কাঁসার তৈরি জিনিসপত্র
আমের জেলা হিসেবে পরিচিত চাঁপাইনবাবগঞ্জে কাঁসাশিল্পের এক সময় সুদিন থাকলেও এখন ধুঁকে ধুঁকে টিকে আছে। বর্তমান প্রজন্মের কয়েকজন বাপ-দাদার পারিবারিক এ ব্যবসা ধরে রাখলেও একটা বড় অংশই ছেড়ে গেছেন। অনেকেই নতুন করে আর এ পেশায় জড়াতে চাচ্ছেন না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কাঁসা-পিতলের কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় ও দক্ষ কারিগরের অভাবে হারাতে বসেছে শিল্পটি। তবে সরকারি সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এ শিল্পের সম্ভাবনার দুয়ার আবার খুলবে বলে আশা তাদের।
তিন দশক আগেও চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের রামকৃষ্টপুর, আজাইপুর, শংকরবাটি, মাঝপড়া ও বটতলাহাট এলাকার ঘরে-ঘরে কাঁসা-পিতলের কাজ হতো। তখন ছোট-বড় মিলিয়ে অন্তত পাঁচশ কাঁসা-পিতলের কারখানায় অন্তত দশ হাজার কারিগর কাজ করতেন। এক সময় এসব এলাকার মানুষের ঘুম ভাঙত বাসন তৈরির টুং-টাং শব্দে, সেই কর্মযজ্ঞ চলত ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। কারিগরদের পটু হাতে তৈরি হতো কাঁসার থালা-বাসন, কলসি, গ্লাস, জগ, চামচ ও বালতিসহ নানা ধরনের তৈজসপত্র। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেইসব দিন অতীত হয়েছে। বর্তমানে চাঁপাইনবাবগঞ্জে কাঁসা-পিতল শিল্পে প্রায় পাঁচশ কারিগর কাজ করছেন, আর কারখানা বিলুপ্ত হতে হতে ত্রিশে গিয়ে ঠেকেছে।
শহরের অদূরে শান্তি মোড়ের পাশে একটি কাঁসা-পিতলের কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, শ্রমিকরা থালা-বাসন তৈরি করছেন। ওমর ফারুকের মালিকানাধীন ওই কারখানায় শ্রমিক ১৮ জন। ষাটোর্ধ্ব ওমর দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে কাঁসা শিল্পের সঙ্গে জড়িত। এই পেশায় হাতেখড়ি হয়েছিল বাপ-দাদার কাছে। তিনি বলেন, কাঁসা-পিতলের কারিগর, মহাজন ও ব্যবসায়ীকে বলা হয় ‘কাঁসারি’। ‘কাঁসারি পাড়ায়’ আগে পাঁচশ’র বেশি কারখানা ছিল। এসব কারখানায় কাজ করত প্রায় হাজার দশেক মানুষ।
এ শিল্পের ‘ভালো সময়ের’ কথা স্মরণ করে ওমর ফারুক বলেন, একটা সময় সারাদিনই টুং-টাং শব্দে কাঁসা-পিতলের বাসন বানানোর কাজ চলত। এখন আর সেই দিন নাই। দিন-দিন কাঁচামালের দাম বাড়ায় আর প্লাস্টিক ও মেলামাইনের কম দামের বাহারি পণ্যের ভিড়ে এ শিল্পের মন্দাভাব দেখা দিয়েছে। তাই অনেক মালিক ও শ্রমিক মুখ ফিরিয়ে অন্য পেশায় জড়িয়ে পড়েছে। তিনি আরও বলেন, এখন হাতেগোনা ৩০-৩৫টি কারখানা আর পাঁচশ’র মতো কারিগর কাঁসা শিল্পের সঙ্গে রয়েছে। তবে মানুষ আগের মতোই কাঁসা-পিতল ব্যবহার করছে; চাহিদাও রয়েছে এ শিল্পের।
কিন্তু ‘দক্ষ কারিগরের অভাবে’ উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে না। ফারুকের কারখানার কারিগর আলমগীর হোসেন ৪৫ বছর ধরে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত। এক সময় এ কাজের খুব নামডাক ছিল। সেই থেকে ভালোবেসে শুরু করে আর ছেড়ে যেতে পারেননি। আলমগীর বলেন, নতুন প্রজন্ম এখন আর এই পেশায় আসতে চায় না। আমরা আগে থালা-বাসন, বাটি, গ্লাস, জগ, গামলা, বাচ্চাদের দুধ খাওয়ানোর ঝিনুক, তেলের খুরি, চামচ, হাতা, ছেঁচকি ও বালতি তৈরি করতাম। এখন দক্ষ কারিগর নেই, তাই এর মধ্যে অনেক জিনিস বানানো আর সম্ভব হয় না।
শরিফুল ইসলাম নামের আরেক দোকানদার বলেন, কাঁসা-পিতলের কাঁচামালের দাম যেহেতু বর্তমান বাজারে বেশি, তাই আমরা পুরনো কাঁসা-পিতল গলিয়ে নতুন তৈজসপত্র তৈরি করে বিক্রি করছি। এতে কিছুটা হলেও ‘কমদামে’ কিনতে পারছেন গ্রাহকরা। চাঁপাইনবাবগঞ্জে বিয়ে-শাদি, খতনা, স্বাদ খাওয়ানি ও অন্নপ্রাশন অনুষ্ঠানে কাঁসার থালা, বাটি, গ্লাস, জগ ও কলসি দান-দক্ষিণা ও উপহার দেওয়ার প্রচলন আছে। এতে আমাদের বেচাবিক্রিও ভালো? হয়। এখনো অনেকেই কাঁসা পিতলের তৈরি জিনিসপত্র সংসারের নিত্যদিনের ব্যবহারের জন্য কিনতে আসেন।
স্থানীয় লোকসংস্কৃতি গবেষক শহীদ সার?ওয়ার আলো বলেন, মুঘল আমলে কাঁসা শিল্পের প্রসার ঘটে এবং বাংলার নবাবী আমলে এ শিল্প চূড়ান্ত উৎকর্ষ লাভ করে। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মতো চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের পাশে বর্তমান পৌর এলাকার বেশকিছু গ্রামে অনেকগুলো কাঁসা শিল্পের কারখানা ছিল। এসব গ্রামের প্রায় সকল পরিবার এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত ছিল। স্থানীয় ভাষায় এ পেশাকে কাঁসারি বলে।
কাঁসারিরা তৈরি করা মালামাল ঘোড়ায় করে দূর-দূরান্তের গ্রামেগঞ্জে ফেরি করতেন। তবে বিভিন্ন বইপত্রে এদের ‘কংস বণিক’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে জানিয়ে শহীদ সার?ওয়ার আলো বলেন, স্বাধীনতার আগে এ শিল্পটি ব্যাপক দাপটের সঙ্গে টিকে ছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে এর দাপট কিছুটা কমে যায়। তবে এখনো এই নন্দন শিল্পের বিভিন্ন ক্রেস্ট, সীল, মনুমেন্ট, স্মারক, দেওয়াল কর্ম সম্মানিত জনদের উপহার দেওয়ার চল চালু আছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ কাঁসা বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সোহেল রানা বলেন, কাঁসা? শিল্পের সোনালি অতীত ছিল। দেশীয় শিল্পটি টিকিয়ে রাখতে সরকারি বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। আমদানি-নির্ভর এ শিল্পের কাঁচামাল সুলভ মূল্যে প্রাপ্তির নিশ্চয়তায় আমদানি শুল্কমুক্ত করে দেওয়া দরকার। পাশাপাশি সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করা দরকার। তিনি বলেন, এখনো বাজারে কাঁসা-পিতলের বেশ ভালো চাহিদা রয়েছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এ শিল্পের সম্ভাবনার দ্বার আবারও খুলবে বলে আশা করছি।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তাসমিনা বলেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী কাঁসা শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সবধরনের সহায়তা করা হবে। কাঁসা শিল্পের সবাই মিলে চাইলে আমরা একটি কাঁসা প্রদর্শনী মেলার আয়োজন করব, যাতে এ শিল্প সম্পর্কে সবাই জানতে পারে। বর্তমান সরকার শিল্প- বান্ধব সরকার। আমরা কাঁসা শিল্পের বিভিন্ন প্রেক্ষাপট ঊর্ধ্বতন মহলে তুলে ধরব।