ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

aiub
aiub

রুপালি শস্যের খোঁজে

মেজবাহউদ্দিন মাননু

প্রকাশিত: ০১:৫৪, ১২ জুলাই ২০২৪

রুপালি শস্যের খোঁজে

নদীতে ইলিশের খোঁজে স্থানীয় জেলেরা

কলাপাড়া উপকূলের দ্বিতীয় বৃহত্তম জেলে পেশায় এখন চরম দুর্দিন চলছে। এক ধরনের অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে পেশার ভবিষ্যৎ নিয়ে। সাগর-নদীতে মাছের আকাল, জলবায়ুর দ্রুত পরিবর্তনজনিত নেতিবাচক প্রভাব, সাগর-নদীতে বার বার ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের হানায় মাছ ধরার অনুকূল পরিবেশ না থাকাসহ বিভিন্ন ধরনের সমস্যায় এখন জেলে পেশায় মহাসংকট চলছে। অন্তত ২০ হাজার জেলে পরিবার, প্রায় তিন শ’ ট্রলার মালিক ও অন্তত দুই শ’ আড়তমালিকসহ মাছ বেচা-কেনার সঙ্গে জড়িত আরও প্রায় দশ হাজার পরিবারের জীবন-জীবিকায় এখন চরম টানাপোড়েন চলছে।

আর এ কারণে কোটি কোটি টাকার লোকসানের বোঝায় কাহিল হয়ে পড়ছেন ট্রলার মালিকসহ শত শত জেলে পরিবার। অভাব-অনটনে দিন পার করছেন তারা। বহু পরিবার পেশা থেকে ছিটকে পড়েছেন। শ্রমজীবী কামলায় পরিণত হয়েছেন। কেউ কেউ ধার-দেনা শোধ করতে না পেরে এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন। অপরদিকে কোটি টাকার লগ্নি করে আসা কাঠের ট্রলিংবোট মালিকরা এক ধরনের সূক্ষ্ম ফাঁসের জাল দিয়ে সাগরের ছোট ছোট ইলিশের পোনাসহ সব ধরনের মাছ শিকার করায় দ্রুত মাছের বংশ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে এই ট্রলিংয়ের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে।

সরেজমিনে খোঁজ-খবর নিয়ে জেলেদের এমন দুরাবস্থার তথ্য জানা গেছে।
সোমবার দুপুরে দেখা গেছে, কলাপাড়া উপজেলার সবচেয়ে বড় মৎস্য বন্দর মহীপুর-আলীপুরের মৎস্য আড়তগুলো এখন নেই কোনো প্রাণচাঞ্চল্য। জনমানবশূন্য হয়ে আছে। ৬৫ দিনের অবরোধের কারণে কোথাও কোনো মাছ বেচা-কেনার দৃশ্য চোখে পড়েনি। জেলে ও আড়তমালিকরা জানান, আন্ধারমানিক, খাপড়াভাঙ্গা ও রাবনাবাদ নদীর আহরিত মাছও জেলেরা জেল-জরিমানার ভয়ে এখানে বিক্রি করতে আসেন না। কিছুদিন আগে অসাধু কিছু বোট মালিক প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে আহরিত মাছ কেনাবেচা করায় কলাপাড়া উপজেলা প্রশাসনের নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। চালানো হয় ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান। বর্তমানে খাপড়াভাঙ্গা নদীর দুই পাড়ের আড়তগুলো খাঁ খাঁ করছে। 
শতাধিক ফিশিং বোট দুই পাড়ে ভেড়ানো রয়েছে। কোনো কোনো জেলে ছেড়া জাল সেলাই করছেন। কেউ কেউ আবার কয়েকদিন পরে সাগরে মাছ শিকারে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তবে নিষেধাজ্ঞার কারণে এ পেশায় থাকা জেলেরা এখন দুর্বিষহ সময় পার করছেন। তারপরও সাগরে কাক্সিক্ষত মাছের দেখা অবরোধের পরে মিলবে কি না তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করলেন অধিকাংশ জেলে, ট্রলারমালিক। সকলের মধ্যে এক ধরনের অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
কলাপাড়া উপজেলা ট্রলার মাঝি সমিতির সভাপতি নুরু মিয়া জানান, জেলেদের অবস্থা খুব খারাপ। মাছের এমনিতেই এ বছর আকাল চলছে। তার ওপরে অবরোধ চলছে। এ ছাড়া মৌসুমের অধিকাংশ সময় সাগরর প্রচ- উত্তাল থাকছে। ৩০ বছর এ পেশায় থাকা নুরু মাঝি নিজেও এখন শঙ্কায় আছেন। জানালেন তিনি, মাছের আশায় সাগরে গিয়ে প্রতিবারে ১০-২০ লাখ টাকা খরচ করে ফিরতে হয়েছে খালি হাতে। এ বছর অবরোধের পরেও মাছ না পাওয়ার আশঙ্কায় রয়েছেন তিনি। জানালেন, কলাইয়া পাড়া গ্রামের ইসমাইল মাঝি লোকসানের ধকলে জেলে পেশা ছেড়ে এখন কৃষিকাজ করছেন।

পাশাপাশি গবাদিপশু পালন করে কোনো মতে জীবিকা নির্বাহ করছেন। ৫-৬টি ট্রলারের মালিক ছিলেন কাদের মাঝি। খাজুরা গ্রামে বাড়ি, মাছের আকালে লোকসানের কারণে এখন মানুষটি নিঃস্ব হয়ে গেছেন। একটি ট্রলারও নেই। এখন ক্ষুদে দোকানি। দেনার চিন্তায় মানুষটি দিশেহারা। তারপরও নুরু মাঝির সোজা-সাপটা কথা ট্রলিংয়ের মাধ্যমে ছোট ছোট সকল মাছের পোনা মারা বন্ধ করতে হবে। নইলে কোনো অবরোধ কিংবা নিষেধাজ্ঞায় কাজ হবে না। সাগরে মাছের মজুদ শূন্য হয়ে যাবে। এমনিতেই সাগরে যা আছে তা কোটিপতি ট্রলিংয়ের মালিকরা ধরে নিয়ে যায়। প্রকৃত ট্রলারের জেলেরা কোনো মাছ পায় না। তার তথ্যমতে কলাপাড়া উপজেলায় অন্তত কাঠের তৈরি ৪০টি ট্রলিং বোট রয়েছে। যার মধ্যে ১৫টিতে মাছ শিকার চলছে।
মহিপুর মৎস্য বন্দরের আড়তমালিক সমিতির নেতা মো. ফজলু গাজী জানান, মহিপুরে অন্তত ৯৫টি মাছ কেনা-বেচার আড়ত রয়েছে। স্থানীয় ট্রলার মালিক রয়েছে দেড় শ’র মতো। এ ছাড়ার বাগেরহাট, ভোলা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, কুতুবদিয়া, মহেশখালী এলাকার সহস্রাধিক ট্রলারের জেলেরা এই মোকামে সাগরের আহরিত ইলিশসহ বিভিন্ন সামুদ্রিক মাছ বিক্রি করে থাকে। গত তিন বছর ধরে মাছের আমদানি ভয়াবহভাবে কমে গেছে বলে জানালেন ফজলু গাজী। তার ভাষ্যমতে, সোনারচর থেকে কুয়াকাটাসহ সুন্দরবন এলাকার আশপাশে সাগরবক্ষে মাছ ধরা জেলেরা এই মোকামে আসে। কিন্তু গত তিন বছর বেহাল দশা। 
পেশায় চরম দুর্দিন চলছে। এখন চোখে-মুখে অন্ধকার দেখছেন। বোট মালিকরা অনেকে নিঃস্ব হয়ে গেছেন বলেও জানালেন তিনি। উদাহরণ দিয়ে জানান, মহিপুরের লাল মিয়ার দুই খান মাছ ধরার ট্রলারের এক খান ট্রলার ২২ লাখ টাকায় বিক্রি করে দেনা হওয়া লোকসানের বোঝা কিছুটা হাল্কা করেছেন। অথচ একটি ট্রলার নতুন বানাতে ৫০-৬০ লাখ টাকা খরচ করতে হয়েছে। একইভাবে নিজামপুরের নাসির বেপারীর দুই খানা বোট ছিল। এখন একটিও নেই। পুঁজির সংকটে তার মাছ ধরার ব্যবসা বন্ধ হয়ে আছে। এ মানুষটি প্রায় কোটি টাকার লোকসানি। ফজলু গাজীর দাবি মহিপুর ইউনিয়নে অন্তত তিন হাজার জেলে পরিবার রয়েছে। যাদের সরকারি উদ্যোগে অবরোধকালীনসহ বিভিন্ন সময় বিশেষ প্রণোদনা দেওয়া হোক।
আলীপুর মৎস্য বন্দরের ব্যবসায়ী নেতা ও লতাচাপলী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আনছার উদ্দিন মোল্লা জানান, আলীপুরের ১১৩ জন আড়তদার, সাড়ে তিন শ’ ট্রলারমালিক এখন পেশা নিয়ে সংকটে রয়েছেন। লতাচাপলী ইউনিয়নে সরকারি কার্ডধারী জেলে রয়েছে ২২৯২ জন এবং কার্ডবিহীন জেলে রয়েছে আরও ২৪৭২ জন। বর্তমানে এসব জেলেরা খুব খারাপ অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। আনছার মোল্লা বলেন, ‘বছরে ৩৬৫ দিনের মধ্যে দুই দফায় ৮৭ দিন অবরোধ। এছাড়া দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে এক শ’ দিনের বেশি সাগরে যাওয়া যায় না। এরপরে আবার বর্ষা মৌসুমে অমাবস্যা-পূর্ণিমায় সাগর ভয়াবহ উত্তাল থাকে। মাছ ধরা যায় না।’ উদাহরণ টেনে বলেন তিনি, ‘২০২১ সালে দুর্যোগে ১১৭ দিন, ২০২২ সালে ১১০ দিন এবং ২০২৩ সালে ১১৩ দিন সাগরে মাছ শিকার করতে পারেনি কোন জেলে।’ এসব হিসাব করলে বছরের যে কয়দিন বাকি থাকে তাতে কতবার সাগরে যাওয়া যায় এমন প্রশ্ন করেন এ আড়তমালিক। তবে তারও অভিযোগ-বিত্তশালীরা কৌশলে নিষেধাজ্ঞাকালীন সময় মাছ শিকার করছে। কিন্তু গরিব জেলেরা বঞ্চিত থাকছে। বর্তমানে এ পেশায় ভয়াবহ সংকট চলছে বলে জানান তিনি। সাধারণ জেলেরা এখন মানবেতর জীবনযাপন করছেন বলে দাবি তার।
পটুয়াখালী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম জানান, কলাপাড়ায় কার্ডধারী জেলে রয়েছে ১৮৩০৫ জন। অবরোধকালীন সময় এসব জেলে পরিবারকে সরকারের পক্ষ থেকে খাদ্য সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। দরিদ্র জেলেদের সহায়তা ও পুনর্বাসনে একটি প্রকল্পের মাধ্যমে বিনামূল্যে জালসহ বিভিন্ন উপকরণ দেওয়া হয়েছে। বিনামূল্যে বকনাবাছুর পর্যন্ত দেওয়া হচ্ছে বিকল্প পেশায় টিকে থাকতে। এছাড়া টেকসই উপকূল ও সামুদ্রিক মৎস্য প্রকল্পের মাধ্যমে জেলে সন্তানদের পর্যন্ত বিভিন্ন ট্রেডে প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা হচ্ছে। জেলেদের দল গঠনের মধ্য দিয়ে প্রাথমিক পুঁজির জোগান দিয়ে নিজেদের মধ্যে ঋণ নেওয়ার সক্ষমতা সৃষ্টি করা হচ্ছে। সঞ্চয়ী মনোভাব গড়ে তোলা হচ্ছে। মোটকথা, জেলেদের জীবনমানের উন্নয়নে সরকারের ব্যাপক পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান এ কর্মকর্তা। এছাড়া মৎস্য সম্পদ রক্ষায় সূক্ষ্ম ফাঁসের জালের ব্যবহার বন্ধে উপজেলা প্রশাসন, কোস্টগার্ড ও নৌপুলিশের সহায়তায় প্রশাসনিক অভিযান চলমান রয়েছে।
মেজবাহউদ্দিন মাননু, কলাপাড়া

×