লক্ষ্মীপুরের দিঘুলীতে বন্যার পানিতে ডুবে আছে রাস্তাঘাট। জলমগ্ন বাড়িঘরে যাতায়াতে দুর্ভোগ
দফায় দফায় ভারিবর্ষণ ও উজানের অব্যাহত ঢলে নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ও কুমিল্লায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। বন্যা দীর্ঘায়িত হওয়ায় বানভাসি মানুষের দুর্ভোগ চরমে। খাবার ও বিশুদ্ধ পানির চরম সংকটে মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন লাখ লাখ মানুষ। তবে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে ফেনীতে। এতে বাড়িঘরে ফিরতে শুরু করেছেন বন্যার্তরা।
বাড়িঘর তলিয়ে যাওয়ায় এখনো খোলা আকাশের নিচে দিন কাটাচ্ছে বানভাসি অনেক মানুষ। বৃষ্টি বাদলে মাথার ওপর পাতলা পলিথিন তাদের ভরসা। সব হারানো এসব মানুষ জানেনও না, আদৌ ফিরতে পারবেন কি না নিজ বাড়িতে। আপাতত বাঁচার জন্য খাবার আর পরে পুনর্বাসনে সবার সহায়তা চেয়েছেন তারা।
দিন দিন নোয়াখালীতে ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে বন্যা পরিস্থিতি। রাতের ব্যবধানে জেলার অধিকাংশ এলাকায় পানি বেড়েছে এক থেকে দেড় ফুট। জেলার ৮টি উপজেলার প্রায় ২০ লাখ মানুষ পানিবন্দি। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে প্রতিদিনই বাড়ছে দুর্গতদের ভিড়। পর্যাপ্ত ত্রাণের অভাবে ইতোমধ্যেই দেখা দিয়েছে খাবারের সংকট। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় প্রত্যন্ত অঞ্চলে ত্রাণ পৌঁছানো যাচ্ছে না।
জেলাটিতে এ পর্যন্ত বন্যায় ও বিদ্যুৎস্পৃষ্টে প্রাণ গেছে ১০ জনের। লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার প্রায় সব কটি ইউনিয়নই এখন প্লাবিত। ভালো নেই, রায়পুর, রামগতি, কমলনগর, রামগঞ্জও। এদিকে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা সচল রাখতে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে শিক্ষার্থীসহ তিনজনের মৃত্যু হয়েছে।
সবমিলিয়ে প্রায় জেলার ৯ লাখ মানুষ পানিবন্দি। বন্যাকবলিতরা ত্রাণের আশায় থাকলেও দুর্যোগের কারণে ব্যাহত হচ্ছে ত্রাণ সরবরাহ। এদিকে, কুমিল্লায় বিভিন্ন স্থানে বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় এখনো লোকালয়ে ঢুকছে ঢলের পানি। জেলার ৭টি উপজেলায় পানিবন্দি অবস্থায় আছেন ১০ থেকে ১২ লাখ মানুষ। বন্যাদুর্গত এলাকায় দেখা দিয়েছে খাবার ও বিশুদ্ধ পানির চরম সংকট।
লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার প্রায় সবকটি ইউনিয়নই এখন প্লাবিত। তাই ক্রমেই দুশ্চিন্তা বাড়ছে এই জনপদের মানুষের। ভালো নেই, রায়পুর, রামগতি, কমলনগর, রামগঞ্জও। সব মিলিয়ে প্রায় জেলার ৯ লাখ মানুষ পানিবন্দি। বন্যাকবলিতরা ত্রাণের আশায় থাকলেও দুর্যোগের কারণে ব্যাহত হচ্ছে ত্রাণ সরবরাহ।
এদিকে, নদীর পানি কমলেও কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া, বুড়িচং উপজেলায় বাড়ছে বন্যার পানি। এসব এলাকায় নেই বিদ্যুৎ সংযোগ। জেলার ৭টি উপজেলায় পানিবন্দি অবস্থায় আছেন ১০ থেকে ১২ লাখ মানুষ। বন্যা দুর্গত এলাকায় দেখা দিয়েছে শিশু খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির চরম সংকট। পর্যাপ্ত নেই ত্রাণ সহায়তা।
ফেনীতে বন্যা পরিস্থিতির ধীরে ধীরে উন্নতি হলেও কমেনি দুর্ভোগ। লোকালয় থেকে পানি নামছে ধীরগতিতে। এতে বাড়িঘরে ফিরতে শুরু করেছেন বন্যাদুর্গতরা। ত্রাণ দেওয়া হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকট এখনো চরমে। রয়েছে স্যালাইনসহ বিভিন্ন ওষুধের সংকটও। বন্যায় এখনো পানিবন্দি ১ লাখ মানুষ। বাড়িঘরে থাকার মতো অবস্থা নেই বেশিরভাগ মানুষের। ছাগলনাইয়া, সাতসতি, দাইয়াবিবিসহ ২৫টি গ্রামে এখনো ত্রাণ না পৌঁছানোর অভিযোগ রয়েছে।
এ ছাড়া ভারতের ফারাক্কা বাঁধের ১০৯টি গেট খুলে দেওয়া হলেও এখনো স্বাভাবিক রাজশাহী পদ্মা নদীর পানি। আগামী তিনদিন পর্যন্ত পানি বাড়বার আশঙ্কা নেই বলছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। তবে নদীর পানি বৃদ্ধির কারণে শহরের উজানে বেশকিছু জায়গার অরক্ষিত বাঁধ নিয়ে দুশ্চিন্তায় গ্রামবাসী।
এদিকে মৌলভীবাজারে সবগুলো নদীর পানি বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে এখনো পানিবন্দি দুই লাখের বেশি মানুষ।
এদিকে চলমান বন্যা পরিস্থিতিতে এখন পর্যন্ত ২৭ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। মঙ্গলবার দুপুরে, রাজধানীর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানানো হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মারা গেছে কুমিল্লায়। সেখানে মৃতের সংখ্যা ১০ জন। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নোয়াখালী ও চট্টগ্রামে মারা যান ৫ জন করে।
এছাড়া, কক্সবাজার জেলায় ৩ জন মৃত্যুবরণ করেছেন। ফেনী, খাগড়াছড়ি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও লক্ষ্মীপুরে একজন করে মারা গেছেন। এ ছাড়া, মৌলভীবাজার জেলায় দু’জন নিখোঁজ রয়েছে বলেও জানিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। খবর স্টাফ রিপোর্টার ও নিজস্ব সংবাদদাতার।
নোয়াখালীতে বন্যার অবনতি হয়েছে। অপরদিকে বন্যার্তদের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা সচল রাখতে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে শিক্ষার্থীসহ তিনজনের মৃত্যু হয়েছে।
নোয়াখালীতে কোনো কোনো এলাকায় বন্যার পানি সামান্য কমতে শুরু করলেও বন্যার্তদের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে। বন্যার্ত এলাকায় কাজ করতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে এক শিক্ষার্থীসহ তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। সোমবার রাতে জেলার বেগমগঞ্জ উপজেলায় পৃথক ঘটনায় ওই তিনজনের মৃত্যু হয়। নিহত ব্যক্তিরা হলেন নোয়াখালী পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির দুই লাইনম্যান মো. জাকির হোসেন (৩০) ও মো. ইব্রাহিম (২৮) এবং বেগমগঞ্জ টেক্সটাইল ভোকেশনাল ইনস্টিটিউটের দশম শ্রেণির ছাত্র সাব্বির আহমেদ (১৭)। সাব্বির স্থানীয় একলাশপুর ইউনিয়নের অনন্তপুর গ্রামের মো. সালাউদ্দিনের ছেলে।
এ ছাড়া পল্লী বিদ্যুতের দুই কর্মীর মধ্যে মো. জাকির হোসেনের গ্রামের বাড়ি লক্ষ¥ীপুর জেলায় এবং মো. ইব্রাহিমের গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামে। পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তা ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সেমবার পড়ন্ত বিকেলে বেগমগঞ্জ উপজেলার আমিনবাজার এলাকায় বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের কাজ করার সময় পানিতে পড়ে থাকা ছেঁড়া তারে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে সমিতির লাইনম্যান মো. জাকির হোসেন ঘটনাস্থলে মারা যান।
একই দিন শেষ বিকেলে মীরওয়ারিশপুর এলাকায় বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন চালু করতে গিয়ে লাইনম্যান মো. ইব্রাহিম ঘটনাস্থলে মারা যান। নোয়াখালী পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির মহাব্যবস্থাপক মো. জাকির হোসেন বলেন, ঘটনার আগে থেকেই পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির সাবস্টেশন বন্ধ। বন্যার পানিতে কাজ করতে গিয়ে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিউবো) ছেঁড়া তারে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে তাঁদের দুজন লাইনম্যান ঘটনাস্থলে মারা গেছেন। আইনি প্রক্রিয়া শেষে নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের কাছে মঙ্গলবার লাশ হস্তান্তর ও সমিতির পক্ষ থেকে পরিবারকে সব রকম সহায়তা দেওয়া হবে।
বেগমগঞ্জ টেক্সটাইল ভোকেশনাল ইনস্টিটিউটের সুপারিনটেনডেন্ট মো. মোজাম্মেল হক বলেন, শিক্ষার্থী সাব্বির আহমেদ কয়েক দিন ধরে ইনস্টিটিউটে আশ্রয় নেওয়া বন্যার্তদের সেবা দিয়ে যাচ্ছিল। এরই মধ্যে বাড়িতে তার নিজের ঘরেও বন্যার পানি বেড়ে বসবাসের অযোগ্য হয়ে যায়। মঙ্গলবার পরিবারের সদস্যরাসহ সে পানিতে প্লাবিত ঘরের মালামাল অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছিল। এরই মধ্যে ঘরে থাকা মাল্টিপ্লাগের তারে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ঘটনাস্থলে মারা যায় সে।
বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি থাকায় পানিবন্দি মানুষের সংখ্যা কমে আসছে। সোমবার রাতের তুলনায় মঙ্গলবার ৩০ হাজারের বেশি পরিবার পানির বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়েছে। বন্যায় মঙ্গলবার পর্যন্ত ১২ লাখ ৩৮ হাজার ৪৮টি পরিবার পানিবন্দি অবস্থায় ছিল। তবে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি অব্যাহত থাকার পাশাপাশি পানিবন্দি মানুষের সংখ্যাও কমেছে। সর্বশেষ প্রাপ্ত হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী ৩০ হাজার ৬১৯টি পরিবারের ঘরবাড়ি থেকে পানি নেমে গেছে।
এখন ১২ লাখ ৭ হাজার ৪২৯টি পরিবার পানিবন্দি হয়ে আছে। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যাও কমেছে। মঙ্গলবার ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৬ লাখ ১৯ হাজার ৩৭৫ জন, যা গতকাল পর্যন্ত ছিল ৫৭ লাখ ১ হাজার ২০৪। আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে ৩ হাজার ৮৮৬টি। এগুলোতে ৫ লাখ ৯ হাজার ৭২৮ জন মানুষকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ৩৪ হাজার ৪২১টি গবাদিপশুকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে।
কিছু কিছু এলাকায় পরিস্থিতি উন্নতির দিকে হলেও বন্যার পানি সরছে ধীরগতিতে। বন্যাকবলিত প্রত্যন্ত এলাকাগুলোয় সুপেয় পানি ও খাবারের সংকট দেখা দিয়েছে। নৌযানের অভাবে স্বেচ্ছাসেবীরা ত্রাণসামগ্রী পৌঁছাতে পারছেন না। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত সোমবার সকাল ৯টা থেকে মঙ্গলবার সকাল ১০টা পর্যন্ত জেলায় ৪৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে।
অন্যদিকে নোয়াখালী থেকে রহমতখালী খাল হয়ে বন্যার পানি ঢুকছে লক্ষ¥ীপুরে। এতে পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। জেলার প্রায় সাত লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। দুর্গত এলাকার প্রায় ২৩ হাজার মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছে। অন্যদের মধ্যে অধিকাংশ মানুষ কষ্ট করে বাড়িঘরেই রয়েছে। দুর্গম এলাকায় ত্রাণ পৌঁছাতে পর্যাপ্ত নৌকার প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
উজান থেকে আসা পানির চাপ বাড়তে থাকার পাশাপাশি নতুন করে বৃষ্টির ফলে নোয়াখালীর সার্বিক বন্যা পরিস্থিতিরও অবনতি হয়েছে। জেলার নয়টি উপজেলার মধ্যে আটটিতেই বন্যার পানি বেড়েছে। পরিস্থিতি বেশি খারাপ হয়েছে সেনবাগ, বেগমগঞ্জ, সদর, সোনাইমুড়ী ও চাটখিল উপজেলায়। এসব উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকাগুলোয় সরকারি-বেসরকারি ত্রাণ পৌঁছানো যাচ্ছে না বলে জানা গেছে।
নোয়াখালী জেলা আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের জ্যেষ্ঠ পর্যবেক্ষক মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, সোমবার সকাল নয়টা থেকে মঙ্গলবার সকাল নয়টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় মাইজদীতে ১০২ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে। বঙ্গোপসাগরে লঘুচাপের প্রভাবে আগামী ২৪ ঘণ্টায়ও বৃষ্টি হতে পারে। এতে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতির আশঙ্কা রয়েছে।
সেনবাগ উপজেলার উত্তর কাদরা গ্রামের আব্দুল খালেক বলেন, তাদের বাড়ির কাছে প্রাথমিক বিদ্যালয় ও পাশের একটি মাদ্রাসায় ৫০০ বন্যার্ত মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। এত দিন চাঁদা তুলে তাদের দুই বেলা খাবার দিয়েছেন। আর খাবার দেওয়ার মতো টাকাও তাদের কাছে নেই। ওই এলাকায় দ্রুত ত্রাণসামগ্রীর ব্যবস্থা করা প্রয়োজন বলে জানান তিনি।
এদিকে বন্যা ও বৃষ্টির পানির চাপে ধসে পড়ায় নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার মুছাপুর স্লুইসগেট (রেগুলেটর) এতে আতঙ্ক বেড়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড, নোয়াখালী কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী আমির ফয়সাল সন্ধ্যা সাতটায় জানান, উজান থেকে ধেয়ে আসা পানি ও অতিবৃষ্টির চাপ নিতে না পারার কারণে স্লুইসগেটটি ভেঙে গেছে বলে প্রাথমিকভাবে তারা ধারণা করছেন। এর ফলে নোয়াখালীর সেনবাগ ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার একাংশে জমে থাকা বন্যার পানি নামতে পারবে। পাশাপাশি সাগরে যখন বেশি জোয়ার হবে, তখন লোনা পানিতে আশপাশের এলাকা প্লাবিত হতে পারে।
ফেনী ॥ অতি বৃষ্টি ও ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সৃষ্টি হয়েছে ভয়াবহ বন্যার। এ বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে জেলার আট লাখ মানুষ। জেলার ৬টি উপজেলা বন্যাকবলিত। ফেনী সদর, ফুলগাজী, পরশুরাম, ছাগলনাইয়াতে বানের পানি নামতে শুরু করলেও দাগনভুইয়া ও সোনাগাজীর বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে কয়েকদিন যাবত আটকা পড়ে আছে অসংখ্য মানুষ। বন্যাকবলিত এসব এলাকায় আটকা পড়া মানুষ ত্রাণ না পাওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
জেলা প্রশাসক জানান সবার সমন্বিত সহযোগিতায় বন্যা মোকাবিলার কাজ করছে জেলা প্রশাসন। ফেনীর বিভিন্ন স্থানের আশ্রয় কেন্দ্রে নারী-পুরুষ ও শিশু অবস্থান করছে। এদিকে ত্রাণ বিতরণে সমন্বয়হীনতায় ত্রাণ পৌঁছাচ্ছে না প্রত্যন্ত অঞ্চলে এমনটাই অভিযোগ করছেন অনেক স্বেচ্ছাসেবীরা। সড়কের পাশে থাকা একই ব্যক্তি একাধিক বার ত্রাণ পেলেও আবার আনেকে একবারও ত্রাণ পাননি এমন অভিযোগ করেছেন।
বন্যায় আটকা পড়া ক্ষতিগ্রস্তদের উদ্ধারের পাশাপাশি ত্রাণ বিতরণ করছেন সেনা, নৌ, বিজিবি, ফায়ারব্রিগেড কোস্টগার্ডসহ প্রায়শতাধিক স্বেচ্ছাসেবীসংগঠন।
লক্ষ্মীপুর ॥ বন্যা পরিস্থিতি আরও অবনতি ঘটেছে। মেঘনা সংলগ্ন কিছু এলাকার বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও অভ্যন্তরীণ এলাকা জেলা শহরসহ প্রায় শতকরা ৯০ শতাংশ লোকালয় বন্যার পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। রায়পুর-ঢাকা মহাসড়ক ছাড়া জেলার সকল সড়ক পানিতে ভেসে গেছে। জেলার সঙ্গে উপজেলা তখা গ্রামাঞ্চলে সড়কগুলো স্থান ভেদে হাঁটু পানি থেকে কোমর পর্যন্ত বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। এ পর্যন্ত আশ্রয় কেন্দ্রে লোক আশ্রয় নিয়েছেন। সদর উপজেলার ১৮০টি আশ্রয় কেন্দ্রে মঙ্গলবার থেকে রান্না করা খাবার বিতরণ শুরু হয়েছে।
এমনটাই জানিয়েছেন সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আরিফুর রহমান। এদিকে বৃষ্টি কিছুটা কম হলেও স্বাভাবিকে অভ্যন্তরীণ এলাকা বন্যার পানি বেড়েছে। বর্তমানে খাল-সড়ক ও ফসলি খেত একাকার হয়ে বুঝার উপায় নেই। জেলা প্রশাসন থেকেও বন্যার পানি বৃদ্ধির খবর নিশ্চিত করা হয়েছে। গ্রামের কোথাও গলা থেকে মাথার ওপর পর্যন্ত পানি উঠেছে। এতে জেলা সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রায় পুরোপুরি ব্যাহত হচ্ছে। নৌযানের অভাবে প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখনো সরকারি ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছেনি বলে এলাকার থেকে দাবি উঠেছে। এমনকি ছাত্র আন্দোলনের একজন সমন্বয়কারী এ খবর জানিয়েছেন।
লক্ষ্মীপুর পৌরসভার ১৩ এবং ১৪ নং ওয়ার্ড, সদর উপজেলার বাঙ্গাখাঁ, গরিনগর, নেয়ামতপুর, উত্তর জয়পুরের উত্তরাঞ্চল, রাধাপুর কেন্দ্রগুলোতে এ পর্যন্ত সরকারি ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছেনি বলে দাবি করেছে এলাকাবাসীর। তবে প্রশাসন থেকে দাবি সব আশ্রয় কেন্দ্রগুলো ত্রাণ সামগ্রী পাঠানো হয়েছে। এর পাশাপাশি ছাত্র আন্দোলনসহ বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে এবং বিতরণের অপেক্ষায় আছে।
উপদ্রুত এলাকায় সুপেয় পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। এদিকে প্রশাসনের হস্তক্ষেতে পানিতে আটকা পড়া নারী ও শিশুদের উদ্ধারে ফায়ার সার্ভিস নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। এদিকে জেলা প্রশাসন থেকে এ পর্যন্ত নগদ ২৬ লাখ টাকা, ৫০৯ টন চাল বিতরণ করা হয়েছে। এর পাশাপাশি শুকনো খাবার দেওয়া হয়েছে। কৃষি ও মৎস্য সম্পদের প্রায় শতভাগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
জেলা প্রশাসক সুরাইয়া জাহানের সভাপতিত্বে মঙ্গলবার দুপুরে অনুষ্ঠিত জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির এক জরুরি সভায় জেলা থেকে ওয়ার্ড পর্যন্ত ছাত্র সমাজসহ বিভিন্ন শ্রেণির লোকদের নিয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এদিকে কমলনগর চরলরেন্স গ্রামে মাছ ধরার খালের পানিতে ডুবে গিয়ে মৃত্যু হয়েছে হৃদয় (১৪) নামে এক কিশোরের। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন স্থানীয় ইউপি মেম্বার আবদুল মালেক। বন্যার পানিতে এ নিয়ে মৃত্যুর সংখ্যা দুজনে পৌঁছাল। অপরদিকে সদর উপজেলার লাহার কান্দি আশ্রয় কেন্দ্রে নিউমোনিয়া আক্রান্ত হয়ে আব্দুল মালেক (৭০) নামে এক ব্যক্তির মারা গেছেন। বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে এ পর্যন্ত ২৭ হাজার ৭০০ মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন।
রাজশাহী ॥ ফারাক্কা বাঁধের সব গেট খুলে দেওয়া হলেও রাজশাহী অঞ্চলে বন্যার কোনো পূর্বাভাস নেই বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। সোমবার ফারাক্কা খুলে দেওয়ার খবরের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বন্যা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ পদ্মা বিধৌত এলাকাগুলোতে।
তবে এখনো আতঙ্কের কোনো কারণ দেখছে না পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। তাদের দাবি, রাজশাহী অঞ্চলের নদীগুলোতে পানি এখনো বিপৎসীমার অনেক নিচে রয়েছে। আগামী পাঁচ দিনের মধ্যেও এ অঞ্চলে বন্যার কোনো পূর্বাভাস পাওয়া যায়নি।
রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তথ্যমতে, রাজশাহীতে পদ্মা নদীর বিপৎসীমা ১৮ দশমিক ০৫ সেন্টিমিটার নির্ধারিত আছে। গত ১৮ ঘণ্টায় অপরিবর্তিত রয়েছে পদ্মা নদীতে পানির উচ্চতা। সোমবার সন্ধ্যা ৬টায় রাজশাহীর বড়কুঠি পয়েন্টে নদীতে পানির উচ্চতা ছিল ১৬ দশমিক ৩০ সেন্টিমিটার। যা মঙ্গলবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত অপরিবর্তিত ছিল। তবে ১৭ আগস্ট চলতি মৌসুমের সর্বোচ্চ পানির উচ্চতা ১৬ দশমিক ৫৪ সেন্টিমিটার ছিল।
এদিকে নদী সংলগ্ন ও চরের বাসিন্দাদের ভাষ্য, প্রতি বছরের মতো চলতি মৌসুমেও ফারাক্কা বাঁধের সব গেট খুলে দিয়েছে ভারত সরকার। তবে নদী সংলগ্ন চরগুলোর দু’এক জায়গায় পানি ঢুকলেও রাজশাহী অঞ্চলে পদ্মা নদীর পানি এখনো স্বাভাবিক আছে। আগামীতে খারাপ কোনো পরিস্থিতি তৈরি হয় কি না সেটি নিয়েও শঙ্কিত অনেকেই।
জানতে চাইলে রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার চর আষাড়িয়াদহ ইউনিয়নের ভুবন পাড়া গ্রামের কৃষক ফারুক আলী বলেন, পদ্মা নদীর পানি এখনো বৃদ্ধি পায়নি। তবে নদীতে প্রচ- ঢেউ এবং ভাঙন দেখা দিয়েছে। বিগত চার-পাঁচ বছরে যে পরিমাণ ভাঙন দেখা দেয়নি এবার সেটা দেখা দিয়েছে, যে কারণে আবাদি জমিগুলো তলিয়ে যাচ্ছে। তাই ফারাক্কা গেট খুলে দেওয়ায় আমরাও কিছুটা আতঙ্কে আছি।
একই ইউনিয়নের ট্যাকপাড়া গ্রামের কৃষক জাহিদ হোসেন বলেন, আমাদের এলাকায় এখন পর্যন্ত পানি বৃদ্ধি পায়নি। তবে নদীর ভাঙন বৃদ্ধি পেয়েছে। যে কারণে আমাদের ফসলের জমিগুলো ভেঙে যাচ্ছে। ফারাক্কার সমস্ত গেট খুলে দিলেও পানি তেমন বৃদ্ধি পায়নি। তিন দিন আগে যেখানে পানি ছিল এখনো সেখানেই রয়েছে। শুধু পানির চাপ বাড়ার ফলে আবাদি জমি ভেঙে যাচ্ছে।
এদিকে রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) গেজ রিডার এনামুল হক বলেন, ফারাক্কার সব গেট খুলে দেওয়ার বিষয়টি আমরাও শুনেছি। তবে এখনই আতঙ্কের কিছু নেই। ২০১৩ সালের পরে রাজশাহীতে পদ্মার পানি বিপৎসীমা পার হয়নি। রাজশাহীর সব পয়েন্টে সোমবার সন্ধ্যা ৬টায় পানির যে উচ্চতা ছিল, মঙ্গলবার দুপুর ১২টার দিকেও সেটাই ছিল।
তিনি আরও বলেন, ভারতের বিহার অঞ্চলের পানি বেড়ে গেলে সেটা মূলত আমাদের এদিকে প্রবেশ করে। সেখানে যদি আরও পানি বেড়ে যায় সেক্ষেত্রে আমাদের বিপৎসীমার আশপাশে পানি আসতে পারে। তার আগে মুর্শিদাবাদ এলাকায় পানি প্রবেশ করবে। তাই আপাতত কোনো আতঙ্কের কারণ নেই।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ ॥ ফারাক্কার ভাটিতে চাঁপাইনবাবগঞ্জের পদ্মা নদীতে গত ২৪ ঘণ্টায় পানি বেড়েছে সাত সেন্টিমিটার। তবে এখনো পদ্মার পানি বিপৎসীমার দেড় মিটার নিচে রয়েছে। মঙ্গলবার দুপুরে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী ময়েজ উদ্দীন এ তথ্য জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ফারাক্কা ব্যারেজের পর ভারত থেকে পদ্মা নদী চাঁপাইনবাবগঞ্জের পাংখা পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। সেই পাংখা পয়েন্টে ২৪ ঘণ্টায় ৭ সেন্টিমিটার পানি বেড়েছে। তবে সর্বশেষ ১২ ঘণ্টায় পানি বেড়েছে ৪ সেন্টিমিটার।
প্রকৌশলী ময়েজ উদ্দীন আরও বলেন, পদ্মায় বিপৎসীমা ধরা হয় ২২ দশমিক ৫ মিটার। বর্তমানে পানির স্তর ২০ দশমিক ৫৫ মিটার। এখনো পানির স্তর বিপৎসীমার দেড় মিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি বৃদ্ধির যে হার, তাতে এখনো আকস্মিক বন্যার আশঙ্কা নেই এ অঞ্চলে।
উল্লেখ্য, ফারাক্কা ব্যারেজের ১০৯টি জলকপাট খুলে দেওয়ার খবর দেয় ভারতের বেশ কিছু গণমাধ্যম। সংবাদে বলা হয়, ভারতের বিহার ও ঝাড়খন্ডে বন্যার কারণে ফারাক্কার কপাট খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
মৌলভীবাজার ॥ বন্যার পানি উঁচু এলাকা থেকে নেমে যাওয়ার অনেকেই বাড়ি ফিরছেন। অনেক স্থানে বন্যার পানির তোরে ভেঙে যাওয়া ঘর মেরামত শুরু করেছেন ক্ষতিগ্রস্তরা। নি¤œাঞ্চল থেকে ধীরগতিতে পানি কমতে শুরু করেছে। গত কয়েকদিন উজানে বৃষ্টিপাত না হওয়ায় মৌলভীবাজার জেলার ৪টি নদীর পানি কমতে শুরু করেছে। মনু, ধলাই ও কুশিয়ারা নদীর পানি বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে জুড়ী নদীর পানি এখনো বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, ইতোমধ্যে মনু নদীর ৩টি স্থানে এক্সেভেটর দিয়ে ভাঙন মেরামতের কাজ চলছে।
সরকারিভাবে ত্রাণ দেয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন ও ব্যক্তি উদ্যেগে ত্রাণসামগ্রী বন্যার্তদের মাঝে বিতরণ করা হচ্ছে। তবে দুর্গম বা নি¤œাঞ্চলে ত্রাণ সামগ্রী প্রয়োজনের তুলনায় কম যাচ্ছে। বন্যাদুর্গত এলাকায় খাদ্যসংকট ও বিশুদ্ধ পানির অভাব রয়েছে।
সাউথ সিলেট কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাসিব হোসেন খানের তত্ত্বাবধানে কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার শাহাব উদ্দিন আহমদ কামারচাক ইউনিয়নের ইসলামপুর ও আদমপুর এলাকায় সশরীরে উপস্থিত হয়ে নৌকার মাধ্যমে বানভাসি অসহায় মানুষের ঘরে ঘরে গিয়ে ৫০০ পরিবারের মাঝে এই খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দেন।
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশ মৌলভীবাজার জেলা শাখার পক্ষ থেকে মৌলভীবাজার সদর ও রাজনগর উপজেলার বিভিন্ন দুর্গম এলাকায় ত্রাণ বিতরণ করা হয়। নৌকাযোগে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত শতাধিক পরিবারের মাঝে নিত্য প্রয়োজনীয় ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দেন কেন্দ্রীয় সদস্য ও জেলা সভাপতি শাইখুল হাদিস মুফতী হাবিবুর রহমান ক্বাসেমী।
চট্টগ্রাম ॥ জেলার মীরসরাইয়ে বন্যার পানি কমতে শুরু করছে। বন্যা পরবর্তী পরিস্থিতিতে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি সংকট দুর্যোগের কবলে থাকা মানুষ বাড়ি ফিরে যাবার পর খাবার, পানি ও যোগাযোগ সংকট। কিছু এলাকায় এখনো বিদ্যুৎ সংকট রয়েছে। উপজেলার ৫৪টি সড়কের ক্ষতবিক্ষত অবস্থা না সারলে মানুষের যোগাযোগেও বেশ দুঃসহ হয়ে উঠবে। আবার কিছু মানবেতর মানুষের বাসস্থান ও কিছুদিনের ন্যুন্তম খাবারের সংস্থান এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।