ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৮ অক্টোবর ২০২৪, ৩ কার্তিক ১৪৩১

ঐতিহ্যের ভাসমান হাট

জলের ওপর ঢেউয়ের তালে ধান-চালের বিকিকিনি

খোকন আহম্মেদ হীরা

প্রকাশিত: ২৩:২১, ১৫ জুলাই ২০২৪

জলের ওপর ঢেউয়ের তালে ধান-চালের বিকিকিনি

বরিশালে দু’শ’ বছরের ঐতিহ্য জলের ওপর ধান-চালের ভাসমান হাট

ঘন মেঘে ছেয়ে আছে আকাশ। নতুন রূপে যেন সেজেছে সন্ধ্যা নদী। ছোট ছোট ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে তীরে। একে একে নৌযান ভিড়ছে পন্টুনে। কোনোটি ইঞ্জিনচালিত, কোনোটি চলছে বৈঠায়। কেউ এসেছেন গলুইভর্তি চাল নিয়ে, কেউ ফিরছেন গলুই ভরে।
সকাল ৮টার মধ্যেই সরগরম হয়ে ওঠে সন্ধ্যার বুক। ক্রেতা-বিক্রেতার হাঁকডাক, পণ্য বুঝে নেওয়ার ব্যস্ততা আর দর কষাকষিতে প্রাণবন্ত পুরো অঞ্চল। ভাসতে ভাসতে ক্রেতা-বিক্রেতা আসেন এখানে। যে কারণে এর নাম হয়েছে ভাসমান চালের হাট। চালের হাটের ঠিক ওপারে বসে ধানের হাট। ভোর থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত চলে চালের হাট। এর পর জমে ধানের হাট। চলে দুপুর ২টা পর্যন্ত। এমন অভূতপূর্ব চিত্র বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার ধান ও চালের ভাসমান হাটে মেলে।
এ হাটে সব ধরনের লেনদেন নগদে হয় বলে অনেক ব্যবসায়ীর কাছে এটি ‘নগদের হাট’ নামেও পরিচিত। ঠিক কত সালে প্রথম জমেছিল এ হাট- তার সঠিক তথ্য জানা না গেলেও স্থানীয়দের ধারণা, দুইশ’ বছরের বেশি সময় ধরে এখানে বসছে ভাসমান এ হাট। আর বংশ পরম্পরায় তা টিকিয়ে রেখেছেন এখানকার কারবারিরা। প্রতিদিন প্রায় দেড় হাজার মণ ধান ও চাল বিকিকিনি হয়। সরেজমিনে হাট দেখতে দেশ-বিদেশের পর্যটকরা ছুটে আসেন এলাকায়।

বরিশাল জেলা সদর থেকে ১৮ কিলোমিটার পশ্চিমের উপজেলা বানারীপাড়া। সদরের বুক চিরে বয়ে যাওয়া সন্ধ্যা নদীর তীরে সপ্তাহের প্রতি শনি ও মঙ্গলবার জমে এই ভাসমান হাট। দুদিন হাটবার হলেও ক্রেতা-বিক্রেতা বাড়লে রবি ও বুধবারও তা বর্ধিত করা হয়। স্থানীয়রা বর্ধিত সময়কে বলেন ‘গালা’।
দক্ষিণের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ধান কিনে এ হাটে বিক্রি করা হয়। এখান থেকে তা কিনে কুটিয়ালরা। নিজস্ব পদ্ধতিতে চাল তৈরি করে আবার এ হাটেই বিক্রি করেন। এখানে কোনো আড়তদার কিংবা খাজনা আদায়ের ব্যবস্থা নেই। এমনকি বাকিতেও বিক্রি হয় না পণ্য। যে কারণে মধ্যস্বত্বভোগীদের কোনো দৌরাত্ম্য নেই এ হাটে। বিক্রেতারা নৌযানে পণ্য নিয়ে এসে হাটের সীমানায় নোঙর করেন। ক্রেতারা এসে পছন্দমতো প্রয়োজনীয় ধান ও চাল নগদ টাকায় কিনে নিয়ে যান।
কারবারি মিজানুর রহমান বলেন, দাদা ও বাবা ধান-চালের ব্যবসা করতেন। আমি ১৮ বছর ধরে এ ব্যবসায় আছি। বানারীপাড়ায় মূলত কুটিয়ালদের ওপর নির্ভর করে ব্যবসা টিকে আছে। তবে, বিভিন্ন স্থানে অটোরাইস মিল হওয়ায় কুটিয়ালের সংখ্যা কমে গেছে। তারপরও এ অঞ্চলের ব্যবসার কেন্দ্র এখনো বানারীপাড়ার এই ভাসমান হাট। আগের বছরগুলোর তুলায় এবার ব্যবসা ভালো হচ্ছে। পাইকারি ব্যবসায়ী আব্দুল হাই জানান, প্রতিহাটে এক থেকে দেড় হাজার মণ চাল বেচাকেনা হয়।

গোপালগঞ্জ থেকে ধান নিয়ে আসা ব্যবসায়ী আব্দুর রহমান বলেন, ২০ বছরের বেশি সময় ধরে এখানে ব্যবসা করছি। বানারীপাড়ার ধান ও চালের ভাসমান হাট দক্ষিণাঞ্চলের ঐতিহ্যের একটি অংশ। তিনি আরও বলেন, নৌকায় বসেই পরিমাপ করে ক্রেতার নৌকায় পণ্য তুলে দেওয়া হয়। 
গবেষক আনিসুর রহমান খান স্বপন বলেন, বানারীপাড়ার ধান ও চালের ভাসমান হাট দক্ষিণাঞ্চলের ঐতিহ্যের একটি অংশ। এ অঞ্চলে বিশেষ করে নদী এলাকার ব্যবসা ও বিনিয়োগের কেন্দ্রবিন্দু বানারীপাড়ার ভাসমান হাট। আমাদের নদী ও অর্থনীতি এবং নদীকেন্দ্রিক ব্যবসার প্রসারে বানারীপাড়ার হাটটি উদাহরণ হতে পারে। এ হাটের সঙ্গে কৃষক, ভোক্তা, পাইকার ও কুটিয়ালরা জড়িত। ঐতিহ্যবাহী এ ব্যবসায়িক কেন্দ্রকে প্রসারিত করতে স্থানীয় প্রশাসনের এগিয়ে আসা উচিত।
বানারীপাড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার অন্তরা হালদার বলেন, ধান ও চালের ভাসমান হাট শুধু স্থানীয় অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করেনি, যুগ যুগ ধরে এর সুখ্যাতি ছড়িয়েছে দেশ ও দেশের বাইরে। হাটটি যেহেতু নদীতে মেলে, এজন্য খাজনা মওকুফ করা হয়েছে। ফলে এ হাটে ব্যবসা করতে ক্রেতা ও বিক্রেতা সবাই বেশ আগ্রহী। তিনি আরও বলেনÑ আমি মনে করি, নদী যতদিন থাকবে নদীকেন্দ্রিক এমন বাজার এবং বাজারকেন্দ্রিক অর্থনীতিও টিকে থাকবে।

×