শেরপুরের নালিতাবাড়িতে আদিবাসীদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের তরুণীদের নৃত্য প্রদর্শন
শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার বিস্তীর্ণ পাহাড়ি এলাকাজুড়ে কোচ ও গারো উপজাতিরা প্রাচীনকাল থেকে বসবাস করে আসছে। ৩২৭ দশমিক ৬১ বর্গকিলোমিটার আয়তন বিশিষ্ট নালিতাবাড়ী উপজেলায় ১টি পৌরসভা, ১২টি ইউনিয়ন, ৩টি খ্রিস্টান মিশন, ২টি আদিবাসী কমিউনিটি সেন্টার ও ১৯৯টি গ্রামে ২ লাখ ৫১ হাজার ৮২০ জন লোকের বসবাস। আগামীর স্মার্ট বাংলাদেশের সব মানুষের জীবনমান বাড়লেও উপজাতিদের হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্য এখন হারিয়ে যেতে বসেছে। তাই তারা সরকারের কাছে তাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সংরক্ষণের দাবি জানিয়েছেন।
সূত্রে জানা গেছে, নালিতাবাড়ী উপজেলায় ১২টি ইউনিয়নের মধ্যে ১১টি ইউনিয়নে ৭৪টি গ্রামে সহ¯্র্রাধিক পরিবারে প্রায় ৪০ হাজার উপজাতি লোকজন নানা প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবিলা করে আদিকাল থেকেই বসবাস করে আসছে। এসব উপজাতিদের মধ্যে অন্যতম হলো- গারো, হাজং ও কোচ উপজাতি। এসব সম্প্রদায়ের রয়েছে আলাদা কৃষ্টি সংস্কৃতি ও আলাদা সমাজ ব্যবস্থা।
গারোরা খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী আর কোচ ও হাজং সম্প্রদায়ের লোকজন হলেন সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বী। গারো উপজাতিরা মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার অধীনে পরিচালিত পরিবার। গারোদের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব হলো বড়দিন। এছাড়া প্রতিবছর স্টার সানডে, তীর্থউৎসব, ইংরেজি নববর্ষ ও ওয়ানগালা উৎসব পালন করে থাকে। কোচদের বৃহৎ ধর্মীয় উৎসব হলো দুর্গাপূজা ও কালিপূজা উৎসব। এসব ধর্মীয় উৎসব ছাড়াও এই দুই সম্প্রদায়ই আরও আলাদা আলাদা সামাজিক আচার অনুষ্ঠান পালন করে থাকে।
কালের বিবর্তনে বর্তমান ডিজিটাল যুগে এসব গারো, হাজং ও কোচ উপজাতিদের হাজার বছরের ঐতিহ্য সংস্কৃতি অনেকটাই হারিয়ে যেতে বসেছে। তাই তাদের ঐতিহ্য সংস্কৃতি রক্ষায় সরকারি বেসরকারিভাবে সমন্বি^ত উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
উপজেলার সীমান্তবর্তী পানিহাটা, তাড়ানি, পেকামাড়ি, মায়াঘাসি, নাকুগাঁও, দাওধারা, আন্ধারুপাড়া, খলচান্দা, বুরুঙ্গা, বাতকুচি, সমশ্চুড়া, খলিসাকুড়া, গাছগড়া, নয়াবিল এলাকায় কোচ ও গারো উপজাতিদের বসবাস। অনাদিকাল থেকেই এসব এলাকায় বাপ-দাদার বসতভিটায় উপজাতিরা বসবাস করে আসছে। চলমান স্মার্ট পৃথিবীতে বিশ্বের সব মানুষের জীবনমান বাড়লেও উপজাতিদের ভাগ্যের উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন ঘটেনি।
বরং তাদের হাজার বছরের ইতিহাস ঐতিহ্য হারিয়ে যেতে বসেছে।
আদিবাসী নেতা মি. প্রদীপ জেংচাম বলেন, বর্তমান ডিজিটাল যুগে উপজাতিদের কৃষ্টি সংস্কৃতি এখন হারিয়ে যেতে বসেছে। গারোদের হারিয়ে যাওয়া বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে আছে (উপজাতিদের ভাষায়) মান্দিদামা, ক্রাম, খোল, নাগ্রা, জিপসি, খক, মিলাম, স্ফি, রাং, বাঁশের বাশি ও আদুরী নামের বাদ্যযন্ত্র। পোশাক দকবান্দা, দকশাড়ী, খকাশিল, দমী ও রিকমাচুল। আর কোচ উপজাতিদের রাঙ্গা লেফেন ও আছাম হারিয়ে যেতে বসেছে।
আর খাদ্যের তালিকায় আছে বাঁশের কড়াল আর চালের গুড়া দিয়ে তৈরি খাবার উপকরণ মিয়া, কলাপাতায় করে ছোটমাছ পুড়া দিয়ে খাওয়া যার নাম ইথিবা, মুরগির বাচ্চা পুড়া দিয়ে বাঁশের চোঙ্গায় ভরে পেয়াজ ও কাঁচা মরিচ দিয়ে ভর্তা করে খাওয়া যার নাম ব্রেংআ, মিমিল, কাকড়া, শামুক ও শুকরের গোশত, চালের তৈরি মদ যার নাম চু আর কোচ উপজাতিদের কাঠমুড়ি খাবার উপকরণ প্রায় বিলুপ্ত হতে চলেছে।
উপজেলার খলচান্দা কোচপাড়া গ্রামের শ্রী পরিমল কোচ বলেন, নিজস্ব ভাষায় কথা বলার জন্য কোচদের আছে ‘কোচ ভাষা’ আর গারোদের আছে ‘আচিক’ ভাষা। বর্তমানে এই দুই ভাষাতেও বাংলা ভাষার সংমিশ্রণ হয়ে গেছে। নতুন প্রজন্মের অনেকেই তাদের নিজস্ব ভাষার ফাঁকে ফাঁকে বাংলাজুড়ে দিয়ে কথা বলে থাকে। একই গ্রামের শ্রী রমেশ চন্দ্র কোচ বলেন, আমাদের কোচ ভাষায় এখন বাংলা ভাষার মিশ্রণ ঘটে গেছে।
এমনকি তিনি নিজেও তাদের নিজস্ব ভাষার সঙ্গে বাংলা ভাষা যোগ করা ছাড়া কথা বলতে পারেন না। নালিতাবাড়ী উপজেলার উপজাতি সংগঠন ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের (টিডব্লিউএ) সাবেক চেয়ারম্যান মি. লুইস নেংমিনজা জানান, উপজাতিদের কৃষ্টি সংস্কৃতি সংরক্ষণে নালিতাবাড়ী উপজেলায় আমরা একটি কালচারাল একাডেমি স্থাপনের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি। আশা করছি বর্তমান সরকার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করবেন।