চট্টগ্রামে ভারি বর্ষণে ডুবে গেছে অনেক সড়ক। মঙ্গলবার সকালে নগরীর মুরাদপুর এলাকা
কয়েকদিনের টানা বর্ষণে দেশের বিভিন্ন স্থানে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। এতে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। চট্টগ্রাম মহানগরীর অনেক সড়ক এখন পানির নিচে। রাঙ্গামাটিতে নি¤œাঞ্চল তলিয়ে যাওয়ায় সাজেকে আটকা পড়েছে শতাধিক পর্যটক। এ ছাড়া খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী ও ফেনীতে পানিবন্দি হয়ে চরম বিপাকে পড়েছে ৩০ লাখের ওপর মানুষ। খবর স্টাফ রিপোর্টার ও নিজস্ব সংবাদদাতাদের।
চট্টগ্রামে তিনদিন ধরে অবিরাম বর্ষণে থমকে গেছে জনজীবন। মঙ্গলবার বন্দরনগরীর আরও বেশি এলাকা প্লাবিত হয়েছে। প্রধান সড়কে যানবাহন চলাচল করলেও অপেক্ষাকৃত নিচু রাস্তাগুলো পানিতে ডুবে গেছে। এসব সড়কে অযান্ত্রিক যানবাহনই ভরসা। এদিনও চরম দুর্ভোগে পড়তে হয় কর্মস্থলমুখী মানুষ ও শিক্ষার্থীদের। অন্তত দুদিন ভারি বর্ষণ অব্যাহত থাকতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া দপ্তর।
পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, মঙ্গলবার বিকেল ৩টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রামে বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে ১১৩ মিলিমিটার। অতিভারি বর্ষণে চট্টগ্রাম মহানগরীর চকবাজার, কার্পাসগোলা, বাদুড়তলা, শুলকবহর, মুরাদপুর, আগ্রাবাদ, ছোটপুল, খাতুনগঞ্জ, কোরবানিগঞ্জসহ অনেক এলাকার সড়ক পানিতে তলিয়ে গেছে। অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বাসাবাড়িতেও ঢুকেছে বৃষ্টির পানি। ফলে নষ্ট হয়েছে পণ্য ও আসবাবপত্র। চট্টগ্রাম বন্দর বহির্নোঙরে এদিনও পণ্য লাইটারিং ব্যাহত হয়। জেটিতে কন্টেনার ওঠানামা স্বাভাবিক থাকলেও বৈরী আবহাওয়ার কারণে ইয়ার্ড থেকে পণ্য ডেলিভারি হয়েছে কম।
রাঙ্গামাটি ॥ কয়েকদিনের ভারি বৃষ্টিপাতে রাঙ্গামাটির জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় থেমে থেমে ভারি বৃষ্টিপাত হয়েছে। বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলায় কয়েকটি গ্রাম বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। এ ছাড়া মারিশ্যা দিঘিনালা সড়কে ও সাজেক সড়কে মাচালং এলাকায় পানি উঠেছে। সেখানে আটকা পড়েছে বেশকিছু যানবাহন। বাঘাইছড়িতে পাহাড় ধসের ঘটনায় সড়কের দুইপাশে আটকা পড়েছে বহু যানবাহন। এতে দুর্ভোগে পড়েছে সাধারণ মানুষ।
এদিকে সাজেকের মাচালং ও বাঘাইহাট বাজার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় সাজেকে আটকা পড়েছে শতাধিক পর্যটক। বৃষ্টিপাতের ফলে কাচালং নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্লাবিত হয়ে বাঘাইছড়ির নিচু অঞ্চল পানিতে তলিয়ে গেছে। বহু ঘরবাড়ি, স্কুল এবং মাছের পুকুর তলিয়ে গেছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জানান, বাঘাইছড়িতে দ্রুত পানি বাড়ছে। রাঙ্গামাটির জেলা প্রশাসন ভারি বৃষ্টির ফলে পাহাড় ধসের আশঙ্কায় শহরে প্রশাসনের পক্ষ থেকে বারবার লোকজনকে নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য মাইকিং করে আহ্বান জানিয়েছেন।
খাগড়াছড়ি ॥ চারদিনের টানা বর্ষণে ফের বন্যা দেখা দিয়েছে খাগড়াছড়িতে। ইতোমধ্যে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে কয়েকশ পরিবার। ২৪ ঘণ্টায় খাগড়াছড়ি জেলায় ৬৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। বর্ষণ অব্যাহত থাকায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে। মঙ্গলবার সকাল থেকে চেঙ্গী নদী তীরবর্তী নি¤œাঞ্চলে পানি ঢুকতে শুরু করেছে।
এতে করে জেলা সদরের মুসলিমপাড়া, মেহেদীবাগ, কালাডেবা, রুইখই চৌধুরীপাড়া, মেহেদীবাগ, শান্তিনগর, গঞ্জপাড়া, শব্দমিয়া পাড়া, কমলছড়ি ও মাটিরাঙার তাইনংয়ের নি¤œাঞ্চলে বসবাসকারী কয়েকশ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এদিকে, টানা বর্ষণে পাহাড় ধসের ঝুঁকি রয়েছে। সকালে জেলা সদরের শালবনে পাহাড় ধসে সড়কের ওপর গাছ ভেঙে পড়ে। এতে বৈদ্যুতিক তারের ওপর গাছ পড়ায় সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়।
নোয়াখালী ॥ জেলায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছে ৩০ লাখ মানুষ। টানা ভারি ভর্ষণে তলিয়ে গেছে পুরো জেলা। ৯টি উপজেলার সবকটিতেই গ্রামাঞ্চলের বসতঘর, গ্রামীণ সড়ক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। অনেক স্কুল-কলেজের পাঠদান বন্ধ রয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়ছে লাখ লাখ মানুষ। এ ছাড়া, জেলার সদর, সেনবাগ, সোনাইমুড়ী, চাটখিল, বেগমগঞ্জ, কবিরহাট, কোম্পানীগঞ্জ, সুবর্ণচর উপজেলার বেশিরভাগ নিচু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এতে সীমাহীন ভোগান্তিতে পড়েছেন এসব উপজেলার বাসিন্দারা। বৃষ্টির পানিতে ডুবে গেছে আমন ধানের বীজতলা, শাক-সবজি।
এ ছাড়া মাঠে পানি থাকায় অনেক এলাকার কৃষক খেতে আমন লাগাতে পারছেন না। জলাবদ্ধতায় আটকে আছে ২০ লাখ মানুষ। ডুবে গেছে সড়ক, বাসা-বাড়িতেও ঢুকছে পানি। নিষ্কাশন ব্যবস্থা ভালো না হওয়ায় দীর্ঘ সময়ের ব্যাপক জলাবদ্ধতায় চরম দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে নোয়াখালীবাসীদের। আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, সোমবার ভোর ৬টা থেকে মঙ্গলবার সকাল ৬টা পর্যন্ত ১৭৪ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। সারাদিন বৃষ্টিপাত অব্যাহত ছিল। স্থানীয়রা জানান, নোয়াখালী পৌর শহরের সব রাস্তা পানির নিচে তলিয়ে গেছে। শহরের হাজার হাজার বসতঘরের ভেতরে পানি থৈথৈ করছে।
জলাবদ্ধতার কারণে নি¤œ আয়ের মানুষ চরম বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। বৃষ্টির পানিতে ময়লা মিশে দেখা দিয়েছে পানিবাহিত রোগ। এসব মানুষের পাশে দাঁড়াতে প্রশাসন ও ধনীদের আহ্বান জানিয়েছে স্থানীয়রা।
পানি উন্নয়ন বোর্ড নোয়াখালীর নির্বাহী প্রকৌশলী মুন্সী আমির ফয়সাল বলেন, নোয়াখালীতে রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে। যা গত ২০ বছরেও হয়নি। এ ছাড়া জোয়ার থাকায় পানি নামতে পারছে না। আমরা জলাবদ্ধতা রোধ প্রকল্পে শহর ও আশপাশের ১৬১ কিলোমিটার খাল খনন করেছি। এতে করে সব উপজেলায় পানি নিষ্কাশন হওয়ার কথা। তা ছাড়া পুরোপুরি জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পেতে ড্রেন ও নালা রক্ষণাবেক্ষণ প্রয়োজন।
জেলা প্রশাসক দেওয়ান মাহবুবুর রহমান বলেন, সবার সহযোগিতায় আমরা জলাবদ্ধতা নিরসনে কাজ করছি। ইতোমধ্যে বিভিন্ন অবৈধ বাঁধ কেটে পানি স্বাভাবিক করার কাজ শুরু হয়েছে। বৃষ্টিপাত কমে গেলে পানি কমে যাবে।
এ ছাড়া, প্রবল বর্ষণে জেলার চাটখিল উপজেলার নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হয়ে সৃষ্ট বন্যায় কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে আছে। এতে অনেকেই কর্মহীন হয়ে পড়েছে। উপজেলার বহু বাড়িঘর, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, রাস্তাঘাট পানির নিচে তলিয়ে গেছে। এতে করে জনজীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। স্থানীয়রা দাবি করছে, জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড যথাযথভাবে মহেন্দ্র খাল ও বিরেন্দ্র খাল খনন না করার ফলে খালগুলো ময়লা-আবর্জনায় ভরাট হয়ে রয়েছে। যার ফলে পানিবন্দি হয়ে বন্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে। আরও ২-৩ দিন বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে বড় ধরনের বন্যার আশঙ্কা রয়েছে।
ফেনী ॥ পরশুরাম ও ফুলগাজী উপজেলায় দেড় মাসের ব্যবধানে তৃতীয় দফায় বন্যার পানিতে ডুবছে জনপদ। গত কয়েকদিনের ভারি বৃষ্টিপাত ও ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনীয়া নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের গতবারের ১৭টি ভাঙন অংশে পানি প্রবেশ করে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন হাজার হাজার মানুষ। রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, ফসলি জমি, পুকুর ও মাছের ঘের পানিতে তলিয়ে গেছে। লোকালয়ে পানি ঢুকে দুই উপজেলার অন্তত ৭০ গ্রাম প্লাবিত হয়ে ১৫ হাজার পরিবার পানিবন্দি রয়েছে।