ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৩১ ভাদ্র ১৪৩১

মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে কবিগুরুর প্রিয় ফুল

কুরচি, পড়েছ ধরা, তুমিই রবির আদরিণী...

মোরসালিন মিজান

প্রকাশিত: ২২:৪৩, ৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪

কুরচি, পড়েছ ধরা, তুমিই রবির আদরিণী...

ঢাবিতে কবি নজরুলের সমাধি কমপ্লেক্সে অপরূপ সৌন্দর্য নিয়ে ফুটেছে কুরচি ফুল

কুরচির সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের স্মৃতি হুবহু মনে রেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কবিগুরু লিখেছিলেন, ‘অনেককাল পূর্বে শিলাইদহ থেকে কলকাতায় আসছিলেম। কুষ্টিয়া স্টেশনঘরের পিছনের  দেয়ালঘেঁষা এক কুরচিগাছ চোখে পড়ল। সমস্ত গাছটি ফুলের ঐশ্বর্যে মহিমান্বিত। চারি দিকে হাটবাজার; এক দিকে রেলের লাইন, অন্য দিকে  গোরুর গাড়ির ভিড়, বাতাস ধুলোয় নিবিড়।

এমন অজায়গায় পি. ডব্লিউ. ডি-র স্বরচিত প্রাচীরের গায়ে ঠেস দিয়ে এই একটি কুরচিগাছ তার সমস্ত শক্তিতে বসন্তের জয়ঘোষণা করছেÑ উপেক্ষিত বসন্তের প্রতি তার অভিবাদন সমস্ত হট্টগোলের উপরে যাতে ছাড়িয়ে ওঠে এই যেন তার প্রাণপণ চেষ্টা। কুরচির সঙ্গে এই আমার প্রথম পরিচয়।’ খেয়াল করুন ‘কুরচির সঙ্গে এই আমার প্রথম পরিচয়’ কথাটি কত প্রেম নিয়ে উচ্চারণ করেছেন রবীন্দ্রনাথ। গদ্যের মতো পদ্যেও কুরচির প্রতি পক্ষপাত দেখিয়েছেন তিনি। লিখেছেন, ‘কুরচি, তোমার লাগি পদ্মেরে ভুলেছে অন্যমনা/যে ভ্রমর, শুনি নাকি তারে কবি করেছে ভর্ৎসনা।/আমি সেই ভ্রমরের দলে...।’ 
আর আপনি? দেখেছেন তো কুরচি? প্রশ্নটি করার কারণ, এই গাছ একটু দুর্লভ। এমনকি বাংলাদেশের ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনের তফসিল ৪ অনুযায়ী সংরক্ষিত। তবে শহর ঢাকার বিভিন্ন স্থানে সচেতনভাবেই গাছটির চারা রোপণ করা হয়েছিল। বলধা গার্ডেন, জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান, রমনা পার্ক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল এলাকাতেও আছে। একটু খুঁজে নিতে হয়, এই যা।

আলাদা করে বলা যায় পুরান ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের কুরচি গাছটির কথা। নিজ হাতে এই গাছের চারা রোপণ করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১০ সালের ৮ মে সেখানে বঙ্গবন্ধু জাদুঘরের সামনে তিনি গাছটি রোপণ করেন। একাধিকবার গিয়ে দেখা গেছে, আপন মনে বেড়ে উঠছে গাছটি। ফুলভর্তি গাছের দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। আর ঘ্রাণ? সে তো আপনি নাকে এসে লাগে! 
অবশ্য কারাগার এলাকায় প্রবেশ নিষেধ। তাই সেদিকে না গিয়ে ফুলপ্রেমীরা কবি নজরুলের সমাধিসৌধ থেকে ঘুরে আসতে পারেন। কদিন আগেও সেখানে গাছভর্তি ছিল কুরচি ফুলে। এখনো কতটা আছে, খবর নেওয়া হয়নি। তবে থাকার কথা। ঘুরে আসতে পারেন। এই ফুল সাদা দেখতে হলেও সাদামাটা নয়। যেমন সুন্দর, তেমনি সুগন্ধি। একসঙ্গে অজ¯্র ফুল ফুটে থাকতে দেখে উদাসীন হেঁটে চলা পথিকবরও চোখ মেলে তাকান।

কুরচির আরও কয়েকটি নাম আছে। এই যেমন- কুটজ বা গিরিমল্লিকা। ইংরেজিতে বলা হয় ইস্টার ফ্লাওয়ার। বৈজ্ঞানিক নাম হোলারে‌্যনা এ্যান্টিডিসেন্টেরিকা। এটি অ্যাপোসিনেসিয়ে পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। জন্মস্থান বাংলাদেশ ও ভারত। ছোট-খাটো গাছ। উচ্চতা ১০ থেকে ১২ ফিট। গাছের বিষদ বর্ণনা দিয়েছেন উদ্ভিদবিদ দ্বিজেন শর্মা। তার বর্ণনা মতে, এটি ক্ষুদ্রাকৃতির বৃক্ষ। কা- সরল। গাছের বাকল অমসৃণ ও হালকা ধূসর রঙের।

ওপরের দিকে অজ¯্র ঊর্ধ্বমুখী শাখায় এলোমেলো। পাতা লম্বা-ডিম্বাকৃতির, মসৃণ এবং উভয়ের বিপরীত দিকে সমভাবে বিন্যস্ত থাকে। শীতকালে পাতা থাকে না। মঞ্জরিতে ফুল সংখ্যা কম হলেও বিক্ষিপ্ত মঞ্জরির সংখ্যা অজ¯্র। অন্য অনেক ফুলের মতো এটিও পাঁচ পাপড়ির। ফুলের নিচের অংশ নলাকৃতির। দেখার সময়, চাইলে, এই তথ্যগুলো মিলিয়ে নিতে পারেন। তাহলে চেনা জানাটা আরও ভালো হবে। গভীর হবে প্রেমটাও। হয়তো কবিগুরুর মতোই তখন বলতে চাইবেন, ‘সূর্যের আলোর ভাষা আমি কবি কিছু কিছু চিনি,/কুরচি, পড়েছ ধরা, তুমিই রবির আদরিণী।’

×