ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

aiub
aiub

বিক্রমপুরের  দোতলা ঘর

মীর নাসিরউদ্দিন উজ্জ্বল

প্রকাশিত: ০১:৫২, ২৬ জুলাই ২০২৪

বিক্রমপুরের  দোতলা ঘর

মুন্সীগঞ্জ-বিক্রমপুরের ঐতিহ্যবাহী টিনের দোতলা ঘর

মুন্সীগঞ্জ তথা বিক্রমপুরের ঐতিহ্যবাহী দোতলা ঘর। এই ঘরের কদর বেড়ে গেছে এখন। তাই ঐতিহ্যের ঘর বিক্রি হচ্ছে বাণিজ্যিকভাবে। রেডিমেট এই ঘর বিক্রি ক্রমেই বাড়ছে। পাকা ভবনের চেয়ে অনেক ক্ষেত্রে খরচ সমান বা বেশি হলেও  নানা কারণেই এই ঘর ব্যবহার করছে এই অঞ্চলের মানুষ। যা এখন জেলা ছাপিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েছে এর জনপ্রিয়তা। তাই ডুপ্লেক্স এই ঘর যাচ্ছে নানা স্থানে। 

আর নান্দনিক দোতলা ঘরের পসরা বসেছে জেলার বিভিন্ন স্থানে। মুন্সীগঞ্জের সদর উপজেলা হাতিমারা, বজ্রযোগিনী, মহাকালী, লৌহজং উপজেলার কনকসার ও টঙ্গীবাড়ি উপজেলার কুন্ডের বাজারসহ নানা স্থানে। হাটের পাশেই দিনভর এই ঘর তৈরির কাজ চলে। তৈরি করা ঘর অস্থায়ীভাবে সাজিয়ে রাখা হয়।  
এমনভাবে ঘরগুলো তৈরি করা, যা পাটে পাটে খুলে ফলা সম্ভব। স্ক্রু বোল্ড সিস্টেমের নতুন টিন আর কাঠে ঘরগুলো অল্প সময়ে স্থানান্তর সম্ভব। বিক্রির পর তাই খুলে নিয়ে ক্রেতার বাড়িতে স্থায়ীভাবে বসিয়ে দেওয়া হয়।
বিভিন্ন সাইজের একতলা, দোতলা এমনকি তৃতীয় তলা ঘর সারি সারি সাজিয়ে রাখা হয়। সামর্থ্য অনুযায়ী পছন্দের ঘর কিনে নেন আগ্রহীরা। ঘরের হাটে এসেছেন আসা প্রবাসী ক্রেতা মিজানুর রহমান বলেন, দীর্ঘদিন জাপান ছিলেন। এখন দেশে এসে বাড়িতে বিল্ডিং না করে দোতলা ঘর করার জন্য পছন্দের ঘর কিনতে এসেছেন। তিনি বলেন, এই ঘরে বাসবাস ভালো লাগে, বিল্ডিংয়ে কিন্তু সেটি উপভোগ করা যায় না। ঘরের দোতলায় ঝুলন্ত বারান্দায় বসে প্রকৃতি দেখতে কার না ভালো লাগে। আর চাঁদ রাতে আরও ভালো লাগা।   
তার বোন দৃপ্তি আক্তার বলেন, ঋতু বৈচিত্র্যের এই দেশে এ ঘরে বসবাসে রয়েছে বৈচিত্র্যপূর্ণ অভিজ্ঞতা। বৃষ্টির দিন টাপুরটুপুর বৃষ্টির ছন্দও দেয় বিশেষ ভালোলাগার। কাঠের সিঁড়িসহ মেঝেও কাঠের। বেশির ভাগই কাঠের ব্যবহার। 
ঘরগুলো দূর থেকে দেখতেও বেশ ভালো লাগে। মুন্সীগঞ্জ তথা বিক্রমপুরের টিনের ঘরগুলো দৃষ্টিনন্দন করে তুলছে পুরো এলাকাকে। এ অঞ্চলের মানুষের কাছে টিন কাঠে ঘরের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। 
কাঠের ঝুল বারান্দায় কাঠের কারু কাজ, টিনের কারুকাজ। দুইয়ে মিলে নজর কাড়া কাঠামো। দৃষ্টি কাড়ে চালা, ঘাম দরজা জানালার নকশাও। যুগ যুগ ধরে এমন দৃষ্টিনন্দন কাঠামোর বাড়িগুলো হয়ে উঠেছে মুন্সীগঞ্জের ঐতিহ্য। নকশাকারের পাকা হাতের নিরেট কাঠ আর টিন রূপ নেয় শৈল্পিক আবাসের। দালান তৈরিতে সামর্থ্যবাড়লেও আশ্রয় নেন মনের দুয়ারে। তাই টিন কাঠের ঘর প্রতি বিশেষ আকর্ষণ। 
মুন্সীগঞ্জের লৌহজ, টঙ্গীবাড়ি, সিরাজদিখান, শ্রীনগর ও মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলায় দেখা মিলে এসব ঘরের। স্থানীয়দের মতে শৈল্পিক মনের প্রকাশ তো বটেই নদী ভাঙন এলাকা হওয়ায় এমন ঘরের প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়েছে। দোতলা ঘর ব্যবহারকারী লৌহজংয়ের হলদিয়া গ্রামের মাসুদ মিয়া জানান, পদ্মার ভাঙনে এই অঞ্চলের মানুষ ক্ষতবিক্ষত। অনেকে ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে। উপজেলাটির বড় একটি অংশ পদ্মায় হারিয়ে গেছে। যাদের পাকা বা আধাপাকা ভবন ছিল তারা সবই হারিয়েছেন। আর যাদের টিন কাঠের ঘর, তা ভেঙে এনে অন্যত্র তুলে বসবাস করতে পারছেন। পদ্মাপাড়ের ঐতিহ্য হালকা গড়নের মজবুত এই বাসস্থান। এক সময় নিজ নিজ পছন্দের নকশা অনুযায়ী এসব ঘর নিজ বাড়িতেই তৈরি করতেন। এখন বাণিজ্যিকভাবে সেই ঘর তৈরির কারখানা বাড়ছে। এখানে তাই কর্মসংস্থানের সুযোগও সৃষ্টি হচ্ছে। শ্রমিকরা সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত কাজ করেন। 
দৃষ্টিনন্দন টিন কাঠের তৈরি ঘরগুলো। যে কারও নজর কাড়বে। ব্যবসায়ীদের হিসাব অনুযায়ী আছে চৌচালা ও সাতচালা ঘরও। সব ঘর তৈরি করা হয়েছে বিক্রির জন্য। বেশ কয়েকটি স্থানে গড়ে উঠেছে এমন ঘর তৈরির কারখানা। চাহিদার কারণে কোনো কোনো কারখানার শাখা পর্যন্ত করা হয়েছে। মুন্সীগঞ্জের টঙ্গীবাড়ি উপজেলার কুন্ডের বাজার ‘কথামনি ঘর বিতান’ এর মালিক আহমদ আলী জানান, তাদের পরিবার থেকেই এই টিনকাঠের দোতলা ঘর বিক্রি বাণিজ্যিকভাবে শুরু হয়েছে। প্রতিদিন ৪/৫টি ঘরের অর্ডার তিনি পাচ্ছেন। তাই ঘরের হাটের পাশে ধুম কাজ চলছে তার কারখানায়। 
এই এলাকায় বহু বছরের রীতিতে পরিণত হয়েছে এমন টিন কাঠের ঘর। শৈল্পিক সৌন্দর্য ছাড়াও এই ঘরে বসবাসেও রয়েছে নানা ভলোলাগা। নির্মাণের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানান বাণিজ্যিকভাবে তৈরি করায় ঘরগুলো তুলনামূলক কমদামে তারা দিতে পারছেন। আর কাঠের ধরন নকশার ওপর দাম নির্ভর করে। লৌহজংয়ের কনকসারের ঘরব্যবসায়ী মফিজুল ইসলাম বলেন, এক সাথে টিন-কাঠ পাইকারি কেনায় এবং মাসিক কাঠ মিস্ত্রী থাকায় তুলনামূল কমেই ঘর তৈরি করা যায়। কিন্তু নিজ বাড়িতে একটি ঘর করতে গেলে নানা কারণেই খরচ আর বাড়ে। এসব কারণেই ক্রেতারা সময় না নিয়ে পছন্দের ঘর কিনে নেন বা অর্ডার করেন। পদ্মা পারের কনকসারে কাঠপট্টি এলাকায় পাশপাশি কয়েকটি ঘরের হাট। বিশাল এলাকাজুড়ে তৈরি করা ঘর পসরা সাজানো হয়েছে। আর পাশেই এই ঘরগুলো তৈরির কাজও চলছে। এর মধ্যেই ক্রেতারা আসছেন। কনসারের আরেক ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম বলেন, ৭ থেকে ১০ দিনেই একটি দ্বিতল ঘর তৈরি করা সম্ভব। তবে নকশা ও বড় আকারের ঘর তৈরিতে এক মাস সময়ও লেগে যায়। ঘর স্থানান্তরিত করে স্থায়ীভাবে বসাতে সময় লাগে দুই থেকে তিন দিন।
১৭ ফুট থেকে ৩২ ফুট পর্যন্ত নানা সাইজ এবং নানা নকশায় দেড় তলা ও দুই তলা রেডিমেট ঘর বিক্রি হচ্ছে দেড় ১ লাখ থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত। ব্যবসায়ীদের দাবি এই ঘরগুলোর স্থায়িত্ব অন্তত ২০ বছর থেকে ৭০ বছর পর্যন্ত। নজরুল ইসলাম বলেন, ঘরের খুঁটি তৈরি হয় এখন রড-সিমেন্ট-কংক্রিটে। আর পুরো ঘরই উন্নত মানের কাঠে। দেশী-বিদেশী হরেক রকম কাঠ ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে ক্রেতার ইচ্ছায়ও কাঠ দেওয়া হচ্ছে। টিনের মধ্যেও কয়েকটি ধাপ রয়েছে। তাই টেকসইয়ের জন্য মানসম্মত টিন এবং কাঠ ব্যবহারে সুফল বেশি। ভালো ঘর ব্যবহারের পরেও ক্রয় দরের চেয়েও কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেশি বিক্রি করা যায়। কারণ কাঠ ভালো হলো কদর একই রকম। আর ঘর তৈরিতে এখন ব্যবহার করা হচ্ছে আধুনিক যন্ত্রপাতিও। তাই ঘরের নকশা ও ফিনিশিং ভালো হচ্ছে।
মীর নাসিরউদ্দিন উজ্জ্বল, মুন্সীগঞ্জ

×