গাজীপুরের টঙ্গীর বিলে ফুটেছে লাল শাপলা
শাপলা বাংলাদেশের জাতীয় ফুল। খাল-বিল হাওড়-বাঁওড় পুকুর দীঘিনালা বেষ্টিত আমাদের সারাদেশ জুড়ে শাপলা ফুলটি কোনো চাষবাস ছাড়াই জন্ম নেয়। দেশে নানা ফুলের উপস্থিতি থাকা সত্ত্বেও ফুলটি দেশের সর্বত্র বিরাজমান থাকায় শাপলাকে দেশ স্বাধীনের পর জাতীয় ফুল হিসেবে ঘোষণা করা হয়। খাল- বিলে ফুটে থাকা অপরূপ সৌন্দর্যের শাপলা দেখলে মন জুড়িয়ে যায় যে কারোর। কাছে গিয়ে ধরতে ইচ্ছে করে মন-মিতালীর মাখামাখিতে। খুব সুন্দর এই শাপলা ফুলটি দেখে ভালোবাসায় চোখ জুড়ায়, মনও জুড়ায়, শান্তি লাগে মনে।
কেন এই সাদা শাপলাকে বাংলাদেশের জাতীয় ফুল করা হলো? সাদা শাপলা হলো বাংলাদেশের জনগণের সাদা মনের প্রতীক। এটা বিশ্বাস করা হয় যে, শাপলার সাদা রং আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে আর পাপড়িগুলোর মতো দেশের মানুষকে একত্রিত করে। তাই শাপলা ফুল অনেক রঙের হলেও কেবল সাদা শাপলা বাংলাদেশের জাতীয় ফুলের মর্যাদা পেয়েছে। আরেকটি কারণ হলো, বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। তাই সারাদেশে শাপলা পাওয়া যায়। দেশের আনাচে-কানাচে নদী, খাল-বিল, হাওড়-বাঁওড় ও পুকুর-ডোবায় ছড়িয়ে থাকে ফুলটি। আর এখানে সারা বছর প্রচুর শাপলা ফোটে। আর এ কারণেই জাতীয় ফুলের মর্যাদা পেয়েছে শাপলা ফুলটি।
খাল বিল নদীনালায় বর্ষা মৌসুমে শাপলা ফুলটি নিজেদের অস্তিত্বের জানান দেয়। আগে শুধু সাদা, লাল শাপলা ফুল দেখা যেত। এখন লাল সাদা ব্লু নানা রঙের শাপলা ফুল দেখা যায় খাল-বিলে। শাপলা সপুষ্পক উদ্ভিদ পরিবারের একপ্রকার জলজ উদ্ভিদ। এ পরিবারভুক্ত সকল উদ্ভিদই শাপলা নামে পরিচিত।
শাপলা ফুল একটি গ্রিক শব্দের অনুবাদ। প্রাচীনকালে গ্রিসে জলদেবীদের এই ফুল উৎসর্গ করে উপাসনা করার নিয়ম ছিল। প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ লাল নীল শাপলা, সাদা শাপলা ফুলের অনুরাগী। মানুষ এই ফুল রান্না করে এবং কাঁচা সালাদেও খেয়ে থাকেন। তা ছাড়া শাপলা অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন জাতির প্রার্থনার সময় ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এর মধ্যে মিসর, চীন, জাপান ও এশিয়ার বিভিন্ন এলাকা উল্লেখযোগ্য। শাপলার প্রায় ৭০ থেকে ৮০টি প্রজাতি আছে পৃথিবীতে। এদের বিভিন্ন দেশে ভিন্ন নামে ডাকা হয়। বাংলা ভাষায় এদের শাপলা, শালুক বলা হয়।
ইংরেজিতে ডধঃবৎ খরষু বলা হয়, তামিল ভাষায় ভেলাম্বাল, সংস্কৃততে কুমুদ, অসমিয়া ভাষায় নাল বলা হয়। এমন আরও অনেক নাম আছে এদের বিশ্বের অন্যান্য দেশে। শাপলা ফুল নানা রঙের হয়। যেমন সাদা, লাল, গোলাপি, নীল, বেগুনী, হলুদ। শাপলা ফুল আমাদের দেশের পুকুর, হাওড়-বাঁওড়, নদী-নালা ও হ্রদে জন্মে। এই ফুল সাধারণত ভারত উপমহাদেশেই বেশি দেখা যায়। বাংলাদেশে প্রচুর পরিমাণে। এই ফুল অনেক রঙের হলেও শুধুমাত্র সাদা শাপলা বাংলাদেশের জাতীয় ফুলের মর্যাদা পেয়েছে।
এই ফুল সাধারণত ভারত উপমহাদেশে দেখা যায়। হাওড়-বিল ও দিঘিতে এটি বেশি ফোটে। বছরের সবসময় শাপলা ফুটতে দেখা যায়, তবে বর্ষা ও শরতে এই উদ্ভিদ জন্মানোর শ্রেষ্ঠ সময়।
খাল-বিল আর নদীতে ভরা পানিতে কখনো রোদ, কখনো বৃষ্টির এই সময়ে প্রকৃতির সঙ্গে শাপলা ফুলের মাখামাখি দেখতে অনেকে ছুটে যান খাল-বিল নদীনালার কাছে। পানিতে সবুজ পাতার ওপর মাথা উঁচু করে সৌন্দর্য ছড়ায় সাদা লাল শাপলা।
শাপলা ফুল রাতে পূর্ণাঙ্গভাবে ফোটে। এরা দিনের বেলায় কিছুটা সঙ্কুচিত হয়। এর কিছু প্রজাতির ফুল দিনের বেলায়ও ফোটে। এই ফুল সরাসরি কা-ের সঙ্গে যুক্ত থাকে।
ফুলের কা- বা ডাঁটা পানির নিচে মূলের সঙ্গে যুক্ত থাকে এবং এই মূল জলাশয়ের তলদেশের ভূমিতে যুক্ত থাকে। এর পাতাগুলো পানির ওপর ভেসে থাকে। পাতার আকার প্রায় গোল, তবে এর একটি পার্শ্ব বিভক্ত থাকে। পাতার রং সবুজ, পাতার প্রান্ত ঘিরে ধারাল খাঁজ থাকে। এর কলি দেখতে অনেকটা গম্বুজের মতো লাগে। এর বাইরের দিকের রং সবুজাভ। যখন ফুল ফোটে তখন এর ভেতরের পাপড়িগুলো ছড়িয়ে পড়ে। একটি শাপলা ফুলের স্থায়িত্ব একনাগাড়ে সাত থেকে দশদিন পর্যন্ত হয়ে থাকে। প্রায় সারা বছরই শাপলা ফুল দেখা যায়।
সারা বিশ্বে ৫০ প্রজাতির শাপলা আছে, কিন্তু বাংলাদেশে মাত্র ২ প্রজাতির শাপলা জন্মে। সাদা ও লাল রঙের শাপলা। একটা রক্তকমল প্রজাতির আর অন্যটা হলো শালুক প্রজাতির। শাপলার শেকড় পানির নিচে থাকে আর ফুল ডাঁটা দিয়ে পানির ওপর ফুটে থাকে। ফুলগুলো প্রায় পাঁচ থেকে সাতদিন পানির ওপর ভেসে থাকে। এর পাতাগুলো দেখতে গোলাকার ও সবুজ রঙের। সবুজ পাতায় সাদা লাল শাপলা দেখতে অপূর্ব লাগে। বাংলাদেশে সারা বছর শাপলা কম-বেশি সব জায়গায়ই হয়। তবে বেশি হয় বর্ষা আর শরৎকালে।
বর্তমানে অধিক জনসংখ্যার কারণে, জলাশয় কমে যাওয়ায় এই উদ্ভিদ দুর্লভ হয়ে উঠেছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশ ছাড়াও এই ফুল থাইল্যান্ড ও মিয়ানমারে দেখা যায়। শুধু তাই নয়, ভারত, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, তাইওয়ান ইত্যাদি দেশের পুকুর ও হ্রদেও এই ফুল প্রচুর দেখা যায়। শ্রীলঙ্কার জাতীয় ফুলও শাপলা। তবে সাদা শাপলা নয়, নীল শাপলা। শ্রীলঙ্কায় এই ফুল নীল মাহানেল নামে পরিচিত। নর্থ আমেরিকা, সাউথ আমেরিকা, ইউরোপ এবং অস্ট্রেলিয়ার কিছু এলাকায়ও বিভিন্ন রঙের শাপলা জন্মে থাকে।
বিশ্বের অনেক দেশেই সবজি হিসেবে শাপলার ফুল ও ডাঁটা খাওয়া হয় রান্না করে এবং কাঁচা। উদ্ভিদটির গোড়ায় থাকে আলুর মতো এক ধরনের কন্দ যার নাম শালুক, অনেকে একে সবজি হিসেবে খায়। শাপলার ফল সাধারণত আমরা ঢ্যাপ বলে থাকি। এই ঢ্যাপ হয় সবুজ গোলাকার। ঢ্যাপ যখন কচি থাকে তখন এর ভেতরের বীজগুলোর রং থাকে লাল, যখন বীজ পেকে যায় তখন কালো রং ধারণ করে। এই ফল পাকলে ফেটে যায়, এর মধ্যে অনেকগুলো কোষ থাকে। কোষগুলোর মধ্যে থাকে অসংখ্য বীজ। বীজগুলো আকারে খুবই ছোট।
শাপলা বিভিন্নভাবে রান্না করে খাওয়া হয় আমাদের দেশে। বিশেষ করে ইলিশ ও চিংড়ি মাছের সঙ্গে রান্না করলে অতুলনীয় স্বাদ লাগে খেতে। শাপলার ডাঁটা ছোট করে কেটে চিংড়ি মাছ আর নারকেল বাটা দিয়ে মাখা মাখা ঝোল করে রান্না করা হয়। এর ডাঁটা ছোট করে কেটে শুধু নারকেল কোড়া দিয়ে ভাজি করলেও চমৎকার স্বাদ লাগে খেতে। শাপলার ডাঁটা একটু লম্বা করে কেটে ইলিশ মাছ দিয়ে ঝোল করে খেতেও খুব স্বাদের।
আমাদের দেশের গ্রাম অঞ্চলে এখনো এই ধরনের খাবারের খুব প্রচলন আছে এবং অতীতেও ছিল। এখনো কিছুটা আছে তবে আধুনিকতার জোয়ারে অনেকটা কমে গেছে। বই পুস্তকে পড়ে ছবি দেখে শাপলা ফুল চিনে থাকে।
আমরা সবাই আমাদের সন্তানদের খাল বিল হাওড়-বাঁওড় নদীনালা দীঘি পুকুরের কাছে নিয়ে জাতীয় এই শাপলা ফুলের সঙ্গে পরিচিত করাই আমাদের শিকড়ের অস্তিত্বের স্বার্থে। আসুন ভালোবাসার রঙে রাঙিয়ে তুলি শাপলা ফুল উপহার দিয়ে প্রিয়জন, প্রিয়তম মানুষটির হৃদয়ের ভালোবাসায়।
নূরুল ইসলাম, টঙ্গী