ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৪ অক্টোবর ২০২৪, ৯ কার্তিক ১৪৩১

তিস্তার চর যেন ফুড বাস্কেট

দেড় দশকে বদলে গেছে উত্তরের চাষাবাদ

তাহমিন হক ববী

প্রকাশিত: ২৩:৩০, ১৩ আগস্ট ২০২৪

দেড় দশকে বদলে গেছে উত্তরের চাষাবাদ

তিস্তার চরে বাদামের খেতে কীটনাশক ছিটাচ্ছেন কৃষক

দেশের ছন্দপতনে উত্তরের কৃষকদের মনে কোনো প্রভাব পড়েনি। কৃষির উন্নয়নের এ অঞ্চলের কৃষক ফসল উৎপাদনে লড়েই চলেছেন। আগেও যেমন কৃষক ফসল উৎপাদনে দিনরাত পরিশ্রম করেছে এখনো এই পরিশ্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। এতে ফসল উৎপাদনে কৃষক নিজেরাও যেমন স্বাবলম্বী হচ্ছেন এবং ভোক্তাদের চাহিদা মিটিয়ে চলছেন। 
কৃষকরাই বলছেন উন্নয়নের ছোঁয়ায় বদলে যাচ্ছে উত্তর জনপদ, সমৃদ্ধ হচ্ছে নদনদীতে ভরা উত্তরের কৃষি। বন্যা ও খরাসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে ঘুরে দাঁড়াতে শিখেছে এখানকার কৃষিনির্ভর পরিবারগুলো। এতে বদলে যাচ্ছে গ্রামীণ অর্থনীতি, কৃষিতে বাড়ছে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার। উন্নয়ন বিশ্লেষকরা বলছেন, কৃষিভিত্তিক পরামর্শ ও গবেষণায় গ্রামীণ অর্থনীতিতে পরিবর্তন এসেছে। সঙ্গে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পরামর্শ ও সেবায় লাভজনক ফসল উৎপাদনে ঝুঁকছেন কৃষকরা।
এক সময়ের অভাব ও মঙ্গাকবলিত উত্তরাঞ্চলের রংপুর অঞ্চলের কৃষিতে আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। সার, বীজ, কীটনাশক, ডিজেল, বিদ্যুতের সংকট আর ফসলের দাম না পাওয়া কৃষক হাপিত্যেস করলেও দিন বদলেছে শস্যভান্ডার’খ্যাত উত্তরাঞ্চলে। এই অঞ্চলের  খাদ্য ঘাটতি-সংকটের এলাকাটি কেবল স্বয়ম্ভরতাই অর্জন করেনি, পরিণত হয়েছে উদ্বৃত্ত খাদ্যের এলাকায়।

শস্যবহুমুখী ও কৃষি যান্ত্রিকীকরণ, উন্নত বীজ, সার-কীটনাশক সরবরাহ, সেচ-ব্যবস্থার উন্নয়নসহ বর্তমান সরকারের নানা উদ্যোগে গত দেড় দশকে বদলে গেছে  কৃষি। একদিকে ফসলের নিবিড়তা বেড়েছে, আরেক দিকে সুগন্ধি চাল, চা, ভুট্টা, আলু, ফুলসহ নতুন নতুন ফসল উৎপাদনের দিকে কৃষকরা আগ্রহী হয়ে ওঠায় মজবুত হয়ে উঠছে এই এলাকার কৃষিনির্ভর অর্থনীতি।
তিস্তা নদীর চরগুলো ফসলের সবুজ সমারোহ ঘটেছে। বালু মাটির ওপর পলি জমায়  ধান, গম, আলু, ভুট্টা, মিষ্টি কুমড়া, রসুন, পেঁয়াজ, মরিচসহ অন্যান্য ফসলের চাষ হচ্ছে। গবেষণারা জানান, দেশে ৩২ জেলার ১০০ উপজেলার চরে এক কোটি মানুষ বসবাস করেন। এর মধ্যে দেশের উত্তরাঞ্চলে ১০ লাখ মানুষের বসবাস। বর্তমানে এই অঞ্চলের প্রায় ৬০০ চরের এক লাখ হেক্টর জমিতে উৎপাদন হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের ফসল।

শুধু দেশীয় চাহিদাই নয়, চরের উৎপাদিত ফসল জায়গা করে নিয়েছে বিশ্ববাজারেও।কৃষি বিভাগের তথ্য বলছে, বছরে অন্তত ৫০ হাজার কোটি টাকার ফসল হচ্ছে উত্তরের চরগুলোতে। এ ছাড়া ২০২২-২৩ অর্থ বছরে বিভাগের বিভিন্ন চর থেকে উৎপাদিত প্রায় ১৫ হাজার মেট্রিক টন মিষ্টি কুমড়া, আলু ও মিষ্টি আলু রপ্তানি হয়েছে মধ্যপ্রাচ্য, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা, জাপান ও ভুটানে।

বাংলাদেশ সরকার ও সুইজারল্যান্ডের অর্থায়নে মেকিং মার্কেটস ওয়ার্ক ফর দি চরস, এমফোরসি প্রকল্পের মাধ্যমে রংপুর বিভাগের চার জেলাসহ মোট ছয়টি জেলায় বসবাসরত চরাঞ্চলের মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে দশ বছর মেয়াদের একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। উদ্দেশ্য প্রকল্প এলাকায় বসবাসকারী মানুষের আয় বৃদ্ধি করা বলে জানান বগুড়া পল্লী উন্নয়ন একাডেমির মহাপরিচালক খুরশীদ আলম রেজভী।

তিনি বলেন, এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে চরাঞ্চলের জনগণের উৎপাদিত পণ্য যেন সঠিক বাজার মূল্য পায় তা নিশ্চিত করা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তিস্তা শাসন করা গেলে অনেক বেশি চরকে উৎপাদনের আওতায় আনা সম্ভব হবে। যার মধ্য দিয়ে মজবুত হবে দেশের কৃষি ও অর্থনীতি।

উত্তরাঞ্চলে কোনো জমি যেন পতিত পড়ে থাকছে না। এক সময়ের মরুময় ছিল এ অঞ্চল। চাপাতা,  ভুট্টা, আলু, মিষ্টি কুমড়ার আবাদ বেড়েছে পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও রংপুর, নীলফামারী ও লালমনিরহাটে। দিনাজুপর-ঠাকুরগাঁও এখন সুগন্ধি ধানের এলাকা। কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধাসহ বৃহত্তর রংপুর-দিনাজপুর অঞ্চলের ৮টি জেলার আবাদি জমির প্রায় সবটুকু এখন আমন ও বোরো ধানসহ তিন ফসলি। ক্রমেই ফসলের ন্যায্যমূল্য পেতে শুরু করেছে কৃষক।

প্রধান ফসল ধান ও আলুর দাম কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাওয়ায় সন্তুষ্টি এসেছে কৃষককুলে। চা, কফি, ফল ও ফুল চাষ নতুন স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছে কৃষককে। পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায়  শুরু হয়েছে টিউলিপের চাষ। তেঁতুলিয়ায় বিদেশী ফুলের চাষ সম্প্রসারণের মাধ্যমে ইকো ট্র্যরিজম কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে সরকারের সহায়তা চেয়েছে একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা। পঞ্চগড়ে চা উৎপাদন ও প্রক্রিয়াকরণ অসংখ্য কারখানা গড়ে উঠেছে।

সেখেনে এখন চা চাষ ও চা শিল্প ক্রমবিকাশমান। ভোজ্যতেলের সংকট কাটাতে এখন হাত বাড়ানো হচ্ছে কৃষির দিকেই। সরিষার আবাদ হয়েছে ব্যাপকভিত্তিতে। রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, এই অঞ্চলে সূর্যমুখির চাষও জনপ্রিয় হচ্ছে। রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা এনামুল হক বলেন, সনাতনী চাষ পদ্ধতির বদলে এসেছে যন্ত্রপাতি।

কম্বাইন্ড হাভেস্টরের মতো কৃষি যন্ত্রপাতির জন্য ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ভর্তুকি দিচ্ছে সরকার। তিনি বলেন, সেচ-সার-বীজের নিরববচ্ছিন্ন সরবরাহ, নীতিগত সহায়তায় ২২৫ শতাংশ থেকে ২৪০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে ফসলের নিবিড়তা। এ ছাড়া পাট চাষ বেড়েছে।
উত্তরাঞ্চলের তিস্তা ও ধরলাসহ বিভিন্ন নদ-নদীর  চরগুলো এখন হীরক বা হীরায় পরিণত হয়েছে। যাকে ইংরেজিতে বলা হয়  হিডেন ডায়মন্ড। কেউ কেউ বলেন ফুড বাস্কেট। প্রতিবছর এসব চরে ৩৩ প্রকার ফসল চাষাবাদ হচ্ছে।
যা প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ হাজার কোটি টাকার ফসল উৎপাদন হয়ে থাকে। এ ছাড়া বছরে ২৫ লাখ গবাদিপশুর জোগান দিচ্ছে চরে বসবাসকারীরা। বিভিন্ন চরে আবাদ হয় আলু, রসুন, মরিচ, পেঁয়াজ, ভুট্টা, গাজর, মিষ্টি কুমড়া, ধানসহ নানা ধরনের ফসল।  গম, ছোলা, মসুর, সরিষা ও বাদাম চাষও হচ্ছে প্রচুর। চরের কৃষকরা জানায়, সারা বছরই চরের জমিতে ৩৩ ধরনের ফসল চাষ করা হয়। বন্যার পর চরের মাটিতে পলি জমে।

এ কারণে সার খুব একটা লাগে না। পোকামাকড়েরও আক্রমণ কম। কীটনাশকের ব্যয় তেমন নেই। তাই ফসল উৎপাদনে খরচও কম। চরাঞ্চলগুলোতে পণ্য পরিবহনের জন্য সাধারণত ঘোড়ার গাড়ি, ঠেলাগাড়ি, মহিষের গাড়ি, ব্যাটারিচালিত ভ্যান এবং বাইসাইকেল ব্যবহার করেন চাষিরা। 
লালমনিরহাট, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, রংপুর ও গাইবান্ধা জেলায় ১১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ তিস্তার বুকে অন্তত ১০০ চরে চাষাবাদ হচ্ছে। আগে যেসব চরে ফসল ফলানো সম্ভব হয়নি সেসব চরেও  আবাদ হয়েছে। ফসলের আশানুরূপ ফলনও ঘরে তুলছে তিস্তাপাড়ের কৃষকরা। কৃষি বিভাগ বলছে,গত বছরগুলোয় শুকনো মৌসুমে ২০-২২ হাজার হেক্টর জমিতে ফসলের চাষ হতো। এ বছর আবাদ হয়েছে প্রায় ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে।

ভুট্টা চাষ হয়েছে ২০ হাজার হেক্টর জমিতে ও ধান হয়েছে পাঁচ হাজার হেক্টর জমিতে। এ ছাড়াও, আলু, গম, রসুন, পেঁয়াজ, মরিচ, কুমড়াসহ নানা জাতের সবজি চাষ হয়েছে প্রায় ২৫ হাজার হেক্টর জমিতে। তিস্তাপাড়ের কৃষকরা  জানান, বিগত বছরগুলোর ন্যায় এ বছর আগাম  আশানুরূপ ফসল তোলা যাবে ঘরে।তিস্তার চর কালমাটি এলাকার কৃষক দেলোয়ার হোসেন (৫৮) বলেন, ‘চরে ৩০ বিঘা জমি আছে।

গত ২০ বছরে এসব জমিতে চাষাবাদ করতে পারিনি। জমিতে শুধু বালু আর বালু। পলি আসায় সব জমিতে ফসল হয়েছে।  চর বগুড়াপাড়ার কৃষক রফিজ উদ্দিন মন্ডল (৭০) বলেন, ‘তিস্তার কোনো চরই এ বছর ফাঁকা পড়ে নাই। সব চরে চাষাবাদ হয়েছে। চরের মাটিতে প্রচুর পলি জমেছে। অতীতে তিস্তার অধিকাংশ চর ফাঁকা পড়ে থাকত। বালুর কারণে ফসল ফলাতে পারেননি। পলি জমায় তা চরের কৃষকদের কাছে আশীর্বাদ হয়ে উঠেছে।

‘কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, তিস্তার চরে গাজর চাষের পদ্ধতি শেখানো হয়েছে। কৃষকদের সব ধরনের টেকনিক্যাল সাপোর্ট দেওয়া হয়েছে। পরিবেশ রক্ষায় সৌরবিদ্যুৎ স্থাপনে চরের জমিতে ছায়া ফসলও উৎপাদন করা যাবে।  জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশে পরিবেশ রক্ষায় সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে জোর দেওয়া হচ্ছে। উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ও জ্বালানি আমদানি কমাতে তিস্তা নদীর চরে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের পর এবার উত্তরবঙ্গে আরও দুটি সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে।

নতুন আধুনিক মডেলের এই সৌর বিদ্যুৎ স্থাপনের স্থানে কৃষক তাদের চরের জমিতে ছায়া ফসলও উৎপাদন করতে পারবেন। এ জন্য ধরলা নদীর তীরবর্তী সোনাইকাজী ও যতিন্দ্র নারায়ণের চরে এক ফসলি জমিতে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্প। 
অপর আরেকটি প্রকল্প তিস্তার চর এলাকায় একই ধরনের সৌর বিদ্যুৎ স্থাপনের জরিপ কাজ চলমান রয়েছে। ধরলা নদীর চরে বাংলাদেশ ও চীন সরকারের যৌথ উদ্যোগে ১৪০ একর জমিতে তৈরি হতে যাচ্ছে দেশের প্রথম কৃষিবান্ধব বাণিজ্যিক সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এ কেন্দ্র থেকে উৎপাদন হবে ৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। যা কৃষিখাতে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে বলে জানিয়েছেন সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রকৌশলী তারেক রহমান।

রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক মো. ওবায়দুর রহমান ম-ল বলেন, রংপুর ও লালমনিরহাট থেকে মিষ্টি কুমড়া মালয়েশিয়ায় রপ্তানি হয়। গাইবান্ধার চরাঞ্চলের মিষ্টি আলু জাপানে যায়। এ কারণে চর এখন ধীরে ধীরে আমাদের রপ্তানি যোগ্য কৃষিপণ্যের হাবে পরিণত হচ্ছে।

তিনি আরও জানান, কৃষি সম্প্রসারণে প্রশিক্ষণ, উন্নত বীজ, সার সরবরাহ, উন্নতজাত উদ্ভাবনসহ সরকারের গৃহীত নানা পদক্ষেপ, প্রণোদনা, ভর্তুকির তথ্য উল্লেখ করে বলেন, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এই অঞ্চলের কৃষির উন্নয়নে দিনরাত নিবেদিত। সরকারের শস্যবহুমুখীকরণ, কৃষি যান্ত্রিকীকরণসহ বিভিন্ন পদক্ষেপে উৎপাদন বেড়েছে। এভাবেই এক সময় বদলে গেছে এ অঞ্চলের কৃষি।

×