ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

aiub
aiub

পেশা বদলের সন্ধিক্ষণে

কামার কুমার জেলে চাষি ॥ দেশকে ভালোবাসি

এ রহমান মুকুল

প্রকাশিত: ০১:৫৩, ১২ জুলাই ২০২৪

কামার কুমার জেলে চাষি ॥ দেশকে ভালোবাসি

স্বল্প সংখ্যক কুমার বাপ-দাদার পেশা ধরে রাখতে কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন

বাংলাদেশের মৃৎশিল্পের এক সমৃদ্ধ ঐতিহ্য রয়েছে। সে ঐতিহ্যের রূপকার হলেন কুমোর বা কুমার শ্রেণির পেশাজীবীরা। কুমাররা মাটি দিয়ে বিভিন্ন সামগ্রী তৈরি করেন। কিন্তু সেই মৃৎশিল্পই বর্তমানে হারিয়ে যেতে বসেছে। বাংলার কুমাররা হাতের নিপুণ স্পর্শে কারুকাজের মাধ্যমে যে শিল্পের সৃষ্টি করে তাকেই মৃৎশিল্প বলে। বাংলাদেশে কুমার শ্রেণি সাধারণত হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত, তারা ‘পাল’ পদবীতে পরিচিত।

বংশপরম্পরায় তারা এ কাজ করে আসছেন। নরম কাদামাটি দিয়ে নিপুণ কৌশলে গড়ে তোলেন বিভিন্ন তৈজসপত্র ও গৃহস্থালি কাজে ব্যবহার্য সামগ্রী। কুমাররা হাঁড়ি, কলসি, ঘড়া, ঘাগড়া, সানকি, প্রদীপ, পাঁজাল বা ধুপতি, বদনা, ঝাঁঝর, চাড়ি, মটকি, পিঠার সাজ, সরা, ঢাকন, বাটি, ফুলের টব, পুতুল, প্রতিমা, মূর্তি তৈরি করেন। এঁটেল মাটি হলো এসব সাম্যগ্রী  তৈরির প্রধান উপকরণ। কুমাররা এসব সামগ্রী তৈরি করতে চাকযন্ত্রও ব্যবহার করে থাকেন। কাঁচামাটি দিয়ে এসব সামগ্রী বানানোর পর পুড়িয়ে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে রঙ করে সেগুলো বাজারে বা গ্রামে ফেরি করে বিক্রি করেন।

এককালে মৃৎ শিল্প রাজা, বাদশা, জমিদার ও অভিজাত পরিবারে নিত্যদিনের ব্যবহার্য বস্তু ছিল। প্রযুক্তি অগ্রগতি আর বিজ্ঞানের জয়ের ফসল হিসেবে কমদামে অধিক টেকসই সিলভার, মেলামাইন, প্লাস্টিক বিভিন্ন সামগ্রীর দাপটে মৃৎশিল্পের তৈরি সামগ্রীর চাহিদা ব্যাপক হারে হ্রাস পেয়েছে। জৌলুস হারিয়ে ফেলেছে এই শিল্পটি।
দিন চলে যাবে সময় হারিয়ে যাবে অতীতের অদৃশ্য গহব্বরে তবে সে শুধু চলেই যায় না, রেখে যায় ইতিহাস। যুগে যুগে পৃথিবীর একেক মেরুতে গড়ে ওঠে মানুষের ভিন্ন ইতিহাস, ঐতিহ্য শিল্প সংস্কৃতি! বিভিন্ন সময় এই শিল্প নানা রূপ রঙে আমাদের সামনে বৈচিত্র্য নিয়ে হাজির হয়েছে। পঞ্চগড় সদর উপজেলার করতোয়া নদী তীরবর্তী মিরগড় মালিপাড়ার মৃৎশিল্পের ইতিহাস শত বছরের। এক সময় এখানকার কুমারদের হাতে তৈরি মাটির জিনিস পত্রের ব্যাপক চাহিদা ছিল। এলাকার চাহিদা মিটিয়ে বিভিন্ন হাট-বাজারেও পাওয়া যেত। মাটির এসব সামগ্রী তৈরিতে কুমারদের স্ত্রী ও মেয়েদেরও একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে।

বৈশাখ মাস হলো তাদের মলো মাস, এ মাসে তারা কোনো মাটির জিনিস তৈরি করেন না, শুধু বিক্রি করেন। বর্তমানে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগায় সেই শিল্পে অনেকটা ভাটা পড়েছে। এখন শহরের প্রায় সবাই ধাতব, প্লাস্টিক, ম্যালামাইন ও চিনামাটির সামগ্রী ব্যবহার করায় কুমার শ্রেণির পেশা হুমকির মুখে পড়েছে। তবে নতুন করে মৃৎশিল্পের আর একটি শাখা উন্মোচিত হয়েছে। সেটি হলো নান্দনিক মৃৎশিল্প। এ শাখার মৃৎশল্পীরা মাটি দিয়ে বিভিন্ন শৌখিনসামগ্রী ও শিল্পকর্ম তৈরি করে থাকেন, ইংরেজিতে একে বলা হয় পটারি শিল্প। প্রাচীনকালের টেরাকোটা বা মৃৎফলকে খোদাই করে সুন্দর সুন্দর শোপিস  তৈরি করেন।
সরেজমিনে জানা গেছে, মীরগড় মালিপাড়ায় ছিল ৬০টি পরিবার। বর্তমানে রয়েছে ৩০ পরিবার। তবে মৃৎশিল্প ধরে রেখেছে ১০টি পরিবারে। এসব পরিবারে সদস্য এখনো মাটির তৈরি জিনিসপত্র নিজ হাতে বানিয়ে বাজারে বিক্রি করে সংসার চালায়। প্লাস্টিকের তৈরি আধুনিক জিনিসপত্রের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় কদর কমেছে মাটির  তৈরি জিনিসপত্রের। তাই বেকার হয়ে পড়েছে মাটির কারিগররা। কুমারদের থেকে শিক্ষা নিয়ে উদ্ভাবিত হয়েছে আধুনিক প্রযুক্তি। আর আধুনিক প্রযুক্তির উদ্ভাবনের ফলে গ্রামাঞ্চল কি শহরাঞ্চলে ঘরে ঘরে প্লাস্টিক ও অ্যালুমিনিয়ামের জিনিসের ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। মাটির জিনিসের চাহিদা দিনে দিনে হ্রাস পাচ্ছে।

আর এর প্রভাব পড়ছে নতুন প্রজন্মের মধ্যে। শ্রম, খরচ ও বাজারদর হিসাব করে নতুন প্রজন্ম এ পেশার প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করছে কম। অনেকে লেখাপড়া করে চাকরি বা ব্যবসার প্রতি ঝুঁকছেন।
মৃৎশিল্পি প্রভাতী রানী পাল জানান, চৈত্র-বৈশাখ এ দু’মাসে রোদের তেজ বেশি থাকায় তাদের কাজও বেশি হয়। তাই সংসারের কাজকর্মের পাশাপাশি মৃৎশিল্পের কাজটিও করি।  
খগেন্দ্রনাথ পাল অভিযোগ করে বলেন, এ পেশায় এখন আর আগের মতো লাভ নেই। অন্য কোনো কাজ জানিনা তাই বাপ-দাদার পেশাকে কোনো রকমে আঁকড়ে ধরে আছি। তিনি আরও বলেন, সরকার যদি আমাদের মাটির কাজকে একটু প্রাধান্য দিয়ে মাটির তৈরি জিনিসের দাম বাড়িয়ে এ খাতে বরাদ্দ দিত তবে মাটির শিল্পটি বাংলাদেশে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হতো। 
বর্ষা মৌসুমে কাজ বন্ধ থাকায় কুমারদের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ যায়। এ সময় কুমাররা সারা বছর কাজ করার জন্য এঁটেল মাটিসহ প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সংগ্রহে নেমে পড়েন। পুঁজির অভাবে অনেকে মহাজনের কাছ থেকে চড়াসুদে টাকা ঋণ নেন। শুষ্ক মৌসুমে কাজ করে যা উপার্জন হয় তার বেশির ভাগই চলে যায় মহাজনের ঋণ পরিশোধ করতে। এভাবে কুমার সম্প্রদায় যুগযুগ ধরে থেকে যাচ্ছেন সহায় সম্বলহীন হয়ে।
কুমাররা জানান, বর্তমানে মানুষের ব্যবহারিক জীবনে মৃৎশিল্পের আর বিশেষ ভূমিকা নেই। একটা সময় ছিল যখন মাটির তৈরি হাঁড়ি-পাতিল, থালা-বাসন, সানকি, ঘটি, মটকা, সরা, চারি, কলস, সাজ, ব্যাংক, প্রদীপ, পুতুল, কলকি, দেবদেবীর মূর্তি ও ঝাঝরের বিকল্প ছিল না। ঋণ প্রদানে অনীহা ও প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা আর প্রযুক্তি বিকাশের এ যুগে এ শিল্পের প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ সাধিত না হওয়ায় তা আজ আর প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না। ফলে বাপ-দাদার পেশা ছেড়ে অনেকে অন্য পেশার দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। তবে আশার কথা হলো, শিল্প সচেতন ব্যক্তিরা মৃৎশিল্পের কদর করছেন বেশ তাদের চাহিদায় শৌখিনতা রয়েছে। মাটির তৈরি জিনিসপত্র দিয়ে ঘরের শোভা প্রকাশ করছেন। সঠিক ব্যবহারে প্রশংসাও পেয়েছেন এই শিল্প। বর্তমানে কর্মক্ষেত্রেও এর ব্যবহার ভালো লক্ষণীয়। মীরগড়ের মালিপাড়াসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গাতেই পেতে পারেন আপনার শখের ফুলদানি কিংবা মাটির নিত্য প্রয়োজনীয় মাটির পণ্য। এসব পণ্য বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের নিজস্ব কুমার দিয়ে নিত্যনতুন ডিজাইনের মাটির জিনিসপত্র তৈরি করছেন। এদেরকে উৎসাহ দিয়ে তাদের তৈরি জিনিসপত্র ক্রয় করে এই শিল্পটিকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব বলে মন করছেন এই শিল্পের কারিগরগণ। 
বর্ষা মৌসুমে কাজ বন্ধ থাকায় কুমারদের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ যায়। এ সময় কুমাররা সারা বছর কাজ করার জন্য এঁটেল মাটিসহ প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সংগ্রহে নেমে পড়েন। পুঁজির অভাবে অনেকে মহাজনের কাছ থেকে চড়াসুদে টাকা ঋণ নেন। শুষ্ক মৌসুমে কাজ করে যা উপার্জন হয় তার বেশিরভাগই চলে যায় মহাজনের ঋণ পরিশোধ করতে। এভাবে কুমার সম্প্রদায় যুগযুগ ধরে থেকে যাচ্ছেন সহায় সম্বলহীন হয়ে।
মাটির শিল্প আমাদের ঐতিহ্য ও গর্ব। মাটির সঙ্গে মানুষের দেহের একটা সম্পর্ক আছে। মাটির জিনিস স্বাস্থ্যসম্মত। কোনো রকম কেমিক্যাল ছাড়াই মাটি ব্যবহার করে জিনিস  তৈরি হয়। এ শিল্পের নিদর্শন থেকে প্রমাণ মেলে যে, এদেশের মানুষেরা কতটা শিল্পমনা ছিল। বর্তমান সভ্যতার কারণে এই আদি প্রযুক্তি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। শুধু এঁটেল মাটি হলেই যে মাটির শিল্পের কাজ করা যাবে তা নয়। এর জন্য প্রয়োজন যতœ আর শ্রম। দরকার হাতেরে নৈপুণ্য ও কারিগরি জ্ঞান। এ শিল্প আমাদের ঐতিহ্যের ধারাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। এগুলো সংরক্ষণে আমাদের সকলেরই যতœবান হওয়া জরুরি। এ শিল্প ধরে রাখতে প্রচার-প্রচারণা ও প্রযুক্তিগত জ্ঞানের সুব্যবস্থাও জরুরি। 
পঞ্চগড়ের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ হাসনুর রশিদ বাবু বলেন, কুমারদের থেকে শিক্ষা নিয়ে উদ্ভাবিত হয়েছে আধুনিক প্রযুক্তি। আর আধুনিক প্রযুক্তির উদ্ভাবনের ফলে গ্রামাঞ্চল কি শহরাঞ্চলে ঘরে ঘরে প্লাস্টিক ও অ্যালুমিনিয়ামের জিনিসের ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। মাটির জিনিসের চাহিদা দিনে দিনে হ্রাস পাচ্ছে। আর এর প্রভাব পড়ছে নতুন প্রজন্মের মধ্যে। শ্রম, খরচ ও বাজারদর হিসাব করে নতুন প্রজন্ম এ পেশার প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করছে কম। অনেকে লেখাপড়া করে চাকরি বা ব্যবসার প্রতি ঝুঁকছেন। আবার কেউ মাটির কাজে ইট ভাটায় যাচ্ছেন। কেউ বা পাড়ি জমাচ্ছে বিদেশে। ফলে একটা সময় বাপ ঠাকুরদার এই ঐতিহ্যগত পেশাকে হারিয়ে যাচ্ছে। 
    এ রহমান মুকুল, পঞ্চগড়

×