ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৩১ ভাদ্র ১৪৩১

ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে আযমী

‘প্রতি রাতেই ক্রসফায়ারের ভয়ে থাকতাম’

স্টাফ রিপোর্টার

প্রকাশিত: ২২:৩৬, ৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪; আপডেট: ২২:৩৭, ৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪

‘প্রতি রাতেই ক্রসফায়ারের ভয়ে থাকতাম’

আবদুল্লাহিল আমান আযমী

‘গেল ৮ বছর বন্দি থাকা অবস্থায় পৃথিবীর কোনো আলো দেখিনি, আকাশ দেখিনি, সূর্য দেখিনি। তারা খুব দুর্ব্যবহার করত আমার সঙ্গে। তাদের আচরণে আমার বন্দিদশা নিয়ে রাতের পর রাত কেঁদে কেঁদে সময় কেটেছে। মাঝে মাঝে তারা চোখ এমনভাবে বাঁধত, মনে হচ্ছিল আমার চোখের মণি ফেটে যাবে। হাতকড়া পরা থাকতে থাকতে হাতে ঘা হয়ে যেত।

বারবার মনে হতো- তারা হয়তো আমাকে ক্রসফায়ার করে হত্যা করবে। প্রতি রাতেই ক্রসফায়ারের ভয় থাকত। রাতে তাহাজ্জুদ পড়ে আল্লাহর কাছে শুধু কান্না করতাম। আল্লাহ আমার লাশটা যেন কুকুরের খাদ্যে পরিণত না হয়। আমার লাশটা যেন আমার পরিবারের কাছে যায়।’ 
এই বর্ণনা জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির প্রয়াত গোলাম আযমের মেজো ছেলে সেনাবাহিনীর সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহিল আমান আযমীর। ৮ বছর গুম থাকার পর মঙ্গলবার জাতীয় প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বক্তব্য রাখেন তিনি।

আযমী বলেন, ২০১৬ সালের ২২ আগস্ট দিবাগত রাতে যখন আমার বাসায় তারা এলো, তখন তাদের কাছে আমি জানতে চেয়েছিলাম আপনারা কারা, পরিচয় কী, পরিচয়পত্র দেখান। আমাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার জন্য কোনো ওয়ারেন্ট আছে কি না তা আমি জানতে চেয়েছিলাম। তারা আমার কথার জবাব দেননি। আমার সঙ্গে খুবই খারাপ ব্যবহার করে।

এক পর্যায়ে আমাকে নিয়ে গাড়িতে উঠিয়ে চোখ বেঁধে দেয়। আমার চোখ মুখ বাঁধা অবস্থায় একটা জায়গায় নিয়ে গেল। সেখানেই ফেলে রাখা হয়, অন্ধকার এক ঘরে। সেখানে দিন না রাত এসব কিছুই বোঝা যেত না। টয়লেট যেতে চাইলে চোখ হাত বেঁধে নিয়ে যেত।
আবদুল্লাহিল আমান আযমী বলেন, গত আগস্ট মাসের ৫ তারিখ যে বিপ্লব হয়েছে, সেটি আমি জানতাম না। সেদিন রাত সাড়ে ১০টার সময় এসে আমাকে বলা হলো আপনাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হবে। আমি বললাম, আমিতো ফজরের নামাজ পড়ে ঘুমাই। যদি দুইটার দিকে আসেন আমার সুবিধা হয়।

তাদের আমি বললাম, কয়েকদিন আগেই আমাকে ডাক্তার দেখে গিয়েছেন। রক্ত পরীক্ষাও করলেন। এখন আবার আমাকে কোথায় নিয়ে যাবেন? তখন তারা বললো, আপনাকে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। সে অনুযায়ী আমাকে মুখোশ পরিয়ে আরেকটি কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়।
তিনি বলেন, ৫ আগস্ট রাতে যখন আমাকে বলা হলো, আপনাকে হাসপাতালে নিয়ে যাব। তখন আমি বললাম, আট বছর ধরে আপনাদের বলছি আমার দাঁত ভেঙে গেছে, আমার কানের সমস্যা হচ্ছে। এতদিন আপনাদের বলছি আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যান, আপনারা নিয়ে যাননি। আর এখন বলছেন, হাসপাতালে যেতে হবে। এটা কেমন কথা?
এরপর চোখ বেঁধে আমাকে গাড়িতে তোলা হয়েছে। তারা দীর্ঘ পথ পাড়ি দিচ্ছিল। আমি বললাম ঢাকা শহরের কোনো হাসপাতাল তো এত দূরে না।

আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? কেউ কোনো জবাব দিল না। রাস্তা ভাঙাচোরা। আমি বললাম, ঢাকা শহরের কোনো রাস্তা তো এত ভাঙাচোরা না। আমি বললাম, আপনারা কি আমাকে কোনো গ্রামের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন নাকি? তারা কোনো জবাব দিল না। পরে আমাকে আরেকটি বন্দিশালায় নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি বলেন, আমি অনুমান করতে পারি, ওইদিন রাস্তায় ছাত্র-জনতা গাড়ি চেক করছিল।

সেজন্য তারা আমাকে গ্রামের রাস্তা দিয়ে নিয়ে গেছে। পরে তারা বলল, আপনি এখানে থাকেন। আমি বললাম, আপনারা না আমাকে হাসপাতালে নিয়ে আসবেন এটা কোথায় নিয়ে এলেন? তারা বলল, আপনাকে পরে জানানো হবে। 
মুক্তির ঘটনা তুলে ধরে তিনি বলেন, ৬ আগস্ট আমাকে একজন জানাল, আজ আমাকে মুক্তি দেওয়া হতে পারে। একজন বলল, আপনার কাপড়ের সাইজ বলেন। আমি বললাম, আমি তো গার্মেন্টের কাপড় পরি না, সাইজ বলতে পারব না। পরে একটা কাপড় নিয়ে আসা হলো। যেটা আপনারা দেখেছেন মুক্তির পরে প্যান্ট-শার্ট। ওটা পরে দেখলাম ঠিক আছে।

বাইরে কী হচ্ছে সে খবরই তো নাই আমার কাছে। পরে সোয়া ৯টার দিকে আমাকে নিয়ে তারা রওনা হলো। টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা সড়কের পাশে আমাকে নিয়ে তারা ছেড়ে দিল। বলল, গাড়ি আসবে গাড়িতে উঠে আপনি চলে যাবেন। তখন রাত পৌনে বারোটা বাজে।
গাড়ি ভাড়া হিসেবে ৫ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, তারা আমাকে টাকা দিল। আমি বললাম ঢাকার ভাড়া কত? তারা বলল, ঠিক জানি না। বললাম, এখানে কত টাকা আছে। তারা বলল, পাঁচ হাজার টাকা। আমি বললাম আমি আপনাদের টাকার মুখাপেক্ষি নই। এখান থেকে ঢাকার ভাড়া যত সেই টাকাই দিন। তারা বলল আপনি যা করেন, করেন দান করেন, কিছু টাকা আপনাকে নিতে হবে।

তাদের সঙ্গে এক সেকেন্ড কথা বলার আমার রুচি ছিল না। এরপর তারা আমাকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। মুক্তির সেই মুহূর্তের সম্পর্কে আযমী বলেন, যখন আমাকে ছেড়ে দেওয়া হয় আমি ঠিকমতো হাঁটতে পারছিলাম না। এরপর দেখলাম একটা গাড়ি আসছে। আমার মনে হচ্ছিল, ঝাঁপ দিয়ে বাসে মধ্যে উঠি। পরে আমি বাসে উঠলাম। আমার স্ত্রী এবং চাচাত ভাইয়ের ফোন নম্বর আমার মনে ছিল। বাসের একযাত্রীর থেকে ফোন চেয়ে নিয়ে আমি তাদের ফোন করি। বাস আমাকে টেকনিক্যাল মোড়ে নামিয়ে দিল। এরপর পরিবারের সঙ্গে নিয়ে চিকিৎসা গ্রহণ করে ৮ তারিখ ভোরে আমি বাসায় গিয়ে পৌঁছি।
আযমী বলেন, দীর্ঘ বন্দিশালা কথিত ‘আয়নাঘর’ থেকে আমি ৮ বছর পর মুক্তি পেয়েছি। অন্যায়ভাবে আমাকে এখানে দীর্ঘদিন বন্দি করে রাখা হয়েছিল। বন্দি জীবনে মৌন প্রতিবাদ হিসেবে নিজের চুল বড় রেখেছি। আমার দিনগুলো কেমন কেটেছে মনে হলে বুক ফেটে যায়। একদিন আমাকে এসে বলা হলো, ‘আপনার লিখিত দিতে হবে। সেখানে আপনি লিখবেন, আমি রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হব না। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বিদেশে সুখে শান্তিতে থাকতে চাই। আমি বিদেশে চলে যাব।’
তখন আমি বলেছি, আমি স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক। আপনারা আমাকে অবৈধভাবে অপহরণ করেছেন। আটক করে রেখেছেন, আমাকে নির্যাতন করছেন। আমি এটার প্রতিবাদে মিছিল মিটিং করতে পারছি না। তাই মৌন প্রতিবাদ হিসেবে বড় চুল রেখেছি। আমি স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক আমার ব্যক্তিগত ইচ্ছা আমি রাজনীতি করব কি করব না, আমি এ দেশে থাকব কি থাকব না। আল্লাহ আমাকে সেই সৎ সাহসটুকু দিয়েছিলেন। আমি এটা দৃঢ়ভাবেই বলেছি।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বাংলাদেশের সঠিক ইতিহাস যেন জনগণের মাঝে তুলে ধরা হয়, এমন দাবি তুলে ধরে তিনি বলেন, একটা যুদ্ধে কত মানুষ মারা গেলেন তার কোনো সঠিক সংখ্যা জাতি এখনো জানে না। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান কোনোরকম জরিপ ছাড়াই মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত যেন নতুন করে লেখা হয়। বর্তমানে যে জাতীয় সংগীত আছে তা করেছিল ভারত।

দুই বাংলাকে একত্রিত করার জন্য করা হয়েছিল এই জাতীয় সংগীত। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে তাই বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত নতুনভাবে হওয়া উচিত। বক্তব্যের এক পর্যায়ে ঢাকার পিলখানায় তৎকালীন সীমান্তরক্ষা বাহিনী বিডিআরের সদরদপ্তরে বিদ্রোহে ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তা হত্যাকা-ের ঘটনায় বদলা চান বলে উল্লেখ তিনি। তিনি বলেন, দেশের সবগুলো প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। নতুন সরকার এই প্রতিষ্ঠানগুলো ঢেলে সাজাবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালে গুমের শিকার হন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির অধ্যাপক গোলাম আযমের সন্তান আবদুল্লাহিল আমান আযমী। দীর্ঘ ৮ বছর পরে গত ৬ আগস্ট দিবাগত রাতে তিনি কথিত সেই ‘আয়নাঘর’ থেকে মুক্তি পেয়েছেন।

×