ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

aiub
aiub

মহাপরিকল্পনা নেওয়া হলেও নিরসন হয়নি সমস্যার

১০৭ বছরেও জলাবদ্ধতা থেকে রাজধানীবাসীর মুক্তি মেলেনি

ইবরাহীম মাহমুদ আকাশ

প্রকাশিত: ২৩:২১, ১৩ জুলাই ২০২৪

১০৭ বছরেও জলাবদ্ধতা থেকে রাজধানীবাসীর মুক্তি মেলেনি

রাজধানীতে শুক্রবার কয়েক ঘণ্টার বৃষ্টিতে পানি জমে যায় বুয়েটের আবাসিক এলাকায়

ঢাকা সমতল এবং বৃষ্টিপ্রবণ একটি শহর। জলাবদ্ধতা থেকে ঢাকাকে রক্ষার জন্য ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ সরকার একটি পরিকল্পনা করেছিল। নগর-পরিকল্পনাবিদ স্যার প্যাট্রিক গেডিস এই পরিকল্পনাটি তৈরি করেছিলেন। এর নাম ছিল ‘ঢাকা টাউন প্ল্যান’। ওই পরিকল্পনায় উল্লেখ করা হয়, ‘ঢাকার চারপাশে চারটি নদী ঘিরে আছে। এ ছাড়া ঢাকায় ৫০টির মতো প্রাকৃতিক খাল রয়েছে। এই খালগুলো দিয়ে বৃষ্টির পানি প্রবাহিত হয়ে নদীতে পড়বে।’

কিন্তু ১০৭ বছর পরও জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ থেকে মুক্ত হতে পারেননি রাজধানীবাসী। ঢাকার খাল ও নদীকে কেন্দ্র করে একাধিক মহাপরিকল্পনা নেওয়া হলেও জলাবদ্ধতা নিরসন হয়নি। গত শুক্রবার তিন ঘণ্টার ভারি বৃষ্টিতে ডুবে যায় ঢাকার বেশির ভাগ এলাকা। কোথাও হাঁটু পানি, কোথাও কোমর পানির নিচে ছিল নগরীর বিভিন্ন সড়ক ও গলিপথ। কোনো কোনো এলাকায় বাসা-বাড়ির নিচতলা এবং দোকান-পাটে বৃষ্টির পানি ঢুকে পড়ে। এতে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয় নগরবাসীকে।
অথচ ঢাকার খাল ও ড্রেনেজ ব্যবস্থা সংস্কারের জন্য গত চার বছরে প্রায় ৭০০ কোটি টাকা খরচ করেছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। তবুও জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ থেকে মুক্তি দিতে পারেনি ঢাকাবাসীকে। এর মূল সমস্যা মনিটরিং ও রক্ষণাবেক্ষণ না করা। বিশেষ করে যথাযথভাবে হয়নি ড্রেনেজ, খাল ও বক্স কালভার্ট পরিষ্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ। তাই পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জ্যরে কারণে বর্জ্যরে নালা এবং ড্রেনের মুখ বন্ধ হয়ে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয় বলে বিশেষজ্ঞরা জানান।
তাদের অভিমত, জলাবদ্ধতা নিরসনে ইতোমধ্যে যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে, সেগুলোও সুপরিকল্পিতভাবে হয়নি। বিশেষ করে যথাযথভাবে হয়নি ড্রেনেজ, খাল ও বক্স কালভার্ট পরিষ্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ। আর বিভিন্ন কার্যক্রম সম্পাদনে সিটি করপোরেশন এবং সরকারের অন্য সংস্থার মধ্যে তেমন সমন্বয়ও থাকে না। ফলে জলাবদ্ধতার জন্য একে অন্যকে দায়ী করেই বছর পার করছে সংস্থাগুলো।

তবে সুযোগ পেলেই মোটা অঙ্কের একাধিক প্রকল্প নেওয়ার ব্যাপারে যথেষ্ট আগ্রহী সংশ্লিষ্টরা। সমস্যার সমাধান হচ্ছে কি না, সেদিকে নজর নেই তাদের। বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়ে সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণের ওপর তাগিদ দিয়ে প্রতিটি কাজের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।
এ বিষয়ে বিআইপি’র সভাপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান জনকণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা নিজেরা নদী ও খালগুলো গলা টিপে হত্যা করেছি। প্রাকৃতিকভাবে আমাদের ড্রেনেজ ব্যবস্থা ছিল খালগুলো। তা আমরা ভরাট করেছি বক্স কালভার্ট বানিয়ে। এখন আবার খাল উদ্ধার নামে নতুন নতুন প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। শুধু প্রকল্পের মাধ্যমে টাকা অংক বাড়ালেই জলাবদ্ধতা নিরসন হবে না।

খাল সংস্কার, ড্রেনেজ ও পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন কাজ করার পর তা মনিটরিং ও রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। কিন্তু সিটি করপোরেশন কাজ শেষ হওয়ার পর তা আর রক্ষণাবেক্ষণ না করার কারণে খাল ও ড্রেনের মুখ আবার ভরাট হয়ে যায়।’ তাই কাজ বাস্তবায়নের পর রক্ষণাবেক্ষণ ও জবাবদিহিতা থাকা দরকার বলে মনে করেন তিনি।
চার ঘণ্টার ভারি বৃষ্টিতে ঢাকায় জলাবদ্ধতা ॥ গত শুক্রবার সকাল ছয়টা থেকে ১০টা পর্যন্ত একটানা বৃষ্টিতে ঢাকার বিভিন্ন সড়কে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, শুক্রবার সকাল সাড়ে ছয়টা থেকে সাড়ে ৯টা পর্যন্ত তিন ঘণ্টায় ঢাকায় বৃষ্টি হয়েছে ৬০ মিলিমিটার। এরপরও অবশ্য হয়েছে, তবে তা ভারি বৃষ্টি ছিল না। কিন্তু সকালের বৃষ্টিতেই ধানমন্ডি, গ্রিন রোড, নিউমার্কেট, মতিঝিল, আরামবাগ, কাজীপাড়া, রোকেয়া সরণি, দক্ষিণখান, কল্যাণপুর, বিজয় সরণি, মালিবাগ, মৌচাকসহ রাজধানীর বেশিরভাগ এলাকার সড়ক ডুবে যায়। অনেক বাসাবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকেছে। কোথাও পানি ছিল হাঁটু সমান, কোথাও কোমর সমান।

তবে সরকারি ছুটির দিন হওয়ায় শুক্রবার সড়কে যানবাহন ও মানুষের চাপ কম ছিল। কিন্তু ডুবে যাওয়া সড়কের বিভিন্ন অংশে বিকল হয়ে পড়ে ছিল সিএনজিচালিত অটোরিক্সা, বাস ও প্রাইভেটকার। যে কারণে দুপুর ১২টার দিকে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগ ঢাকাবাসীকে গন্তব্যে যাওয়ার জন্য হাতে সময় নিয়ে বের হওয়ার অনুরোধ জানায়। গণমাধ্যমে প্রচারের জন্য ডিএমপির বার্তায় বলা হয়, প্রচ- বৃষ্টিতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ডুবে গিয়ে রাস্তায় অনেক গাড়ি বিকল হয়ে যানজটের সৃষ্টি করেছে।

পুলিশ তাদের বার্তায় শুক্রবার দুপুরে বৃষ্টিতে ডুবে যাওয়া রাজধানীর ২২টি এলাকার কথা উল্লেখ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে ফকিরাপুল, নয়াপল্টন, বায়তুল মোকাররম, শান্তিনগর, মালিবাগ মোড়, আরামবাগ, প্রগতি সরণি, নিউমার্কেট, ধানমন্ডির রাপা প্লাজা, বংশাল, মিরপুর রোকেয়া সরণি, দয়াগঞ্জ মোড়, সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল, নিমতলী, টয়েনবি সার্কুলার রোড, ধানমন্ডি ২৭, এলিফ্যান্ট রোড, মৎস্য ভবন, কাওরান বাজার, বিজয় সরণি, ঢাকা গেট, ভিআইপি রোড ও মিরপুর মাজার রোড। তবে প্রকৃতপক্ষে তখন রাজধানীতে ডুবে যাওয়ার এলাকার সংখ্যা আরও অনেক বেশি ছিল।

সরেজমিনে রাজধানীর মানিকনগর থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ঘুরে দেখা গেছে, শুক্রবার সন্ধ্যার পরও মানিকনগর থেকে টিটিপাড়া পর্যন্ত সড়কটি পানিতে ডুবে ছিল। এ ছাড়া এই সড়কের বিভিন্ন স্থানে বড় বড় গর্তের পানি জমে থাকার কারণে যানবাহন চলাচলে ব্যাহত হয়েছে। রাজধানীর গোলাপবাগ থেকে কমলাপুর পর্যন্ত মাত্র ৩-৫ মিনিটের পথ। জলাবদ্ধতা ও খানা-খন্দের কারণে এই সড়কটি অতিক্রম করতে এক-দেড় ঘণ্টা সময় লেগেছে বলে যাত্রীরা জানান।
একই অবস্থা রাজধানীর অন্যান্য এলাকারও। রাজধানীর মধ্যবাড্ডা ও মেরুল বাড্ডা এলাকায় সরেজমিনে দেখা গেছে, প্রতিটি অলি-গলিসহ মূল সড়কেও হাঁটু পরিমাণ পানি জমেছিল। শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় রাস্তায় তুলনামূলক মানুষজন কম ছিল। যাত্রীর সংখ্যা কম থাকায় অধিকাংশ সড়কেই যানবাহনের কোনো চাপ দেখা যায়নি। তবে বৃষ্টিতে বেশি বিপাকে পড়েছেন ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেওয়া চাকরিপ্রার্থীরা।

শুক্রবার সকাল ৯টা থেকে পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা থাকলেও বৃষ্টির কারণে অনেকেই যথাসময়ে বাসা থেকে বের হতে পারেননি। কেউ কেউ বের হলেও সড়কে পর্যাপ্ত যানবাহন না থাকায় বিপাকে পড়ছেন। এই সুযোগে সিএনজি-রিক্সাচালকরা ভাড়া দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছেন। বাধ্য হয়ে বেশি ভাড়ায় গন্তব্যে যেতে হচ্ছে যাত্রীদের।
রাজধানীর তিতুমীর কলেজ কেন্দ্রে নিবন্ধন পরীক্ষার সিট পড়ে তানজিয়া শারমিন শোভার। বৃষ্টির মধ্যে আটটার দিকে বাসা থেকে বের হন তিনি। তিনি জানান, শুক্রবার সকাল ৭টা থেকে প্রস্তুতি নিয়ে বসে আছি, এত বৃষ্টিতে বের হওয়ার কোনো উপায় দেখছিলাম না। অবশেষে বৃষ্টির মধ্যেই বের হতে হয়েছে। বাসা থেকে মূল সড়ক পর্যন্ত কোনো রিক্সা নেই, তাই হাঁটু পানি ডিঙিয়ে হেঁটে আসতে হয়েছে।
জলাবদ্ধতা নিরসনে ৩৫০ কোটি টাকা খরচ ডিএসসিসির ॥ রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনে এ পর্যন্ত প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা খরচ করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। খাল সংস্কার, ড্রেনেজ ও পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রকল্পে এ অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। কিন্তু জলাবদ্ধতা দুর্ভোগ থেকে এখনো নগরবাসীকে পুরোপুরি মুক্ত করতে পারেনি। ভারি বৃষ্টিতে ডুবে যায় ঢাকার বিভিন্ন সড়ক।

তবে ঢাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয় এমন ১৩৬টি পয়েন্টের মধ্যে ১০৪টি পয়েন্টের কাজ শেষ হয়েছে বলে জানান ডিএসসিসির কর্মকর্তারা। খালগুলো সংস্কার করে পানি প্রবাহ সৃষ্টি হলে ঢাকার জলাবদ্ধতা পুরোপুরি নিরসন করা সম্ভব্য হবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা কর্মকর্তারা।
এ বিষয়ে ডিএসসিসির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (পরিবেশ, জলবায়ু ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সার্কেল) মো. খায়রুল বাকের জনকণ্ঠকে বলেন, ‘ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে কোনো প্রকল্প নেই। দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নিজস্ব অর্থায়নের খাল ও ড্রেনেজ সংস্কার করে জলাবদ্ধতা নিরসন করা হচ্ছে। এ পর্যন্ত দেড়শ’ থেকে দুইশ’ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। এর মধ্যে কিছু খরচ হয়েছে আরও কিছু বাকি আছে। ঢাকায় জলাবদ্ধতার ১৩৬ পয়েন্টের মধ্যে ১০৪ পয়েন্টের কাজ শেষ হয়েছে।

এর মধ্যে অনেক স্থানে ড্রেনের ময়লা পরিষ্কার করেই জলাবদ্ধতা নিরসন করা হয়েছে। তবে এটা একটি চলামান প্রক্রিয়া। এক পয়েন্টের কাজ শেষ হলে আবার নতুন পয়েন্ট যুক্ত হয়।’ তাই ঢাকার খালগুলো সচল না হলে জলাবদ্ধতা পুরোপুরি নিরসন করা সম্ভব্য নয় বলে জানান তিনি। 
তবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন চারটি খালের সৌন্দর্যবর্ধনে ২০২২ সালের অক্টোবর মাসে ‘খাল পুনরুদ্ধার, সংস্কার ও নান্দনিক পরিবেশ সৃষ্টি’ শীর্ষক প্রকল্প অনুমোদন পায়। ৮৯৮ কোটি টাকার এই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ২০২৭ সালের জুনে। এই প্রকল্পের কাজ শেষ হলে ঢাকা দক্ষিণের জলাবদ্ধতা অনেকটাই নিরসন হবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা বলছেন, সর্বোচ্চ ৫৫ মিলিমিটার বৃষ্টি হলে তা দ্রুত সময়ে নিষ্কাশন করার সক্ষমতা তাদের রয়েছে। এর বেশি বৃষ্টি হলে তারা নিরুপায়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংস্থার একজন প্রকৌশলী বলেন, বিগত সময়ে তারা কেবল খাল থেকে ভাসমান বর্জ্য অপসারণ করেছেন। তাই কাক্সিক্ষত ফল পাচ্ছেন না। তবে বিভিন্ন সময় খাল ও ড্রেনেজ সংস্কার বাবদ প্রায় সাড়ে ৩০০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান।

×