আড়িয়াল খাঁ নদের ভাঙনে বিপর্যস্ত মানুষ
চিলমারী উপজেলার চিলমারী ইউনিয়নের কড়াই বরিশাল গ্রামের বাসিন্দা মিনারা বেগম বসত ভিটে হারিয়ে এখন সর্বহারা। ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙনের কারণে শেষ সম্বলটুকু রক্ষা করতে ব্যস্ত। তার মতো ওই গ্রামের আরও ১০/১২টি পরিবার। ভাঙনের মুখে পড়ায় ঘর-বাড়ি সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে অন্যত্র। শুধু চিলমারী উপজেলা নয় জেলার উলিপুর, রৌমারী, নাগেশ^রী, ভূরুঙ্গামারী এবং সদর উপজেলার বেশ কিছু স্থানে চলছে ভাঙন। এতে করে প্রায় শত শত পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়েছে। ভাঙন কবলিতরা তাদের ঘর-বাড়ি ও আসবাবপত্র সরানো নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। বসতবাড়ি ফসলি জমি এবং গাছপালাসহ বিভিন্ন স্থাপনা নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। ভাঙনে ভিটামাটি হারিয়ে নিঃস্ব গৃহহারা পরিবারগুলোর অসহায় দিন কাটছে।
জেলার ১৬টি নদ-নদীর পানি বেড়ে তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, দুধকুমার, ধরলা নদীর অব্যাহত ভাঙনে বসতবাড়ি, ফসলি জমি এবং বিভিন্ন স্থাপনা বিলীন হয়েছে। এ ছাড়াও বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কমিউনিটি ক্লিনিকও ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে। এসব এলাকার মানুষের দাবি রোধে দ্রুত ব্যবস্থার পাশাপাশি স্থায়ী পদক্ষেপের। শুধু ঘরবাড়ি নয় নদ-নদীর ভাঙনে শত শত একর কৃষি জমিও বিলীন হয়ে যাচ্ছে। শুষ্ক মৌসুমে বরাদ্দ না পাওয়ায় ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছে এই জনপদের মানুষকে।
জেলার সারডোব, জগমহনেরচর, সিতাইঝাড়, ছিনাইকালুয়া, যাত্রাপুর, সাহেবের আলগা, বেগমগঞ্জ, ঠুটা পাইকর, ঘড়িয়ালডাঙ্গা, বিদ্যানন্দ, চরবলদিয়া, পাইকডাঙ্গা, ছিটপাইকের ছড়া, ধলডাঙ্গা, বালারহাট, চরব্যাপারি গ্রাম, মাঝিপাড়া, বল্লভেরখাস, কড়াই বরিশাল, শাখাহাতি, মনতলা, সোনাপুর, চরগেন্দার আলগা, কুঠির চর খানপাড়া, ঝাউবাড়ি, চরসাজাই, নাওছালা, কোদালকাটি বাজার, শিকারপুর, কীর্তন তরিসহ প্রায় পাঁচ কিলোমিটার এলাকায় ভাঙন চলছে।
চিলমারী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম জানান, ভাঙনকবলিত এলাকার জন্য বারবার অনুরোধ করেও কোনো লাভ হয়নি। চরম দুর্ভোগে কাটাচ্ছে ভাঙনকবলিত মানুষ। কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রাকিবুল হাসান জানান ভাঙন রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ড জরুরি ভিত্তিতে কাজ শুরু করার পাশাপাশি ব্রহ্মপুত্র নদের তীর রক্ষা প্রকল্প করে পাঠিয়েছে মন্ত্রণালয়ে। বরাদ্দ পেলে ভাঙন রোধে স্থায়ী কাজ শুরু করবেন।
তেঁতুলিয়া
নিজস্ব সংবাদদাতা, বাকেরগঞ্জ, বরিশাল থেকে জানান, বাকেরগঞ্জ উপজেলার দুর্গাপাশা ইউনিয়নে তেঁতুলিয়া নদীর ভাঙনে ভিটেমাটিহীন শত শত পরিবার। অব্যাহত ভাঙনে জিরাইল ও পাটকাঠি এই দুই গ্রামের প্রায় পাঁচ হাজার একর ফসলি জমি বিলীন হয়েছে। বর্ষা মৌসুমে ভয়াল রূপ ধারণ করেছে তেঁতুলিয়া নদী। এতে নতুর করে হুমকির মুখে পড়েছেন নদীর তীরবর্তী দুটি গ্রাম। তিন কিলোমিটারের অধিক এলাকাজুড়ে ভাঙনের সৃষ্টি হওয়ায় ইতোমধ্যে অর্ধশতাধিক ঘর-বাড়ি বিলীন হয়ে গেছে। জিরাইল বাজার হতে পাটকাঠি পর্যন্ত ৩ কিলোমিটার বাঁধ বিলীন হচ্ছে। জিরাই বাজারসহ অন্তত দশটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভাঙনের মুখে। বর্তমানে ভাঙনের মুখে পড়েছে দুই গ্রামের শত শত ঘরবাড়ি। এতে চরম আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন তেঁতুলিয়া নদীর পাড়ে শত শত মানুষ।
দুর্গাপাশা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান বাশার সিকদার জানায়, পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রীর সহায়তায় ১০ কিলোমিটার বাঁধ রক্ষায় ইউনিয়নে এক হাজার কোটি টাকার বরাদ্দ এনেছি, যাহার কাজ চলমান। বিগত সময়ের তুলনায় এ বছর তেঁতুলিয়া নদীর ভাঙন তীব্রতা অনেক বেশি, এখন জিরাইল ও পাটকাঠি দুই গ্রামে প্রতিদিনই ফসলি জমিসহ বাঁধ বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এই দুই গ্রাম রক্ষা করতে হলে আরও বরাদ্দের দরকার। ভাঙন রোধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি এলাকার বাসিন্দাদের।
বরিশাল পওর বিভাগ, বাপাউবো, বরিশাল নির্বাহী প্রকৌশলী মো. খালেদ বিন অলিদ বলেন, দুর্গাপাশা ইউনিয়নে ১০ কিলোমিটার ভেরি বাঁধ রক্ষায় ১ হাজার কোটি টাকার কাজ চলমান রয়েছে। দুই গ্রাম রক্ষার ৩ কিলোমিটার বাঁধ এখনো ভাঙনের মুখে রয়েছে। সরেজমিনে পরিদর্শন করে ভাঙন রোধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছেন তিনি।
আড়িয়াল খাঁর ভাঙন
নিজস্ব সংবাদদাতা, কালকিনি, মাদারীপুর থেকে জানান, আড়িয়াল খাঁ নদে প্রতিবছর নতুন করে শুরু হয় ভাঙন। ভাঙনের কবলে পরে ইতোমধ্যে বিলীন হয়ে গেছে কয়েকশ’ একর বিভিন্ন প্রকার ফসলি জমি, বাজার, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সাইক্লোন সেন্টার ও মসজিদ। এছাড়া বিগতদিনে নদীভাঙনে প্রায় কয়েকশত পরিবার ভিটেমাটি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছে। নতুন করে ভাঙন আতঙ্কে রয়েছে নদীর পাড়ের শতাধিক পরিবার, বাজার, মসজিদ ও বিভিন্ন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান। যে কোনো সময় রাক্ষুসী আড়িয়াল খাঁ নিয়ে যেতে পারে তাদের বাড়িঘর ও ফসলি জমি। এদিকে অনেকে বসতবাড়ি ভেঙে নিয়ে অন্যস্থানে আশ্রয় নিয়েছেন।
জানা গেছে, উপজেলার প্রত্যন্তঞ্চল সাহেবরামপুর এলাকার পূর্ব সাহেবরামপুর লঞ্চঘাট, নতুন আন্ডারচর, কামালেরহাট, সিডি খানের নতুন চরদৌলাত খান, বাঁশগাড়ীর আউলিয়ারচর, পৌর এলাকার লক্ষ্মীপুর পখিরা গ্রামের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে আড়িয়াল খাঁ নদ। বছরের পর বছর আড়িয়াল খাঁর তা-বে বিলীন হয়ে গেছে নদ পারের হাজারও বাড়িঘর। নদের গর্ভে চলে গেছে পূর্ব সাহেবরামপুর গ্রামের হিরন সরদার, সাহাদাত সরদার, জালাল সরদার, মজিবর বেপারী, আক্কাস আকন, মোয়াজ্জেম ফকির, শিরাজ ফকির, মোশারফ সরদার, শাহাবুদ্দিন সরদার ও সাবেক ইউপি সদস্য আদেল বেপারীর বসতঘরসহ শতাধিক বাড়িঘর।
এ ছাড়া নতুন করে বর্তমানে ভাঙন আতঙ্কে রয়েছে আলী সরদার, সবুজ সরদার, লতিফ সরদার, শাহীন সরদার, সজীব বেপারী, সুলতান বেপারী, স্বপন বেপারী, কালাম বেপারী, মন্টু সরদার, বাদশা হাওলাদার, আলিম সরদার, শাহাদাত সরদার, আজিজুল ফকির ও সোহাগ ফকিরসহ শতাধিক বাড়িঘর। অপরদিকে বর্তমানে নতুন আন্ডারচর গ্রামের চানমিয়া সরদার, বজলু সরদার, কামাল হাওলাদার, বিউটি বেগম, হাচিনা বেগম ও দাদন সরদারের বাড়িঘর আড়িয়াল খাঁ নদে বিলীন হয়ে গেছে। নদী ভাঙন আতঙ্কে রয়েছে নতুন আন্ডারচর প্রাথমিক বিদ্যালয় ও নবারুন উচ্চ বিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান। ভাঙনকবলিত মানুষ তাদের ভিটেমাটি হারিয়ে পুরোপুরি নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন।
স্থানীয় বাসিন্দা আসিকুর রহমান ও সাহানারা বেগমসহ বেশ কয়েকজন বলেন, ভাঙন প্রতিরোধে ব্যবস্থা না নেওয়া হলে আমাদের পুরো গ্রাম নদীর পেটে চলে যাবে।
আন্ডারচর গ্রামের বীরমুক্তিযোদ্ধা মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, আড়িয়াল খাঁ নদ বিগতদিনে হাজারও বসতবাড়ি কেড়ে নিয়েছে। বর্তমানে জরুরিভিত্তিতে ভাঙন প্রতিরোধের ব্যবস্থা না করা হলে বাকি ফসলি জমি, বাজার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কোনোমতে বাঁচানো সম্ভব হবে না।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার উত্তম কুমার দাশ বলেন, ভাঙন ঠেকাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ব্যাপারে উপজেলা চেয়ারম্যান তৌফিকুজ্জামান শাহীন বলেন, খবর পেয়ে স্থানীয় এম.পি তাহমিনা বেগম ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার উত্তম কুমার দাশসহ বেশ কয়েকবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। তবে ভাঙন ঠেকাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য কাজ চলছে।