প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার সিরাজগঞ্জে চলনবিলের উধুনিয়া
বর্ষায় যতদূর চোখ যায় চারদিকে শুধু পানি আর পানি। ছোট-বড় ঢেউয়ের অথৈ পানিতে ডিঙি নৌকায় পারাপার। মাঝে-মধ্যে উঁচু ভূমিতে কিছু বাড়িঘর। দূর থেকে মনে হবে পাহাড়ের টিলা। কাছে গেলেই সমতল ভূমি থেকে কমপক্ষে ১০ ফুট উঁচুতে বাড়ি। এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ির দূরত্ব দুইশ থেকে তিনশ ফুট। সন্ধ্যায় প্রতিটি বাড়ি বিদ্যুৎ বাতির আলোয় ঝলমলিয়ে ওঠে। কোথাও কাশবন বা ছনের ছাপড়া ঘর নেই।
কমপক্ষে মেঝে পাকা টিনের চৌচালা ঘর। অনেকেরই আছে টিনের চৌচালায় পাকা বাড়ি, মেঝে টাইলস মোড়ানো। বাথরুমও পাকা। ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলন করে রিজার্ভার ট্যাঙ্ক ব্যবহারও হয় অনেক বাড়িতে। মোবাইল ফোন, টেলিভিশন, ফ্রিজ হাতের মুঠোয়। সাবমারসিবল পাকা সড়কপথে যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই ভালো। এ অবস্থা সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার উধুনিয়া ইউনিয়নের গজাইল গ্রামের। গ্রাম ও শহরের মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। গ্রাম ও শহর হবে এক-প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ বক্তব্য এখন অনেকটাই বাস্তব।
প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর উত্তরের বৃহত্তর বিল চলনবিল। এই চলনবিলেরই একটি অংশ উধুনিয়া। সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার ১৪ ইউনিয়নের মধ্যে উধুনিয়া একটি ইউনিয়ন। উপজেলা সদর থেকে কমপক্ষে ১৪ কিমি দূরে পূর্বদিকের শেষ সীমানায় অবস্থিত উধুনিয়ার গজাইল গ্রাম। লোকমুখে গজাইল শ্যামপুর নামে প্রচলিত। গজাইল গ্রামে অনার্স পর্যায়ের একটি কলেজ রয়েছে। আছে হাই স্কুল, সরকারি প্রাইমারি স্কুল।
ধর্মীয় শিক্ষার জন্য মাদ্রাসাও রয়েছে। জনসংখ্যা প্রায় তিন হাজার। এ গ্রামে প্রায় সাড়ে তিনশ সরকারি চাকরিজীবীর পৈত্রিক ভিটা। এ ভিটামাটি থেকে পড়ালেখা শেষ করে তারা এখন সরকারি চাকরি করেন। কৃষিপণ্য উৎপাদন গ্রামের মানুষের প্রধান আয়ের উৎস। ইরি বোরো ধান ও সরিষার আবাদ হয় শুকনো মৌসুমে। বর্ষায় অথৈ পানিতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে গ্রামের দরিদ্র পরিবার। পাশেই তাড়াশ উপজেলা এবং পাবনা জেলার ভাঙ্গুড়া-চাটমোহর উপজেলা অবস্থিত। একটি উপজেলার শেষ সীমানার গ্রামে বিদ্যুতের বাতি জ¦ললে পরিষ্কার হয়ে ওঠে গ্রামের উন্নয়ন চিত্র।
কথা হলো উধুনিয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সাত্তারের সঙ্গে (বিকম সাত্তার)। তিনি জানালেন, কফি হাউসের কথা। এককাপ কফি খাওয়ার জন্যও দাওয়াত দিলেন। খুশি লাগল। কারণ- এমনই একটি প্রত্যন্ত এলাকায় বিলের মধ্যে বাঁশের খুঁটি দিয়ে উঁচু করে গড়ে তোলা হয়েছে কফি হাউস। স্কুল ও কলেজপড়ুয়া যুবকেরা সেখানে গিয়ে কফি খায়। আনন্দ উপভোগ করে। বর্ষার সময় নৌকা নিয়ে নানা বয়সী মানুষ সাবমারসিবল সড়কে এসে আড্ডা দেয়। নৈসর্গিক দৃশ্য উপভোগ করে। বিশুদ্ধ বাতাসে গা জুড়ায়। বিকেলে সড়কের পাশে ফুচকা, চটপটি, পিঁয়াজুসহ মুখরোচক নানা পসরা সাজিয়ে বসে দোকান।
মোটরসাইকেল, অটো ভ্যানে চড়ে যুবক-যুবতীরা আসে, বিলের অথৈ পানিতে সূর্য অস্তমিত যাবার মনোমুগ্ধকর দৃশ্য উপভোগ করে, মুখরোচক খাবার খেয়ে বাড়ি ফেরে। নিরাপত্তা নিয়ে কোনো শঙ্কা নেই। বর্ষার বিকেলে নানা বয়সী মানুষের আড্ডায় জমে ওঠে গজাইল শ্যামপুর, মহেশপুর গ্রামসহ আশেপাশের গ্রামগুলোও।
উল্লাপাড়া উপজেলা সদর থেকে শ্যামলীপাড়া হয়ে পাকা সড়ক দিয়ে কিছুদূর গেলেই বিল। বিলের নিচু জমির ভেতর দিয়ে সাবমারসিবল পাকা সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। বর্ষায় পানিতে ডুবে গেলেও সড়কের কোনো ক্ষতি হবে না। এই ডুবো সড়ক পেরিয়ে গজাইল গ্রামের অবস্থান। অপরদিকে বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিমপারের মহাসড়ক দিয়ে হাটিকুমরুল গোল চত্বর পেরিয়ে নাটোর-রাজশাহী রোডের দবিরগঞ্জ থেকে বামে উল্লাপাড়া উপজেলা সীমানার কুচিয়ামারা, প্রতাপ বাজার হয়ে পাকা সড়ক পথে মহেশপুর হয়ে এই গজাইল গ্রামে যেতে হবে।
গজাইল অনার্স কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ও অধ্যক্ষ মনজিরুল হক জানান, বর্ষায় নৌকাই একমাত্র বাহন। শুকনো মৌসুমে সড়ক পথে যাতায়াতে কোনো সমস্যা হয় না। এ গ্রাম থেকে বিলের মধ্যে নির্মিত সাবমারসিবল পাকা সড়ক দিয়ে উপজেলা সদরে যেতে ২০ থেকে ২৫ মিনিট সময় লাগে। ব্যাটারিচালিত অটো রিক্সা ও ভ্যানগাড়ি সবসময় পাওয়া যায়। মনেই হয় না আমরা গ্রামে বসবাস করি। আধুনিক সকল সুবিধাই আছে।
মোবাইল ফোন, টেলিভিশন, ফ্রিজ হাতের মুঠোয়। গ্রামের বাড়িতে বসে দুনিয়ার খবর ইন্টারনেটে পাওয়া যায়। তার কলেজে সাতশরও বেশি শিক্ষার্থী। তবে গ্রামের ধনাঢ্য ও জোতদার পরিবার উপজেলা ও জেলা সদরে বসবাস করেন। কিন্তু খোঁজ রাখেন এলাকার। ১৯৩০ সালে প্রতিষ্ঠিত উধুনিয়া ইউনিয়নের মোট জনসংখ্যা ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী ৩২ হাজার ৫শ। আয়তন ১৪ দশমিক ৮৫ বর্গ কিমি। গ্রামের সংখ্যা ২৬। এর মধ্যে গজাইল গ্রাম অধিকতর শিক্ষিত।