ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

aiub
aiub

ঢাকার সঙ্গে সারাদেশের ট্রেন বন্ধ ছিল সাড়ে ৫ ঘণ্টা 

রাজধানী স্থবির চরম দুর্ভোগ ॥ বাংলা ব্লকেড

স্টাফ রিপোর্টার

প্রকাশিত: ০০:১৪, ১১ জুলাই ২০২৪

রাজধানী স্থবির চরম দুর্ভোগ ॥ বাংলা ব্লকেড

কোটাবিরোধীদের সড়ক অবরোধে দুর্ভোগ পোহাতে হয় চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের

কোটা বাতিলের দাবিতে ডাকা সকাল-সন্ধ্যা সর্বাত্মক ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচির দরুন কার্যত অচল হয়ে পড়ে রাজধানী ঢাকা। বুধবার দিনভর ছিল এই ভোগান্তি। যারাই গতকাল ঘর থেকে বের হয়েছেন, তারাই ভুগেছেন। যারা ঘরে ছিলেনÑ তারাও দুশ্চিন্তায় ছিলেন স্বজনরা কিভাবে রাজপথে চলেছেন তা নিয়ে। এই ভোগান্তি দিনের শেষে রাতেও দেখা গেছে যানবাহনের চাপের মুখে।

বিশেষ করে রাজধানীর ৮টি পয়েন্টে কর্মসূচি ঘোষণা দেওয়ার পরও সারা নগরেই অবরোধ দেওয়ায় পরিস্থিতি আরও দুর্বিষহ হয়ে পড়ে। কয়েকটি স্পটে সরেজমিনে দেখা যায়, দিনের শুরু থেকেই কৌশলে পর্যায়ক্রমে সারা নগরীতে ছড়িয়ে দেওয়া হয় অবরোধ কর্মসূচি। কোটাবিরোধী দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মিছিল সকালের দিকেই শাহবাগ মোড়ে আসার পর পুলিশের অনুরোধে ওই এলাকা ছেড়েছে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চসহ বেশ কয়েকটি সংগঠন।

বুধবার দুপুর ১২টার কিছু আগে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা শাহবাগে মোড়ে এসে অবরোধ করলে পুলিশের অনুরোধে জাতীয় জাদুঘরের সামনে অবস্থানকারীরা চলে যান। শিক্ষার্থীদের মিছিল আসার সময় জাতীয় জাদুঘরের সামনে অবস্থান করছিলেন মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ডসহ কয়েকটি সংগঠনের নেতাকর্মীরা। এ সময় উভয় পক্ষকেই উত্তপ্ত স্লোগান দিতে দেখা যায়। এরপর দুপুর ১২টার দিকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় যাতায়াত ব্যবস্থা। বাসসহ অন্যান্য যানবাহন প্রধান সড়কগুলোয় আটকা পড়ে। এতে নগরজুড়ে দেখা দেয় তীব্র যানজট। অনেকে গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা দেন।
কাওরানবাজারে রেল লাইনের ওপর বসে পড়ে কোটাবিরোধী আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। প্রায় এক ঘণ্টা ধরে তাদের অবরোধের কারণে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে রেল চলাচল বন্ধ থাকে। একই সঙ্গে রিক্সা, ভ্যান, মোটরসাইকেলসহ সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয় আন্দোলনকারীরা। দুপুর ১টার দিকে কয়েকশ’ আন্দোলনকারী অবস্থান নেয় কাওরান বাজার সংলগ্ন রেল লাইনের ওপরে। এ সময় তারা রেল লাইনের দুই পাশে কাঠের স্লিপার দিয়ে রেল লাইনের ওপরে বসে পড়ে। এতে বেলা ১১টার পর কমলাপুরের সঙ্গে পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। 
বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে আন্দোলনকারীরা রেল লাইন থেকে উঠে গেলে প্রায় সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা পর ঢাকার সঙ্গে সারাদেশের ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হয়। এ বিষয়ে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের মাস্টার মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন জানান, ছাত্রদের অবরোধের কারণে বুধবার দুপুর ১২টা থেকে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বিকেলের সাড়ের ৫টার পর ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হয়।
বুধবার সড়ক ও রেলপথ অবরোধের কারণে বিভিন্ন এলাকায় আটকাপড়ে অনেক যানবাহন। যাত্রীদের গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে যেতে দেখা যায়। এদিন গুলিস্তান জিরো পয়েন্ট মোড় ও পল্টন মোড় অবরোধ করে রাখে শিক্ষার্থীরা। গুলিস্তানের নূর হোসেন চত্বর দিয়ে সব ধরনের যানবাহন বন্ধ ছিল। শিক্ষার্থীরা সকাল ১০টার পর থেকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে এই মোড়। গুলিস্তান মোড়ে শিক্ষার্থীরা চারপাশে বৃত্তাকার হয়ে বসে পড়েছেন। শিক্ষার্থীরা দখলে নেন পল্টন মোড়ও।

রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, শ্যামপুর, জুরাইন, পুরান ঢাকার লোকজন ঢাকার অন্যান্য অংশের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য এই জিরো পয়েন্ট মোড় ব্যবহার করেন। কিন্তু চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিভিন্ন দিক থেকে আসা গাড়িগুলোকে জিরো পয়েন্টের আশপাশের সড়কে থেমে থাকতে দেখা যায়। আগারগাঁও মোড়ের চারটি রাস্তা বন্ধ করে দেয় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। এতে মিরপুর থেকে গাড়ি আসা যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়।

শ্যামলী বা বিজয় সরণির দিকেও যায়নি কোনো গাড়ি। যে গাড়ি যেদিক থেকে এসেছে, সেদিকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ সময় মিরপুর ও গাবতলীর পথে চলাচলের সড়কটিতেও যান চলাচল ব্যাহত হয়। জরুরি প্রয়োজনে হেঁটে ও গলি পথ ধরে রিক্সায় যাতায়াত করেন পথচারীরা।
একইভাবে মহাখালী থেকে বনানী পর্যন্ত রাস্তা ছিল বন্ধ। যানবাহন না চলার কারণে অনেকে হেঁটে গন্তব্যে যান। অনেকে যানজটে দীর্ঘ সময় গাড়িতে বসেছিলেন আশপাশের রাস্তায়। ছাত্তার নামের এক প্রাইভেট কারচালক বজলু মেম্বারকে নিয়ে শাহীন স্কুলের সামনে বসে থাকতে বাধ্য হন টানা ৫ ঘন্টা। স্কুল থেকে শিক্ষার্থী বের হওয়ার পর সন্ধ্যার দিকে কোনোক্রমে বাসায় যেতে সক্ষম হন। সীমাহীন ভোগান্তির দরুন দুপুরে না খেয়েই থাকতে হয়েছে তাদের। 
তবে এ সময় রামপুরা থেকে শান্তিনগর, কাকরাইল পর্যন্ত রাস্তায় যানজট ছিল না। রাস্তার পরিস্থিতি স্বাভাবিক দেখা গেছে। প্রতিদিনের মতো আবুল হোটেলের মোড় ও মেরুল বাড্ডা এলাকায় যানবাহনের চাপ বেশি ছিল। এ রাস্তায় শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চোখে পড়েনি।
এদিন জরুরি কাজ ছাড়া সকাল থেকে রাজধানীতে সড়কে বের হননি অনেকেই। এ কারণে বেশিরভাগ সড়ক ছিল অনেকটা ফাঁকা। কোথাও কোনো সিগন্যাল ছাড়া পার হয় যানবাহন। সড়কে বাসসহ অন্যান্য যানবাহনের সংখ্যাও কম চলাচল করতে দেখা গেছে। ভোগান্তির শিকার হয়ে তীব্র গরমে হেঁটেই গন্তব্যে গেছেন সাধারণ মানুষ। পল্টন, গুলিস্তান জিরো পয়েন্টে দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েন নারী-শিশুসহ গুলিস্তান ও আশপাশে আসা ব্যবসায়ীরা। এ সময় মালামাল মাথায় করে হেঁটে হেঁটে গন্তব্যে যেতে দেখা গেছে তাদের।
পল্টন থেকে মালামাল নিয়ে রাজধানীর সায়েদাবাদ যাবেন রাশেদ হাসান নামের এক ব্যবসায়ী। তিনি জানান, বাস বন্ধ হয়ে গেছে। সিএনজি চালিত অটোরিক্সাও পাওয়া যাচ্ছে না। রিক্সা এত দূর যাবে না। তাই মালামালা মাথায় নিয়েই গন্তব্যে যাচ্ছি। মালিবাগ থেকে গুলিস্তান এসেছেন লিজা আক্তার। অবরোধের কথা জানতেন না তিনি। লিজা জানান, মালিবাগ থেকে রিক্সা কাকরাইল নেমে যেতে হয়েছে। এরপর কোনো গাড়ি পাচ্ছি না। বাচ্চা হাঁটিয়ে নিয়ে এদিকে এসেছি। আবার বাসায় কীভাবে ফিরব সেটা ভাবছি।
বাংলা ব্লকেডের দরুন ভোগান্তি থেকে বাদ যাননি অ্যাম্বুলেন্সে আসা রোগীরাও। তারাও নিস্তার পাননি। সড়কের পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা মহাখালী, বনানী ও কাওরান বাজার এলাকায় রেল লাইন অবরোধ করে রাখায় সারা দেশের ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায। পাশাপাশি যানবাহনও আটকে পড়ে। এসব কারণে হাসপাতালগামী রোগীদের সড়কে আটকে থেকে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে রোগীরা সডকে অবস্থানের পর এক পর্যায়ে হাসপাতালে পৌঁছাতে সক্ষম হন।

যে পথে অ্যাম্বুলেন্সে করে রোগীদের হাসপাতালে আনতে সময় লাগত এক ঘণ্টা, আজ সেই পথে অবরোধের কারণে রোগী আনতে সময় লেগেছে ৬ ঘণ্টা! এতে রোগীরা দ্রুত চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হন। দুপুরের দিকে ঢাকা মেডিক্যাল হাসপাতালের জরুরি বিভাগে দূর-দূরান্ত থেকে রোগীদের নিয়ে আসা অ্যাম্বুলেন্স চালক ও তাদের স্বজনরা এই সমস্যার কথা তুলে ধরেন। কুমিল্লার দাউদকান্দির একটি গ্রাম থেকে মাথায় রক্তক্ষরণের কারণে মজনু মিয়া (৬৫) নামে এক রোগীকে অ্যাম্বুলেন্সে করে শিক্ষার্থীদের অবরোধ পেরিয়ে হাসপাতালে আনতে সময় লেগেছে ৬ ঘণ্টার মতো।

অ্যাম্বুলেন্স চালক ও রোগীর স্বজনরা বলছেন, সাধারণ দিনে কুমিল্লার দাউদকান্দি থেকে রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে আসতে সর্বোচ্চ সময় লাগত এক থেকে দেড় ঘণ্টা। অ্যাম্বুলেন্স চালক মাইনুদ্দিন বলেন, দাউদকান্দি থেকে সকালে রোগী নিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশে রওনা দেই। শিক্ষার্থীদের অবরোধের কারণে হানিফ ফ্লাইওভার দিয়ে হাসপাতালে রোগীকে নিয়ে পৌঁছাতে পারিনি। কাঁচপুর এলাকায় অবরোধের কারণে আটকে থাকি। পরে শিক্ষার্থীদের অনুরোধ করে অনেক ঘুরে গুলিস্তান হয়ে ঢাকা মেডিক্যাল হাসপাতালে পৌঁছতে লেগেছে ৬ ঘণ্টার মতো।

অথচ সাধারণত দিনে সর্বোচ্চ সময়  লাগত এক থেকে দেড় ঘণ্টা। এ সময় রোগী মজনু মিয়ার ভাই জালাল মিয়া জানান, তার ভাই ব্রেন স্ট্রোক করেছেন। তার দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে  চিকিৎসা দরকার অথচ অবরোধের কারণে সড়কেই চলে গেল ৬ ঘণ্টা! 
তারই মতো দুর্ভোগের শিকার হন রাজধানীর জুরাইনের চেয়ারম্যান বাড়ি এলাকা থেকে মাথায় পুরনো আঘাতজনিত কারণে আসা পারভেজ (২৫) নামে এক রোগী। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে আসতে দুই ঘণ্টা সময় লেগেছে। আদ-দ্বীন হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্সের চালক শহিদুল ইসলাম সুমন জানান, জুরাইন থেকে মাত্র আধা ঘণ্টা সময় লাগত হাসপাতালে পৌঁছতে। এই অবরোধের কারণে হানিফ ফ্লাইওভারে উঠতে না পেরে অনেক ঘুরে অনেক পরিশ্রম করে হাসপাতালে রোগীকে আনতে দুই ঘণ্টা সময়  লেগেছে।
এ বিষয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের টিকিট কাউন্টারের ইনচার্জ তরিকুল ইসলাম জানান, বুধবার সকাল ১০টার পর থেকে দুপুর পর্যন্ত তুলনামূলকভাবে টিকিট বিক্রির সংখ্যা অনেক কম। ঢাকা মেডিক্যালে অবস্থান করা অনেক অ্যাম্বুলেন্স চালক জানান, অবরোধের কারণে খালি অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে হাসপাতালে আসার পথে অনেকে বাধা দিচ্ছে। খালি অ্যাম্বুলেন্স যেতে দিচ্ছে না।

চালকরা জানান, আমরা তো রোগী পৌঁছে দিয়ে আবার হাসপাতালে ফিরে আসছি, তা হলে কেন আমাদের অ্যাম্বুলেন্স আটকে দিচ্ছে? তবে শিক্ষার্থীরা রোগী বহন করা অ্যাম্বুলেন্স ছেড়ে দিচ্ছেন। কিন্তু তাতেও তেমন লাভ নেই। জায়গায় জায়গায় যানজটের কারণে দীর্ঘ সময় রোগীবাহী অ্যাম্বুলেন্সকে রাস্তায় আটকে থাকতে হয়। 
শিক্ষার্থীদের অবরোধের কারণে সড়কে এতটাই যানজট লেগে আছে যে, অ্যাম্বুলেন্স পেছনে বা সামনে নেওয়ার মতো অবস্থা নেই। অ্যাম্বুলেন্স চালকরা জানান, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের প্রবেশ মুখেই শিক্ষার্থীদের অবস্থান চাঁনখারপুল মোড়, শাহবাগ মোড় ও গুলিস্তানসহ  অনেক জায়গায়।

×