ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

aiub
aiub

কতটা সজাগ প্রজন্ম

নাগিনীরা চারি দিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিশ্বাস...

মোরসালিন মিজান

প্রকাশিত: ২৩:০৫, ২৪ জুলাই ২০২৪; আপডেট: ০১:৫০, ২৫ জুলাই ২০২৪

নাগিনীরা চারি দিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিশ্বাস...

শহর ঢাকার বুকে নির্মম ক্ষত। কমপ্লিট শাটডাউনের ষড়যন্ত্র শেষ হলো কি?

বাতাসটাও যেন আগুনে পোড়া। ‘কমপ্লিট শাটডাউনের আগুনে, আহা, দেশটা কী ভয়ংকরভাবে পুড়ল! সরকারি গুরুত্বপূর্ণ অফিসে গাড়িতে আগুন দিয়ে, ভেঙে চুরমার করে মূলত মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ করার নীলনকশা গ্রহণ করা হয়েছিল। টানা কয়েক দিন ধরে চলা তা-বের পর বর্তমানে দৃশ্যমান নৈরাজ্য বন্ধ হয়েছে। প্রাথমিক ব্যর্থতা কাটিয়ে উঠেছে প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

সেনাবাহিনী আছে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে। সাধারণ মানুষ ভয় জয়কে করে জেগে উঠতে শুরু করেছে। বুধবার থেকে খুলে দেওয়া হয়েছে অফিস আদালত। তবে এত কিছুর পরও ষড়যন্ত্র কিন্তু থেমে নেই। প্রত্যাখ্যাতরা নতুন নতুন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হচ্ছে। ‘নাগিনীরা চারি দিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিশ্বাস...।’
গত কয়েকদিনের কোটাবিরোধী আন্দোলন এবং আগে পরের ঘটনাবলি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে এমন আভাসই পাওয়া যাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী একটি চোরা¯্রােত আন্দোলনের শুরুতেই লক্ষ্য করা গিয়েছিল। এই অংশটির মূল টার্গেট ছিল মহান মুক্তিযুদ্ধ। বীর মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে তারা চরম অবমাননাকর বক্তব্য দিয়ে আসছিল। অন্যদিকে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত-শিবিরের অপরাধকে ধর্মের মোড়কে ঢেকে দেওয়ার দুরভিসন্ধি ছিল তাদের বক্তৃতায় স্লোগানে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের একাধিক সূত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে এখন বলছে, জামায়াত-শিবিরের কর্মীরাই  ১৪ জুলাই দেওয়া প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে বিকৃত করে শিক্ষার্থীদের সামনে উপস্থাপন করেছিল।

এ সময় শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ স্বগতোক্তি করতে থাকেন, আমরা তা হলে রাজাকার! কৃত্রিম উত্তেজনা ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয় তখন। উত্তেজনা চরমে পৌঁছলে সুযোগ বুঝে ‘তুমি কে আমি কে/রাজাকার রাজাকার’ স্লোগানটা মুখে তুলে দেওয়া হয় শিক্ষার্থীদের। কাজটি ঠান্ডা মাথায় সুকৌশলে একাত্তরের রাজাকারদের দল জামায়াত-শিবির প্রথম করেছিল বলে সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে। 
আরেকটি সূত্রমতে, কিছু শিক্ষার্থী এই স্লোগানে আপত্তি জানানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সংখ্যায় কম থাকায় তাদের কণ্ঠ বেশি দূর পৌঁছাতে পারেনি। পরবর্তীতে স্লোগানের বিরোধিতা করলে তাদের সন্দেহ করা হতে পারেÑ এই ভয়ে তারা চুপ হয়ে যান।     
সেদিন দেওয়া ‘রাজাকার’ স্লোগানটির ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ হচ্ছে এখনো। বিশ্লেষকরা বলছেন, স্লোগানটির মধ্য দিয়ে মূলত সারাদেশের জামায়াত-শিবির কর্মীদের বার্তা পাঠানো হয়েছিল। একাত্তরের ঘাতকদের প্রজন্মকে স্বরূপে ফেরার প্রস্তুতি গ্রহণ করতে বলা হয়েছিল। রাজাকারদের বাঙালি চিরকাল ঘৃণা করে আসছে। কিন্তু হঠাৎ বিষয়টিকে সহজ করে ফেলা হলে চিহ্নিত শিবির কর্মীরা বিনা বাধায় সামনের সারিতে চলে আসে। বিশেষ তৎপর হয়ে ওঠে ইসলামী ছাত্রী সংস্থার ছদ্মবেশী কর্মীরা। এভাবে মুক্তিযুদ্ধের নানা গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের সাক্ষী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে রাজাকার স্লোগান দিয়ে কলঙ্কিত করা হয়। 
‘বাংলা ব্লকেড’ এবং ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ নামকরণেরও চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম বলছে, দুটি শব্দই উগ্রতা এবং অসহিষ্ণুতার বার্তা দিয়েছে। সংকট সমাধানের চেয়ে তারা চরমপন্থা অবলম্বনের দিকে বেশি ঝুকেছিল। স্বাধীনতাবিরোধীদের রাজনীতির সঙ্গে এই বৈশিষ্ট্য মিলে যায়। বস্তুত বিএনপি জামায়াতের রাজনীতি এবং আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র আন্দোলনের গতি প্রকৃতি নিয়ন্ত্রণ করছিল। পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে তারা বলছেন, কোটাবিরোধীরা আন্দোলনের সময় ‘বায়ান্নর হাতিয়ার/গর্জে উঠুক আরেকবার’ স্লোগান দিয়ে ভাষা আন্দোলনের প্রতি তাদের আনুগত্যের কথা জানিয়েছিলেন। কিন্তু পরে দেখা গেল তারা আন্দোলনের কর্মসূচির নামকরণ করছে ইংরেজিতে। ইংরেজি নামকরণ বিদেশী প্রভাবকেই পরিষ্কার করে।

বাইরে থেকে এই নামগুলো ঠিক করে দেওয়া হয়েছিল বলে মনে করছেন কোনো কোনো বিশ্লেষক। তারা বলছেন, বাাইরের দেশে থেকে বাংলাদেশের বিরোধী রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে যে শক্তি, সে শক্তিটিই এখানে ‘ইনভলভ’ হয়েছিল।  
আরেকটি সূত্রের বিশ্লেষণ : বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটি অংশের বিরুদ্ধে সরাসরি জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে বিভিন্ন সময়। বিত্তবান পরিবারের ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া ছেলেরাই মূলত গুলশানের হলি আর্টিজানে নারকীয় হামলা চালিয়েছিল। ‘বাংলা ব্লকেড’ বা ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ নামকরণ এবং পরবর্তী কর্মকা- তাদের অতীতের জঙ্গী কর্মকা-ের কথা মনে করিয়ে দেয় বলে সূত্রটি মনে করছে।  
আবার গণমাধ্যম বিশ্লেষকদের কারও কারও ব্যাখ্যা হলো কর্মসূচির ইংরেজি নামকরণ করে আন্দোলনের নেপথ্যের শক্তি বিদেশী মিডিয়ার কাছে সহজে পৌঁছতে চেয়েছিল। এটিও তাদের পরিকল্পনার অংশ। তারা এ জায়গায় সফল হয়েছে। এখনো বিশ্বগণমাধ্যমে বহু ভুল তথ্য তুলে ধরা হচ্ছে। দেশে এত ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর পরও হামলাকারীদের পক্ষ নিচ্ছে অনেক গণমাধ্যম। উস্কে দেওয়ার চেষ্টা করছে তাদের। বিদেশে অবস্থানকারী উগ্রবাদী অ্যাক্টিভিস্টরাও ফেসবুকে ইউটিউবে একটার পর একটা গুজব ছড়িয়ে আন্দোলন জাগিয়ে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।    
আন্দোলনের কিছু কিছু সমন্বয়কারীর ভূমিকাও রহস্যজনক। সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে যা আশা করা হয়েছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি তারা পেয়েছেন। এটা দিবালোকের মতো সত্য। সরকারি প্রজ্ঞাপনেও হাইকোর্টের আপিল বিভাগের রায় শতভাগ অনুসরণ করা হয়েছে। এর পরও তারা আন্দোলন কর্মসূচি বাতিলের  স্পষ্ট ঘোষণা দিচ্ছেন না। গোয়েন্দা সূত্র বলছে, এত কিছু ঘটানোর পরও তাদের কেউ কেউ বাইরের পরামর্শকদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছে। সরকার পতনের আন্দোলন নতুন করে জাগিয়ে তোলা যায় কিনা, খতিয়ে দেখছে। 
তারও আগে এই সমন্বয়করা ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ সফল করতে শিক্ষার্থীদের অভিভাবক, মাদ্রাসার ছাত্রসহ সর্বস্তরের মানুষের প্রতি  আহ্বান জানান। কিন্তু এখন অগ্নিসন্ত্রাস এবং দেশবিরোধী তৎপরতার দায় নেবেন না বলছেন আহ্বানকারীরা। অথচ কমপ্লিট শাটডাউনের কর্মসূচি ছাত্ররা দিলেও বাস্তবায়ন করেছে রাজনৈতিক শক্তি।

ফলে দু’ পক্ষের মধ্যে সম্পর্ক ছিলÑ এমনটি ধারণা করা হচ্ছে। উগ্র মৌলবাদী জঙ্গীরা সংগঠিত হওয়ার জন্য বিশেষভাবে শুক্রবারকে বেছে নেয়। কোটাবিরোধীরা এটি জেনেও শুক্রবারে কেন কর্মসূচি রেখেছিলেন তাও বড় প্রশ্ন হয়ে ধরা দিয়েছে। তাদের কর্মসূচির মধ্যেই নরসিংদী কারাগার লুট করে বেশ কয়েকজন জঙ্গিকে বের করে নিয়ে যাওয়া হয়। এরই বা কী ব্যাখ্যা? জানতে চাইছে সচেতন মহল। 
ছাত্রাবাসের ছাদ থেকে শিক্ষার্থীদের ছুড়ে ফেলে দেওয়া, মধ্যযুগীয় কায়দায় রগ কেটে হত্যা করার ভিডিও ফুটেজও নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, রগ কেটে ছাত্র হত্যার এমন নিষ্ঠুর নজির শিবির-ই স্থাপন করেছিল বাংলাদেশে। সেটিই আবার দেখা গেছে কোটাবিরোধী আন্দোলনে। এখানেই শেষ নয় ‘কোমলমতি’ বলা হলেও কোনো কোনো ছাত্রছাত্রী সরাসরি বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত হয়েছেন।

উগ্র এই কিশোর গ্যাংয়ের নিষ্ঠুর আক্রমণের অনেক ভিডিও ফুটেজ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে এসেছে। এগুলোও পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।  
এভাবে সব বিষয় নিয়েই কাজ করা হচ্ছে এখন। এর পরও  সবাইকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, সাধারণ শিক্ষার্থীদের এ ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে। নাগিনীদের বিষাক্ত ছোবল থেকে নিজেকে এবং দেশকে রক্ষা করার দায়িত্ব তাদেরই। 
কিন্তু আসলে কতটা সজাগ প্রজন্ম? ‘দায় নেওয়ার আগে তাই/ডাক দিয়ে যাই/দানবের সঙ্গে যারা সংগ্রামের তরে/প্রস্তুত হতেছে ঘরে ঘরে...।’ ঘরে ঘরে প্রস্তুত হচ্ছেন তো তারা?

×