপতিয়া রাজা প্রমথনাথ রায়ের কন্যা।

২০১৭ সালের দিকে দিঘাপতিয়ার রাজপরিবারের হারানো ব্যবহার্য সামগ্রী উদ্ধারে মাঠে নামে জেলা প্রশাসন। এ সময় নাটোরের রাজপরিবারের নানা মূল্যবান ব্যবহার্য জিনিসপত্র পাওয়া যায়। এ ছাড়া এই অভিযানে সে সময়কার একটি অমূল্য আবিষ্কার হলো রাজকুমারী ইন্দুপ্রভা দেবী। সে সময় জেলা ট্রেজারিতে রক্ষিত একটি ট্রাংকে রাজকুমারী ইন্দুপ্রভা দেবীর স্বহস্তে লেখা আত্মজীবনী, সাহিত্যকর্মসহ তার ব্যবহার্য সামগ্রী দৃষ্টিগোচর হয়। রাজকুমারীর সেই আত্মজীবনী ও সাহিত্যকর্ম এখনো পড়া যায়। পরবর্তীতে যদিও মূল্যবান এই সাহিত্যকর্মগুলো বইয়ের আকারে রূপদানের চেষ্টা করে জেলা প্রশাসন। 
যেভাবে আবিষ্কার হলেন রাজকুমারী ইন্দুপ্রভা দেবী : কাকতালীয়ভাবে ওই সময় জেলা প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় দিঘাপতিয়া রাজপরিবারের বেহাত হয়ে যাওয়া জিনিস স্থানীয় নাগরিকদের বাড়ি তল্লাশি করে উদ্ধারপর্ব চলছিল। উদ্দেশ্য ছিল রাজপরিবারের ব্যবহৃত সামগ্রীর যথাযথ সংরক্ষণ ও দর্শনার্থীদের চাহিদা বিবেচনায় উত্তরা গণভবনে একটি সংগ্রহশালা স্থাপন। সে সময় নাটোরের জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন শাহিনা খাতুন।

উদ্ধারপর্ব শেষে রাজকুমারী ইন্দুপ্রভার স্বহস্তে রচিত ‘আত্মকথা’কে বই আকারে বের করার উদ্যোগ নেন তিনি। তিনি ‘রাজকুমারীর আত্মকথা’ বইয়ের প্রসঙ্গ কথায় লেখেন, রাজকুমারীর তল্লাশিকালে পাওয়া গেল রাজপরিবার কর্তৃক ব্যবহৃত অনেক মূল্যবান সামগ্রী। এ সময় বড় একটি সিন্দুকে পাওয়া গেল একটি ট্রাংক। ট্রাংকের ওপরে লেখা ছিল ইন্দুপ্রভা দেবী। সেটি খুলে পাওয়া যায় আরও একটি ট্রাংক।

এই ট্রাংকের ভেতরেই পাওয়া যায় রাজকুমারী ইন্দ্রপ্রভার স্বহস্তে লেখা কাব্যগ্রন্থ, ১০ খ- ডায়েরি, একটি আত্মকথা, রাজকীয় কলম, দোয়াত, সিলমোহর, হাতির দাঁতের গহনাসহ তার ব্যক্তিগত ব্যবহার্য অনেক কিছু। এছাড়া ট্রাংকের গোপন এক কুঠরিতে তালাবদ্ধ অবস্থায় পাওয়া রাজকুমারীর ২৮৫টি প্রেমপত্র। রাজকুমারীর লেখা কাব্যগ্রন্থ পাঠে জানা যায় এ এক মূল্যবান সাহিত্য সম্পদ। মাইকেলীয় ঢংয়ে লেখা প্রতিটি কবিতা। নির্ভুল বানানে অসাধারণ কাব্যরসে সমৃদ্ধ অতি উচ্চমানের একটি পা-ুলিপি।

ডায়েরিসমূহ  রাজকুমারীর ব্যক্তিগত জীবনের নানা চড়াই উৎরাইয়ে ভরপুর সাহিত্যমূল্য সম্পন্ন ঐতিহাসিক আকরও বটে। আর ‘রাজকুমারীর আত্মকথা’! সে তো রূপকথার রাজকুমারীর রহস্য গল্পকেও হানার মানায়! রাজকুমারীর ব্যক্তিজীবন, প্রেম, বিরহ, রাজপরিবারের মাজার সব ঘটনা! এর পরতে পরতে পাঠক দেড়শ’ বছর আগের রাজ দেওয়ালে বন্দি অসাধারণ অথচ চিরায়ত এক বাঙালি নারীমনের কৈশোর ও যৌবনের অব্যক্ত অনুভূতির নানা স্মরণী ও চিত্তাকর্ষক নানা ঘটনাবলির চিত্র ফুটে উঠেছে রাজকুমারী ইন্দুপ্রভার লেখনীতে।

এ ছাড়া রাজকুমারীর অপ্রকাশিত সাহিত্যকর্মগুলো রচিত হয়েছে বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে। ছোট্ট ছোট্ট খামে ভরা চিঠিগুলো খুবই যতেœ ভাঁজ করে রাখা। প্রায় ১২০ বছর বা তার কাছাকাছি সময় ধরে চিঠিগুলো ওভাবেই খামের ভেতরে রয়েছে। চিঠিগুলো এখনো পড়া যাচ্ছে। একইভাবে ইন্দুর হাতের লেখা কবিতা ও তার আত্মজীবনীও পড়া যাচ্ছে। ১২০ বছর এসব অমূল্য সাহিত্যকর্ম নাটোর জেলা ট্রেজারিতে রক্ষিত ছিল। বর্তমানে এসব সাহিত্যকর্ম উত্তরা গণভবনের সংগ্রহশালায় দর্শনার্থীদের প্রদর্শনের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে।
কে এই ইন্দুপ্রভা দেবী? 
কে এই ইন্দুপ্রভা দেবী? এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানা যায়। ইন্দুপ্রভা দেবী ছিলেন রাজকুমারী। তিনি দিঘাপতিয়া রাজ দয়ারাম রায়ের চতুর্থ বংশধর রাজা প্রমথনাথ রায়ের কনিষ্ট কন্যা। ইন্দুপ্রভার বড় আরও চার ভাই ছিলেন। প্রমদানাথ রায়, বসন্তকুমার রায়, শরৎকুমার রায় এবং হেমন্ত কুমার রায়। ১৭৩৪ খ্রিস্টাব্দে নাটোর শহর থেকে তিন কিলোমিটার দূরে দিঘাপতিয়ায় জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেন দয়ারাম রায়। রাজকুমারী ইন্দুপ্রভা দেবী ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে (বাংলা ১২৮৮) সনে জন্মগ্রহণ করেন।

মাত্র ২ বছর বয়সে তিনি পিতা প্রমথনাথ রায়কে হারান। পরে ১৩ বছর বয়সে মহেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরীর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। যদিও মহেদ্র নারায়ণ চৌধুরী সম্পর্কে বেশি কিছু জানা যায় না। বাবার মৃত্যুর পর রাজা দয়ারাম রায়ের প্রথম পুত্র প্রমদানাথ রায় নিয়মানুসারে জমিদারির দায়িত্ব পান। এই প্রমদানাথ রায় পরে রাজা হন। ইন্দুপ্রভা দেবী এই প্রমদানাথ রায়ের নিকট সবচে ¯েœহশীলা ছিলেন।
১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দের ১০-১২ জুন নাটোরে বিশ^কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ ভারতবর্ষের অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে নাটোর রাজ ও দিঘাপতিয়া রাজের পৃষ্ঠপোষকতায় বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস অধিবেশন চলছিল। অধিবেশনের শেষ দিন ১২ জুন ১৮ মিনিট স্থায়ী এক মহাপ্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্প হয়। এতে রানী ভবানীর প্রাসাদ এবং দিঘাপতিয়া প্রাসাদ পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়।

পরে অতি উচ্চ শিল্পবোধসম্পন্ন ও প্রগতিশীল রাজা প্রমদানাথ রায় ১৮৯৮ সাল থেকে ১৯০৮ সালের মধ্যে ইউরোপীয় ও মোঘল স্থাপত্যের মিশেলে বিদেশী প্রকৌশলী ও শিল্পী দিয়ে অত্যন্ত নিপুণতার সঙ্গে দিঘাপতিয়া রাজপ্রাসাদ নির্মাণ করেন। ১৯৭২ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নান্দনিক নির্মাণশৈলী দেখে মুগ্ধ হয়ে এই প্রসাদকে প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাঞ্চলীয় বাসভবন বা উত্তরা গণভবন হিসেবে ঘোষণা করেন।

কৈশোরকাল থেকেই রাজকুমারী ইন্দুপ্রভা ভাবুক প্রকৃতির একজন মেয়ে ছিলেন। তিনি বাস্তব জীবনে যা উপলব্ধি করেছেন, তিনি সেই অনুভূতি, উপলব্ধির লিখিত রূপ দানের চেষ্টা করেছেন। তার নিজ হস্তে লিখা ‘আত্মকথা’, প্রেমিক মহেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরীর নিকট লেখা ও পাওয়া ২৮৫টি ‘প্রেমপত্র’, সাহিত্যকর্ম ‘বঙ্গোপসাগর’সহ নানা লেখা হতে তখনকার রাজপরিবারের অন্দর মহলের নানা কাহিনী মূল্যবান সাহিত্যরসের সৃষ্টি করে।

এসব অমূল্য লেখনীতে রাজপরিবারের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, প্রেম, বিরহ, উচ্ছ্বাস-আনন্দসহ ছোট-বড় নানা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাসমূহ ইতিহাস ও সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। সেই রচনাগুলো অনেকাংশে নষ্ট হয়ে গেলেও এখনও পড়া যায়। পরে সেগুলো বইয়ের আকাশে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়।
রাজকুমারী ইন্দ্রপ্রভা দেবীর ২৮৫টি প্রেমপত্র ॥ রাজকুমারী ইন্দুপ্রভা তার স্বহস্তে লেখা ‘আত্মজীবনী’তে একজনকে বারংবার ‘তিনি’ হিসেবে সংবোধন করেন। এই ‘তিনিটা’ হলেন মহেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী। মহেন্দ্র রাজকুমারীর দাদাদের সঙ্গে লেখাপড়া করতেন। দিনে দিনে  ইন্দুপ্রভার হৃদয় মন্দিরে জায়গা করে নিতে থাকেন এই মহেন্দ্র। একপর্যায়ে মহেন্দ্রর চরণে নিজেকে সঁপে দেন ইন্দুপ্রভা। রাজকুমারী এই মহেন্দ্রকে জনম জনমের সাথী ও পতি হিসেবে গ্রহণ করেন।

মহেন্দ্র ও ইন্দুপ্রভার প্রেম চলাকালে তাদের মধ্যে বিভিন্ন সময় চিঠি আদান-প্রদান হতো। সে চিঠিগুলো অসম্ভব রকমের প্রেম, বিরহ, শ্রদ্ধা, ভালোবাসায় পূর্ণ থাকত। প্রেমপত্রগুলোতে ইন্দুপ্রভাকে ‘প্রিয়তমে’ সংবোধন করে চিঠির শেষে লেখা থাকত ‘তোমারই মহেন্দ্র’। চিঠির পরতে পরতে ছড়িয়ে রয়েছে মান-অভিমান। ইন্দুপ্রভা কলকাতায় থাকার সময় তাকে তিনটি ঠিকানায় চিঠি দিয়েছেন। আবার ইন্দু যখন রাজবাড়িতে থেকেছেন, তখনো কলকাতা থেকে মহেন্দ্র তাকে চিঠি লিখেছেন।

দিঘাপতিয়ায় চিঠিপত্রে তার নাম কখনো রাজকুমারী ইন্দুপ্রভা, কখনো শ্রীমতী ইন্দুপ্রভা দেবী আবার কখনো শ্রীমতী ইন্দুপ্রভা চৌধুরানী লেখা পাওয়া গেছে। ছোট্ট ছোট্ট খামে ভরা চিঠিগুলো খুবই যতেœ ভাঁজ করে রাখা। প্রায় ১২০ বছর বা তার কাছাকাছি সময় ধরে চিঠিগুলো ওভাবেই খামের ভেতরে রয়েছে। রাজকুমারী ইন্দুপ্রভার ভাষ্যমতে, মা’র সাথে তার সম্পর্ক ততটা ভালো না হলেও বড় দাদা প্রমদানাথ রায়ের (পরবর্তীতে রাজা হন) তার হৃদ্যতাপূর্ণ ও ¯েœহপূর্ণ সম্পর্ক ছিল।

শৈশবের বেশিরভাগ সময় দিঘাপতিয়া ও রামপুরায় (রাজশাহী) অতিবাহিত হলেও পরবর্তীতে কলকাতাতেও স্বামীর সাথে বসবাস করেছেন তিনি। মহেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী রাজশাহী ও নাটোর দুই জায়গাতেই থাকতেন। কর্মপোলক্ষে তিনি কলকাতায় থাকতেন। এই দূরুত্ব রাজকুমারীর হৃদয়ে নানা প্রেম বিরহ ও সাহিত্যরসের জন্ম দেয় বলে ধারণা করা হয়। সাহিত্যকর্ম ও চিঠিগুলো এখনো পড়া যাচ্ছে। 
রাজকুমারী ইন্দুপ্রভা দেবীর আত্মকথা : মহেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরীর সঙ্গে নানা প্রেম, বিরহের নিখুঁত ছবি ফুটে উঠেছে রাজকুমারীর ‘আত্মকথা’য়। ফুটে উঠেছে রাজকুমারীর ব্যক্তিজীবন, প্রেম, বিরহ, রাজপরিবারের সুখ-দুঃখ-বিয়োগসহ মজার সব ঘটনা! এর পরতে পরতে পাঠক দেড়শ’ বছর আগের রাজ দেয়ালে বন্দি অসাধারণ অথচ চিরায়ত এক বাঙালি নারীমনের কৈশোর ও যৌবনের অব্যক্ত অনুভূতির নানা স্মরণী ও চিত্তাকর্ষক নানা ঘটনাবলির চিত্র খুঁজে পান। অন্য সাধারণ নারী হৃদয়ের মতো রাজকুমারী ইন্দুপ্রভার মনেও প্রেম, বিরহের প্রাদুর্ভাব ও তীব্রতা দৃশ্যমান হয়েছে।

আত্মকথায় প্রকটভাবে তার প্রেম, বিরহভাব প্রকট হয়েছে। ‘আত্মকথা’য় প্রেমিক মহেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরীর প্রতি আবেগ প্রকাশ করে তিনি রাজকুমারী ইন্দ্রপ্রভা দেবী লেখেন, ‘এই সময় কিছুদিন আমাদের বাসায় থাকা পর তিনি ও দাদাদের বাসায় থাকিয়া পড়িতেন। সেখানে গেলেই প্রায় দেখা হইত। সে হইতে আসল জিনিস আরম্ভ হইল। তখন আমার বয়স ১০/১১ বৎসর। হৃদয় ফুটোন মুখ। পূর্ব্বের স্মৃতি নূতন করিয়া হৃদয়ে জাগিল। তাঁহার মন কেমন না জানিয়াও নীরবে অযাচিত ভাবে তাঁর চরণে আত্মসমর্পণ করিলাম।

মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিলাম তিনি ভিন্ন আর কাহারও হইব না, যদি মা জোর করিয়া অন্যের সঙ্গে বিবাহ দিবার চেষ্টা করেন, তবে আমি আত্মহত্যা করিব। সেই হইতেই কেবল ঈশ^রের চরণে মিনতি আর সর্ব্বদা তাঁকে দেখিবার জন্য ভয়ানক ইচ্ছা হইত। সর্ব্বদা দেখিলেও পিপাশা মিটিত না।’
‘আত্মকথা’য় রাজকুমারী ইন্দুপ্রভা নিজেকে স্বামী মহেন্দ্রকে দেবতা জ্ঞান এবং নিজেকে পিশাচী উল্লেখ করে লেখেছেন, ‘আমার আসার সময় তিনি যার-পর-নাই দুঃখিত হইলেন।

মুখখানি নিতান্ত মলিন এবং চোখ দুটো ছল ছল হইল। আমি পিশাচী তাহা দেখিয়াও হাসিতে হাসিতে পাষাণের মত চলিয়া আসিলাম। তখন তাঁর কষ্ট কিছুই বুঝি নাই, কিন্তু এখন তার প্রতিফল পাইতেছি বাড়ীতে আসিয়াই বেশ থাকিলাম। তিনি কত ¯েœহপূর্ণ সুধাময় পত্র লিখিতেন। আমি হেলাফেলা করিয়া ২/১ খানের মাত্র উত্তর দিতাম। আমার এত কু ব্যবহারেও তাঁর ভালবাসা কিছুমাত্র কমিল না। বুঝিতে পারি না তখন কিরূপে এ পাপিষ্ঠাকে এত ভালবাসিলেন। তিনি সত্যই দেবতা। এবং তা তাঁর ভালবাসাও স্বর্গীয়।’

‘আত্মকথা’য় স্বামীর সাথে প্রণয়ের বর্ণনা দিতে গিয়ে রাজকুমারী ইন্দুপ্রভা লিখেছেন, তাহারা (দাদারা) যাইবার সময় আমি জাগা হইলাম। তিনিও তখন জাগা ছিলেন। কিন্তু ঘুমের মতই থাকিলেন। দাদারা গেলে পর ঘরের আর সকলে নিদ্রিত হইলে তিনি লেপের নিচ দিয়া অতি ধীরে ধীরে আমার গায়ে হাত দিলেন। প্রথমে হঠাৎ হাত লাগিয়াছে মনে করিয়া আমি লজ্জায় জড়সড় হইয়া আরও দূরে সরিয়া গেলাম। কিন্তু কারপরেই তিনি আবার আমাকে ধীরে ধীরে ধরিলেন। তখন তাঁর ইচ্ছা বুঝিয়া আনন্দ ও লজ্জায় শিহরিলাম। তিনি ক্রমে আমাকে নিজের কাছে টানিলেন।

তখন আমি অতি সলজ্জাভাবে তাঁর দিকে মুখ ফিরিয়া শুইলাম। তিনিও তখন খুব আনন্দের সহিত একেবারে কাছে সরিয়া আসিলেন। সে মুহুর্ত্তটী আবার ফিরিয়া পাইবার জন্য অকাতরে জীবন বিসর্জন দিতে পারি।....ঘরের উজ্জ্বল প্রদীপ জ¦লিতেছিল। দুজনই দুজনকে বেশ দেখিতে পাইতেছিলাম। তাঁর সেই প্রেমপূর্ণ সুধামাখা হাসিটুকু কখনও জীবনে ভুলিব না।’ 
দাদা প্রমদানাথ রায় রাজকুমারী ইন্দুপ্রভার কাছে বাবার চাইতে কম ছিলেন না। ইন্দুপ্রভার বয়স যখন দুই বছর, তখন তারা পিতৃহারা হন। এরপর থেকেই ইন্দুপ্রভা বড় দাদার কাছে অসামান্য আদর, ¯েœহ, ভালবাসা পেয়েছেন। রাজা প্রমদানাথ রায়কে রাজকুমারী দ্বিতীয় ঈশ^র জ্ঞান করতেন।
রাজকুমারী তার ‘আত্মকথায়’ তার বড় দাদা অর্থাৎ রাজা প্রমদানাথ রায়কে নিয়ে লিখেছেন, ‘ এই সময় বড় দাদা তাকে (মহেন্দ্র) ও আমাকে চিরস্থায়ী রূপে বৎসর ছয় হাজার টাকা আয়ের এক জমিদারি দান করিলেন। ছেলেবেলা বড় দাদারি আদর যতেœ কখনও পিতার অভাব জানিতাম না। পরে বড় দাদাই তাঁর সঙ্গে বিবাহ দিয়া জীবন ও সুখশান্তি সমস্তই প্রদান করিয়াছিলেন। আবার এখন চিরদিনের জন্য দুজনের সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের বন্দোবস্ত করিয়া দিলেন। এক কথায় বড় দাদাই আমাদের পক্ষে সর্ব্বদাতা দ্বিতীয় ঈশ^র স্বরূপ। আমাদের সাধ্য নাই যে এ ¯েœহের বিন্দুমাত্র প্রতিদান দিতে পারি। তবে ঈশ^রের নিকট এই মাত্র প্রার্থনা যেন বড় দাদার প্রতি আমাদের ভক্তি শ্রদ্ধা চিরদিন অটন অবিচল থাকে।’
‘বঙ্গোপসাগর’ কবিতায় ইন্দুপ্রভা লিখেছেন, ‘সচঞ্চল নীল জল করিছে কি ঝলমল/জ্যোৎস্না মাখিয়া গায় সমুজ্জ্বল নিরমল’। ডায়েরির অনেক লেখাই তিনি রাজশাহীতে বসে লিখেছেন। ১৩১১ বঙ্গাব্দের নববর্ষের দিনের কথা লিখেছেন রাজশাহীতে বসে। রাজশাহীকে তখন রামপুর লেখা হতো। প্রতিটি লেখার সঙ্গে তিনি বাংলা ও ইংরেজি তারিখ বারসহ লিখেছেন।
পরিশেষে, রাজকুমারী ইন্দুপ্রভা দেবীর স্বহস্তে লেখা ‘আত্মকথা’ প্রসঙ্গে উদ্ধারপর্ব চলাকালীন সময়কার নাটোরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) ড. মো. রাজ্জাকুল ইসলাম যথার্থই মূল্যায়ন করে লিখেন, ‘তাঁর (ইন্দুপ্রভা) জীবন ও প্রেম-বিরহের দোলাচল ‘আত্মকথা’ জীবনীগ্রন্থকে রসোত্তীর্ণ উপন্যাসের বিশষত্ব দান করেছে। ইন্দুপ্রভার ভাষায়, ‘ঝাঁকি লাগিয়া গাড়ির মধ্যস্থ খাবার জিনিসের পাত্রটা গড়িবার উপক্রম হইল। অমনি চকিতে তিনি ও আমি সেটা একত্রেই ধরিলাম। দুজনের হস্তে স্পর্শ হইল।

বিদ্যুতের মতো সেই স্পর্শ সুখ সর্ব্বাঙ্গে ব্যপ্ত হইল। সে সুখ এত তীব্র যে ভালো করিয়া তার আস্বাদ পাইলাম না। শিহরিয়া উঠিলাম।’ এই ‘তিনিটা’ কে? তাঁদের সেই সুখ-স্মৃতি কী স্থায়ী হয়েছিল? পরিণতিই বা কী হয়েছিল? রাজবাড়ির অন্দরমহলে শুধুই কি আনন্দের বন্যা বয়ে যেত, নাকি তাদেরও ছিল দুঃখ যাতনা! জানতে হলে এই জীবনীগ্রন্থে একবার চোখ বুলাতে হবে। একবার ধরলে শেষ না করে আর ছাড়া যাবে না। রাজকন্যার এই জীবনী পড়তে পড়তে মনে হবে, ‘বনলতা সেন নয়, ইন্দুপ্রভাই পাখির নীড়ের মতো চোখ তোলে’।’

×