ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

aiub
aiub

লালমনিরহাট-বগুড়ায় নদীভাঙন প্রকট

সিলেট-কুড়িগ্রামে বাড়ছে পানি, ফের শঙ্কায় বানভাসি মানুষ

জনকণ্ঠ ডেস্ক

প্রকাশিত: ২৩:১৫, ১১ জুলাই ২০২৪

সিলেট-কুড়িগ্রামে বাড়ছে পানি, ফের শঙ্কায় বানভাসি মানুষ

বগুড়ায় বাঙালি নদীর ভাঙনে মানুষের বসতভিটা বিলীন হয়ে যাচ্ছে

বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে সিলেট ও কুড়িগ্রামের সব নদ-নদীর পানি আবারও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি নিয়ে শঙ্কা বাড়ছে। এমনিতেই বন্যাকবলিত এলাকায় মানুষ খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানিসহ নানা দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। এদিকে লালমনিরহাট ও বগুড়ায় প্রকট আকার ধারণ করেছে নদীভাঙন। খবর স্টাফ রিপোর্টার, নিজস্ব সংবাদদাতা ও সংবাদদাতার।
সিলেট ॥ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্র জানায়, বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টায় সুরমা নদীর পানি কানাইঘাট পয়েন্ট বিপৎসীমার ৬১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এর আগে বুধবার এই পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ৩৬ সেন্টিমিটার ওপরে ছিল। একই সময়ে কুশিয়ারার পানি আমলশিদ পয়েন্টে বিপৎসীমার ৩৯ সেন্টিমিটার ওপর ও ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে ৮৮ সেন্টিমিটার দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এর আগে, বুধবার দুটি পয়েন্টে পানি যথাক্রমে বিপৎসীমার ৩২ সেন্টিমিটার ও ৯১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।
 সিলেট জেলা প্রশাসন জানায়, বন্যায় জেলার ১৩টি উপজেলার ৯৫টি ইউনিয়নের ১ হাজার ৪১টি গ্রাম প্লাবিত রয়েছে। এতে পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন ৫ লাখ ৩৯ হাজার ২৯৮ জন। এসব এলাকায় ২১৩টি আশ্রয়কেন্দ্রে ৯ হাজার ২০৬ জন মানুষ অবস্থান করছেন। এর মধ্যে বালাগঞ্জ, ওসমানীনগর, ফেঞ্চুগঞ্জ ও বিয়ানীবাজার উপজেলায় বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় দুর্ভোগ বেড়েছে।  সিলেট আবহাওয়া  অফিস জানায়, বুধবার সকাল ৬টা থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ৬টা পর্যন্ত  সিলেটে ১১৩ দশমিক ৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। আরও বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে।
এদিকে বন্যাকবলিত এলাকাগুলোতে বিভিন্ন ধরনের পানিবাহিত রোগের প্রকোপ দেখা দিয়েছে। দূষিত পানি পান ও নোংরা পানিতে চলাফেরা করায় ডায়রিয়া চর্ম ও চোখের রোগে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। 
জানা গেছে, দফায় দফায় বন্যায় সিলেট বিভাগের প্রায় ৭ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছিলেন। পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও এখনো পানিবন্দি প্রায় ৪ লক্ষাধিক মানুষ। 
বিশুদ্ধ পানির অভাবে কোনো কোনো দুর্গত এলাকায় লোকজন বাধ্য হয়ে দূষিত পানি পান করছেন। আর বন্যার পানিতে ভেসে আসা ময়লা আবর্জনাযুক্ত পানি ভেঙে তাদের চলাফেরা করতে হচ্ছে। এসব কারণে নানা পানিবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়ছে। এসব রোগে আক্রান্তের সংখ্যা আট শতাধিক। 
কুড়িগ্রাম ॥ ধরলা নদীর পানি বিপৎসীমার ১০ সেন্টিমিটার, দুধকুমার নদীর পানি ৩ সে.মি, ব্রহ্মপুত্র নদের নুনখাওয়া পয়েন্টে ৩২ সে.মি ও চিলমারী পয়েন্টে ৪৬ সে.মি ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। বৃহষ্পতিবার রাতে অবিরাম বৃষ্টির কারণে শহরের বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। শহরের মজিদা ডিগ্রি কলেজ প্লাবিত হওয়ায় পরীক্ষার্থীরা হাঁটুপানি পাড়ি দিয়ে পরীক্ষা কেন্দ্রে প্রবেশ করে।

বাফার সার গুদামের সামান্য নিচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। ধরলা নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় বৃহস্পতিবার দুপুরে কুড়িগ্রাম পৌরসভায় প্রায় ৫ হাজার মানুষ নতুন করে পানিবন্দি হয়ে পড়ে। শহরের রিভারভিউ উচ্চ বিদ্যালয়, জলিল বিড়ি মোড়ের ফেরিঘাট দাখিল মাদ্রাসা ও হরিকেশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তিন শতাধিক মানুষ আশ্রয় নিয়েছে।  
বৃহস্পতিবার সকালে নতুন করে ধরলার পানির ¯্রােতে ধরলা সেতুর পূর্বদিকের সংযোগ সড়কের অংশবিশেষ ধসে গেছে। সকাল থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত জেলার নাগেশ্বরী, ফুলবাড়ি ও ভূরুঙ্গামারী উপজেলার সঙ্গে সড়কপথের যোগাযোগ বন্ধ ছিল। দুপুরের পর জেলা সড়ক বিভাগ থেকে দ্রুত মেরামত করায় আংশিকভাবে ধীর গতিতে যান চলাচল পুনরায় শুরু হয়েছে।
  এদিকে বন্যাকবলিত মানুষের দুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করেছে। প্রায় দুই সপ্তাহ থেকে ঘরগুলো পানিতে ডুবে থাকার কারণে কাদা পানিতে চরম দুর্গন্ধের সৃষ্টি হয়েছে। ওইসব গ্রামে ল্যাট্রিন ও টিউব অয়েল পানির নিচে তলিয়ে রয়েছে। খাদ্যের পাশাপাশি খাবার পানির সংকট দেখা দিয়েছে। 
 মানুষজন ঘরে ফিরতে শুরু করলেও তাদের ঘরে খাবার নেই। মানুষের পাশাপাশি গবাদিপশুও তীব্র খাদ্য সংকটে পড়েছে। 
লালমনিরহাট ॥ বন্যার পানি কমতেই তিস্তার তীরবর্তী অঞ্চলে তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে। ভাঙনের তীব্রতা বেশি হাতীবান্ধা উপজেলার ডাউয়াবাড়ি ইউনিয়নে।  অর্ধাহারে-অনাহারে দিনাতিপাত করছেন নদীভাঙা পরিবারগুলো।
গত ৪৮ ঘণ্টায় উত্তর ডাউয়াবাড়ির অন্তত ৫০টি বাড়ি, দুটি মসজিদ ও একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় নদীভাঙনের কবলে পড়েছে। ভাঙনের মুখে পড়েছে উত্তর ডাউয়াবাড়ি কমিউনিটি ক্লিনিকসহ অসংখ্য বাড়িঘরসহ বিভিন্ন স্থাপনা। এ এলাকায় বসবাসরত মানুষ নিজেদের শেষ সম্বলটুকু রক্ষা করতে আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। 
অপরদিকে আদিতমারী উপজেলার গোবর্ধন তিস্তা পাড়ে বালির বাঁধে ধস ও ভাঙন দেখা দিয়েছে। এতে তাৎক্ষণিক পাঁচটি পরিবারের বাড়িঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। হুমকির মুখে পড়েছে ভাটিতে থাকা প্রায় ৫০ কোটি টাকার বাঁধ। পাউবো থেকে জরুরি জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙন রোধের চেষ্টা করা হচ্ছে।
নীলফামারী ॥ তিস্তাপাড়ে এখন চলছে ভাঙা-গড়ার খেলা। বালু ও পলিতে ভরা  নদীর পেটে পানির উচ্চতা কখনো কমছে আবার বাড়ছে। বৃহস্পতিবার নদীর পানি এতইটাই কমেছে যে, এতে নদীর বুকে চর দৃশমান হয়ে উঠেছে। তবে পানি বাড়া-কমার সঙ্গে বাড়ছে ভাঙন। 
ভাঙনে যে সকল পরিবার উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছে সেখানে শুকনা খাবার, বিশুদ্ধ পানি আর গবাদিপশুর খাদ্যের সংকট দেখা দিয়েছে চরম আকারে। অনেকে বসতভিটা হারিয়ে কোনো রকমে টিনের চালা তুলে গবাদিপশুসহ বাস করছে। 
তিস্তা নদীর পানি  কমতে কমতে বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টায় নীলফামারীর তিস্তা ব্যারাজ ডালিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার (৫১.১৫) দশমিক ৭৯ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। বুধবার ওই সময় পানি প্রবাহিত হয় দশমিক ৩৮ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে। রাতারাতি তিস্তার পানি কমতে থাকায় নদীর বুকে চর জেগে ওঠে। অপর দিকে একই সময় ডালিয়ার ভাটিতে তিস্তার কাউনিয়া পয়েন্টেও পানি কমতে শুরু করেছে। 
এদিকে চলমান বন্যায় রংপুর অঞ্চলের পাঁচ জেলায়  ৩১৭ হেক্টর জমির ফসল ও ৫ কোটি টাকার মাছ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে চাষীরা সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়েছেন রোপা আমন ধানের বীজতলা নিয়ে। 
বৃহস্পতিবার সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর এক পরিসংখ্যান মতে, বন্যায় রংপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা ও নীলফামারীসহ রংপুর বিভাগের ৫ জেলায় দুই হাজার ৩১৫ হেক্টর জমির ফসল এখনো কমবেশি বন্যার পানিতে তলিয়ে রয়েছে। এতে করে ৩১৭ হেক্টর জমির ফসল পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ছাড়া এই  পাঁচ জেলার ১২১ হেক্টর জমির ৬০৫টি পুকুরের ২০৫ টন চাষকৃত মাছ বানের পানিতে ভেসে গেছে। যার বাজার মূল্য  প্রায় ৫ কোটি টাকারও বেশি।  অপর দিকে বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে রংপুর অঞ্চলের ৩৭টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। 
গাইবান্ধা ॥ বন্যা পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হলেও আবারও ব্রহ্মপুত্র, ঘাঘট ও তিস্তা নদীর পানি বাড়ছে। তবে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি এখনো বিপৎসীমার ৪০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
বৃহস্পতিবার ৩টায় গাইবান্ধা পাউবোর নিয়ন্ত্রণ কক্ষের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্র নদের পানি ফুলছড়ি উপজেলার তিস্তামুখঘাট পয়েন্টে ৫ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ৪০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ঘাঘট নদীর পানি জেলা শহরের নতুন ব্রিজ পয়েন্টে বিপৎসীমার ৮ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে বইছে। করতোয়া নদীর পানি গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার চকরহিমাপুর পয়েন্টে বিপৎসীমার ১১৬ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তিস্তার পানি সুন্দরগঞ্জ উপজেলা সংলগ্ন কাউনিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ২৩ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

বগুড়া ॥ সারিয়াকান্দি উপজেলায় বাঙালি নদীতে তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে। উপজেলা চর ডোমকান্দি এলাকার নদীতীরবর্তী এলাকার পরিবারগুলো সব হারানোর আতঙ্কে দিশেহারে হয়ে পড়েছে। তাদের অভিযোগ পাউবোর ওই এলাকায় নদীতীর সংরক্ষণ প্রকল্পের কাজ সময়মতো হলে তারা বসতভিটা হারানোর হুমকির মুখে পড়তেন না। এদিকে ৪ দিন যমুনার পানি কমার পর বৃহস্পতিবার থেকে আবার পানি বাড়তে শুরু করেছে। বৃহস্পতিবার যমুনার পানি বিপৎসীমার ৪১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। 
টাঙ্গাইল ॥ গোপালপুর উপজেলার হেমনগর ও ঝাওয়াইল ইউনিয়নের চার গ্রামের মানুষ এখনো পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে। এসব গ্রামে খাবার পানির সংকটে পানিবন্দি মানুষ। এতে করে পাঁচ শতাধিক পরিবার বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছে দিচ্ছে উপজেলা প্রশাসন। এদিকে বন্যাকবলিত বেশ কিছু পরিবার ভূঞাপুর-তারাকান্দি যমুনা বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের পূর্ব পাশের কয়েকটি গ্রামে আশ্রয় নিয়েছে। 
জানা যায়, উপজেলার হেমনগর ও ঝাওয়াইল ইউনিয়নের গুলিপেচা, পশ্চিম শাখারিয়া, চর সোনামুই ও নলিন পশ্চিমপাড়া গ্রামগুলো বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে।

×