ত্রাণ সহায়তায় এগিয়ে এসেছে শিক্ষার্থী, সেনাবাহিনী
ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল এবং টানা বৃষ্টিতে সৃষ্ট বন্যায় আগস্টের মাঝামাঝিতে ডুবে যায় দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের ১২টি জেলা। দুর্গম এলাকায় উদ্ধার তৎপরতা ও ত্রাণ পৌঁছাতে বেগ পোহাতে হয় মানুষের। তবে ত্রাণ সহায়তায় এগিয়ে এসেছে শিক্ষার্থী, সেনাবাহিনী ও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান। এদিকে বন্যা আক্রান্ত জেলা লক্ষ্মীপুরে বন্যার পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে।
তবে এখনো পানিবন্দি প্রায় ১২ লাখেরও বেশি মানুষ। জেলায় সাপে কেটেছে ১১৬ জনকে। ফটিকছড়িতে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত দেড় লাখ মানুষ ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৪৭৬ কোটি টাকা। খাগড়াছড়িতে সরকারিভাবে বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে কাজ চলছে। চার দফা বন্যায় জেলায় সড়ক, অবকাঠামো, কৃষি ও কাঁচা ঘরবাড়ির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া বন্যায় বেড়েছে ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়াসহ নানা পানিবাহিত রোগ। এতে ঝুঁকিতে পড়েছে শিশুসহ সাধারণের স্বাস্থ্য সেবা। খবর স্টাফ রিপোর্টার ও নিজস্ব সংবাদদাতার।
লক্ষ্মীপুরে শনিবার বন্যা পরিস্থিতি কিছুটা হলেও পানি নামছে ধীরগতিতে। ক্রমেই বানভাসিদের ভোগান্তি বাড়ছে। ছড়িয়ে পড়ছে পানিবাহিত চর্মরোগ, ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়াসহ অন্যান্য রোগ। তবে এখন পর্যন্ত আশ্রয় কেন্দ্র ছেড়ে যাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। উজান থেকে নেমে আসা পানির চাপ এবং মাঝে মধ্যে বৃষ্টির কারণে বন্যা পরিস্থিতি উন্নতি হচ্ছে ধীরগতিতে জানান, পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নাহিদ উদ-জামান। তিনি জানান, পানি নামতে আরে কয়েকদিন লাগবে।
মেঘনার পানি বিপৎসীমার অনেক নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তিনি আরও জানান, নোয়াখালী, ফেনী, কচুয়া এবং চাঁদপুর থেকে নেমে আসা পানি লক্ষ্মীপুরে ডাকাতিয়া ভুলুয়া নদী হয়ে ধেয়ে আসছে। লক্ষ্মীপুর থেকে ওয়াপদা খাল, রহমতখালী খালসহ অন্য কয়েকটি খালে এসে রহমতখালী ও হাজিমারা রেগুলেটার হয়ে ওই সব পানি মেঘনা হয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়। তবে পানি নামার চেয়ে উজান থেকে আসা পানির চাপ অনেক বেশি।
তার ওপর মাঝে মধ্যে বৃষ্টির পানির উচ্চতা বেড়ে যাচ্ছে। সরকারি হিসেব মতে এখন পর্যন্ত সাত লাখ মানুষ পানি বন্দি বলা হলেও বেসরকারি মতে এ সংখ্যা ১২ লাখেরও বেশি। সরকারি মতে ২৬৫টি গ্রাম এবং চারটি পৌরসভার ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার এক লাখ ৮০ হাজার। তবে এ পর্যন্ত ত্রাণ সামগ্রীর মধ্যে সরকারিভাবে নগদ বিশ লাখ ৭০ হাজার টাকা, ৭৮৯ মে. টন চাল এবং ২৯ হাজার ৬৯৩ প্যাকেট শুকনা খাবার বিতরণ করা হয়েছে।
এদিকে জেলা প্রশাসক সুরাইয়া জাহান জানিয়েছেন, উপজেলা কর্মকর্তাগণ স্থানীয় রান্না করা খাবারসহ অন্যান্য সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছেন। সরকারিভাবে মৃতের সংখ্যার একজনের কথা বলা হলেও প্রকৃত অর্থে বন্যার কারণে এ পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা চার। এদিকে দিন যতই যাচ্ছে মানুষের ভোগান্তি ততই বাড়ছে।
বেড়েছে সাপের উপদ্রব ॥ লক্ষ্মীপুরে বন্যা স্থায়ী রূপ নেওয়ার ফলে সাপের উপদ্রব বেড়েছে। প্রতি দিনই আসছে জেলা সদর হাসপাতালে সাপে কাটা রোগী। শনিবার পর্যন্ত লক্ষ্মীপুর জেলা সদর হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে ১১৬ জন সাপে কাটা রোগীকে। এদের মধ্যে রয়েছে নারী-পুরুষ ও শিশু।
জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। শনিবার বিকেল পর্যন্ত সদর হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন ১৬ জন। এদের মধ্যে চারজন শনিবার ভর্তি হয়েছে। জেলা সদর হাসপাতালে ৮৪ জন, রামগঞ্জে ১৪ জন, কমলনগরে ১১জন এবং রায়পুরে ৭ জন সাপে কাটা রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। তবে বিষধর সাপে কাটার খবর এ পর্যন্ত নিশ্চিত করা যায়নি বা কেউ মারা যাওয়ার খবরও পাওয়া যায়নি। প্রতি দিনই বাড়ছে এর সংখ্যা। এমনটাই জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা। একই সঙ্গে হাসপাতালগুলোতে বাড়ছে নিউমোনিয়া এবং ডায়রিয়াজনিত অন্যান্য রোগীর সংখ্যাও।
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, বন্যার ফলে জাল দেওয়া এবং অন্যান্য সমস্যা এবং সাপের গর্ত বা আবাসস্থলে বন্যার পানি ঢোকার ফলে সাপের স্বাভাবিক জীবন ও চলাচলে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। একই সঙ্গে পানি নামার স্থানে ও জালের পাশে মাছ খাওয়ার জন্য ওঁৎ পেতে থাকে। অপরদিকে সাপ নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য শুকনা স্থান পছন্দ করে। সিভিল সার্জন ডা. আহম্মাদ কবির জানিয়েছেন, এ ব্যাপারে সবাইকে সচেতন এবং সাবধান থাকতে হবে।
কাউকে সাপে দংশন করছে কাল বিলম্ব না করে অতি দ্রুত জেলা সদর হাসপাতালে নিয়ে এসে চিকিৎসা দিতে হবে। একই সঙ্গে সাপের কামড়ের উপরের স্থানে একাধিক স্থানে বেঁধে দিতে হবে। রোগীর মনোবল অটুট রাখতে হবে।
ফটিকছড়ি ॥ অতিবর্ষণ, পাহাড়ি ঢলে ফটিকছড়িতে ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি হয়। এবারের বন্যাতে উপজেলার ভারত সীমান্তবর্তী বাগান বাজার ছাড়াও দাঁতমারা, নারায়ণহাট, ভূজপুর, হারুয়ালছড়ি, সুয়াবিল, খিরাম, রোসাংগিরী, নানুপুর, লেলাং, পাইন্দং, কাঞ্চন নগর, বখতপুর, ধর্মপুর, সুন্দরপুর, সমিতিরহাট, জাফতনগর, আব্দুল্লাপুর ইউনিয়ন এবং ফটিকছড়ি পৌরসভা, নাজিরহাট পৌরসভায় বন্যার পানিতে তলিয়ে যায়।
ঘর-বাড়ি, দোকানপাট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় উপাসনালয়, গবাদিপশুর অ্যাগ্রো ফার্ম, মৎস্য খাত, পুকুর, ফলের বাগান, বৈদ্যুতিক খুঁটি, ব্রিজ-কালভার্ট, সড়ক, কৃষিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অন্তত ৪৭৬ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে তথ্য প্রকাশ করেছে ফটিকছড়ি উপজেলা প্রশাসন। পাশাপাশি ১ লাখ ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
জানা যায়, পার্শ^বর্তী দেশ ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্তবর্তী ফেনী নদীর উজানের পানিতে হালদা নদী, ধুরুং খালের বিভিন্ন অংশে অতিরিক্ত পানির কারণে ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়াও সর্তা খাল, লেলাং খাল, মন্দাকিনি খাল, কুতুবছড়ি খাল সহ ফটিকছড়ির অভ্যন্তরীণ নদ-নদীগুলোর পানিতে উপজেলার ১৮টি ইউনিয়ন ও ২টি পৌরসভার বেশির ভাঙা অংশ জনপদ বন্যার পানিতে ডুবে গেছে।
এ বিষয়ে ফটিকছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, বন্যার পানি কমে গেলেও ক্ষতচিহ্ন রেখে গেছে। সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ফটিকছড়ির মানচিত্রজুড়ে অভাবনীয় ক্ষতি সাধিত হয়েছে। বন্যার্তদের বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, ছাত্রসমাজ, ব্যক্তি উদ্যোগে যেভাবে ত্রাণ সহায়তা ও উদ্ধার অভিযান চালানো হয়, সেভাবে প্রকৃত বেশি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে পুনর্বাসন করতে সরকারের পাশাপাশি বিত্তবানসহ সকলের সহযোগিতা প্রয়োজন।
খাগড়াছড়ি ॥ জেলায় সরকারিভাবে বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের কাজ চলছে। বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান তাদের মাঠ পর্যায়ে কর্মকর্তা কর্মচারীদের এ বিষয়ে নির্দেশনা প্রদান করেছে। এদিকে পাহাড়ি জেলা খাগড়াছড়িতে সাম্প্রতিক বন্যা পরবর্তী ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির চিত্র ফুটে উঠেছে। গ্রামীণ সড়ক অবকাঠামো, কৃষি খাত ও কাঁচা ঘর-বাড়ি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলো থেকে মানুষ ফিরলেও কাটেনি দুর্ভোগ।
রেখে আসা ঘর-বসতির পুরোটাই যেন ধ্বংসস্তূপ। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো সব হারিয়ে পথে বসার উপক্রম। এ ছাড়া বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর এখনো তারা ঘুরে দাঁড়াতে পারেননি। পর পর চার বারের বন্যায় ব্যাপক ক্ষতির মুখে খাগড়াছড়ি। জেলা সদর ছাড়াও দীঘিনালা, রামগড় ও মহালছড়ি উপজেলায় বন্যায় কবলিত হওয়ার সংখ্যা বেশি। জেলা ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সূত্র অনুযায়ী, এই দুর্যোগে খাগড়াছড়ি জেলায় প্রায় এক লক্ষাধিক পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
বন্যার পানিতে মারা গেছে এক কিশোরী। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর ধীরে ধীরে সৃষ্ট ক্ষতচিহ্ন দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৩৫ হাজার কাঁচা ও আধা-পাকা ঘরবাড়ি বিনষ্ট হয়েছে। চেঙ্গী, মাইনী ও ফেনী নদীর তীরবর্তী বহু মানুষের ঘরবাড়ির টিন, আসবাবপত্র ও গবাদিপশু ভেসে নিয়ে গেছে।
কেবল মানুষের পারিবারিক ক্ষতিই নয়; ভয়াল বন্যায় জেলার গ্রামীণ সড়ক অবকাঠামো অনেকটাই ভেঙে পড়েছে।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের সূত্রে মতে, জেলায় ১০৭ কিলোমিটার রাস্তা, ১৪টি কালভার্ট ও ৩টি সেতুর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া কৃষি খাতেও ৩ হাজার ১৮০ হেক্টর ফসলি জমির ক্ষতির তথ্য দিয়েছে কৃষি বিভাগ। এর মধ্যে রোপা আমন, আউশ ও গ্রীষ্মকালীন শাক-সবজি রয়েছে। ফলে ১৩ হাজার ৩শ’ ৩০ জনেরও বেশি কৃষকের মাথায় হাত। শুধু কৃষি খাতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৬ কোটি ৬৬ লাখ, ৭৫ হাজার ৫ শ’ ৪০ টাকা।
বন্যায় ১৫৬টি মংস্য খামার ধ্বংস ও ৫টি মাছের ঘের এবং ১৫৬৯টি পুকুরের মাছ বন্যার পানিতে ভেসে গেছে। মংস্য বিভাগ সূত্রে এ খাতে ক্ষয়ক্ষতির পারমাণ ৬৫ লাখ ৫৫ হাজার টাকা । এ ছাড়া বন্যার পানিতে ৬৫টি পুশুর খামার, ৮৫টি গরু ছাগল, ৫৬৬৫টি হাঁস-মুরগি বন্যার পানিতে ভেসে গেছে। এ খাতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এক কোটি ৩ লাখ ২৮ হাজার টাকা। তবে বিভিন্ন মহল থেকে ধারণা করা হচ্ছে এ বন্যায় খাগড়াছড়িতে ক্ষতির পরিমাণ ছাড়িয়ে যাবে এক হাজার কোটির বেশি।
জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত কৃষি কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ক্ষতি পুষিয়ে নিতে আগাম রবিশস্য চাষে প্রণোদনা দেওয়া হবে। অন্যদিকে এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী তৃপ্তি শংকর চাকমা বললেন, যোগাযোগ সচল রাখতে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে ১০ কিলোমিটার সড়ক ও একটি সেতু মেরামত করা হয়েছে ।