ফটিকছড়ির হারুয়ালছড়ি গ্রামে দুই সন্তানকে নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে এক বাবা
উজানে ভারতের ত্রিপুরা থেকে নেমে আসা ঢল ও কয়েক দিনের প্রবল বৃষ্টির কারণে বন্যার কবলে পড়েছে দেশের ১১টি জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল। ভয়াবহ সংকটে এখনো পানিবন্দি এসব দুর্গত এলাকার মানুষ। এদিকে, উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বন্যার পানি কিছুটা কমলেও দুর্ভোগ কমেনি সাধারণ মানুষের। বানের পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে আসছে ক্ষতচিহ্ন। শিশু খাদ্য, গোখাদ্য ও শুকনা খাবার আর বিশুদ্ধ পানির সংকট ভোগান্তিতে যোগ করছে নতুন মাত্রা। খবর স্টাফ রিপোর্টার ও নিজস্ব সংবাদদাতার।
বন্যায় অবনতি হয়েছে লক্ষ্মীপুরের বন্যা পরিস্থিতির। এখনো পানিবন্দি প্রায় ৭ লাখ মানুষ। যাদের মধ্যে ২০ হাজার আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই পেয়েছে। স্থানীয়রা বলছেন, শনিবার খুলে দেওয়া হয় নোয়াখালীর স্লুইসগেটের ২৩টি রেগুলেটর। সেই পানি লক্ষ্মীপুরের নদী-খাল হয়ে মিশবে সাগরে। উপচে পড়া জল মেঘনাসহ আশপাশের খাল-বিলে জমেছে। জলমগ্ন সদরসহ ৫ উপজেলা। আশ্রয়কেন্দ্রে ছুটছে বানভাসিরা।
সোনাগাজী ও দাগনভূঞা ছাড়া ফেনীতে সামগ্রিকভাবে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। জেলার সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ফুলগাজী-পরশুরাম ও ছাগলনাইয়া থেকে পানি কিছুটা নেমেছে। তবে নতুন করে আরও কয়েকটি ইউনিয়ন নিমজ্জিত হচ্ছে বলেও জানা গেছে। প্রশাসন সূত্রে জানানো হয়েছে, সোনাগাজী ও দাগনভূঞার অবস্থা ভয়াবহ। এই মুহূর্তে ফেনী সদর, ফুলগাজী ও সোনাগাজীর মানুষের ত্রাণের বেশি প্রয়োজন। তবে বহু এলাকা থেকে জোর করে ত্রাণ ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগও পাওয়া গেছে।
তিন দিন আগে কুমিল্লার বুড়িচংয়ের বুড়বুড়িয়া এলাকায় গোমতী নদীর বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করতে থাকে। শুক্রবার থেকে নতুন করে অনেক গ্রাম প্লাবিত হতে থাকে। ভয়াবহতা আরও বৃদ্ধি পায়। কুমিল্লা সদর দক্ষিণ, চৌদ্দগ্রাম, নাঙ্গলকোট, বুড়িরচংসহ ১৪ উপজেলার ১১৮টি ইউনিয়ন তলিয়েছে বানের জলে। পানিবন্দি প্রায় সাড়ে ৬ লাখ মানুষ। কুমিল্লার বুড়িচংয়ে পানি, নৌকা ও খাবার পানির সংকট বাড়ছে বলে জানা গেছে। এ ছাড়া পানিতে ডুবে মারা গেছে দুই শিক্ষার্থী।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা ও আখাউড়ায় পানি আরও কমেছে। এ ছাড়া বন্দর দিয়ে আগরতলায় যাত্রী পারাপার শুরু হয়েছে।
চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি ও মীরসরাইয়ে পানিবন্দি লাখো মানুষ। রবিবার বৃষ্টি হওয়ায় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। পর্যাপ্ত ত্রাণ না পৌঁছায় খাদ্য এবং সুপেয় পানির হাহাকার বেড়েছে। মহানগরীতে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। শনিবার বৃষ্টি না হওয়ায় এবং রবিবার কম বৃষ্টিপাত হওয়ায় সড়কগুলো থেকে পানি নেমেছে। কিন্তু এখনও জনজীবনে প্রাণচাঞ্চল্য আসেনি। চট্টগ্রাম বন্দর সূত্র জানায়, জেটিতে কন্টেনার হ্যান্ডলিং স্বাভাবিক রয়েছে।
বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে হবিগঞ্জে। ধীরে ধীরে পানি নামতে শুরু করায় ঘরে ফিরতে শুরু করেছে বানভাসিরা। তবে চারদিকেই বন্যার ক্ষত। সড়ক থেকে শুরু করে গৃহস্থের ঘর, কিছুই আর অক্ষত নেই।
মৌলভীবাজারের জেলায় বন্যা পরিস্থিতি উন্নতির দিকে। জেলার চারটি নদীর পানি দ্রুত কমতে শুরু করেছে। তবে নি¤œাঞ্চল প্লাবিত রয়েছে। পানি কমেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেও। তবে এখনো জলমগ্ন কসবাসহ নি¤œাঞ্চল। দুর্গত এলাকায় ত্রাণ সহায়তা নিয়ে পাশে আছে স্বেচ্ছাসেবীরা। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। এ ছাড়া মৌলভীবাজারেও বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। তবে চোখ রাঙাচ্ছে হাল্কা থেকে মাঝারি বৃষ্টি।
রাত থেকে কয়েক দফায় বৃষ্টি হয়েছে খুলনা নগরীতে। ভারি থেকে মাঝারি বর্ষণে তলিয়ে গেছে নগরীর পথঘাট। বাসাবাড়ি-ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও ঢুকে পড়েছে পানি। সড়ক জলমগ্ন থাকায় বিড়ম্বনায় পড়ে কর্মজীবী মানুষ। আবহাওয়া অফিস জানায়, রবিবার সকাল পর্যন্ত শেষ ২৪ ঘণ্টায় সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়েছে খুলনা বিভাগে। ২৭ আগস্টের পর থেকে বৃষ্টি কমে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। ভারি বর্ষণে বাগেরহাটের বেশিরভাগ এলাকা তলিয়ে গেছে।
খাগড়াছড়িতে ধীরে ধীরে নামতে শুরু করেছে পানি। স্পষ্ট হতে শুরু করেছে ক্ষতচিহ্ন। প্লাবিত এলাকা থেকে পানি নামতে থাকায় ঘরবাড়িতে ফিরতে শুরু করেছে মানুষ। তবে পানি নামার তিন দিনেও ঘুরে দাঁড়াতে পারেননি সদরসহ দীঘিনালা, মাটিরাঙ্গা উপজেলার শতাধিক পরিবার। অনেকের ঘর-বাড়ি ভেঙে গেছে, ক্ষতি হয়েছে বাড়ির আঙ্গিনা ও আশপাশের শাক-সবজির খেত। এদিকে, রবিবার সকালে খুলে দেওয়া হয় রাঙ্গামাটির কাপ্তাই বাঁধের ১৬টি গেট। পরে ছয় ঘন্টা পর আবার বন্ধ করে দেওয়া হয়।
অন্যদিকে, ভয়াবহ বন্যায় দেশের ৭ জেলায় ১৮ জন মারা গেছে বলে জানিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। বন্যায় দেশের ১১ জেলায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন ১০ লাখ ৪৭ হাজার ২৯ পরিবার। আর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন প্রায় ৫২ লাখ মানুষ। রবিবার দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ সচিব কামরুল হাসান।
তিনি বলেন, ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, লক্ষ্মীপুর ও কক্সবাজারের বন্যা পরিস্থিতি ‘উন্নতির দিকে’। নতুন করে কোনো জেলা প্লাবিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তবে বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন নদীর পানি বৃদ্ধির আভাস দেওয়া হয়েছে।
নোয়াখালীতে সার্বিক বন্যার পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। এ ছাড়া মৃত্যু হয়েছে তিনজনের। সেনবাগসহ কিছু এলাকায় রবিবারও বেড়েছে বন্যার পানি। তবে নোয়াখালী সদর, কবিরহাট, কোম্পানীগঞ্জ ও সুবর্ণচর উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। অপরিবর্তিত রয়েছে চাটখিল উপজেলার বন্যা পরিস্থিতি।
নোয়াখালীর সার্বিক বন্যার পরিস্থিতির অবনতি হলেও তেমন কোনো উন্নতি নেই। বন্যায় এ পর্যন্ত তিন জনের মৃত্যু হয়েছে। বৃষ্টি তেমন নেই। এর পরও নোয়াখালীর সেনবাগসহ কিছু এলাকায় রবিবারও বেড়েছে বন্যার পানি। তবে নোয়াখালী সদর, কবিরহাট, কোম্পানীগঞ্জ ও সুবর্ণচর উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। অপরিবর্তিত রয়েছে চাটখিল উপজেলার বন্যা পরিস্থিতি। বন্যার মধ্যে এ পর্যন্ত জেলায় পানিতে ডুবে ও বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যু হয়েছে তিনজনের।
সেনবাগের দিন দিন পানি বৃদ্ধিই পাচ্ছে। উপজেলার অধিকাংশ স্কুল কলেজ, মাদ্রাসাকে আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করা হলেও ওই কেন্দ্রগুলোতে আশ্রয় নেওয়া মানু খাদ্য পানির সংকট প্রকোট আকার ধারণ করেছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ব্যক্তি ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের লোকজন ত্রাণ তৎপরতা চালালেও তা অপ্রতুল। সেনবাগ-সোনাইমুড়ী সড়কসহ উপজেলার সকল পাকা ও কাঁচা সড়ক পানির নিয়ে তলিয়ে থাকায় যানবাহন চলাচলা কমে গেছে। বর্তমানে নৌকা একমাত্র বাহন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সেনবাগ উপজেলার গিরুয়া গ্রামের বাসিন্দা ও সাবেক ইউপি সদস্য আলমগীর হায়দার বলেন, শনিবার থেকে বৃষ্টি তেমন হয়নি। কিন্তু পার্শ্ববর্তী জেলা ফেনী হয়ে উজানের পানি ধেয়ে আসছে। এ কারণে বৃষ্টি কমা সত্ত্বেও বন্যার পানি আরও ৩ থেকে ৪ ইঞ্চি বেড়েছে। স্থানীয় বাসিন্দারা বন্যার কারণে খুবই দুর্ভোগে রয়েছেন।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জিসান বিন মাজেদ গণমাধ্যমকে বলেন, সেনবাগের বন্যা পরিস্থিতি আগের দিনের তুলনায় অবনতি হয়েছে। ফেনী থেকে বন্যার পানি ঢুকে পড়ায় পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, উপজেলার ১২৫টি অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে এরই মধ্যে প্রায় ২২ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোয় উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দুই বেলা খিচুড়ি রান্না করে বিতরণ করা হচ্ছে। তবে এখানে শুকনা খাবারের তীব্র সংকট রয়েছে।
রবিবার বেগমগঞ্জ উপজেলার চৌমুহনী পৌরসভার গনিপুর, কিসমত করিমপুর, হাজীপুর, করিমপুর, একলাছপুর, মীর ওয়ারিশপুর, গোপালপুর, লক্ষ্মীনারায়ণপুর এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিটি বাড়িতেই হাঁটু থেকে কোমর এমনকি বুক পর্যন্ত পানি। এর মধ্যেই বাসিন্দাদের অনেকে দুর্ভোগ সয়ে বসতঘরে অবস্থান করছেন। চাটখিলের ইউএনও কাজী এহসান উদ্দিন বলেন, চাটখিলে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে।
উপজেলার ৯টি ইউনিয়নের সব ক’টি বন্যার পানিতে প্লাবিত অবস্থায় রয়েছে। এরই মধ্যে আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন প্রায় ৭ হাজার মানুষ। পানি নামছে না বরং পানি বাড়ার আশঙ্কা রয়ে গেছে। বিকেলে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা জায়েদ হাসান খান বলেন, জেলায় বন্যার পানিতে ডুবে এবং বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে এ পর্যন্ত তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে দুজন সেনবাগ এবং একজন সদর এলাকার বাসিন্দা।
ফেনীর উজানের পানিতে নোয়াখালীতে পানিবন্দি রয়েছে প্রায় ২১ লাখ মানুষ। বন্যা দুর্গত এলাকায় দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানি ও খাদ্য সংকট। অন্যদিকে, খাদ্য সংকট ও সাপের উপদ্রবে নাকাল বন্যা দুর্গতরা। অনেকের কাটছে নির্ঘুম রাত।
রবিবার দুপুরের দিকে ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার সৈয়দ মহিউদ্দিন আব্দুল আজিম বলেন, গত তিন দিনে নোয়াখালীতে ৬৩ জনকে সাপে কেটেছে। এর মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে সাপে কেটেছে ২৮ জনকে। বন্যার কারণে ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছে ১০৮ জন।
সেনবাগ উপজেলার বাসিন্দা মো. আবু জাফর জানান, ফেনীর মুহুরী নদীর উজানের পানি প্রবেশ করায় জেলার সেনবাগ, বেগমগঞ্জ, সোনাইমুড়ী উপজেলার আরও নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এসব উপজেলায় গত দুদিন বৃষ্টি না হলেও উজানের পানিতে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়। অনেক জায়গায় ঘরবাড়ি ও সড়ক তলিয়ে গেছে। স্কুলে ঢুকে পড়েছে পানি।
দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকট। কবিরহাটের বাসিন্দা আমির হাসান বলেন, বন্যা ও ভারি বর্ষণের কারণে কবিরহাটের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। এদিকে দিনমজুর খেটে খাওয়া মানুষগুলো কাজ করতে না পেরে মানবেতর জীবনযাপন করছে। কর্মহীন মানুষ সাহায্যের আবেদন জানিয়েছেন সরকার ও বিত্তশালীদের কাছে।
বন্যাকবলিত বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, জেলার ৮টি উপজেলার প্রায় ৯০ ভাগ মানুষ পানিবন্দি হয়ে আছেন। প্রতিটি বাড়িতে ৩ থেকে ৫ ফুট জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। নিচু এলাকাগুলো যার পরিমাণ ৬ থেকে ৭ ফুট। বসতঘরে পানি প্রবেশ করায় বুধবার রাত পর্যন্ত অনেকে খাটের ওপর অবস্থান করলেও বৃহস্পতিবার সকাল থেকে তারা নিকটস্থ আশ্রয় কেন্দ্র, প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে অবস্থান নিয়েছেন।
বসত ও রান্নাঘরে পানি ঢুকে পড়ায় খাবার সংকটে রয়েছে বেশির ভাগ মানুষ। জেলার প্রধান সড়কসহ প্রায় ৮০ ভাগ সড়ক কয়েক ফুট পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। বন্যার পানি ঢুকে পড়ায় বেশিরভাগ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে। সড়কগুলোতে যান চলাচল অনেকটাই কম। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, জেলার ৯টি উপজেলার মধ্যে আটটি উপজেলার মানুষ বন্যাকবলিত হয়েছে। এসব উপজেলায় ইতোমধ্যে ৮২৬টি আশ্রয়কেন্দ্রে প্রায় ১ লাখ ৫৩ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন।
ফেনী ॥ বন্যার পানি নামতে শুরু করেছে ফুলগাজী, পরশুরাম ও ফেনী সদরে। তবে নতুনভাবে প্লাবিত হয়েছে সোনাগাজী ও দাগনভূঞা উপজেলা। বিপদ সীমার নিচে প্রবাহিত হচ্ছে পরশুরামের মুহুরী ও কহুয়া নদীর পানি। তবে পানিবন্দি রয়েছে ফেনী সদর ফুলগাজী, পরশুরাম, ছাগলনাইয়া, উপজেলার কয়েক লাখ মানুষ। সকাল থেকে সেনাবাহিনীসহ স্বেচ্ছাসেবী টিম সোনাগাজী ও দাগনভূঞা উদ্ধার কাজ করে।
বন্যার পানি নেমে যাওযার জন্য সোনাগাজীর মুহুরী রেগুলেটরের ৪০টি স্লুইসগেট ও নোয়াখালীর মুছাপুরের ১৭টি স্লুইসগেট খুলে দেওয়া হয়েছে। সোনাগাজী ও দাগনভূঞার বন্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে এখনো পানিবন্দি কয়েক লাখ মানুষ। ফেনী জেলায় বিভিন্ন সংগঠনের আনা ত্রাণ সামগ্রী পর্যাপ্ত মজুত থাকলেও বন্যা দুর্গতদের কাছে ঠিকমতো পৌঁছানো যাচ্ছে না।
জেলার বন্যাকবলিত এলাকায় ত্রাণ বিতরণে সমন্বয় না থাকায় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, সেনাবাহিনী আশপাশের এলাকায় ত্রাণ বিতরণ করলেও প্রত্যন্ত এলাকায় বানভাসির কাছে খাদ্যসমগ্রী যাচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। ফেনীসহ জেলার সর্বত্র দোকানপাট বন্ধ থাকায় এই মুহূর্তে ফেনীর সর্বত্র খাদ্য খাওয়ার পানি ও ওষুধ সংকট দেখা দিয়েছে। ফেনী শহরের বিদ্যুতের ৯টি লাইন সচল হয়েছে। গত চারদিন ধরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। ফেনীর বিভিন্ন স্কুল-কলেজ ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া ॥ কসবা ও আখাউড়া উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির আরও উন্নতি হয়েছে। রবিবারও পানি কমেছে দুই উপজেলাতেই। কসবায় কিছু সড়কে পানি থাকলেও বেশিরভাগ জায়গার বাড়িঘর থেকে পানি সরে গেছে। আখাউড়ায় বন্যার পানি না থাকলেও কিছু বাড়িতে জলাবদ্ধতার কারণে পানি দেখা যায়।
এদিকে পানি শুকিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বন্যার ক্ষতচিহ্ন বের হচ্ছে। আখাউড়ার কেন্দুয়াই, রাজেন্দ্রপুর, খলাপাড়া, ইটনা, আইড়ল, কর্নেল বাজার এলাকায় গিয়ে দেখা যায় বেশি কিছু বাড়িঘর বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভাসতে শুরু করেছে ডুবে যাওয়া জমি। তবে এসব জমিতে লাগানো বেশিরভাগ ধানের চারা একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে। একই অবস্থা কসবা উপজেলাতেও।
আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে রবিবার বিকেল থেকে যাত্রী পারাপার শুরু হয়েছে। বন্যার কারণে যারা ভারতে কিংবা বাংলাদেশে আটকা পড়েছিলেনে তাদের ভিসা শেষ হয়ে থাকলেও বিশেষ বিবেচনায় যেতে দেওয়া হচ্ছে। তবে গাজীর বাজার এলাকায় সেতু ভাঙা থাকায় সহসাই আমদানি-রপ্তানি চালু করা সম্ভব হবে বলে মনে করা হচ্ছে। ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস ভবন পানিতে ডুবে থাকায় গত চারদিন ধরে সব ধরণের কার্যক্রম বন্ধ ছিলো।
আখাউড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) গাজালা পারভীন রুহি জানান, এখন পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক। তবে কয়েকটি বাড়িতে জলাবদ্ধতা রয়েছে। জলবদ্ধতার কারণ নিরসন করে পানি সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।
কসবার ইউএনও মুহাম্মদ শাহরিয়ার মুক্তার বলেন, ‘এখানকার বন্যা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে চলেছে। তবে কিছু সড়কে এখনো পানি রয়ে গেছে। যে কারণে আশ্রয় কেন্দ্র থেকে লোকজন এখনই বাড়ি ফিরতে পারছেন না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে বন্যার্তদের মাঝে পর্যাপ্ত ত্রাণ বিতরণ হয়।
কুমিল্লা ॥ গোমতী নদীর ভয়াবহ ভাঙন ও প্রবল বর্ষণে তলিয়ে যাওয়া গ্রামগুলোর বানভাসি মানুষের দুর্ভোগ ক্রমেই বাড়ছে। এদিকে গোমতী নদীর পানি রবিবারও বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। ফলে পানিতে ডুবছে নতুন নতুন এলাকা।
এদিকে পানি নামতে শুরু করলেও বন্যা দুর্গত এলাকায় লোকজনের দুর্ভোগ ক্রমেই বাড়ছে। রবিবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে গোমতীর পানি বিপৎসীমার ৬৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল বলে পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে। এরই মধ্যে গোমতীর ভেঙে যাওয়া বাঁধ দিয়ে জেলার বুড়িচং উপজেলার অধিকাংশ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। বানের পানি ঢুকে পড়েছে পাশের ব্রাহ্মণপাড়া ও দেবিদ্বার উপজেলার বেশ কিছু এলাকায়।
জেলা প্রশাসনের তথ্য মতে এ পর্যন্ত জেলার ১৭টি উপজেলার মধ্যে ১৪টি উপজেলা বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে ১২৩ ইউনিয়নের ৮ লাখেরও বেশি মানুষ। এর মধ্যে গোমতীর বাঁধ ভাঙনের ফলে শুধু জেলার বুড়িচং উপজেলায় আড়াই লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। জেলায় আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে ৭৪২টি। এর মধ্যে বুড়িচং উপজেলায় ৩৫টি।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কুমিল্লার নির্বাহী প্রকৌশলী খান মোহাম্মদ ওয়ালিউজ্জমান জানান, রবিবার সন্ধ্যা ৬টায় নদীর পানি বিপৎসীমার ৬৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।
তিতাসে মাদ্রাসা থেকে ফেরার পথে বন্যার পানির প্রবল স্রোতে ভেসে দুই চাচাত বোন পানিতে তলিয়ে যায়। পরে তাদের মৃত উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা। রবিবার দুপুরে উপজেলার বাগাইরামপুর গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। নিখোঁজ দুই বোন ওই গ্রামের প্রবাসী মনির হোসেনের মেয়ে আয়েশা (১০) ও মোক্তার হোসেনের মেয়ে ছামিয়া (৯)। তারা নয়াকান্দি ইসহাকিয়া সহিনিয়া দারুল কোরআর মাদ্রাসার ছাত্রী ছিল।
চট্টগ্রাম ॥ কিছু এলাকায় বন্যা পরিস্থিতি উন্নতি হলেও রবিবার বৃষ্টি হওয়ায় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ফলে এখনো পানিবন্দি কয়েক লাখ মানুষ। অল্পকিছু বন্যার্ত আশ্রয়কেন্দ্র এলেও বিপুলসংখ্যক মানুষ এখনো চরম দুর্ভোগে রয়েছেন। পর্যাপ্ত ত্রাণ না পৌঁছায় খাদ্য এবং সুপেয় পানির হাহাকার বেড়েছে।
চট্টগ্রামের মীরসরাই, ফটিকছড়ি ও হাটহাজারী সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বন্যায়। মীরসরাইয়ের ১৬টির মধ্যে ১২টি ইউনিয়নই বন্যায় কবলিত। অপরদিকে শনিবার ফটিকছড়ির বেশিরভাগ এলাকায় পানি নামতে শুরু করলেও রবিবার সকাল থেকে বৃষ্টি হওয়ায় বেশ কয়েকটি ইউনিয়ন নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। ফটিকছড়িতে হালদা নদীর বাঁধ বিভিন্ন অংশে ভেঙে বানের পানি ঢুকে পড়ায় সব ইউনিয়নে বন্যা হয়। চট্টগ্রাম মহানগরীতে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে।
মৌলভীবাজার ॥ গত দু’দিন উজানে ভারত অংশে বৃষ্টিপাত না হওয়ায় মৌলভীবাজার জেলার চারটি নদীর পানি দ্রুত কমতে শুরু করেছে। তবে মনু, জুড়ী ও কুশিয়ারা নদীর পানি এখনো বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। শুধু ধলাই নদীর পানি বিপৎসীমার নিচ দিয়ে নেমে এসেছে। নদীর পানি কমতে থাকায় জেলায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। তবে নি¤œাঞ্চল প্লাবিত রয়েছে।
হবিগঞ্জ ॥ হবিগঞ্জের নদ-নদীগুলোতে কমতে শুরু করেছে পানি। নদ-নদীর পানি কমলেও দুর্ভোগ কমেনি লোকজনের। তবে বন্যায় আক্রান্তদের পাশে দাঁড়িয়েছে সাধারণ মানুষসহ জেলা ও উপজেলা প্রশাসন এবং সেনাবাহিনী। লোকজনকে দেওয়া হচ্ছে খাদ্য সামগ্রী। থেমেছে বৃষ্টিপাত।
খুলনা ॥ ভারি বৃষ্টিতে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। অবিরাম বৃষ্টিতে সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধতা। একটানা বৃষ্টিতে তলিয়ে নগরীর রাস্তাঘাট, অলিগলি। নগরীর নি¤œাঞ্চলের বাসাবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও তলিয়ে গেছে। গত দুদিনের বৃষ্টির কারণে শ্রমজীবী মানুষ কাজের জন্য বাইরে বের হতে পারছে না।
বাগেরহাট ॥ অতিজোয়ার ও ভারি বর্ষণে বাগেরহাটের বেশিরভাগ এলাকা তলিয়ে গেছে। অর্ধ শতাধিক গ্রামের পাশাপাশি জেলার মোংলা, মোরেলগঞ্জ ও বাগেরহাট পৌর শহরের প্রধান প্রধান সড়ক পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। জলাবদ্ধতায় চরম দুর্ভোগে পড়েছেন এসব এলাকার মানুষ। পানি নিষ্কাশন যথাযথ না হওয়ায় ভোগান্তি আরও বাড়ছে।