ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৩০ ভাদ্র ১৪৩১

বিশুদ্ধ পানির অভাব

বাড়ছে রোগব্যাধি

জনকণ্ঠ ডেস্ক

প্রকাশিত: ২৩:১০, ২৯ আগস্ট ২০২৪

বাড়ছে রোগব্যাধি

বন্যা কবলিত এলাকায় চিকিৎসসেবা প্রধান করছে বাংলাদেশ নৌবািহিনী

রাস্তায়, উঠানে, ঘরে কোথাও কোমর পানি আবার কোথাও হাঁটু পানি। যেদিকে চোখ যায় শুধু পানি আর পানি। অথৈ পানির তল থেকে কেবল মাথা উঁচিয়ে আছে লম্বা লম্বা গাছ। বানভাসি জেলার গ্রামগুলোর চিত্র এখন ঠিক এমনই। চারদিকে এত পানি থাকলেও বিশুদ্ধ পানির অভাব। থই থই পানির মাঝে বাস করেও সুপেয় পানির নিদারুণ কষ্টে বানভাসি মানুষ।

স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় ঘরবাড়ির পাশাপাশি তলিয়ে গেছে নলকূপ। তাই নিরাপদ পানি উঠছে না সেই নলকূপ দিয়ে। ফলে দুর্গত এলাকায় এখন পানির জন্য হাহাকার চলছে। তবে যেসব এলাকায় ত্রাণ পৌঁছায়, সেখানে কিছুটা বোতলজাত পানির দেখা পান বন্যার্তরা। যদিও তা একেবারে নগণ্য। এজন্য লোকজনও খুব হিসাব করে পানি পান করছেন। বিশুদ্ধ পানির সংকটের পাশাপাশি বাড়ছে ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়াজানিত রোগ। বেড না পাওয়ায় হাসপাতালের মেঝে ও চিকিৎসকের চেম্বারের সামনে ঠাঁই নিয়েছে রোগীরা। এ ছাড়া হাসপাতালে প্রচুর সাপে কাটা রোগীও আসছে।

এদিকে দেশে চলমান বন্যায় ১১ জেলায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৫২ জনে দাঁড়িয়েছে। বৃহস্পতিবার চলমান বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে প্রেস ব্রিফিংয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কে এম আলী রেজা এ কথা বলেন।
তিনি বলেন, বন্যায় মোট ৫২ জন মারা গেছেন। এর মধ্যে ৩৯ জন পুরুষ, ৬ জন নারী ও ৭ শিশু রয়েছেন। এর আগে বুধবার পর্যন্ত মোট মৃতের সংখ্যা ছিল ৩১ জন। এই ৫২ জনের মধ্যে কুমিল্লায় ১৪, ফেনীতে ১৭, চট্টগ্রামের ৬, খাগড়াছড়িতে ১, নোয়াখালীতে ৮, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১, লক্ষ্মীপুরে ১, কক্সবাজারের ৩ ও মৌলভীবাজারে একজনের মৃত্যু হয়েছে। মৌলভীবাজারে একজন নিখোঁজ রয়েছেন।
কে এম আলী রেজা বলেন, সিলেট জেলা থেকে প্রাপ্ত আজকের তথ্য মোতাবেক বন্যার পরিস্থিতির সার্বিক উন্নতি হয়েছে। ৬৮ উপজেলা বন্যা প্লাবিত এবং ক্ষতিগ্রস্ত ইউনিয়ন বা পৌরসভা ৪৯২টি। ১১ জেলায় মোট ১০ লাখ ৭২ হাজার ৫৭৯ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত লোকসংখ্যা ৫৪ লাখ ৮০ হাজার ৪৬৩ জন।
তিনি বলেন, পানিবন্দি লোকদের আশ্রয় দিতে মোট ৩ হাজার ৪০৩টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে মোট ৫ লাখ ২ হাজার ৫০১ জন লোক এবং ৩৬ হাজার ৪৪৮টি গবাদি পশুকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। ১১ জেলার ক্ষতিগ্রস্তদের চিকিৎসাসেবা প্রদানের জন্য মোট ৫৯৫টি মেডিক্যাল টিম চালু রয়েছে।
বন্যা উপদ্রুত এলাকায় সরকারি-বেসরকারিসহ সব পর্যায় থেকে ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের সংগৃহীত মোট এক লাখ ৪ হাজার ১০০ প্যাকেট শুকনা খাবার, কাপড় ও পানি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মাধ্যমে বন্যাকবলিত এলাকায় পাঠানো হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে।
তিনি বলেন, বন্যাকবলিত জেলাগুলোতে মোবাইল ও টেলিফোন যোগাযোগ পুনঃস্থাপন করা হয়েছে। বন্যা পরবর্তী পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব রোধে সংশ্লিষ্ট সবাইকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে।
এ ছাড়া ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ফারাক্কা ব্যারাজের গেট খুলে দেওয়ার তিন দিন পর রাজশাহীতে পদ্মা নদীর পানির উচ্চতা বেড়েছে ৪ সেন্টিমিটার। বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টায় রাজশাহী শহরের বড়কুঠি পয়েন্টে পানির উচ্চতা রেকর্ড করা হয়েছে ১৬ দশমিক ৩৪ সেন্টিমিটার। খবর বিশেষ সংবাদদাতা, স্টাফ রিপোর্টার ও নিজস্ব সংবাদদাতার।
নোয়াখালীতে ত্রাণ বঞ্চিতদের হাহাকারে ভারি আকাশ-বাতাস। ত্রাণ বঞ্চিতদের হাহাকার চলছে নোয়াখালীতে। জেলার ৮ উপজেলায় ভয়াবহ বন্যার উন্নতি হচ্ছে না। এই বন্যায় দুর্গতদের পাশে দাঁড়িয়েছে বিভিন্ন ট্রাস্ট ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। বন্যার শুরু থেকেই বন্যাদুর্গত মানুষের মধ্যে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হলেও পৌঁছাচ্ছে না প্রত্যন্ত দুর্গম এলাকায়। পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার ঘাটতির কারণে পানি নামছে ধীরে।

আকস্মিক বন্যার পানি সাধারণত দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে নেমে যায়। কিন্তু ভিন্ন চিত্র দেখা যাচ্ছে দেশের নোয়াখালী অঞ্চলে। নোয়াখালী জেলায় আকস্মিক বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে এক সপ্তাহের বেশি সময় হলো। পানি কমছে, তবে তা ধীরগতিতে। বিপুল সংখ্যক মানুষ এখনো পানিবন্দি। বুধবার রাতে নদী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বন্যার পানি দ্রুত না নামার কারণ এ অঞ্চলের ভূমিরূপ ও পানি সরে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট ব্যবস্থা না থাকা।

প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মো. মুনসুর রহমান বলেন, নোয়াখালী এবং সংলগ্ন এলাকায় সাম্প্রতিকালে অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ নানা কাজে ভূমি পুনরুদ্ধার করা হয়েছে। ফলে ওই এলাকার পানি নিষ্কাশনের গুরুত্বপূর্ণ অনেক খাল এবং নিষ্কাশন নেটওয়ার্ক আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যে কারণে পানি নামতে দেরি হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। অববাহিকার ভূমির গঠনের বিষয়টিকে সামনে আনা হয়। বলা হয়, উপকূলে আসা পলির ২২-৫০ শতাংশ ভূমিতে জমা হয়।

ওই গবেষক দলে ছিলেন বুয়েটের অধ্যাপক মো. মুনসুর রহমান। গবেষণায় আরও বলা হয়, ১৯৮৫ সালে ফেনী নদীর ওপর নির্মিত মুহুরী স্লুইসগেট এবং ২০১৫ সালে একই নদীর ওপর নির্মিত মুসুপুর ‘ক্রস-ড্যামগুলো’ পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আরেকটি বড় কারণ। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের নদী বিশেষজ্ঞ মমিনুল হক সরকার ৩০ বছর ধরে নদী ও পানি প্রবাহ নিয়ে গবেষণা করছেন।

তাঁর গবেষণা পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, দেশের পূর্বাঞ্চলের নোয়াখালীসহ আশপাশে কয়েকটি জেলার ভূমি মূলত সমতল ও নতুন পলি দিয়ে গঠিত। মমিনুল হক সরকার বলেন, নোয়াখালী, ফেনী ও লক্ষ্মীপুরের ভূমি সমতল ও নরম হওয়ায় সেখানে বিভিন্ন জায়গায় পানি জমে থাকছে। গত তিন যুগে সেখানে বড় বন্যা হয়নি। 
ফলে বন্যার পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়নি। তিনি বলেন, ‘আমাদের এবারের বন্যা থেকে শিক্ষা নিয়ে ওই এলাকায় পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।’ শিশু খাদ্য, খাবার সুপ্রেয় পানির জন্য দীর্ঘ ১ সপ্তাহের অধিক সময় হাহাকার চলছে জেলার ৮টি উপজেলায়। বুধবার পর্যন্ত ১২ লাখ ৭ হাজার ৪২৯টি পরিবার পানিবন্দি ছিল।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বলছে, দেশের পূর্বাঞ্চলের বেশির ভাগ নদীর পানি কমতে শুরু করেছে। কারণ ফেনী ও কুমিল্লায় এবং উজানে ভারতের ত্রিপুরায় বৃষ্টি কমে এসেছে। তবে ২৯-৩০ আগস্টের মধ্যে ভারতের ত্রিপুরা ও বাংলাদেশের নোয়াখালীর পাশর্^বর্তী জেলায় আবারও বৃষ্টি শুরু হতে পারে। তবে তা এর আগের বন্যা সৃষ্টিকারী বৃষ্টির মতো অতটা প্রবল না হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
এদিকে জেলার প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষই পানির নিচে। মানবেতর জীবন যাপনে স্থানীয়রা। মারাত্মক খাদ্য সংকটে রয়েছে জেলার লাখ লাখ পানিবন্দি মানুষ। বুধবার রাতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন, অতীতের রেকর্ড ভঙ্গ করে পানি হু হু করে বাড়ছে। বিভিন্ন এলাকায় খাবার পেয়ে খুশি। তবে বেশি খুশি হয়েছেন পানি পেয়ে।

যদি থাকে তাহলে আরও পানি চাইলেন বৃদ্ধ। বন্যার পানি বন্দি একজন জানালেন, ছয় দিন ধরে পরিবার নিয়ে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। নৌকা ছাড়া চলাচল করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ত্রাণ পাওয়ায় খাবারের চিন্তা কিছুটা হলেও দূর হলো। গ্রামীণ সড়কগুলোতে এখনো কোথাও হাঁটু, কোথাও বুকসমান পানি।

বাসাবাড়ির নিচতলা এখনো পানিতে ডুবে আছে। গ্রামের বাসিন্দারা বলেন, ‘পানি নেমে গেলেও আমরা এখনো মানবেতর জীবন যাপন করছি। এর আগেও আমরা ত্রাণ পেয়েছি, তবে তা পরিমাণে খুবই কম।’ বুধবার নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলায় বন্যার্তদের মাঝে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করেন কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী। ত্রাণবাহী নৌকা দেখে এগিয়ে এলেন প্রবীণ এক ব্যক্তি। ত্রাণের প্যাকেট হাতে পেয়ে প্রবীণ এই ব্যক্তি জানালেন, সাত-আট দিন ধরে পরিবারসহ বাড়িতে পানিবন্দি হয়ে আছেন। ঘরে খাবার নেই।

কাজেও যেতে পারছেন না। তাই সকালে বেরিয়েছিলেন কাজ আর খাবারের খোঁজে। যে ত্রাণ পেলেন তাতে অন্তত দুই-তিন দিন স্ত্রী-সন্তান নিয়ে দুবেলা খেতে পারবেন। উনার মতো ত্রাণের মতো নৌকা দেখে দূর থেকে এগিয়ে আসেন আরও কয়েক বন্যার্ত, তারা বলেন, এলাকার সব মানুষ পানবন্দি অবস্থায় রয়েছে কয়েক দিন ধরে। ঘর থেকে কেউ বের হতে পারে না। দুই দিন ধরে শুকনা খাবার খেয়ে আছে, এমন অবস্থায় ত্রাণ পেয়ে স্বস্তি ফিরে পেলাম। আল্লাহ আপনাদের ভালো করবে।
এদিকে প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেখানে ত্রাণ পৌঁছায়নি। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোর তালিকা নেওয়ার দ্রুত চেষ্টা করা হচ্ছে, পূর্ণ তালিকা হাতে পাওয়ার পরপরই দুর্গত এলাকায় ত্রাণ পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা হবে। বৃহস্পতিবার এসব কথা বলেছেন জেলার ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা। 
আশ্রয়কেন্দ্র থেকে ধীরে ধীরে ফিরছে বন্যার্তরা। মৃত্যুর হার বেড়েছে, এখনো পানিবন্দি লাখ লাখ পরিবার। ক্ষতিগ্রস্তরা বসতভিটা নিয়ে হতাশায়। বেগমগঞ্জের মীর ওয়ারিশপুর গ্রামের সেকান্দার ড্রাইভারের ঘরে এক সপ্তাহ ধরে রাতে হু হু করে পানি ঢোকে। জীবন বাঁচাতে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে আশ্রয় নেন স্থানীয় একটি স্কুল ভবনে। বৃহস্পতিবার থেকে পানি নামতে থাকায় বাড়িতে ফিরে দেখেন, তাঁর বসতঘর ল-ভ-।

ঘরে থাকার মতো অবস্থা নেই। সর্বস্ব হারিয়ে তিনি আবার ছোটেন আশ্রয় কেন্দ্রে। মানিকের পুকুরের সব মাছও ভেসে গেছে। মায়ের ছোট্ট মুরগির খামার ছিল, তাও শেষ। এখন কী করবেন, দিশাহীন মানিক। তার আশা, সরকার দ্রুত সহায়তার হাত বাড়াবে। উপজেলার দুর্গাপুরে পূর্বপাড়ে একটি মহল্লায় সড়কের ধারে বাস করে প্রায় ৫০টি পরিবার। এক সপ্তাহ ধরে পরিবারগুলো আশ্রয় নেয় স্থানীয় একটি স্কুলের কেন্দ্রে।

বৃহস্পতিবার ওই এলাকা থেকে পানি কিছুটা নেমে গেছে। ঘর থেকে পানি সরলেও উঠানে রয়েছে। ঘরের ফ্রিজ ও ইলেক্ট্রনিক্সের ব্যবহৃত আসবাবপত্র ঘরের মেজের পানিতে ভাসছে। এতদিনের ঘরের ধ্বংসযজ্ঞ দেখে অনেকেই বুক ফেটে কান্না করছেন। ওয়ার্ডের বাসিন্দা ভুলু কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমাদের সব শেষ। কীভাবে ঘর ঠিক করব? জীবনটা বড় কঠিন হয়ে গেল। মাথার ওপর ঋণের বোঝা। সামান্য রাজমিস্ত্রির হেলপারের কাজ করে সামান্য আয় দিয়ে সংসার চলছিল, তাও খান খান হয়ে গেল।

কীভাবে তা শোধ করব?’ পানি কিছুটা নেমেছে একদিন আগে। সেনবাগের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কিছু এলাকায় পানি নেমে যাওয়ায় এক সপ্তাহ পর ভেসে উঠতে শুরু করেছে ডুবে থাকা বাড়িঘর। বৃহস্পতিবার অনেকে ঘরের অবস্থা দেখতে পথে নামেন। তবে নিজের ঘরের চেহারা দেখে সবার হৃদয় চমকে উঠে। পানির তীব্র স্রোতে সব ল-ভ- হয়ে গেছে। এখনো আশ্রয়কেন্দ্রেই কাটছে অনেকের দিন। যারা ছাড়ছেন, তারা ভাঙা ঘর মেরামতের কঠিন লড়াইয়ে নেমেছেন। এ লড়াই আদৌ কবে শেষ হবে, তা একমাত্র সৃষ্টিকর্তা জানেন বলে স্থানীয়রা জানান। 
জেলা প্রশাসনের তথ্য বলছে, এখনো বিভিন্ন উপজেলায় ২০ লাখ ৩৬ হাজার ৭০০ মানুষ পানিবন্দি। দুর্গত এলাকায় বানভাসি মানুষের জন্য সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা এবং সংগঠন রান্না করা খাবার, শুকনো খাবার, বিশুদ্ধ পানি, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, ডায়রিয়া প্রতিরোধক ট্যাবলেট ও খাবার স্যালাইন বিতরণ করছে। দুর্গম এলাকায় অতিরিক্ত পানি ও ত্রাণ বহন করে নিয়ে যাওয়ার মতো পরিবহন না থাকায় সমস্যা হচ্ছে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি অব্যাহত থাকায় পানিবন্দি মানুষের সংখ্যা কমে আসছে। মঙ্গলবারের তুলনায় বৃহস্পতিবার প্রায় ৩০ হাজারের বেশি পরিবার পানির বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়েছে।
জেলার ৮টি উপজেলায় হাজার হাজার ঘরবাড়ি, কৃষিজমি, চিংড়ির খামার, পুকুর, ডোবা-সবকিছু তলিয়ে গেছে। এমন ক্ষত দীর্ঘ সময় বয়ে বেড়াতে হবে। সে কথাই বেগমগঞ্জের আলী হোসেনের মুখে। বলছিলেন, ‘বন্যার পানি নাইমছে, কিন্তু জীবন তছনছ করি গেছে। ঘরে থাকা কাপড়চোপড় সব পানি আর কাদায় নষ্ট হয়ে গেছে।

এখন শুধু গায়ের পোশাকটাই একমাত্র সম্বল।’ ঋণ নিয়ে বর্গা জমিতে বেগুন ও পুঁইশাকের আবাদ করেছিলেন একলাশপুর বাজারের পাশের বাসিন্দা দিনমজুর হাকিম আলী। বন্যায় তাঁর সবজি ক্ষেত ভেসে গেছে। পানির স্রোতে ভেঙে গেছে ঘরের একাংশও। এখন ঋণ পরিশোধ আর ঘর ঠিক করার পাশাপাশি আগামী দিনে সংসারের খরচ চালানো নিয়ে দুশ্চিন্তায় তিনি। 
এদিকে এক সপ্তাহ পরও অনেকে পানিবন্দি স্বজনের খোঁজ পাচ্ছেন না। দুর্গম অনেক এলাকায় পানি না কমায় সেখানে যাওয়ার সুযোগ নেই। ফলে বৃহস্পতিবারও হাজার হাজার মানুষ নোয়াখালীর কবিরহাট, কোম্পানীগঞ্জ ও শহরের দাদপুর এলাকায় গেছেন স্বজনের খোঁজে। 
সেনবাগে কোনো ভারি বৃষ্টিপাত না হওয়ায় বন্যার পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হয়েছে। কিন্তু এখনা বাড়িরঘর ডুবে থাকায় সিমাহীন দুর্ভোগ রয়েছে বন্যাদুর্গতরা। সেনবাগে প্রবেশের প্রধান সড়কটি এখনো ডুবে থাকায় বেসরকারি ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের যে সকল ত্রাণসামগ্রী সেনবাগে ঢুকছে সেগুলো সঠিক তদারকির অভাবে  রাস্তার পাশে ও শহর কেন্দ্র বিতরণ করায় এতে করে একেকজন একাধিকবার ত্রাণ নিয়ে যাচ্ছে। এখানো প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত ত্রাণগুলো না পৌঁছায়  গ্রামের মানুষরা চরম খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকটে রয়েছে।
লক্ষ্মীপুর ॥ বন্যা স্থায়ী রূপ নেওয়ার ফলে সাপের উপদ্রব বেড়েছে। প্রতিদিনই আসছে জেলা সদর হাসপাতালে সাপে কাটা রোগী। সন্ধ্যা পর্যন্ত সদর হাসপাতালে নারী-পুরুষ ও শিশুসহ একদিনে এসেছে ১৫ জন রোগী। বন্যার শুরু থেকে এ পর্যন্ত ৮০ জন সাপে কাটা রোগী জেলা সদর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। প্রতিদিনই বাড়ছে এ সংখ্যা।

এমনটাই জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা। একই সঙ্গে বাড়ছে নিউমোনিয়া এবং ডায়রিয়াজনিত অন্যান্য রোগীর সংখ্যাও। হাসপাতালে মেঝে, চিকিৎসকের চেম্বার সামনে ঠাঁই নিয়েছেন রোগীরা। সদর হাসপাতালের ইমার্জেন্সি মেডিক্যাল অফিসার ডা. জয়নাল আবেদিন জানিয়েছেন অন্যান্য রোগীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রতিদিনই সাপে কাটা রোগীর সংখ্যা হাসপাতালে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বৃহস্পতিবার একদিনে এসেছে ১৫ জন সাপে কাটা রোগী। তিনি বলেন, চারদিকে স্থায়ী বন্যার মাছ ধরার জন্য ফলে জাল দেওয়া এবং অন্যান্য সমস্যার ফলে সাপের অবাধ চলাচলে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। 

চাঁদপুর ॥ কুমিল্লা, ফেনী ও নোয়াখালী জেলার বানের পানি চাপে চাঁদপুরের শাহরাস্তি এবং কচুয়া উপজেলার লক্ষাধিক বাসিন্দা এক সপ্তাহের অধিক সময় পানিবন্দি হয়ে আছেন। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত কচুয়া উপজেলার আশরাফুর ইউনিয়নের  ভবানিপুর, সানন্দকড়া, রসুলপুর, পিপলকরা ও শাহরাস্তি উপজেলার রায়শ্রী উত্তর ইউনিয়নের উনকিলা, রায়শ্রী, সন্ডিপাড়া দাদিয়াপাড়া ও দক্ষিণপাড়া ঘুরে দেখা যায় বহু ঘরবাড়ি তলিয়ে আছে।
একই সঙ্গে তলিয়ে গেছে রাস্তাঘাট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ফসলি জমি। বিশেষ করে গবাদি পশু ও হাঁস মুরগি নিয়ে লোকজন খুবই বিপাকে রয়েছেন।
এসব এলাকায় দুর্গত লোকদের জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন কিছু সহায়তা দিলেও রান্না বান্না করে খাওয়ার মতো পরিস্থিতি নেই। শুরুতে পানিবন্দি লোকজন কিছু শুকনো খাবার পেলেও এখন চলছে খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট।
পিপল করা গ্রামের দুলাল মিয়া বলেন, গত ১০ দিন যাবত তাদের গ্রামের বহু বাড়িঘর পানির নিচে। গোয়ালঘর, টয়লেট এবং রান্নাঘরগুলোতে পানি উঠে যাওয়ায় চরম সংকটের মধ্যে রয়েছেন। কেউ কেউ উঁচু জায়গায় আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে উঠলেও অনেকেই এখন পর্যন্ত পানির সঙ্গেই বসবাস করছেন। 
রাজশ্রী গ্রামের আনামিয়া বলেন, তার বসতঘরটি গত এক সপ্তাহ পানির নিচে। তিনি স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয় নিলেও গবাদি পশু নিয়ে খুব বিপাকে রয়েছেন। এখন পর্যন্ত তাদের এলাকায় কোনো ধরনের সহায়তা আসেনি।
একই ইউনিয়নের দাদিয়াপাড়ার বাসিন্দা শাহনাজ ও ফারহানা বলেন, বানের পানির কারণে তাদের রাস্তা তলিয়ে গেছে। তারা এখন মূল ইউনিয়নের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। প্রত্যেকটি ঘরে হাঁটু সমান পানি। খাবার রান্না করার পরিস্থিতি নেই। খুবই অসহায় অবস্থায় আছেল বলে জানান তারা।
স্থানীয় মাদ্রাসা শিক্ষক মাওলানা আশিকুর রহমান বলেন, আমাদের এলাকার কিছু লোক সহযোগিতা নিয়ে এসেছে। আমাদের  সামর্থ্য অনুযায়ী অসহায় লোকদের সহযোগিতার চেষ্টা করছি। এমন পরিস্থিতিতে সরকারি ও বেসরকারিভাবে এসব লোকদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসা উচিত। 

শাহরাস্তি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. ইয়াসির আরাফাত জানান, বানের পানিতে এখন পর্যন্ত পানিবন্দি আছে ৫৫ হাজারের অধিক মানুষ। সাড়ে তিন হাজার লোক আশ্রয় কেন্দ্রে নেয়া হয়েছে। তাদের জন্য শুকনো খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিভিন্ন সংগঠনও তাদের সহায়তায় এগিয়ে এসেছে।
কচুয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এহসান মুরাদ জানান, পানিবন্দি এলাকায় ইতোমধ্যে কিছু লোকজন আশ্রয় কেন্দ্রে উঠেছে। তাদের জন্য শুকনো খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

×