ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

aiub
aiub

কে যাস রে ভাটি গাং বাইয়া...

সঞ্জয় সরকার

প্রকাশিত: ০১:৪৯, ২৬ জুলাই ২০২৪

কে যাস রে ভাটি গাং বাইয়া...

পূবালী বাতাসে/ বাদাম দেইখ্যা চাইয়া থাকি/ আমারনি কেউ আসে...

পূবালী বাতাসে/ বাদাম দেইখ্যা চাইয়া থাকি/ আমারনি কেউ আসে...। উজান থেকে ভাটির দিকে ছুটে আসা নৌকার বাদাম (পাল) দেখে এভাবেই মনের আকুতি প্রকাশ করেছিলেন ভাটির বাউল উকিল মুন্সি। তবে এ আকুতি শুধু উকিল মুন্সির একার নয়, ভাটির দেশে বিয়ে হওয়া প্রতিটি নারীই আপনজনের অপেক্ষায় বর্ষার দিনগুলোতে এভাবে নৌকার দিকে তাকিয়ে থাকতেন। আর হাওড়বাংলার পল্লিবধূরা নৌকায় চড়েই বর্ষায় নাইওর যেতেন বাবার বাড়িতে। আবার শুধু নারীরাই নন, দূর-দূরান্তে যাতায়াত, হাটবাজার, বিয়েশাদি, পণ্য পরিবহন, মাছধরা প্রভৃতি প্রয়োজনে প্রায় সকলকেই বর্ষায় নির্ভর করতে হতো নৌকার ওপর।

নদীমাতৃক বাংলার প্রতিটি মানুষের সঙ্গেই ছিল নদী ও নৌকার এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। তবে বিচ্ছিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে হাওড়বাংলায় সে সম্পর্কটি ছিল আরও অটুট। হাওড়ের মাঝি-মাল্লারা দিন-রাত উত্তাল ঢেউয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নৌকা চালাতেন। গুন টানতে টানতে অথবা বৈঠা চালাতে চালাতে মনের আনন্দে গেয়ে উঠতেন ‘রুপালি নদীরে.../ রূপ দেইখ্যা তোর হইয়াছি পাগল...’।
বাংলাদেশ যেমন হাজারো নদ-নদীর দেশ, তেমনি হাওড়বাংলাও বাহারি নৌকার দেশ। একেক নৌকা একেক ধরনের কাজে ব্যবহার করা হতো। ভিন্নতা অনুসারে হাওড়বাংলার নৌকাগুলোর নামও ছিল চমৎকার এবং শ্রুতিমধুর। নেত্রকোনার হাওড় অঞ্চলে যেসব ধরনের নৌকার প্রচলন ছিল এবং এখনো আছেÑ সেগুলোর মধ্যে বেপারির নাও বা গস্তি, কেরায়া নাও বা গয়না, কোষা, কোন্দা, ডিঙ্গি, টেম্পো, পাতাম, দৌড়ের নাও, জোড়া নাও, বাল্কহেড, ট্রলার ইত্যাদি ছিল উল্লেখযোগ্য। 
গয়না ॥ ইঞ্জিনচালিত নৌকার (ট্রলার) প্রচলন শুরু হওয়ার আগে হাওড় অঞ্চলে দূর-দূরান্তে যাতায়াতের প্রধান বাহন ছিল গয়না বা কেরায়া নাও। এটি মাঝারি ধরনের ছৈওয়ালা নৌকা। একটি গয়নায় তিন থেকে পাঁচজন মাঝি থাকতেন। একজন সারেং পেছন থেকে বড় বৈঠা (হাল) ধরতেন। আর অগ্রভাগে দাঁড় টানতেন দুই অথবা চারজন। নদী বা হাওড়ে বাতাসের জোর থাকলে রঙিন ছৈয়ের ওপর মাস্তুলের সাহায্যে টাঙানো হতো রং-বেরঙের পাল। আর নদীর তীর ঘেঁষে যাওয়ার সময় টানা হতো গুন। হাওড়ের বেশিরভাগ সম্পন্ন বাড়ির ঘাটে বর্ষাকালে দু-একটি গয়না বাঁধা থাকত। আবার ভাড়ায়ও পাওয়া যেত। গয়না-আকৃতির কিছু নৌকা এখনো হাওড় অঞ্চলে দেখা যায়। তবে সেগুলো এখন আর গুন, দাঁড় বা পালের সাহায্যে চলে না। চলে স্যালো ইঞ্জিনের সাহায্যে, ভটভট শব্দ করে।  
বেপারির নাও ॥ বেপারির নাও এক ধরনের পণ্যবাহী নৌকা। কোথায়ও কোথায়ও এটিকে ‘গস্তি’ বলা হয়। খুবই বড় আকৃতির ছৈওলা এ নৌকায় সাধারণত ধান, পাট প্রভৃতি কৃষিপণ্য পরিবহন করা হতো। একটি নৌকায় অন্তত ৫শ’ থেকে হাজার মণ পর্যন্ত ধান ভরা যেত। ধানের পাইকার (আঞ্চলিক ভাষায় বেপারি) অথবা ফড়িয়ারা বর্ষাকালে বেপারির নাও ঘাটে ভিড়িয়ে গৃহস্থবাড়ি থেকে ধান কিনতেন। পরে তা বড় বড় মোকামে নিয়ে যেতেন। বেপারির নাওয়ের মাঝিরা বর্ষার ছয় মাস নৌকায়ই জীবনযাপন করতেন। গয়নার মতো এ নৌকাও আগে বড় বৈঠা, কয়েক জোড়া দাঁড়, গুন এবং পালের সাহায্যে চলত। এখন উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন শ্যালো ইঞ্জিনের সাহায্যে চলে। হাওড় অঞ্চলে এখনো কিছু বেপারির নাওয়ের দেখা মেলে।    
ডিঙি ॥ ‘ডিঙ্গি’ ছোট ধরনের নৌকা। দুই প্রান্ত ত্রিভুজ আকৃতির। একবাড়ি থেকে আরেক বাড়িতে, হাটেবাজারে অথবা নিকটবর্তী স্থানে যাতায়াত, স্বল্প পরিমাণের পণ্য পরিবহন অথবা অন্যান্য দৈনন্দিন কাজে ডিঙি নৌকা ব্যবহার করা হতো। আগের দিনে হাওড়ের প্রায় বাড়িতেই একটা না একটা ডিঙি থাকত। ডিঙিতে সাধারণত ছৈ থাকে না। আকারভেদে একটি ডিঙি নৌকায় ছয় থেকে ২০ জন পর্যন্ত চলতে পারেন। সাধারণত লগি-বৈঠার সাহায্যে এটি চালানো হয়। তবে হাল আমলে কেউ কেউ ডিঙি নৌকায়ও ছোট আকারের শ্যালো ইঞ্জিন ব্যবহার করেন। ডিঙি নৌকার প্রচলন এখনো আছে।

কোষা ও কোন্দা ॥ কোষা বা কোন্দা খুবই ছোট ধরনের নৌকা। অগ্র ও পশ্চাৎভাগে দুটি বড় সাইজের তক্তা (কাঠ) জোড়া দিয়ে এটি তৈরি করা হয়। আর নিচের দিকে থাকে পাটাতন। পাটাতনের ওপরে থাকে গুটিকয়েক গোড়া। একটি নৌকায় মাঝিসহ সর্বোচ্চ দুই-চারজন চড়তে পারেন। সাধারণত জাল বা বড়শি দিয়ে মাছ ধরা, গবাদিপশুর ঘাস সংগ্রহ, ফেরি করে পণ্য বিক্রি প্রভৃতি কাজে কোষা বা কোন্দা নৌকার ব্যবহার করা হয়। এখন কালেভদ্রে এটি দেখা যায়।  
টেম্পো ॥ টেম্পোও ছোট আকারের নৌকা। দেখতে অনেকটা ছোটখাটো লঞ্চের মতো। সামনের প্রান্ত ত্রিভুজ আকৃতির। আর পেছনের অংশ চতুর্ভুজের মতো। এটিও স্বল্পসংখ্যক যাত্রী পরিবহনে ব্যবহার করা হয়। শ্যালো ইঞ্জিনের সাহায্যে চলে। এ নৌকায় এক থেকে দুজন মাঝি থাকেন। টেম্পোর ব্যবহার এখনো দেখা যায়। 
দৌড়ের নাও ॥ নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতার নৌকাকে হাওড়াঞ্চলে ‘দৌড়ের নাও’ বা ‘বাইচের নাও’ বলা হয়। এটি আকারে ছোট হলেও বেশ লম্বা এবং সরু হয়।

নৌকার আগা ও দুই পাশে ময়ূর, ঘোড়া, ফুল, লতা-পাতা প্রভৃতি নকশা আঁকা থাকে। দূর থেকে দেখলে মনে হয় পানির ওপর কোনো ময়ূর ছুটে যাচ্ছে। আগে গ্রামের বড় গৃহস্থ, ধনী ও শৌখিন ব্যক্তিদের বাড়ির ঘাটে এ নৌকা দেখা যেত। এটি কিছুটা আভিজাত্যেরও প্রতীক ছিল। যেখানে নৌকাবাইচ হতো, সেখানে গ্রামের লোকেরা সংগঠিত হয়ে নৌকা নিয়ে যেতেন এবং বাইচে অংশ নিতেন। প্রতিযোগিতায় জিতলে সপ্তাহ বা পক্ষকালজুড়ে চলত গ্রামবাসীর আনন্দ-উল্লাস। হাওড়বাংলায় এখন আর সচরাচর দৌড়ের নাও দেখা যায় না। 
জোড়া নাও ॥ দুটি ছোট আকারের নৌকা জোড়া দিয়ে তৈরি করা হয় জোড়া নাও। এটি বড় বড় হাওড়ে মাছ ধরার কাজে ব্যবহার করা হয়। জোড়া লাগানো দুটি নৌকার মাঝখানে বাঁশের পাটাতনের ওপর রাখা হয় বিশাল আকারের জাল। এরপর জেলেরা নৌকার দু’দিক থেকে পানিতে জাল ফেলেন এবং তোলেন। এ নৌকাগুলো সাধারণত দাঁড়, বৈঠা এবং লগির সাহায্যে চালানো হয়। 
বাল্কহেড ॥ বাল্কহেড বিশাল বড় আকারের পণ্যবাহী নৌকা। অনেকটা কার্গোর মতো। স্টিলের পাত দিয়ে তৈরি করা হয়। বাল্কহেডে সাধারণত পাথর, বালি, সিমেন্ট, ধান প্রভৃতি পরিবহন করা হয়। এটিও উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন শ্যালো ইঞ্জিনের সাহায্যে চালানো হয়। পেছন থেকে একজন সারেং গতি নিয়ন্ত্রণ করেন। নেত্রকোনার হাওড়াঞ্চলের সুরমা এবং ধনু নদীতে সারাবছর বাল্কহেড চলে। বড় ও গভীর নদীপথ ছাড়া এটি চালানো যায় না। 
ট্রলার ॥ বড় আকারের শ্যালো ইঞ্জিনচালিত যাত্রীবাহী নৌকারই আরেক নাম ট্রলার। আশির দশক থেকে চালু হওয়া এসব নৌকা হাওড়ের দুর্গম যাতায়াত ব্যবস্থাকে অনেকটাই সহজ করে দিয়েছে। হাওড়ের বাসিন্দারা বর্ষায় সড়ক পথের চেয়ে ট্রলারে যাতায়াত করতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। এতে খরচ কম পড়ে। অল্প সময়ে বহুদূরের পথ পাড়ি দেওয়া যায়। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ট্রলারগুলোর যাত্রীসেবায়ও এসেছে পরিবর্তন। কোনো কোনো ট্রলারে এখন কাঠের পাটাতনের বদলে চেয়ার রাখতে দেখা যায়। সৌরবিদ্যুতের সাহায্যে চালানো হয় ফ্যান। শুয়ে ঘুমানোর জন্য রাখা হয় পাটি, বালিশ, তোষক প্রভৃতি। আকারভেদে একেকটি ট্রলারে ২০ থেকে ২শ’ জন পর্যন্ত যাত্রী পরিবহন করা যায়। 
আর বাইতে পারলাম না ॥ ট্রলার নামক যান্ত্রিক জলযানের প্রসারের ফলে দাঁড় টানা, গুন টানা বা পাল উড়িয়ে নৌকা চালানোর চিরচেনা দৃশ্যগুলো আজ হারিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে নৌকা চলাচলের উপযোগী পথঘাটও সঙ্কুচিত হয়ে আসছে দিন দিন। একদিকে যেমন নদীগুলো নাব্য হারাচ্ছেÑ অন্যদিকে নদীর গতিপথে অপরিকল্পিতভাবে নির্মাণ করা হচ্ছে পাকা সেতু, কালভার্ট, স্লুইসগেট ও বাঁধ। এ ছাড়া আধুনিককালের দ্রুতগতির যানবাহনের সঙ্গে পাল্লা দিয়েও টিকতে পারছে না সনাতন দিনের নৌকাগুলো। এর ফলে হাওড়বাংলার পুরো নৌকা-সংস্কৃতিই যেন পাল্টে যাচ্ছে। আর সঙ্গত কারণেই জাদুঘরে স্থান পেতে যাচ্ছে আবহমানকালের নৌকা। ‘মনমাঝি তোর বৈঠা নে রে/ আমি আর বাইতে পারলাম না...’ নৌকার মতো মেঠোসুরের এ গানগুলোও হয়তো একদিন ভুলে যাবে এখানকার মানুষ।
সঞ্জয় সরকার, নেত্রকোনা

×