ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৯ ভাদ্র ১৪৩১

দিনমজুরদের চোখে-মুখে অন্ধকার

শেষ সম্বল নিয়ে বসতঘর ছাড়ছেন দুর্গতরা

গিয়াস উদ্দিন ফরহাদ, নোয়াখালী

প্রকাশিত: ২২:২৪, ২৩ আগস্ট ২০২৪

শেষ সম্বল নিয়ে বসতঘর ছাড়ছেন দুর্গতরা

.

বন্যা পরিস্থিতির চরম অবনতি হওয়ায় নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটছে নোয়াখালীর দুর্গত মানুষ। হাতের কাছের শেষ সম্বল নিয়েই বসতঘর ছাড়ছেন তারা। শুক্রবার দুপুরে বেগমগঞ্জ সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে দেখা গেল, দল বেঁধে আশ্রয়ের সন্ধানে আসছে মানুষ। সঙ্গে আসছেন গ্যাস, চুলা ও সিলিন্ডার, শুকনা খাবারসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি। 
কথা হয় চৌমুহনী পৌরসভার করিমপুর এলাকার বাসিন্দা মো. শাহজাহানের সঙ্গে। এলাকাবাসীদের নিয়ে তিনি এসেছেন আশ্রয়ের সন্ধানে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। শাহজাহান বলেন, বাড়ির উঠানে কোমর সমান পানি, এলাকার মানুষের ঘরে থাকার মতো অবস্থা নেই। তাই বাধ্য হয়ে এলাকাবাসীদের নিয়ে হাই স্কুলে আশ্রয় নেওয়ার জন্য এসেছি। বেগমগঞ্জ পার হয়ে সেনবাগ উপজেলার দিকে যেতেই বন্যার একই চিত্র চোখে পড়ে। সেনবাগের এমপি রোডের মাথায় দেখা যায়, নারী-শিশুসহ একটি পরিবারের সদস্যরা গাড়ির জন্য অপেক্ষায় আছেন। বেগমগঞ্জ উপজেলার শিবপুর গ্রামের বাসিন্দা এই পরিবার সেনবাগ উপজেলা সদরে তাদের আত্মীয় বাড়িতে যাচ্ছে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। গৃহকর্ত্রী আমেনা বলেন, বাড়িঘর সবই পানির নিচে। তাই সেনবাগে মেয়ের বাড়িতে যাচ্ছেন। সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছেন হাঁস-মুরগি ও কবুতর। বেগমগঞ্জ-সেনবাগে টানা বর্ষণের ফলে নোয়াখালীর আট উপজেলায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। ডুবে গেছে ফেনী-নোয়াখালী সড়কের চৌমুহনী-মাইজদী অংশের একাধিক এলাকা। 
জেলা আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের জ্যেষ্ঠ পর্যবেক্ষক মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, শুক্রবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় জেলা শহর মাইজদীতে ১৪৪ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়। তিনি বলেন, আগামী ৪৮ ঘণ্টাও বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকার আশঙ্কা রয়েছে। অতিবর্ষণে আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র পানিতে ডুবে আছে। বেগমগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আরিফুর রহমান বলেন, উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নের বন্যা পরিস্থিতি খুবই সংকটময়। প্রায় সব এলাকাতেই হাঁটু থেকে কোমর পানি। মানুষজন চরম কষ্টের মধ্যে জীবনযাপন করছে। প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। এরই মধ্যে ১০ হাজারের বেশি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। একলাশপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে আশ্রয় নেওয়া মানুষজন কোনো সরকারি সহায়তা না পাওয়া প্রসঙ্গে ইউএনও আরিফুর রহমান জানান, সরকারিভাবে তিনি এখনো তেমন বরাদ্দ পাননি। যেটুকু পেয়েছেন, সেটির সঙ্গে ব্যক্তিগত উদ্যোগে আরও কিছু যোগ করে, সাড়ে তিন হাজার প্যাকেট ত্রাণসামগ্রী শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে বিতরণের ব্যবস্থা করেছেন।
ভারি বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে নোয়াখালীর লাখ লাখ মানুষ। তাদের বেশিরভাগই খাবার ও বাসস্থানের অভাবে মানবেতর জীবনযাপন করছে। জেলার ৯ উপজেলার সব ক’টিতেই বসতঘর, গ্রামীণ সড়ক, মসজিদ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পানিতে তলিয়ে গেছে। পানিবন্দি হয়ে পড়ছে লাখ লাখ মানুষ। খাল উদ্ধার ও পানি নিষ্কাশনে সেনাবাহিনীসহ প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেছে তারা। 
জানা গেছে, সুবর্ণচর, সেনবাগ, সোনাইমুড়ী, চাটখিল, বেগমগঞ্জ, কবিরহাট, কোম্পানীগঞ্জ, সুবর্ণচর ও সদর উপজেলার বেশিরভাগ নিচু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এ ছাড়া দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ায় স্বাভাবিকের চেয়ে অধিক উচ্চতায় জোয়ার হয়েছে। ফলে সীমাহীন ভোগান্তিতে পড়েছেন এসব এলাকার বাসিন্দারা। 
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা আমির হামজা বলেন, রাস্তাঘাট ডুবে এখন মানুষের বসতঘরে পানি ঢুকেছে। মাছের ঘেরসহ সব ভেসে গেছে। এত পানি ৬০ বছর বয়সে কখনো দেখিনি। বৃষ্টি হলে পানি নেমে যায় কিন্তু এবার পানি নামছে না। কবিরহাট উপজেলার বাসিন্দা রুবেল হোসেন বলেন, হাঁটু পানি দিয়ে চলাফেরা করতে হচ্ছে। বিভিন্ন জায়গায় অবৈধভাবে বাঁধ দিয়ে মাছের ঘের করেছে প্রভাবশালীরা। খাল দখল করে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। কোথাও কোথাও খাল দখল করে বাড়িঘরও নির্মাণ করা হয়েছে। যার কারণে পানি নামছে না। সেনাবাহিনী এসব অবৈধ স্থাপনা ভেঙে দিয়ে খাল পরিষ্কার করলে জলাবদ্ধতা থাকত না। সুবর্ণচর উপজেলার হারিচ চৌধুরীর বাজার এলাকার বাসিন্দা বিবি আয়শা বলেন, টানা বৃষ্টিতে বাড়ির উঠানে পানি জমেছে। রান্নাঘরেও পানি। রান্নাও করতে পারিনি। টিউবওয়েলের পানিতে ময়লা আসে। আমরা অসহায় অবস্থায় আছি। কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আনোয়ার হোসাইন পাটোয়ারী বলেন, মুছাপুর, চরফকিরা এবং চরএলাহী ইউনিয়নের বেড়িবাঁধ সংলগ্ন সব বাসিন্দারা অধিক ঝুঁকিতে থাকায় তাদের নিকটবর্তী আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার অনুরোধ করেছি। অস্বাভাবিক জোয়ারে বাঁধ এবং তৎসংলগ্ন এলাকার জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ও জানমালের ক্ষতির কারণ হতে পারে। জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা জাহিদ হোসেন বলেন, জেলার ৯ উপজেলার ৮৭ ইউনিয়ন ও পৌরসভা আক্রান্ত হয়েছে। পানিবন্দি মানুষ প্রায় ১৯ লাখ ৮০ হাজার জন। এর মধ্যে ৩৮৮ আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে ৩৬ হাজার ১১৫। পানিবন্দি এলাকায় ৮৮টি মেডিকেল টিম খাবার স্যালাইন, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট ও চিকিৎসা সামগ্রী বিতরণ অব্যাহত রেখেছে। জেলা প্রশাসক দেওয়ান মাহবুবুর রহমান বলেন, সার্বিক পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। জেলার ২০ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে অমানবিক জীবনযাপন করছে।
দিনমজুরদের চোখে-মুখে অন্ধকার ॥ ভয়াবহ বন্যায় বেকার হয়ে দিশাহারা নোয়াখালীর হাজার হাজার দিনমজুর শ্রমিক। টানা এক সপ্তাহের বৃষ্টিতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জেলার জনজীবন। নজিরবিহীন বন্যায় ক্ষত-ভিক্ষত গ্রামের পর গ্রাম। ঘর-বাড়ির সঙ্গে শেষ হয়েছে জমির ফসলাদি। আঞ্চলিক সড়কগুলোতে যোগাযোগ বন্ধ। 
স্থানীয়রা বলছেন, নিকট ইতিহাসে তারা এমন পরিস্থিতি মোকাবিলা করেননি। সহসায় এ সমস্যার উন্নতি হবে না বলে তাদের ধারণা। কারণ ভারত থেকে আসা ঢল ও রেকর্ড বৃষ্টিতে বন্যার পরিস্থিতি অবনতি হচ্ছে। রাত হলে আতঙ্ক আরও বেড়ে যায়। অনেকেই নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন। আশ্রয় কেন্দ্রগুলোও হাঁটু পানিতে তলিয়ে গেছে। আশ্রয় কেন্দ্রে নৌকাযোগে যাওয়ার সুব্যবস্থা নেই বলে জানিয়েছেন বন্যাকবলিত এলাকাবাসী। ফলে প্রকট হয়ে পড়েছে বিশুদ্ধ পানি ও খাবার সংকট। এতে মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। 
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, টানা বৃষ্টিতে জেলা শহর মাইজদিসহ ৮ উপজেলার বেশির ভাগ এলাকা জলাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে জেলার অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছে প্রশাসন। এদিকে, জলাবদ্ধতায় ডুবে গেছে বাড়িঘর, রাস্তাঘাট ও ফসলের মাঠ। এছাড়া নোয়াখালী পৌরসভা ও জেলার প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্র চৌমুহনী পৌর এলাকার বিভিন্ন বাসাবাড়ি ও দোকানপাটে পানি ঢুকে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ফলে হাজার হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছেন। পাশাপাশি মৎস্য হ্যাচারির লোকজনও দিশাহারা হয়ে পড়েছেন। বন্যা পরিস্থিতি সামাল দিতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্টদের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। তবে এখনও পর্যন্ত আশানুরূপ সাড়া পাওয়া যায়নি। 
টানা বৃষ্টিতে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছেন শ্রমজীবী, দিনমজুর ও দৈনন্দিন কাজে বাইরে বের হওয়া মানুষ। অস্বাভাবিক পানি বাড়ায় বিপাকে পড়েছেন মৎস্যচাষি ও পোল্ট্রি খামারিরা। এলাকার বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত দৈনিক শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বন্যার কারণে এক সপ্তাহ ধরে কাজে যাওয়া হয় না। দিন হাজিরা হিসেবে তারা ৮৫০ টাকা করে আয় করেন। এভাবে বসে থাকা মানেই ক্ষতি। পরিবার নিয়ে বিপাকে পড়তে হয়েছে তাদের। বৃষ্টির কারণে কর্মহীন দুর্ভোগের কথা জানিয়েছেন অটো রিক্সাচালক আমিরুল ইসলাম।

তিনি বলেন, মুষলধারে বৃষ্টি হওয়ায় লোকজন ঘরের বাইরে বের হয় না। পরিবার নিয়ে অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটছে তাদের। সুবর্ণচর এলাকার চরমহিউদ্দিন গ্রামের জাহিদ হোসেন বলেন, বৃষ্টির কারণে তার পোল্ট্রি খামারের প্রায় ১৫শ মুরগির বাচ্চা নষ্ট হয়ে গেছে। চরবাগ্যা গ্রামের কৃষক হোসেন গাজী জানান, তিনি ৪০ শতাংশ জমিতে কৃষি আবাদ করেছেন। চারদিনের বৃষ্টিতে সকল সবজি পানির নিচে ডুবে গেছে। ওয়াচেকপুর গ্রামের মৎস্যচাষিরা জানান, তারা যৌথভাবে পুঁজি বিনিয়োগ করে মাছ চাষ করেছেন। টানা বৃষ্টির কারণে খামারের সব মাছ ভেসে গেছে। তাদের প্রায় ১০ থেকে ১২ কোটি টাকার মাছ চলে গেছে। এতে তারা ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছেন।


 

×