ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৩০ ভাদ্র ১৪৩১

জীববৈচিত্র্য শূন্য হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা সেন্টমার্টিন দ্বীপ

মুহাম্মদ হানিফ আজাদ উখিয়া, কক্সবাজার 

প্রকাশিত: ১৩:৫১, ১ সেপ্টেম্বর ২০২৪

জীববৈচিত্র্য শূন্য হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা সেন্টমার্টিন দ্বীপ

প্রবাল দ্বীপ কক্সবাজারের সেন্টমার্টিন

দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ কক্সবাজারের সেন্টমার্টিনে আট বছর আগে গিয়েছিলেন রাজধানীর একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম । এরপর আর যেতে পারেননি নানা কারণে। তবে গত বছরের ডিসেম্বরে তিনি আবার গিয়েছিলেন সেখানে স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়ে। তিনি বললেন, বিশাল ফারাক হয়ে গেছে। আট বছর আগের পরিবেশের সঙ্গে এবার বড় পার্থক্য তৈরি হয়েছে। সৌন্দর্য আর আগের মতো নেই।

তরিকুল বলেন, ‘তখন দ্বীপের সৈকতে কচ্ছপের ডিমপাড়ার দৃশ্য উপভোগ করেছিলাম। এখন সৈকত জুড়ে মরা কচ্ছপের দুর্গন্ধ। দ্বীপের তিন দিকের সৈকতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা প্রবাল শৈবাল, শামুক, ঝিনুকও আর তেমন নেই।

শুধু তরিকুল নন; দিনে দিনে সেন্টমার্টিনের জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হতে দেখেছেন পরিবেশবিদ, সমুদ্র বিশেষজ্ঞ, প্রাণিবিজ্ঞানী ও সরকারের সংশ্নিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তারাও। কিন্তু কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে না। দ্বীপটিতে প্রতিদিন অনিয়ন্ত্রিত পর্যটকের যাতায়াত, অপরিকল্পিত স্থাপনা নির্মাণ, পরিবেশ দূষণ, পর্যটকদের অসচেতনতায় প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে কয়েক বছরের মধ্যে সেন্টমার্টিনের জীববৈচিত্র্য শূন্য হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মিয়ানমার সীমান্তে উত্তেজনার গত ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনে ভ্রমণ বন্ধ রয়েছে। এরমধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব পেয়েছে।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান দীর্ঘ দিন সেন্টমার্টিনকে বাঁচাতে লড়াই করছেন। এখন বন্ধ থাকা সেন্টমার্টিনকে পরিবেশবান্ধব করে নতুন করে সাজানোর সময় এসেছে। যাতে দ্বীপও বাঁচে, পর্যটনও বাঁচে। এ জন্য সেন্টমার্টিনকে বাঁচানোর উদ্যোগের পাশাপাশি বিকল্প পর্যটন এলাকা তুলে ধরতেও মনোযোগী হওয়া দরকার।

বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মীর কাশেম বলেন, সেন্টমার্টিনে নির্দিষ্ট কোনো স্যুয়ারেজ নেই। সমুদ্রে বা মিঠাপানির রিজার্ভারে পাইপ দিয়ে মলমূত্রগুলো ছাড়া হয়। পাইপগুলো এক কিলোমিটার পর্যন্ত পাঠিয়েছে। জাহাজগুলোও জেটিতে এসে তাদের স্যুয়ারেজের মলমূত্র সাগরে ছেড়ে দেয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষক ও এক শিক্ষার্থীর এক গবেষণায় বলা হয়, ২০১২ সালে সেন্টমার্টিনে ১৭টি হোটেল ছিল। ২০১৮ সালে তা ৪৮টিতে দাঁড়ায়। আর ইয়ুথ এনভায়রনমেন্ট সোসাইটির (ইয়েস) হিসাব অনুযায়ী, এখন সেন্টমার্টিনে হোটেল, মোটেল ও কটেজের সংখ্যা দেড়শ।

৩৮ বছরে দ্বীপটিতে প্রবাল আচ্ছাদন ১ দশমিক ৩২ বর্গকিলোমিটার থেকে কমে শূন্য দশমিক ৩৯ বর্গকিলোমিটারে দাঁড়িয়েছে। প্রবাল প্রজাতি ১৪১টি থেকে কমে ৪০টিতে নেমেছে। বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা সাড়ে ৪ বর্গকিলোমিটার থেকে কমে নেমেছে ৩ বর্গকিলোমিটারে। ২০৪৫ সালের মধ্যে সেন্টমার্টিন দ্বীপ প্রবালশূন্য হওয়ার আশঙ্কা করা হয়েছে ওই গবেষণায়। গবেষণাটি আন্তর্জাতিক ওশান সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।

অবৈধভাবে নির্মিত সব স্থাপনা অপসারণ, জলজ প্রাণীর অনিয়ন্ত্রিত আহরণ বন্ধ ও অবাধ পর্যটন নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) ২০০৯ সালে জনস্বার্থে হাইকোর্টে মামলা করে। মামলার চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০১১ সালের ২৪ অক্টোবর আদালত দ্বীপে পরিবেশগত ছাড়পত্র ছাড়া গড়ে ওঠা সব স্থাপনা ভাঙার নির্দেশ দেন। পাশাপাশি জলজ প্রাণী সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন। এরপরও কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় ২০১৭ সালে হাইকোর্ট সংশ্নিষ্টদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার রুল জারি করেন।

পরিবেশ অধিদপ্তর জানায়, কয়েক দফায় তারা সেন্টমার্টিনে পরিবেশ দূষণের দায়ে ৮০টি হোটেলের প্রত্যেকটিকে পাঁচ লাখ টাকা করে জরিমানা করেছে। অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের নোটিশও দিয়েছে। কিন্তু অবৈধভাবে গড়ে ওঠা সেন্টমার্টিনের এসব স্থাপনা উচ্ছেদে তারা কয়েক দফা অভিযানে গিয়ে দেখেছে, বেশিরভাগই আদালত থেকে নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে স্থগিতাদেশ নিয়েছে। এ কারণে অধিদপ্তর কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না।

তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০২১ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট স্থগিতাদেশ চেয়ে করা বিভিন্ন হোটেল মালিকদের করা আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন। ফলে উচ্ছেদে আর বাধা নেই। দ্বীপে পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রায় ১৫ কোটি ৮৪ লাখ টাকা বাজেটের একটি প্রকল্প শেষ হয়েছে ২০২১ সালের জুনে। প্রকল্পের সময় শেষে ব্যয় করতে না পারায় প্রায় তিন কোটি টাকা ফেরত দিয়েছে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। তবুও সেন্টমার্টিনের কোনো পরিবর্তন হয়নি। উল্টো পরিবেশ অধিদপ্তর নিজেই গড়েছে চারটি ভবনের একটি রিসোর্ট। যার নাম দেওয়া হয়েছে মেরিন পার্ক। এছাড়া পুলিশেরও রয়েছে ভবন।

ইয়ুথ এনভায়রনমেন্ট সোসাইটির (ইয়েস) কক্সবাজারের প্রধান নির্বাহী ইব্রাহিম খলিল উল্লাহ মামুন বলেন, সেন্টমার্টিনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্তৃত্ব পর্যটন মন্ত্রণালয়ের বাধার মুখে বারবার ভেস্তে যাচ্ছে। কারণ, তারা সোনার ডিম পাড়া হাঁস একবারে কেটে সব ডিম বের করে আনতে চায়। তাদের কাছে পরিবেশের চেয়ে পর্যটন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। 

ব্যাংককে সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটন স্পট ফুকেটে করোনার আগে দুই বছরের জন্য পর্যটক যাওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। ওই দেশের সরকার ফুকেটের পরিবেশ বাঁচিয়ে পর্যটনের কথা চিন্তা করে। আমাদেরও সেই রাস্তায় হাঁটতে হবে।

বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইন্সটিটিউটের মহাপরিচালক ড. তৌহিদা রশীদ বলেন, দ্বীপটিতে প্রতিদিন অনিয়ন্ত্রিত পর্যটকদের যাতায়াত, অপরিকল্পিত স্থাপনা নির্মাণ, পরিবেশ দূষণ, পর্যটকদের অসচেতনতা এবং দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণের কারণে সেখানকার ইকো-সিস্টেম অর্থাৎ প্রতিবেশ ও জীব-বৈচিত্র্য ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এসিডিটি এবং দূষণ প্রক্রিয়ার ফলে সেন্টমার্টিনের প্রবাল খসে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। পানি যখন স্বচ্ছ এবং পরিমাণ কম থাকে তখন সূর্যের আলো সরাসরি প্রবালে গিয়ে পড়ে। এর ফলে প্রবালের গঠনটা হয়।

কিন্তু সেন্টমার্টিনে দেখা যাচ্ছে অতিরিক্ত দূষণ, এসিডিটির পরিমাণ এতো বেশি বেড়ে গেছে প্রবালের গঠন সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া প্রবাল দিন দিন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। প্রবালের মূল উপাদান হচ্ছে ক্যালসিয়াম কার্বোনেট। পিএইচ কতটুকু হলে প্রবালের স্বাস্থ্য ভালো থাকে এমন একটা বিষয় আছে। যখন পিএইচ কমে যাচ্ছে তখন এসিডিফেকেশন প্রক্রিয়ার দিকে যাচ্ছে। ফলে প্রবালের স্বাস্থ্যটা নষ্ট হয়ে যায় এবং ভেঙে যায়। এটাই সেখানে হচ্ছে।

সেন্টমার্টিনকে বাঁচাতে হলে দুটি পরামর্শ দিয়ে সমুদ্র গবেষণা ইন্সটিটিউটের এই মহাপরিচালক বলেন, সেন্টমার্টিনকে রক্ষা করতে প্রথমত দূষণ একেবারেই বন্ধ করতে হবে। দ্বিতীয়ত দ্বীপটিতে পর্যটকরা যাবে কিন্তু রাত্রীযাপন করতে পারবে না। একদমই থাকা যাবে না। বিরক্ত একেবারেই করা যাবে না। পর্যটকরা যাবে এবং চলে আসবে। সেখানে কোনো হোটেল-মোটেল রাখা যাবে না। যেহেতু সেন্টমার্টিনকে মেরিন প্রটেক্টেড এরিয়া (সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা) ঘোষণা করেছে সরকার সেহেতু এখানে থাকা-খাওয়ার কোনো ব্যবস্থা করা যাবে না।

এমন কী যারা ওখানে বসবাস করছে স্থানীয় মানুষ সরকারের উচিত তাদেরকেও অন্য জায়গায় স্থানান্তর করা। কারণ সেখানে কোনো মানব বসতির সুযোগ থাকবে না। যেহেতু বিরল একটি দ্বীপ, শুধু দেশি-বিদেশি পর্যটকরা ঘুরতে যাবে এবং ঘুরে চলে আসবে। এরকম যদি করা যায় তাহলে প্রবাল ধ্বংস বন্ধ হবে।

ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশনের (টোয়াব) সভাপতি শিবুল আজম কোরেশী বলেন, এর আগেও ১৯৯৬ সালে সেন্টমার্টিনকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণা করা হয়েছিল। তখন সেখানে মাত্র একটি হোটেল ছিল। ইসি এ অনুযায়ী এখানে আর একটি ভবনও ওঠার কথা ছিল না। কিন্তু সিদ্ধান্ত নিলেও সেটা বাস্তবায়ন করা যায়নি, এখন সেখানে আড়াই শ’র বেশি হোটেল আছে। তাই এটাকে মাথায় রেখে বাস্তবায়নযোগ্য সিদ্ধান্ত নেওয়ার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, প্লাস্টিক বর্জ্য অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। যত্রতত্র ময়লা ফেলা বন্ধে পর্যটন সংশ্লিষ্ট ও ট্যুরিস্টদের বাধ্য করতে হবে। প্রয়োজনে আইন প্রয়োগ করতে পারলে তার সফলতা সম্ভব।

অপরদিকে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের সিইও আবু তাহের মুহাম্মদ জাবের বলেন, তারা বর্জ্যমুক্ত সেন্টমার্টিন করতে অনেক চেষ্টা করেছেন। কিন্তু একটি ডাম্পিং স্টেশন করার জন্য সংশ্লিষ্ট সবখানে ঘুরে জায়গা পাওয়া যায়নি। এখন করতে হলে জমি কিনে করতে হবে, কিন্তু ট্যুরিজম বোর্ডে বাজেটে সেটি করা সম্ভব হয়নি। তার ভাষ্য, সেন্টমার্টিন এখন একটি মৃত দ্বীপ বলা যেতে পারে। আমরা ধারণক্ষমতার অধিক ট্যুরিস্ট নিয়ে এটিকে মেরে ফেলেছি। সেন্টমার্টিনকে বাঁচানোর উদ্যোগের চেয়েও আমাদের এখন বিকল্পকে তুলে ধরতে বেশি মনোযোগী হওয়া দরকার। তাই সোনাদিয়া দ্বীপ সেন্টমার্টিনের চেয়ে কম আকর্ষণীয় নয়। ট্যুরিস্টদেরকে সেটাতেও আকৃষ্ট করতে পদক্ষেপ নিতে হবে।
 

 এসআর

×